কেবলমাত্র আকার ব্যতীত কমলার সঙ্গে নাশপতির সাদৃশ্য আছে আদৌ?
বাজার মূল্য, পুষ্টিগুণ, স্বাদের ধরন, বায়োলজিকাল কাঠামো, রং— সবকিছুই দূরবর্তী বাতিঘর।
তবু মার্কেট যদি ব্যবসায়িক স্বার্থে ভাইব তৈরি করতে চায় কমলার চাইতে নাশপতি উৎকৃষ্ট ফল, এবং ফলপ্রিয় প্রত্যেক মানুষকে কমলা অথবা নাশপতি দুই দলে বিভক্ত হতে হবে, এদের মধ্য থেকে ৩ জন পাবে বিএমডব্লিউ গাড়ি— উন্মাদনা কোন লেভেলে পৌঁছুতে পারে অকল্পনীয়!
দর্শক সিনেমায় কী খুঁজে?
কনফ্লিক্ট।
যত বর্ণিল রেসিপিতে কনফ্লিক্ট রান্না আর পরিবেশন করা হয়, দর্শকের রসাস্বাদন তত তৃপ্তিময় হয়ে উঠে। এজন্যই নাটক বা সিনেমার ক্ষেত্রে ‘পাবলিক খায় বা খায় না’ ফ্রেজিং এত বেশি প্রচলিত।
স্পোর্টসের ক্ষেত্রে কনফ্লিক্ট প্রতিস্থাপিত হয় রাইভালরি দ্বারা।
স্পোর্টসের এসেন্স যদি কেবলমাত্র পারফরম্যান্স প্রদর্শন হত, দর্শক নিছক বিনোদন জ্ঞানেই তা দেখত। কিন্তু অর্জুন এবং কর্ণ দুজনই অসাধারণ ধনুর্বিদ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে কে এগিয়ে প্রমাণ করতে হবেই, অসাধারণ নয় অতুলনীয় হওয়াই সেখানে লক্ষ্য।
স্পোর্টসের মালিকানাও আদতে এথলেটদের হাতে নেই, তারা মূলত বিভিন্ন ক্যাপিটালফ্রিক কোম্পানির হয়ে ভাড়া খাটে ৩য় পক্ষ হিসেবে, ক্লাব বা বোর্ডগুলো মধ্যস্বত্বভোগী তথা দালাল।
রাইভালরি ব্যতীত প্রফিটের বিস্ফোরণ সম্ভব হয় না৷ যে কারণে পেলে- ম্যারাডোনা সম্পূর্ণ পৃথক প্রজন্মের প্লেয়ার হয়েও রাইভালরি এর সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা হয়ে মার্কেটে চলতে থাকে।
ক্রিকেট মেটাফরিকালি শৌখিন প্রকৃতির জমিদারপুত্রদের খেলা, যেখানে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া নামের দুই জমিদার নিজেদের ইগো আর আভিজাত্যের পসরা সাজিয়ে রাখে, কালক্রমে তৈরি হয় লেগ্যাসি।
অন্য সকল ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ এই দুই বনেদি জমিদারের কাছে প্রজাতুল্য অথবা নায়েব বড়োজোর।
হঠাৎ প্রচুর অর্থের মালিক হওয়াকে বাগধারায় বলে আঙুল ফুলে কলাগাছ। ওদিকে জমিদারি চলে গেলেও রয়ে যায় এটিচুড! তাই নব্য ধনিকশ্রেণি অর্থের ঝনঝনানিতে জমিদারের সংস্পর্শে গেলেও প্রাচীন দম্ভে জমিদার তখনো ধনীকে নিম্নবর্গীয়ই ভাবে।
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড জমিদারিত্বের সমীকরণে ভারত হলো সেই কলাগাছ যে একদা আঙুল ছিল।
সাকিব এবং বেন স্টোকসের আলাপে এই সমস্ত প্রকরণ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
‘প্রিভিলেজ’ আশীর্বাদ নাকি বোঝা?
