এনালাইসিস বা হাইপোথিসিসকে বরাবরই বলি ডুমুরের ফুল। নানা জোড়াতালিপূর্ণ অনুমানকে কানেক্ট এবং কোরিলেট করে কতটা আস্থাযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটাই শেষতক এনালাইসিস নাম পায়, যদিও তাতে ‘অনুমান’ এর বাস্তবতা বদলায় না।
তথ্য এবং উপাত্ত, হোক সেটা প্রাইমারি অথবা সেকেন্ডারি সোর্স থেকে সংগৃহীত, ফ্যাক্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আদতে ফ্যাক্ট কিনা প্রশ্ন করা উচিত।
‘তামিম ইকবাল বিশ্বকাপের মাত্র ৩ মাস আগে কেন অবসর নিল’— যদি এনালাইসিস কর‍তে চাওয়া হয়, একজন সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমি ফেসবুক আর মিডিয়ায় পাওয়া বিভিন্ন স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে নিজস্ব থিসিস তৈরি করবে।
একজন গবেষক হয়তবা ইনসাইড নিউজ সংগ্রহ করে প্যাটার্ন দাঁড় করাতে চাইবে, সাংবাদিক বা বিসিবি সংশ্লিষ্ট কেউ যারা মূল ঘটনার অনেক কিছুই অবগত তারাও নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে, কিন্তু একমাত্র তামিম ইকবাল ব্যতীত কারো সাধ্য নেই যথার্থ কারণ আবিষ্কারের।
এমনকি ৬ মাস বা ১ বছর পরে খোদ তামিমেরই মনে হতে পারে অবসর নেয়ার কারণ সেই সময়ে যা মনে হচ্ছিল এখন দেখছি আরো কিছু কারণ ছিল যা সেসময় মাথায় আসেনি।
খ্যাতি, ক্ষমতা এবং প্রেম— এই তিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিয়তি এবং ভাগ্য সরাসরি সংযুক্ত। মেধা, প্রতিভা, যোগাযোগ, অধ্যবসায়, মানসিক শক্তি, আত্মত্যাগ সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আপনি খ্যাতি বা ক্ষমতার সান্নিধ্য নাও পেতে পারেন যদি না সঠিক সময়ে ভাগ্য অনুকূলে থাকে।
উল্লিখিত পূর্বশর্তগুলো পালন করলে একটা লেভেল পর্যন্ত সাফল্য পাবেন, কেবল এটুকুই নিশ্চয়তা দেয়া যায়। তাই খ্যাতি-ক্ষমতা-প্রেম আপনার চয়েজ নয়, আপনি নিজেই সেখানে চুজেন!
খ্যাতি এবং ক্ষমতার থাকে নিজস্ব রাজনীতি। সেই রাজনীতির বৃহৎ অংশ সংঘটিত হয় পর্দার আড়ালে, অনেকটা পুতুল নাচের মতো, দর্শক দেখে শুধুমাত্র পারফরম্যান্সটুকু।
খ্যাতি-ক্ষমতা রাজনীতি মেকানিক্সে অংশ নেয় মোট স্যাম্পল সাইজের সর্বোচ্চ ২-৩% মানুষ, বাকিরা তার অনুসারি, সুবিধাভোগী, অথবা ভিক্টিম।
যে কোনো গাণিতিক এক্সপেরিমেন্টে ২-৩% বিচ্যুতিকে অনায়াসে উপেক্ষা করা যায়। সোস্যাল হায়ারারকি ডিস্ট্রিবিউশনে তখন তৈরি হয় এক প্যারাডক্সিকাল বাবল৷ আপনার রুচি-বিনোদন বা জীবনযাপন নিয়ন্ত্রিত বা নির্ধারিত হচ্ছে সেইসব মানুষের লাইফস্টাইলের দ্বারা যাদের জন্য প্রযোজ্যই নয় আপনার বা আপনাদের চিরায়ত মূল্যবোধ, বিশ্বাস বা নৈতিকতার কাঠামো!
