একটা সিনেমা মনে পড়ে গেল। ‘দুই পৃথিবী’; সমকালীন কলকাতা বাংলা কমার্শিয়াল সিনেমার দুই মেগাস্টার দেব ও জিতের একত্রে অভিনীত একমাত্র কাজ। জিত এক ধনীর দুলাল। অনুভূতিকে পরিমাপ করে টাকা দিয়ে৷ তার জীবনেও প্রেম আসে, অনুভূতিজনিত গড়বড়তায় প্রেমিকা হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজতেই দেবের বাইকে চড়ে দীর্ঘ জার্নি।
জার্নি করতে করতেই সে দু:খ-শোক-আনন্দ-বন্ধুত্ব সহ গভীর এবং গূঢ় সব অনুভূতির অভিজ্ঞতা পেয়ে যায়, যতদিনে দেখা পায় কোয়েল মল্লিকের, তখন রক্তমাংসের মানুষটির চাইতে তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনুভূতিটি অধিক শক্তিশালী মনে হতে থাকে৷
ঠিক ৬:৩০ এ মহাখালি ডিওএইচএস এর ৩২ নম্বর সড়কমুখ থেকে বাইক স্টার্ট নেয় আমাদের, শ্যামলি সিনেমা হলের সমুখে যখন বিচ্ছিন্নতা নেমে আসে, তাকিয়ে দেখি পেরিয়ে গেছে রাতের ঘড়িতে ১১ এর কাঁটা।
মাঝের ৫ ঘন্টায় বাইক আর পথের যোগসাজশে আমরা চিনলাম দুই প্রান্তিক ব্যবসায়িকে। একজন ৪৪ বছর ধরে বিক্রি করছে চটপটি, একই এলাকায়। অন্যজন পান-সিগারেট বিক্রি ছেড়ে ঝুঁকেছে ডাবের দিকে। আমরা একত্রিত হলাম স্কুলবেলার সহচরদের সঙ্গে, ক্ষণকালের তরে। জিলাপি হাতে নেয়ামাত্র আশপাশের সব রূপান্তরিত হলো গায়ত্রি মিত্রতে। আমরা দেখা পেলাম ২৫ বয়সী তরুণের, যে পারিবারিকভাবেই ব্যাটারি ব্যবসার সাথে জড়িত। ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেছে, এক ক্লায়েন্ট ৬৫ লাখ টাকা ঝেড়ে দিলেও সাহস মরে যায়নি।
আমরা পাই বিসিএস শিকারী ২ তরুণকে যারা জীবনিশক্তি অপচয়েও অক্লান্ত এবং অটুট। এক বিভ্রান্ত তরুণ যার মন বলে লেখক হই, কর্ম বলে প্রতদিন লিখি না ৩০০ শব্দও, ২৯ বয়স পর্যন্ত।
আমরা পেয়ে গেলাম এক শৌখিন ক্রিকেট দলের দেখা, যারা খেলার উদ্দেশ্যেই ঘুরতে থাকে এ জেলা ও জেলায়। সেই দলকে মানিকগঞ্জে আমন্ত্রণ জানানোর পৌনে ইচ্ছা নিয়েই বাইকে নামে রেঁনেসা!
চরিত্রের পাশাপাশি বাইকের শরীরে এবং বাইকের বাইরে কাটানো মুহূর্তগুলোতে আমাদের আলাপে হাজিরা দিতে থাকে মানুষের প্রায়োরিটি কেন বরাবরই কাস্টমাইজড, এম্বিশনের ভাষা কেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের মতোই একক ব্যক্তির জন্য স্বতন্ত্র, পারফেক্ট সময় ধারণা কেন সমস্যাজনক, ইম্যাচিউর হওয়া কেন ব্লেসিং এবং সাকিব বা মুশফিকরা এখনো খেলে যাওয়া কতটা নিরর্থকতা।
আমরাতে আমি এর সঙ্গী Mohammad Imran Khan Nafiz, ১৯৯৬ এর এক বিকেলে মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আমরা একই স্পেস শেয়ার করেছিলাম প্রথমবার; সে ৬ষ্ঠ শ্রেণির বালক, আমি তখনো শিশু, যেহেতু পড়ি সবে ৪র্থ শ্রেণিতে। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি স্কুলে এক ক্লাস উপরে পড়াই বিশাল সিনিয়রিটি, ২ ক্লাস মানে তো দাদুর না হলেও বাবার বন্ধুস্থানীয় মুরুব্বি। তার উপর মানিকগঞ্জ শহর হিসেবে রক্ষণশীল। তাই ক্রিকেট আমাদের উভয়ের হৃদয়ে আলোড়ন তুললেও, ক্রিকেট বাদ দিলে দুই হৃদয়ের মাঝে দেবেন্দ্র কলেজ আর খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন কলেজের সড়ক বয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে!
এক সময়ে আমার উপলব্ধি জাগে, বয়স ৩৫ পেরুনোর পরেই কেবল মানুষ বুঝতে পারে কারা তার জন্য ভ্যালুয়েবল, কারা প্লাস্টিকের চিরুনি, আর কারা ভুল মানুষ। ৩৫ এর পরে বয়স, স্ট্যাটাস, লিঙ্গ, পেশা, ধর্ম সহ যতরকম টোলখানা আছে, সকল টোল মওকুফ করে কেবল এটাই ধ্যানজ্ঞান করা উচিত কে আমাকে স্পার্ক দিচ্ছে, কে দিচ্ছে খেসারির ডাল!
আমি স্পার্ক, রিসোর্স, কমফোর্ট আর খেসারি ডাল শ্রেণিতে তালিকা প্রস্তুত শুরু করি। নাফিজ ভাই ‘কমফোর্ট’ সনদ পেয়ে যায়।
তার মনের খবর অজানা ছিল।
আজ বোধ করলাম তার বাইকের স্পাইকে কোথাও একটা শূন্যতা রয়ে গেছে, সেই শূন্যতার তৃষ্ণার্ততা মিটাতে অপশন হিসেবে যতগুলো দোকান থাকা সম্ভব, সেখানে একটা নাম ‘হিমালয় পাই’ হতেও পারে!