জীবনের প্রথম ১৫ বছর আপনি যদি প্রিভিলেজড শ্রেণিতে না থাকতে পারেন পরবর্তী জীবনে আপনার গল্পটা পুরোপুরি আলাদা৷
সাকিব যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিল তার স্বপ্নের সীমানা আদতে কতটুকু বিস্তৃত ছিল? বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলবে বা ক্যাপ্টেন হবে একদিন; এই তো? তাকে আইডল খুঁজতে যেতে হয়েছে পাকিস্তানের সাঈদ আনোয়ার পর্যন্ত!
নেপালে যে তরুণটি আজ ক্রিকেট খেলায় হাতে খড়ি নিচ্ছে, তার লক্ষ্য কতদূর?
কিন্তু বেন স্টোকস বা শেন ওয়াটসনকে সেই সংকটটা মোকাবেলা কর‍তে হয়নি। স্টোকস এর ডিলেমা হতে পারত নিউজিল্যান্ড নাকি ইংল্যান্ড, কোন দেশের জার্সিতে খেলব। যাদের হয়েই খেলুক তাদের লোকাল হিরো অগণিত। খেলাটা সেখানে পারফর্মিং আর্টের বেশি কিছু নয়। মন চাইলো খেললাম, নইলে অবসর নিয়ে ঢুকে পড়লাম অন্য জীবিকায়।
পরিসংখ্যান ‘ডেমোগ্রাফিক বায়াস’টা কি এড়াতে সক্ষম?
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-উইন্ডিজ বা নিউজিল্যান্ড-সাউথ আফ্রিকাতে খেলাটাকে যেভাবে দেখা হয়, এশিয়ার ৫ ক্রিকেটিয় দেশে যে খেলাটার ভাষাই আলাদা, এবং অর্থনীতির মতো এখানেও যে ‘৩য় বিশ্ব’ ধারণাটা মারাত্মকভাবে প্রাসঙ্গিক, এই ফ্যাক্টটা আমলে নিয়ে মডেল ডিজাইন না করা অবধি, কেবল সংখ্যাগত ইন্টারপ্রেটেশন সামগ্রিকভাবে কোনো অর্থপূর্ণ কমিউনিকেশন তৈরি করতে পারে না৷
একারণে ক্যালিস বা লারা অবসর নিয়ে নেয়, কিন্তু শচীন খেলতেই থাকে, তার অবসরের জন্য আয়োজনের কমতি থাকে না। ‘ক্রিকেটের ৩য় বিশ্ব’ কনটেক্সট এ শচীন এটা ডিজার্ভ করে, কিন্তু ক্যালিস-লারা বা স্টিভ ওয়াহ সেই আদলে চিন্তাও করে না।
সাকিবের ক্যারিয়ার ১৭ বছর চলছে, এখনো ৩ ফরম্যাটে খেলছে। তার চেয়ে জুনিয়র এবং পরে ক্যারিয়ার শুরু করা স্টোকস ইতোমধ্যেই ছেড়ে দিয়েছে ওয়ানডে ফরম্যাট! এমন নয় যে ফর্ম খারাপ যাচ্ছিল। মনে হয়েছে ছেড়ে দিই, অন্য ফরম্যাটে বেশি খেলি, ব্যস৷ ইতিহাসে তার স্থান কোথায় হবে, মানুষ কীভাবে মনে রাখবে এসব মেলোড্রামাটিক ভাবনা ঘুমুচ্ছিল ভাগাড়ে!
‘ডেমোগ্রাফিক বায়াস’ যেখানে এত প্রকট, নেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, সেখানে কমলার সঙ্গে নাশপতির তুলনাটা ব্যবসায়িক ফাঁদ!
আপনি যখন খেলা দেখেন, টিভিতে বা মাঠে, আপনার মনে কেবলমাত্র ওই সুনির্দিষ্ট ম্যাচটিই থাকে। কয়েক বছর ধরে দেখবার পরে যখন স্মৃতিচারণ করবেন তখন কোনো একটা ম্যাচের খন্ডিতাংশ বা বিশেষ কোনো পারফরম্যান্স মনে পড়বে।
এভাবেই তৈরি হয় উপকথা।
পরিসংখ্যান বা ডেটা সাথে নিয়ে খেলা দেখেন না, আপনি মূলত মুহূর্ত খরিদ করেন।
এই পারসপেক্টিভে বেন স্টোকস আপনাকে সেইসব মূল্যবান মুহূর্ত উপহার দিয়েছে, যা সাকিব দিতে পারেনি বা দেয়ার সুযোগও আসেনি। ক্রিকেট দেখলে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল আজীবন মনে থাকবেই, কিংবা টেস্ট অনুসরণ করলে হেডিংলি, এমনকি কার্লোস ব্র‍্যাথওয়েটের শেষ ওভারের ৪ ছক্কা!