যেমন কোনো ফরমাল লেখালিখি আপনাকে জানাবে না খ্যাতি-ক্ষমতার রাজনীতির মূখ্য নিয়ামক ক্রুয়েলটি এবং কানিংনেস বা চাতুর্য, কখনোই স্বচ্ছতা বা ইমপ্যাথি নয়। ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর’— যে শাসকের স্তুতিকাব্য লেখা হয়েছে, তার প্রজাবাৎসল্য যেমন সত্য, একই ব্যক্তির সিংহাসনে আরোহণ বাপ-ভাইয়ের রক্তের উৎসবযোগে, সেটাও ঐতিহাসিক সত্য।
একারণে খ্যাতি-ক্ষমতার মায়া বা মোহ বা প্রলোভন ত্যাগ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
কোটি কোটি চোখ আপনাকে অনুসরণ করে, শত শত ক্যামেরা ক্লিকের শব্দ আপনার হৃৎপিন্ডে লিরিকাল ব্যালেড তৈরি করে; তারপরে একদিন আপনাকে খোঁজে না কোনো চোখ, ক্যামেরার ক্লিকগুলো অন্য কারো— সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গে নিজেকে মনে হতেই পারে রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত মৃতপ্রায় যাবজ্জীবন কয়েদি!
তামিম ইকবাল বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার যার আসলে ক্রিকেট খেলা ব্যতীত ভিন্ন কোনো কাজে যাওয়ার অবকাশই ছিল না, পারিবারিক পরম্পরার কারণেই। মাশরাফি, আশরাফুল, সাকিব, মুশফিক যারই নাম বলি এদের ক্রিকেটার হওয়াটা ছিল ব্যক্তিগত চয়েজ, তামিমের পারিবারিক রেওয়াজ রক্ষা।
তাই তামিমের গল্পটা মিলবে শুধু তামিমের সঙ্গেই।
আমরা চিনেছি হুমায়ূন আহমেদকেও। তার বেশ কিছু নাটকে ডিমের সালুন তরকারিকে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে চরিত্ররা, সংলাপের মধ্য দিয়ে। ডিমের সালুন, আলু ভর্তা বেহেশতি খাবার হিসেবে উপমিত হয়েছে। লক্ষণীয় হলো, এই খাবারগুলোকে অবজেক্টিফাই চরিত্রগুলো প্রায় সবাই দরিদ্র শ্রেণিতে বিলং করে। ডিমের সালুন বা আলু ভর্তাকে বেহেশতি খাবার বলার মধ্য দিয়ে এদের যতটা না রিচফুড এর কাতারে তোলার প্রবণতা তার চাইতে বেশি দারিদ্রকে কৃত্রিমভাবে একটা বড়লোকি বাবল তৈরি করে রাখা।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ লোকরঞ্জনবাদী লেখক। তার প্রভাব পড়েছে ক্রিকেট বাণিজ্যেও। আশরাফুল, সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক প্রত্যেককেই নানা চেহারার বেহেশতি ডিমের সালুন হিসেবে পরিবেশন করা হয়েছে দরিদ্রচিন্তার দর্শকের কাছে, তারা সেটা গ্রহণও করেছে।
লোকরঞ্জনের এই সুনির্দিষ্ট রাজনীতিকে মোরাল গ্রাউন্ডে যেমনই দেখাক, সামাজিক কনটেক্সট এ এর প্রতি সর্বত সমর্থন রয়েছে আমার৷ বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার যদি হত জস বাটলার বা মিচেল স্টার্ক, তাতে এদেশের ক্রিকেট না এগিয়ে পিছিয়ে পড়ত বরং, কারণ স্পন্সর পাওয়া যেত না তখন, প্লেয়ারদের ফ্যাসিলিটি দেয়াই মুশকিল হতো বিসিবির পক্ষে। গ্রামীণ বা নগদ সাকিব-তামিমের পরিবর্তে এম্বাসেডর করত চিত্রনায়ক শাকিব খানকে, বাংলাদেশে খেলতে আসতো স্কটল্যান্ড বা নেদারল্যান্ড জাতীয় সমীকরণের বাইরে থাকা দলগুলো, কিংবা হতেই পারত জিম্বাবুইয়ের মতো ধুঁকতে হত।
ডিমের সালুনকে পোলাও বিশ্বাস করে নেয়ায় দর্শকের মার্কেটে বাটলার বা স্টার্ক বহুদূর ভিরাট কোহলিরাও ঢুকতে পারেনি, যেটা পেরেছে শাহরুখ খান বা সালমান খানরা।
তবে সমস্যাটা তখনই বাঁধে যখন ডিমের সালুনকে আক্ষরিক অর্থেই পোলাও ভাবতে শুরু করে। জহির খান তার বোলিং ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার ছক্কা হজম করেছেন, কিন্তু ১৬ বছর আগে বিশ্বকাপে এক বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের মারা ছক্কা যদি এতদিন পরেও স্বত:স্ফূর্তভাবে স্মরণে আসে অধিকাংশ দর্শকের সেখানে কোয়ালিটি সংক্রান্ত একটা বিশাল প্রশ্নবোধকতা তৈরি হয়। ভারতের ১০০ জন দর্শককে জহির খানের ক্যারিয়ার সামারি জিজ্ঞেস করলে ব্যর্থতা অংশে ওই ছক্কার রেফারেন্স দিবে কয়জন?
পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সমসংখ্যক দর্শক তামিমের ক্যারিয়ার সামারি বলতে গিয়ে যদি সেই ছক্কাকেই টেনে আনে, তখন দুটো সম্ভাবনা থাকে- হয় তামিমের পোর্টফোলিওতে উল্লেখযোগ্য উপকরণ অতি নগণ্য, অথবা দর্শক খেলা বোঝে না।
তামিমের ১৬ বছরের ক্যারিয়ারের হাইলাইটস আদতে ২০১৫ বিশ্বকাপ পরবর্তী পাকিস্তান সিরিজ থেকে ২০১৮ এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচ পর্যন্ত৷ তার আগের ৮ বছর সে ছিল ইনভেস্টমেন্ট, ওই এশিয়া কাপের পর থেকে ২০২৩ এর আফগানিস্তান সিরিজ পর্যন্ত লায়াবিলিটি।
ইনভেস্টমেন্ট ফেইজে ২০১০ এর ইংল্যান্ড সফরে সেঞ্চুরি, ২০১২ এশিয়া কাপের প্রাথমিক দল থেকে বাদ পড়ে পুনরায় সুযোগ পেয়ে টানা ৪ ইনিংসে ফিফটি। সেসময় পারফরম্যান্স বার এত নিচে ছিল যে কোনো সিরিজে ১টা ফিফটি করতে পারলে ২টা সিরিজ দলে থাকার নিশ্চয়তা ছিল। তামিম অন্য ওপেনার বা টপ অর্ডারদের চাইতে এই জায়গায় অনেক আগানো ছিল। টানা ফিফটিহীন সে থাকেনি সেরকম।
আমার স্টেটমেন্ট ঔদ্ধত্যপূর্ণ শোনাতে পারে, তবে ২০২৭ বিশ্বকাপের পরে যদি কোনো গবেষক বাংলাদেশের ক্রিকেট দল নিয়ে সিকুয়েন্সিয়াল এনালাইসিস করে, আমি নিশ্চিত সে এই উপসংহারে আসবে- ‘২০১১ বিশ্বকাপের পরেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফি অধ্যায়ের স্থায়ি সমাপ্তি না হওয়া ছিল ঐতিহাসিক ভুল, যার মাশুল দলকে গুণতে হয়েছে প্রায় দেড় যুগ ধরে’
তামিমের আলোচনায় মাশরাফির ঢুকে পড়াটা অনিবার্য। কারণ মাশরাফি এবং তামিম একটি দীর্ঘ পলিটিক্যাল ডায়নামিক্স।
ব্যক্তি তামিমকে আমার প্রচন্ড প্রাইভেসি প্রিয়, মেলামেশায় সিলেক্টিভ, আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন, এবং ইমপ্যাথিপ্রবণ যেমন লাগে, মুদ্রার উল্টোপিঠে ইগোসর্বস্ব, ভঙ্গুর মানসিক শক্তির, কুইক টেম্পারড এবং নেপোটিজমপ্রিয় মনে হয়। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরেই বাংলাদেশ ঢুকে পড়তে পারত নতুন ওপেনারের যুগে, তামিমের যা পারফরম্যান্স তাতে বাদ পড়া ছিল অবধারিত। অধিনায়ক মাশরাফি তবু তাকে কন্টিনিউ করে, এবং পারফর্ম করে জন্ম হয় অন্য তামিমের।
সেটা শুধু অনফিল্ড তামিম নয়, মিডিয়া চরিত্র হিসেবেও। তার পূর্ব পর্যন্ত মিডিয়া ফ্রেন্ডলি হিসেবে তামিমের সুনাম শোনা যায়নি।
