১৯৬৫ সালের সামাজিক অনুশাসন, ইন্টারেকশন বা জীবন-ভাবনার সাথে কি মিলবে ২০১৫ এর টা? সেই সময়ের একটি দম্পতিকে পোরট্রে করে যদি ফিল্ম নির্মাণ হয় তাদের নর্মস এখনকার লেন্স দিয়ে দেখলে বেখাপ্পা মনে হবে, মোট কথা আপনি স্রেফ ধরতেই পারবেন না বিষয়টা। আপনাকে ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে, অন্যথায় মন্তব্যগুলো হবে ভুলভাল।
বেলাশেষে ফিল্মটা দেখিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত, তবে এর প্রাইম টাইমে সোস্যাল মিডিয়ায় এর অসংখ্য রিভিউ পড়েছি। বেশিরভাগেরই মূল টোন ছিল নারীর প্রতি অবমাননাকর, মেল শ্যাভেনিজমের বাড়াবাড়ি প্রদর্শনী।
তখনই বুঝেছিলাম পপুলিস্ট লোকজনের লম্ফঝম্পের বাইরে এর ভেতরে সাবসটেন্স থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, ভেবেছিলাম কখনো সময় হলে দেখে নিব। সময় আর হয়নি। সম্প্রতি এক সুহৃদ অনেকটা তাগাদার মতো করে এই ফিল্ম দেখা আর ক্রিটিক লেখার রিমাইন্ডার দিয়ে যাচ্ছিল, সেই দিনটা এসেই গেল ফাইনালি।
নারী এবং পুরুষ কনসেপ্টটিকে আমি লিঙ্গভিত্তিক নয়, ন্যাচারভিত্তিক দেখি। মেল এনার্জি এবং ফিমেল এনার্জি।
মেল এনার্জির বৈশিষ্ট্য হবে স্বাধীনচেতা, ডমিনেটিং, এডভেঞ্চারাস, কম্পিটিটিভ। ফিমেল এনার্জি সাবমিসিভ, সফট হার্টেড, শান্তিপ্রিয়, কোঅপারেটিভ। একজন মানুষ শারীরিকভাবে পুংলিঙ্গের হয়ে ফিমেল এনার্জি সম্পন্ন হতে পারে, উল্টোটা ঘটতে পারে শারীরিকভাবে স্ত্রীলিঙ্গের একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও।
প্রকৃতিগতভাবে একজন মানুষ কোন এনার্জিসম্পন্ন এটাই আমার কাছে মূল বিবেচ্য। পুরুষতান্ত্রিকতা বনাম নারীর প্রতি অবমাননা উভয় আলাপই মেরিটলেস লাগে, এখানে মূল কনফ্লিক্টটা সোসিও পলিটিক্যাল, জেন্ডার একটা টুলসমাত্র।
দুটো মানুষ। তাদের শরীর, পারিবারিক ইতিহাস, বেড়ে উঠার পরিবেশ, পছন-অপছন্দ, বহিঃপ্রকাশ, ইমোশন, হরমোনাল ট্রানজিশন সবকিছু আলাদা। তারা যখন সহাবস্থান করে সেখানে ম্যাচিংয়ের চাইতে মিসএলাইনমেন্ট বেশি হবে এটাই বাস্তবতা, এর মধ্যেও তারা এডজাস্ট করে নেয়। কিন্তু এডজাস্ট বা অভিযোজন ক্ষমতাকে উপস্থাপন করা হয় নেগেটিভ বৈশিষ্ট্যরূপে। এডজাস্টমেন্টকে কোয়ালিটির চাইতে সামজিকতা, সন্তানের ভবিষ্যৎ, আর্থিক অনিরাপত্তা প্রভৃতি অনুষঙ্গের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারূপে দেখবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু স্বনির্ভরতা কি কেবলই আর্থিক, মানসিক আর আবেগিয়? আমি কারো খাই না পরি না মনোবৃত্তি দিয়ে মানুষ আসলেই কি স্থিতিশীলতা পায়? যদি পেত তাহলে প্রতিটি স্বচ্ছল এবং কর্মব্যস্ত মানুষ অবসরে দেশ ঘুরা, নানা ধরনের সম্মাননা স্মারক পাওয়ার মধ্যেই পূর্ণাঙ্গতা খুঁজে নিত।
নিতে পারে না কেন; কোথায় সে আটকে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে।
এই প্রশ্নের উত্তর আপাত বিপ্লবী চিন্তাধারার মানুষেরা পর্যালোচনা করে না বলেই শুধু বেলাশেষে নয় যে কোনোকিছুর জন্যই নারীর প্রতি অবমাননা আর পুরুষতান্ত্রিকতার কমন ফ্রেমওয়ার্ক খুঁজে নিয়ে ক্ষণিক হাওকাও করে অন্য ইস্যুতে নিমগ্ন হয়।
বেলা শেষে এর মূল প্রতিপাদ্য ‘সঙ্গ এবং সঙ্গী’। সঙ্গ মানে কেবল যৌনতা নয়, কতক্ষণই বা ব্যাপ্তি থাকে যৌনতার, এর উপর ভর করে কি দিন-মাস-বছর কিংবা সারাজীবন পার করা যায়!
সঙ্গ মানে এক্সচেঞ্জ, এটাচমেন্ট, বন্ডিং; সেটা আসে স্পর্শ থেকে, কোয়ালিটি সময় অতিবাহিত করা থেকে, একজন আরেকজনকে এক্সপ্লোরের মাধ্যমে পুনরাবিষ্কার করা থেকে। নইলে ঔনারশিপ কি তৈরি হয়?
আপনি মেল এনার্জি সম্পন্ন মানুষ, আপনার সঙ্গীও যদি একই এনার্জির হয়, সেই সঙ্গ বা যৌথ জীবন সংঘাতময় এবং টক্সিক হতে বাধ্য। মেল-ফিমেল এনার্জির কম্বিনেশন পারফেক্ট, নিদেনপক্ষে ফিমেল-ফিমেল এনার্জি।
বেলা শেষে এর গল্পের যে সেটিংস সেখানে সঙ্গ-সঙ্গী এক্সপেরিমেন্ট এ ৫টি স্যাম্পল রয়েছে। তবে মূল স্যাম্পল ১টি যুগল যারা ৫০ বছর ধরে সহাবস্থান করছে, সেসূত্রে এসেছে বাকি ৪টি জুটি যারা তাদের সন্তান-সন্ততি।
ইন্টেলেকচুয়ালিটি বনাম লিনিয়ারিটি, বিশ্বনাথ তার সঙ্গী আরতির সাথে যে কনফ্লিক্টটা বোধ করে তার রুট কজ কি এটাই? আরতির নেই এম্বিশন, বাইরের জগত সম্বন্ধে ধারণা, তার চিন্তার প্যাটার্ন গৎবাঁধা অর্থাৎ আরতির সাথে কথা বলে সে মজা পায় না, সে আনরোমান্টিক। সে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়। কিন্তু রেসপনসিবিলিটির জায়গায় আরতির প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তাহলে তাদের সঙ্গ যে ৫০ বছর টিকে গেল এখানে তার নিজের কৃতিত্ব কতটুকু, নাকি সবটাই আরতির অবদান?
আরতি নিজে কখনো ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে কি ভুগেছে?