প্রতিক্ষেত্রেই স্টোকস আপনাকে নক করবে। মাঠে আচমকা কোন ক্যাচ ধরে ফেলা। কিংবা পুরো দল ব্যর্থ, উইকেটে তখনো স্টোকস, আপনি ইচ্ছা সত্ত্বেও আশা হারাতে পারবেন না। সে আপনার ভাবনায় হাঁটতে থাকবে ‘মিরাকল ম্যান’ হয়ে!
কিংবা সাম্প্রতিককালে ইংল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেটটা প্রচলিত কাঠামোর বাইরে খেলতে চাইছে, ক্যাপ্টেন স্টোকস এর ভূমিকা কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?
সাকিব বিভিন্ন মেয়াদে অধিনায়কত্ব পেয়েছে। পারফরম্যান্স দলের সদস্যদের যোগ্যতানির্ভর আউটকাম, কিন্তু কালচার বা ট্রেন্ড এ সাকিবের সিগনিফিক্যান্ট কোনো অভিঘাত কি লক্ষণীয়?
অধিনায়ক সাকিবকে বন্ধনীবদ্ধ করে যদি ক্রিকেটার সাকিবকে লেন্সিং করতে চাই, মূল বিষফোড়াটা হলো ‘অলরাউন্ডার’ বিশেষণটা। এতে সমস্যা যেটা হয়েছে তাকে জেনুইন ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে মিলানো যায় না, আবার জেনুইন বোলারদের সাথেও মিশে না। অলরাউন্ডার হিসেবে আমরা যাদের রেফারেন্স টানি এরা ব্যাটিং বা বোলিং কোনো একটা স্কিলে অধিকতর পারফর্মার ছিল, অন্য স্কিলটা সহায়ক হিসেবে এসেছে, একাদশে ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকরী হয়েছে। ক্রিকেটে যুগে যুগে যারা সুপারস্টার প্রায় প্রত্যেকেই কোনো একটা স্কিলে বিশেষজ্ঞ ছিল।
আমরা যদি যুবরাজ সিংকে রেফারেন্স ধরি, তাকে ব্যাটসম্যান হিসেবেই সমাদর করা হয়, কিন্তু ২০১১ বিশ্বকাপ জেতানোতে তার বোলিংয়েরও অবদান ছিল। সে নিরিখে সেও অলরাউন্ডার।
সাকিব কি যুবরাজের চাইতে বেটার ব্যাটসম্যান? নাহ। বেটার বোলার? হ্যাঁ।
সাকিবের অলরাউন্ডার বিশেষণটাকে তাই শিল্ড বা এসকেপ রুট বলা যায়। সবখানেই আছি। সাধারণত ছোট বা মাঝারি দলগুলোতে এই কম্বিনেশনের প্লেয়ার বেশি থাকে। আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডে ১০ নম্বর ব্যাটসম্যানও কিছু না কিছু ব্যাটিং জানে।
বাংলাদেশের হয়ে খেলাটা সাকিবের জন্য তাই অব্যাখ্যানীয় এক প্যারাডক্স।
কেন?
সাকিবের ক্ষেত্রে পরিসরটাই সংকীর্ণ! মিরপুরেই কেটে গেছে অর্ধেক জীবন। শ্রীলংকা, উইন্ডিজ এর বাইরে একমাত্র নিউজিল্যান্ডই খেলেছে নিয়মিত। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে সাকিব অস্ট্রেলিয়া সফর করেছে মাত্র ১ বার, ২০১০ এর পরে ডাক পায়নি ইংল্যান্ড থেকেও, ভারত বা সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষেই বা খেলা হয়েছে কয়টা ম্যাচ তাদের মাটিতে?
