অভিনেত্রী মৃনালিনী মিত্র কেন আত্মহত্যার চিন্তা বা পরিকল্পনা করছিলেন; অপমান, নাকি অভিমান, নাকি ক্লান্তিকর জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা? উপরিতল থেকে দেখলে রক্তকরবীর নন্দিনী চরিত্রে নির্বাচিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েও গ্ল্যামার বা যৌবনের কাছে হেরে বাদ পড়া,কিংবা প্রৌঢ় বয়সে এক চিলতে রোদের মতো পাওয়া তরুণ প্রেমিকের সমবয়সী নারীর প্রতি আসক্ত হওয়া দেখে প্রতারিত বোধ করা থেকে জন্ম হওয়া অভিমানকেই মনে হবে অনুঘটক, কিন্তু মৃনালিনী মিত্রের জীবন বিশ্লেষণ করলে বরং এটাই মনে জাগে এত দেরি কেন, আরো আগে কেন আত্মহত্যার চিন্তা করলেন না, ১৫ বছর সিনেমা থেকে দূরে থাকার সময়টাতে কী করলেন তবে!
ইতি মৃনালিনী তে মৃনালিনী মিত্র নামের যে অভিনেত্রীর জীবনের টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাক দেখি অপর্ণা সেন এবং তার কন্যা কংকনা সেন এর যৌথ কোলাজ এ তিনি কি অপরিচিত কেউ?
বারে বারে মনে হয় না এমন কাউকে তো দেখেছি, বা শুনেছি রূপালি পর্দার বাইরের ব্যক্তিগত কাহিনীতে৷ মৃনালিনীর জায়গায় বলিউডের নীনা গুপ্তা, কলকাতার নুসরাত কিংবা বাংলাদেশের অপু বিশ্বাস, যে কাউকেই কল্পনা করে নেয়া যায়। কিংবা হতে পারে কিছুটা পরিমার্জিত চেহারায় স্বয়ং অপর্ণা সেন এরই সংশোধিত বায়োপিক। গল্পগুলো অচেনা নয়, মানুষটাই কেবল ঝাপসা।
অপর্না সেন এর প্রতি আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল রয়েছে। তার বাচনভঙ্গি, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ, ফ্যাশনসচেতনতা মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ লাগে; সেটা ব্যক্তিমানুষ হিসেবে। অভিনেত্রী হিসেবে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় কিংবা শকুন্তলা বড়ুয়াকে অধিক ট্যালেন্টেড মনে হয়েছে সবসময়। কিন্তু যেহেতু আমরা দুজন ভিন্ন টাইমলাইন, ভিন্ন ভৌগলিক সীমানার মানুষ তাকে জানার একমাত্র উপায় তার অভিনীত এবং পরিচালিত সিনেমাসমূহ দেখা।
উত্তম কুমারের বিপরীতে মেমসাহেব এর অপর্নার সাথে সৌমিত্রের নায়িকা বসন্ত বিলাপ এর অপর্না আলাদা কেউ। সেখান থেকে ভিক্টর ব্যানার্জির সাথে একান্ত আপন এর মাঝবয়েসী অপর্ণা, সব্যসাচী-দীপংকর দে এর সঙ্গেকার শ্বেতপাথরের থালা সিনেমার স্ত্রী-বন্ধুরূপী অপর্ণা, প্রত্যেকে যেন একে অপরের অচেনা৷ এবং মা-মেয়ে একই পুরুষের প্রতি ফ্যাসিনেটেড হওয়ার সেই তিতলী সিনেমাটা যখন দেখেছিলাম অপর্ণা এবং তার কন্যা কংকনা যেন একই জীবনের দুই উপাংশ হয়ে পড়ে নিয়তিক্রমে।
অপর্ণা সেন যে পরিচালনা করেন জেনেছি অনেক পরে৷ উনিশে এপ্রিল, পারমিতার একদিন ফিল্ম হিসেবে খুব আহামরি আকৃষ্ট করেনি৷
ইতি মৃনালিনী কি করেছিল?