সে ঘরে থাকতে চেয়েছে, ঘরে বসে বই পড়েছে, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চেয়েছে। বিশ্বনাথ তার জন্মদিন মনে রাখে না, বরং অন্নদাশংকর রায়ের বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দেয়ার কথাটাই বেশি মনে থাকে, কিংবা ৩-৪ দিনের জন্য বাইরে চলে গেছে, বাচ্চা অসুস্থ জানেও না; আরতি বুঝে নিয়েছে একলাই পাড়ি দিতে হবে সংসার। সে বিশ্বনাথকে স্পেস দিল নাকি মেনে নিল একে দিয়ে হবে না।
ইন্টেলেকচুয়াল মানে যদি মগজের ব্যবহারে সিদ্ধ অথচ প্রাত্যহিক কাজ-কর্মে অদক্ষতা নির্দেশ করে, সেই ইন্টেলকচুয়ালিটির নিরুপদ্রবতা রক্ষায় কিন্তু লিনিয়ারিটির সিম্বল যেসব মানুষ যারা হয়ত চার্মিং চিন্তা করে না, যার গল্প শুনে ঘোরগ্রস্ততা তৈরি হয় না তাদের উপরই নির্ভর করতে হয়। আরতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে সে হয়ত দূরাবস্থায় পতিত হবে, কিন্তু টিকে থাকতে পারবে৷ বিশ্বনাথ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েও টিকতে পারবে না যদি আরতিদের মতো মানুষেরা তাকে সাপোর্ট দেয়৷
মানুষ শেষ পর্যন্ত ইমোশনের উপরই বাঁচে।
বিশ্বনাথ-আরতির উত্তর প্রজন্ম যে ৪টি যুগল পাই, সেখানকার এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশন দেখি-
* বড় মেয়ে এবং জামাই। দুজনই বৈষয়িক, ইমোশনের চাইতে রেসপনসিবিলিটি বেশি। এখনো পর্যন্ত ভাঙনের সুর নেই, তবে আগামীতে আসবে না অত দৃঢ়ভাবেও বলা যায় না।
* পুত্র এবং পুত্রবধূ। তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে৷ পুত্র বারিন ব্যভিচারি। স্ত্রী শাড়ির ব্যবসা করছে। সন্তানদের কারণে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে গ্যাপ তৈরি হলো কেন; হয়তবা কেউ কারো মনের দুয়ার খুঁজে না আর৷
*মেঝ মেয়ে এবং জামাই৷ এখানে মেয়ে মালশ্রী ব্যভিচারি, স্বামী বিত্তশালী পরিবারের সন্তান, সারাদিন সঙ্গীত সাধনা করে, স্ত্রীর ব্যভিচারিতা সত্ত্বেও নির্বিকার, নিরাসক্ত। মালশ্রী ব্যক্তি স্বাধীনতা, সম্মান, প্রাইভেসি, ইকুয়ালিটি-ইকুয়িটি সহ সব বিষয়ে ভোকাল কিন্তু নিজের জীবনে সেসব রক্ষা করছে কিনা সে প্রশ্নে নিশ্চুপ৷ মালশ্রী এবং বিশ্বনাথ আদতে একে অপরের মিরর ইমেজ, নিজেদের সঙ্গীর প্রতি জাস্টিস হচ্ছে কিনা বোঝার চাইতে নিজেরা সঙ্গীর থেকে কী পেল কিংবা পেল না সে সংক্রান্ত অভিমানবোধ প্রবল।
* ছোট মেয়ে এবং জামাই। প্রথম ৩ সন্তানের চাইতে কনিষ্ঠজনের বয়সের ব্যবধান যথেষ্ট বেশি৷ কনিষ্ঠ কন্যা পিউ বর্তমান জেনারেশনের প্রতিনিধি৷ দুজনই স্বাবলম্বী, একই পেশায় রয়েছে, তবু সম্পর্কে কোথায় যেন কিছু একটা মিসিং। তারা কি সম্পর্কটাকে ৫০ বছর পর্যন্ত টেনে নিতে পারবে?