তার মানে স্টোক্স আর সাকিবের ব্রান্ড অব ক্রিকেটই আলাদা। স্টোকস যদি খেলে হলিউড ফিল্ম লেভেলের ক্রিকেট, সাকিবেরটা বড়জোড় কলকাতার দেব-জিত।
মিরপুরের মাঠে বাউন্ডারি হাঁকালে স্কোরে ৪ রান যুক্ত হয়, ইডেন গার্ডেন্স-মেলবোর্ন বা নর্দাম্পটনে ৫ নয়। কিন্তু কোন প্রতিপক্ষ, কোন সিরিজে রানটা হচ্ছে সেটা অতি অবশ্যই বিবেচ্য। এখান থেকেই ব্রান্ড আলাদা হয়ে যায়। সারাবিশ্বে কোকাকোলার স্বাদ একরকম নয়, অঞ্চলভেদে স্বাদে তারতম্য ঘটে।
এখানে সাকিবের দোষটা কোথায়, বা স্টোকসের নিজের কৃতিত্ব কি থাকে আদৌ?
বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট সাফল্য পেত, বা স্বল্প সুযোগেই এওয়ে সিরিজ জিতে নিত, নিশ্চিতভাবেই আরো কোয়ালিটি ম্যাচ বা সিরিজের সুযোগ আসতো। কিন্তু এওয়েতে বিশেষত টেস্টে তারা এতটাই বিবর্ণ যে, আমরাই বলতে বাধ্য হই বাংলাদেশ ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় খেলা ডিজার্ভ করে না।
এরকম একটা দলে সাকিব নিছকই ভ্রান্তি বাবল। সাধারণত গ্রামের স্কুলে ফার্স্টবয়ের সঙ্গে সেকেন্ড বয়ের নম্বরের পার্থক্য থাকে ৪০-৫০ বা তারও বেশি।ঢাকার স্কুলে দেখা যেত মাত্র ৫ নম্বরের পার্থক্যে পজিশন চলে গেছে ১০ এর বাইরে। গ্রামের স্কুলের সেই ফার্স্ট বয়কে ঢাকার কোনো নামী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে খুবই সম্ভাবনা আছে সে পিছিয়ে পড়বে। তার মানে কি এটা বলা যাবে গ্রামের স্কুল থেকে আসা ফার্স্ট বয়ের মেধা ঢাকার স্কুলের ছেলেদের তুলনায় কম, নাকি দেশের সব মেধাবী ঢাকাতেই?
এখানেই প্রিভিলেজ ব্যাপারটা তুমুলভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে।
তবু কমলা-নাশপাতির তুলনা কেন?
মূলত জাতে উঠানো অথবা জাতচ্যুত করার রাজনীতি।
এই যে এশেজ, এটা একটা নিছক টেস্ট সিরিজই তো। মাঝে অনেকটা সময় গেছে যখন মাইকেল আথারটন, মার্ক রামপ্রকাশরা খেলত, ইংল্যান্ড রীতিমত দুমড়ে মুচড়ে যেত অস্ট্রেলিয়ার সামনে। তবু জাত্যাভিমান প্রশ্নে এ নিয়ে হাইপের অন্ত ছিল না। লর্ডসকেন্দ্রিক যে কৌলিন্য, আজকের পৃথিবীতে একে কেন রেসিজম বলা হবে না এই প্রশ্ন কেউ তুলছে না। লর্ডস ঠিক কোন পয়েন্ট মোহালি বা হাম্বানটোটা থেকে মহিমান্বিত?
আবারো সেই জমিদারিপনাই ফ্যাক্টর হয়ে উঠে।
ধরা যাক, আপনি একজন ফিল্ম ডিরেক্টর৷ একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখবেন।
আপনি যদি ক্রিকেটিয় বিষয়াদিকেই মূখ্য রাখেন, স্টোক্স আপনাকে প্রচুর রসদ দিবে, যেগুলো সেলেবল।
সাকিব আপনাকে দিবে কেবল সংখ্যা। ২০১৯ বিশ্বকাপ। তাকে আপনি হিরোয়িক কোনো রিপ্রেজেন্টেশন দিতে ব্যর্থ হবেন।
কিন্তু
আপনি চিন্তা করলেন একটা বায়োপিক নির্মাণ করবেন, প্রটাগনিস্ট একটি দুর্বল ক্রিকেটিয় দেশের অবিসংবাদি শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার। এই এঙ্গেলে সাকিব আপনাকে যা যা দিবে, তা স্টোকস কেন কোন ক্রিকেটারের পক্ষেই দেয়া সম্ভব নয়। কারণ অন্যরা পুরোমাত্রায় ক্রিকেটার, খন্ডকালীন ব্যবসায়ী বা পণ্যের মডেল!