মহেন্দ্র সিং ধোনি বা ভিরাট কোহলির কয়টা সাক্ষাৎকার পড়েছেন আপনি, বা ভারতীয় দর্শকরা? বিপরীতে মাশরাফির সাক্ষাৎকার সংখ্যা গুনতে শুরু করুন, পিআর কৌশল সম্বন্ধে হাতে-কলমে জ্ঞান লাভ করবেন। ক্রিকেটার-সাংবাদিক অন্তরাত্মা বন্ধু হওয়াকে মাশরাফির মতো করে এক্সপ্লোয়েট কে করতে পেরেছে? তার তৈরি করা কালচারে বোর্ড আর ক্রিকেটারদের কথা চালাচালির মাধ্যম হয়ে উঠেছে মিডিয়া, তাতে টিকেট কেটে হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া দর্শকদের মতো করে আমরাও সিঁটি বাজিয়েছি অক্রিকেটিয় সব বিষয়ে।
তামিমের ক্রিকেট এমনকি শেষ হতে পারত ২০১৯ বিশ্বকাপের অব্যবহিত পরেই। শ্রীলংকা সফরে তাকে আপৎকালীন অধিনায়কত্ব দেয়া হলো, সিরিজে ভরাডুবির পরে চলে গেল স্বেচ্ছানির্বাসনে৷ ফিরতে ফিরতে ফিক্সিং কেলেংকারিতে নিষিদ্ধ সাকিব!
আমি এখনো বিশ্বাস করি সাকিবের নিষিদ্ধ হওয়ায় তামিম এবং মাহমুদুল্লাহ এর ক্যারিয়ার পুনর্জীবন পেয়েছে। এই সমস্ত পরিস্থিতিতে ভাগ্য আপনাকে পিক করবে৷
নইলে বিপিএল এ স্ট্রাইকরেট আর পারফরম্যান্স নিয়ে নিন্দিত তামিম কেন করোনার আগে শেষ সিরিজে টানা ২ সেঞ্চুরি করে বসবে। ততদিনে সে টি২০ ছেড়ে দিয়েছে আনঅফিসিয়ালি, এবং করোনার পরে কালক্রমে আমরা আবিষ্কার করব সে টেস্ট থেকেও চলে গেছে সেমি-রিটায়ারমেন্টে। ওয়ানডেগুলো মিস না করলেও টেস্ট সিরিজেই কীভাবে যেন ইনজুরি তার প্রেমে পড়ে যায়!
তামিমের মতো আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন ক্যারেক্টারের এই রাজনীতিটা কেন করার দরকার ছিল, এই প্রশ্নটা অবান্তর, কেননা ক্লিকের শব্দ আর ক্ষমতার ধর্মে যে বা যারা দীক্ষিত হয়েছে তারা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও ধর্মরক্ষা করতে চাইবে। এখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছার চাইতে কর্পোরেট এনডোর্সমেন্টের স্বার্থ পূরণেরও বিরাট ভূমিকা থাকে, এবং দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি তামিমের জায়গায় যে কোনো মানুষকে বসালে সেও এই পরিস্থিতিতে একই আচরণ করত।
তামিম শেষ পর্যন্ত হেরে গেল ফিটনেসের কাছে। ২ ফরম্যাট ছেড়ে দিয়ে হলেও বিশ্বকাপ খেলার যে স্বপ্ন, একজন এথলেট হিসেবে এটা দেখার অধিকার সে রাখে, এবং স্বপ্নের রাজনীতিতে সেও রোল প্লে করেছে মাত্র, কিন্তু যে দেহকে পুঁজিকে করে এথলেটদের দাপট, সেটাই যদি বেঈমানী করে বসে, তামিমের নিজেকে দুর্ভাগা ভাবাই একমাত্র সান্ত্বনা!