সিনেমার প্রগ্রেস যেরকম তাতে ৫ বছর আর ৫০ বছরের মধ্যে ব্যবধান বোঝা যায় না। অথচ ৫০ বছর অতি দীর্ঘ সময়। দুজন মানুষ স্রেফ এডজাস্ট করে এতদিন টিকে থাকতে পারে? আগের দিনে নানী-দাদীরা যে ৬০-৭০ বছর সংসার করে গেছেন এর কারণ কি কেবলই অর্থনৈতিক নির্ভরতা? হয়ত অনেকের ক্ষেত্রেই এটা সত্য, কিন্তু বৃহত্তর অংশের জন্যই কি প্রযোজ্য? কেবল হ্যাঁ অথবা না এ এই উত্তর দেয়া অসম্ভব।
বিশ্বনাথ-আরতি ৫০ বছর পাড়ি দিল; না দেয়ার কোনো কারণ কি ছিল? দুজনেরই দুজনকে প্রয়োজন ছিল ভিন্ন কনটেক্সট এ। তাই এখানে একজনকে বড় করে অপরজনকে ছোট দেখানোরও সুযোগ নেই।
আরতির রেসপনসিবিলিটিকে যদি স্যাক্রিফাইস বলি বিশ্বনাথের ইন্টেলেকচুয়াল ক্ষুধা, রোমান্টিকতার অভিমান চেপে নিয়ে ৫০ বছর কাটিয়ে দেয়াটাও বিরাট স্যাক্রিফাইস। এই দীর্ঘ সময়ে তার কোনো স্খলনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় না, বরং ‘বারে বারে আমি তার প্রেমে পড়েছি’ লাইনটার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় কী অসীম শূন্যতা আর অপূর্ণতার চাষাবাদ করেই কেটে গেছে জীবন।
৫০ বছর সংসার মানে বয়স কমপক্ষে ৭০, জীবনের বাকিই বা আছে কয়দিন। শরীর কি পারবে ৪০ বয়সের সেই উদ্যমতা-উদ্দীপনার ভার নিতে?
তাই ৫০ বছর সংসার করে কেউ ডিভোর্স নিতে চাইছে, গল্পটা চিন্তার জন্য উপাদেয় হলেও প্র্যাক্টিকালি মিনিংলেস। আমি এই সেই করতে পারতাম, হাতি-ঘোড়া নিধন করতাম সংসারের জোয়াল বইতে গিয়ে পারলাম না– এই ফ্যান্টাসিতেই সময় কাটিয়ে দিয়ে সিংহভাগ বিবাহিত মানুষ। সত্যিই যদি যাবতীয় রেসপনসিবিলিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় ফ্যান্টাসির গতি কীরূপ হবে? অভ্যাসবশত সে আবার সংসারেই ফেরত আসবে, যেমনটা এলো বিশ্বনাথ।
বরং এইসব ফ্যান্টাসি থাকে বলেই মানুষ কেনা-কাটা, ঘুরোঘুরি, সন্তান উৎপাদন, সম্পদ নির্মাণ প্রভৃতি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখে রাষ্ট্রযন্ত্র। সংসার আদতে ভোগবাদী দর্শনেরই প্র্যাক্টিকাল চর্চা; ভোগ আর উপভোগ এর ব্যালেন্স কে কতটা করতে পারলো সেটাই নির্ধারণ করে দেয় সঙ্গী হিসেবে তার পারফরম্যান্স।
বেলা শেষে এর গল্প থেকে ইন্টারপ্রেটেশন তাই এটাই, নিজে কোন এনার্জির সেটা আগে বুঝুন, এবং যাকে সঙ্গী বানাতে চাচ্ছেন তার এনার্জির সাথে আপনারটা ম্যাচ করছে কিনা দেখুন। এটা উপলব্ধির জন্য বেলা শেষে দেখতে হয় না, বেলা শেষে দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত সেই প্রশ্নটিরই উপসংহারে পৌঁছাতে- ইন্টেলেকচুয়ালিটি লিনিয়ারিটির উপর যদি এতটাই নির্ভরশীল হয়, মানুষ তবে ইন্টেলেকচুয়ালিটির প্রতি এতটা মোহগ্রস্ত কেন!