বরং এভাবে করি প্রশ্নটা, মৃনালিনী মিত্র এর চরিত্রটা যদি অপর্না সেন এর পরিবর্তে করতেন শাবানা আজমি অথবা শর্মিলা ঠাকুর, এই ফিল্ম কি দেখার আগ্রহ বোধ করতাম৷
উত্তর নাবোধক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মৃনালিনী মিত্র আত্মহত্যা করতে বসেছেন, এক মুঠো ঘুমের ওষুধ তার হেমলক। মৃত্যুর পূর্বে সুইসাইড নোট লিখতে বসেছেন। লিখতে লিখতে আশপাশে তাকান, নানা কিছু স্পর্শ করেন, ছলকে উঠতে থাকে অতীত; গল্প-অগল্পরা।
এত আয়োজন করে কি মরা যায়? তুমি বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছো না, জীবনটা ভারি লাগছে, মৃত্যু সমাধান কিনা জানো না তবে বেঁচে থাকার চাইতে খারাপ কিছু হবে না এটুকু বুঝে গেছ। বেশ তো, মরে যাও। সুইসাইড নোট লিখবে, স্মৃতিচারণ করবে, এই ট্র্যাপে পড়েছ তো মরার দফা শেষ; অন্য কিছু ট্রাই কর৷
মৃনালিনী মিত্রের সুইসাইড নোট লিখবার মুহূর্ত থেকেই জানি আত্মহননের অপশনটা বন্ধ হয়ে গেল।
আর্ট-কালচার এবং এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ামের মানুষের আত্মহত্যা করার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি কেন?
প্রচলিত থিওরি বলে মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে থাকতে হঠাৎ যখন মনোযোগটা হারিয়ে ফেলে ব্যাপারটা হজম করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। নিজেদের হঠাৎ করেই ভ্যালুলেস এবং নিস্ফলা মনে হয়।
তবে এই থিওরির প্রতি আমার সমর্থন কম। আগুন নিয়ে খেলা, সাপ নিয়ে খেলা যতটা ঝুঁকিপূর্ণ ইমোশন নিয়ে অনবরত খেলার বিপদ তার চাইতেও বেশি। সেখান থেকে তৈরি হয় বিবিধ ইমোশনাল ইমব্যালেন্স। অন্য যে কোনো পেশাজীবীর তুলনায় আর্ট-কালচার-মিউজিক বা এন্টারটেইনমেন্ট পেশার মানুষের প্রেম-রোমান্স-যৌনতাজনিত স্খলন/বিচ্যুতি বা মুখরোচক গল্প বেশি শোনা যায়, তার কারণও ইমোশনে নিত্য মশগুল থাকা।
আপনি ক্যারেক্টার ক্রিয়েট করছেন, কিংবা ক্যারেক্টার প্লে করছেন। দিনের পর দিন ক্যারেক্টারে নিবিষ্ট থাকলে আপনি রোল প্লেয়িং আর রিয়েলিটির মধ্যকার পার্থক্যটা বিস্মৃত হবেনই, হতে পারে সেটা অতি স্বল্পকালীন; তবু বিভ্রম তৈরি হওয়াটাই ন্যাচারাল।
আর্ট-কালচারের মানুষেরা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে মূলত ইমোশনজনিত ভারচুয়াল আর রিয়েলিটির মধ্যকার প্রাত্যহিক দ্বন্দ্বে অতিষ্ঠ হয়ে৷ অনবরত সুইচ বদলটা নিতে পারে না অনেকেই।
মৃনালিনী মিত্রের আত্মহত্যার খেয়াল দেয়াল ভাঙার ডেসপারেটনেস থেকেই, যার ইঙ্গিত জুটে তার প্রস্তাবিত সুইসাইড নোটে। তিনি চান না তাকে নিয়ে কোনো স্মরণসভা হোক, কেউ কথা বলুক। জীবনভর ক্যামেরা-মিডিয়া এত বেশি এক্সপোজার দিয়েছে, অন্তিম যাত্রায় অন্তত দিক রেহাই৷