সাকিবের গল্পের ইউনিকনেসটা ভাবুন।
তার যৌবনের বড় অংশই কেটে গেল আমেরিকা আর বাংলাদেশের ফ্লাইট ধরতে-ছাড়তে। ব্যবসা, রাজনীতি, ফিক্সিং, বিজ্ঞাপন, ফ্র‍্যাঞ্চাইজি, কন্ট্রোভার্সি, শেয়ার বাজার— কোথায় নেই সে! ক্রিকেট সেখানে অন্য অনেক আইটেমের মধ্যে একটা মাত্র!
তাই ক্রিকেট ক্যারেক্টার হিসেবে স্টোকস অবধারিতভাবেই অনেক বেশি আবেদনময়, হিউম্যান ক্যারেক্টার যার এক্সপোজারের উৎস ক্রিকেট, সেক্ষেত্রে সাকিব এলিমেন্টবহুল।
ক্রিকেটিয় স্কিল সংক্রান্ত সাকিবের বোঝাপড়া খুব শার্প। বহুবছর আগেই প্রথম আলোতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জবাব দিয়েছিল- ‘আমি গ্রায়েম স্মিথের মতো ব্যাটিং করতে পারব না, আবার পারবো না আজমলের মতো বোলিং করতে। আমি যেটা পারব, ২টা ভালো ওভার করে দিতে’
সাকিব আদতে কন্ট্রিবিউটর, একদম গেম চেঞ্জিং ধরনের ব্যাটিং বা বোলিং স্কিল না থাকা সত্ত্বেও গেম সেন্স আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে দলে কন্ট্রিবিউট করে। দলে যদি আরো ৫-৬ জন আউটলায়ার ধরনের ক্রিকেটার থাকত, তাকে মূল্যায়ন আরো নির্মোহ হত। অন্যরা এতটাই পিছিয়ে, না হলো নিজের গ্রোথ, না করা হলো দেশীয় ক্রিকেটের রিব্র‍্যান্ডিং! পিআর টিম ম্যানেজেই খরচ হয়ে গেল এনার্জির ভান্ডার!
ধরা যাক, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ড এবং সাউথ আফ্রিকার ৩ জন স্বতন্ত্র ক্রিকেট এনালিস্ট ওয়ানডে এবং টেস্টের জন্য দুটো একাদশ গঠন করবে, গত ১০ বছরের ক্রিকেটারদের মধ্য থেকে৷ খেলাও হবে এই ৩ দেশেই। সেখানকার ক্রিকেটাররা যদি অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান ডমিন্যান্ট হয়, এবং সাকিবকে না রাখা হয়, সেটা কি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে দেখা হবে, নাকি বাংলাদেশের হয়ে খেলে বলে মূল্যায়ন করা হয়নি ভাববেন?
অলরাউন্ডার ধারণাটা ক্রিকেটিয় কনটেক্সট যা মিন করে, বাংলাদেশের বিজনেসপতি এবং তাদের মাইনেভুক্তরা একে ক্রিমিনালি ওভাররেটেড বানিয়েছে, কেবলমাত্র স্টারডম বিক্রির অভিলিপ্সায়। এর সুদূরপ্রসারি খারাপ প্রভাব হলো মিডিয়া এখন জেনুইন ব্যাটসম্যান বা বোলারের চাইতে মিরাজ ঘরানার প্লেয়ারকে অধিক ফুটেজ দিতে চায়, নতুন সাকিব খোঁজে।
কিন্তু যদি ইরান বা রাশিয়ার কোনো দর্শক ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ বনাম ভারত ম্যাচের মধ্য থেকে মাত্র একটা দেখার ইচ্ছা পোষণ করে, সে নির্দ্বিধায় ইংল্যান্ড ম্যাচটা দেখবে, কারণ সেখানে রেজাল্ট ম্যাচ শুরুর আগেই বলে দেয়া সম্ভব নয়, যেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনায়াসে করে দেয়া যায়।
তাই সাকিবের সমগ্র ক্যারিয়ারজুড়ে কখনো ক্যালিস, কখনোবা জয়াসুরিয়া, শেন ওয়াটসন সহ আরো যত ক্রিকেটারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, কিংব গ্যারি সোবার্স গিমিক, এগুলো শেষ পর্যন্ত ফোক ফ্যান্টাসি হিসেবেই দেখা উচিত।
বাংলাদেশের ক্রিকেট কি তার সেরা সময় দেখে ফেলেছে? পক্ষান্তরে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট থেকে নতুন করে পাওয়ার মতো খুব বেশি কি অবশিষ্ট আছে?