মৃনালিনী মিত্র একজন বিশুদ্ধ একাকী স্যাপিওসেক্সুয়াল মানুষ। একমাত্র ভাই তরুণ বয়সেই পাড়ি দিয়েছে কানাডায়, ব্যভিচারি বাবা তাদের পরিত্যাগ করেছে শৈশবেই, মা পড়ে আছে বাবার স্মৃতিঘেরা বাড়িতে যেখানে প্রতিদিন নিয়ম করে ঝগডা লেগেই থাকে শরিকদের মাঝে, যাকে ভালোবাসলেন নকশালগিরির কারণে সে মারা পড়লো পুলিশের এনকাউন্টারে। এরপরে যাকে আকড়ে ধরলো সে বিবাহিত; সামাজিকভাবে স্বীকৃত না হয়েও তার সন্তান ধারণ করলো, স্বীকৃতির অভাবে সেই সন্তানকে রেখে এলো প্রবাসী ভাইয়ের কাছে, ভাইয়ের মেয়ে হিসেবেই সে বড় হতে লাগলো, যতদিনে বাচ্চাটি জানলো নিজের প্রকৃত পরিচয়- ফিরে আসতে চাইলো মায়ের কাছে বিমান দুর্ঘটনায় ভস্মীভূত হলো, পাওয়া গেল না লাশটিও; অনাত্মীয় যে নারী তার পোশাক সজ্জার কাজ করত যাকে আত্মীয়রূপে ঠাঁই দিলেন নিজের বাসায় আগুনে পুড়ে নিভে গেল সেও—– এত বড় দেশে নিজের মানুষ বলতে কেউ কি ছিল তার?
মৃনালিনী মিত্র যেন এক আচমকা জেগে উঠা ছিটমহল। এমনকি মৃত্যুর পরে কে তার লাশের সদগতি করবে জানা নেই সেটিও; শুধু ব্যক্তিগত কিছু জিনিস এক লেখক বন্ধুকে দিয়ে দেবার অনুরোধ রেখেছেন।
মৃনালিনী মিত্রের স্যাপিওসেক্সুয়ালিটির নিদর্শন অজস্র। ১৫ বছর ধরে তিনি অভিনয় করছেন না, সত্যজিত রায়ের থেকে একটি সিনেমার অফার পাবেন সেই অপেক্ষায় দিন গুনেছেন সবসময়, তিনিই যখন লোকান্তরিত হলেন ব্যতিক্রমী সিনেমায় কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও শেষ, আর এক্টিং করে কী হবে!
মৃনালিনী মিত্র কি সত্য বলেছিলেন? মানে হতেও তো পারে এটা একটা কথার কথা। ক্যারেক্টারের সমস্ত সংলাপকে তো ধ্রুবসত্য ধরার কারণ নেই।
তাই মৃনালিনীর রোমান্টিক এঙ্গেল তৈরি হওয়া চরিত্রগুলোর ধরন লক্ষ্য করা যাক। প্রথম যৌবনের প্রেমিক নকশালপন্থী, পড়ুয়া এবং ক্লাসিকাল শিল্পমনা। প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে যার সাথে প্রেম সেই বিবাহিত পুরুষ পরিচালক হিসেবে মেধাবী, ডেডিকেটেড এবং আনকম্প্রোমাইজিং; কাছাকাছি সময়েই প্লেটোনিক প্রেম হওয়া লেখক যার সাথে কেবলমাত্র ইন্টেলেকচুয়াল আলাপের তাগিদ থেকেই কাটানো হত কোয়ালিটি সময়। চিন্তন নামের এই লেখক বন্ধুই তাকে শিখিয়েছে ভালোবাসার অনেক রূপ আর রকম হয়, সে কেবল ভালোবাসার একটা রূপই বুঝে (বিয়ে), যা তার ভালোবাসার বোঝাপড়ায় তৈরি করে গলদ। মৃনালিনী চিন্তনের সেই ফিলোসফি সচেতনভাবে ধারণ কতটা করেছিল জানা নেই, তবে অবচেতনে একটা প্রভাব পড়েছিল হয়ত, নইলে মৃত্যু পরিকল্পনাকালে কেবল চিন্তন এর প্রতিই ইতিবাচক ইমপ্রেসন দেখা যাবে কেন!
তবে দীর্ঘদিনের একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতায় চিন্তনের ভালোবাসা থিওরি হয়তবা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি মৃনালিনীর পক্ষে, সেক্ষেত্রেও অনুঘটক হয়েছিল তার স্যাপিওসেক্সুয়াল প্রকৃতি৷ নিজের অর্ধেক বয়সী তরুণ পরিচালক যখন তাকে কর্ণ-কুন্তী সম্বাদ এর কুন্তী চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিল, মধ্যবর্তী ১৫ বছরে এত স্ক্রিপ্ট প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও এযাত্রায় অন্যথা কেন হলো? ইমতিয়াজও সত্যজিতের মতো দীর্ঘদেহী, এটাই কারণ, যেটা সে রসিকতাচ্ছলে বলেছে। নাকি, ইমতিয়াজের আমেরিকায় ফিল্ম নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা, ফিল্ম বিষয়ে আন্ডারস্ট্যান্ডিং।
নাকি ইমতিয়াজ যখন বলে মৃনালিনী ছাড়া কেউ নেই যে এমন চমৎকার ইংরেজি একসেন্ট এ কথা বলতে পারবে, সে না করলে প্রজেক্টই বাতিল, এমন প্রশংসা আর কোয়ালিটিফুল পরিচালকের সান্নিধ্য দুটোর মোহে পড়ে গিয়েছিলেন?
ইমতিয়াজ যে কিনা নিজেই কর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলো, তার সাথে মৃনালিনীর রোমান্টিক এঙ্গেল তৈরি হলো কীরূপে? কুন্তী কর্নের কুমারী মাতা, দুজনের মধ্যে কামুকতার প্রবেশে ইমতিয়াজের অপরচুনিস্ট স্বভাব, নাকি মৃনালিনীর স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি কোনটা মূখ্য হলো? ইমতিয়াজ যখন তাকে ফ্রান্সে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, সেখানে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখায়, পরবর্তীতে তরুনী নায়িকার সাথে যে ঘনিষ্ঠতা তাতে তাকে প্লেবয় প্রকৃতির বলা উচিত, নাকি তার মধ্যে তৈরি হয়েছে ঈদিপাস কমপ্লেক্স, যেখানে ব্যক্তি নিজের বাবাকে হত্যা করে এবং মাকে বিয়ে করে তার গর্ভে করে সন্তান উৎপাদন (যদিওবা অজ্ঞাতসারে)
ইমতিয়াজের মধ্যে মৃনালিনীর সত্যজিতকে খোঁজার বক্তব্যটা রসিকতা নাও হতে পারে, কারণ অন্তিম দৃশ্যে এক আপাত এন্টি-সোস্যাল যখন পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ানো অবস্থায় যখন তাকে অতিক্রম করে যায়, এক ঝলকে তিনি যেন প্রথম যৌবনের সেই প্রেমিককেই দেখতে পান, এবং পরমুহূর্তেই পুলিশের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাকে ভূপাতিত করে।
মৃনালিনী একজন বিশুদ্ধ একাকী মানুষ; হঠাৎ রাস্তায় বেঘোরে মারা পড়লেন, যেমন গাড়ি চাপায় কিংবা অন্য গোলযোগে নিহত হয় বেওয়ারিশ কুকুর; মৃত্যুকালে সঙ্গে কুকুর রাখার দৃশ্যটা কি সেই সিম্বলকেই প্রতিনিধিত্ব করলো? রাস্তার কুকুরগুলো থাকে অনাদরে, মৃনালিনী যেহেতু সমাজের উচুতলার মানুষ, তার কুকুরটা বিদেশী, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুকুরই তো। বিশুদ্ধ একাকী মানুষের জন্য এমন অতর্কিত মৃত্যুই কি মহার্ঘ্য নয়; যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকত ১ মাস, কে আছে কোথায়!
ইতি মৃনালিনী দেখা শেষ হয়, মাথায় তখনো ঘূর্ণায়মান থাকে অপর্ণা সেন, আর্ট-কালচার আর স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি! কিছু মানুষ, কিছু ভাবনা স্থান-কাল-পাত্রভেদে কেবল ফিরে ফিরে আসে অন্য কারো গল্প হয়ে অন্য কোনো চেহারায়।