এরকম অসম পরিস্থিতিতে সাকিবই যদি হয়ে যায় বাংলাদেশের শেষ কথা, তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আমরা বলতে পারি নদীর বুকে হঠাৎ গজিয়ে উঠা চর, যা আবার নদীগর্ভেই হারিয়ে যাবে। একটা পূর্ণাঙ্গ নগর বা জনপদ হতে যেসব কৃষ্টি-কালচারের শর্ত পূরণ করতে হয়, তার বহু দূরত্বে থেকেই সে বিনষ্ট!
রজনীকান্তের বয়স হয়ে গেছে। থালাপতি বিজয়, ধানুশদের মার্কেট তৈরি হোক!
বাংলাদেশে কি কোনোদিন গুগল, মাইক্রোসফট বা এপল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?
নাহ।
বাংলাদেশের কোনো সিনেমা কি আগামী ৩০ বছরে অস্কার জিতবে?
বাংলা ভাষার কোনো লেখক কি আগামী ৫০ বছরে নোবেল পাবে?
বাংলাদেশে কি আগামী ২০ বছরেও এমন কোনো ফিকশন বা ননফিকশনাল বই লেখা হবে যা ৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হবে?
সব সূচকেই বহুযোজন পিছিয়ে থেকে যদি ক্রিকেটিং গ্রাউন্ডেই ফিরে আসি, একটা দল যাদের পৃথিবী মিরপুরময়, যাদের বিপক্ষে এখনো জমিদারেরা বেশিরভাগ সময়ই রিজার্ভ বেঞ্চ পরখ করা দল পাঠায়, সেই লিলিপুটদের সমাবেশে কারো উচ্চতা যদি ৫ ফুট হয় তাকে দানব লাগে বটে, তাতে পৃথিবী থেকে ৬ ফুটি মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না, আপাত দানবও তখন বৃহৎ লিলিপুটই থাকে। কিংবা এভাবে বলা যায় বৃহৎ লিলিপুটের ক্রাইসিস বরং আরো বেদনা আর যাতনাময়!
বাংলাদেশে বছরে ১০০ কোটি টাকা টার্ন ওভারের বেশ কয়েকটা কোম্পানি আছে, নি:সন্দেহে দেশের মানদন্ডে জায়ান্ট কোম্পানি। সেই ভরসায় তাদের টেসলা বা গুগলের সারিতে রাখা শুরু করলে, এবং প্রচারণা চালালে দেশের বৃহৎ একটি গোষ্ঠী কনভিন্সডও হতে পারে, কারণ ব্রেইনওয়াশ হওয়া তাদের প্রিয় শখ।
বরং আইকনিক দৃশ্য হতে পারত সাকিবের বলে বেন স্টোকস বোল্ড হওয়া পরবর্তীতে সাকিবের স্যালুট, কিংবা ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিবের সেঞ্চুরিকৃত ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে বোল্ড হওয়ার মাধ্যমে, বোলার কে ছিল?
ফুটেজ দেখে নিয়েন!
রাইভালরিকে পোরট্রে করার অসংখ্য স্মার্ট উপায় রয়েছে। কমলা আর নাশপতিকে মুখোমুখি বসিয়ে দেয়াটাকে যতভাবেই গ্লামারাইজ করা হোক, ২৩ বছর পরও সেটা কূপমন্ডুকতাই সাব্যস্ত হবে!