তবু তামিমের অবসর নেয়াটা আকস্মিক ঘটনা। অন্তত সিরিজের ১ ম্যাচ খেলে অবসর নিয়ে নিবে, এটা পূর্বপরিকল্পিত হওয়ার কারণই নেই, যেখানে সে নিয়মিত বিশ্বকাপ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছে৷ তার খারাপ ফর্মকে ঢেকে দেয়ার দায়িত্ব মিডিয়া এবং কর্পোরেট হাউজগুলো ফিটনেসের দায় তো নিজেরই, সেটা কি সামলাতে সক্ষম? তার অনুরাগী সংখ্যার চাইতে নিন্দুক এবং সমালোচক ৫-১০ গুণ বেশি বর্তমানে, বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলে যে ঝড়টা বয়ে যাবে, তা ট্যাকল করার মানসিক শক্তি কি তার আছে সাকিব বা মাশরাফির মতো?
এইসব সমীকরণের বিপরীতে ক্ষমতার অপরিসীম নি:সঙ্গতা, কোনটা তার জন্য সহজে সমাধানযোগ্য; মূল ডিলেমাটা সম্ভবত এখানেই৷ ডিলেমাগ্রস্ত মানুষ মানসিকভাবে প্রচন্ড ভালনারেবলও। এই সময়ে যদি অস্তিত্বের উপর আঘাত আসে, সে বেপরোয়া আচরণ করে, আগ-পিছ ভাবার ফুসর‍ত থাকে না। তামিমের অবসর নেয়াটাকে সেই বেপরোয়াপনার বহি:প্রকাশ হিসেবেই দেখা যায়।
গতকাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন তামিমকে। কারা এই গুজব ছড়ালো। হতে পারে এটাও কোনো পিআর কৌশল৷ কারণ মাত্র একদিনের মধ্যেই যেটা বাস্তবায়িত হয় তাকে গুজব বলা অনুচিত। তাই তামিমের অবসর নেয়াটা স্পোর্টস ইভেন্টের চাইতে পুরোদস্তুর পলিটিক্যাল এপ্রোচ।
আমরা একটা সম্ভাবনার চিন্তা করি। প্রধানমন্ত্রী যদি নির্দেশ দেয় খেলায় ফেরার, তামিমের কি মানা করার সুযোগ থাকবে? পক্ষান্তরে গুজবটাই সত্যি হয়ে যাবে, এটা কি পূর্বপরিকল্পিত?
সাধারণ দর্শক, এত রাজনীতির হিসাবের মধ্যে থাকে না। তারা জানবে তামিম ফিরেছে অথবা ফিরেনি। ২০১২ এশিয়া কাপেও তামিমের দলে ফেরায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছিল৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে ১১ বছর মানে ১ যুগ প্রায়! মাঠে খেলতে হবে তামিমকেই৷ গতকাল অবসরের পরে লোকজন নির্বিশেষে তাকে যেভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে, আজই যদি প্রত্যাহার করে নেয়, ব্যাপারটা হবে লাশ দাফনের পরে কবর থেকে উঠে আসা। তখন যে বিপুল পরিমাণ নিন্দা বা ট্রল জুটবে, তার ভাগীদার একান্তই তামিম।
প্রথমত সেই বিপুল মানসিক শক্তি তার নেই৷ দ্বিতীয়ত তামিমের পারসোনালিটি যেভাবে পোরট্রে করি তাতে তার জীবনের ১ নম্বর প্রায়োরিটি ডিগনিটি। এটা তামাশার বস্তুতে পরিণত করবে, বিশ্বাস হয় না।
তবে খ্যাতি-ক্ষমতা ব্যক্তিকে যে ক্রুয়েলটি আর কানিংনেস শেখায়, সেখানে ডিগনিটির চাইতে প্রলোভন বড় হতেও পারে৷ পৃথিবীর ইতিহাস বড়ই বিচিত্র।
আপাতত ডিগনিটিকে সত্য ধরে তামিমকে অতীত হিসেবেই বিবেচনা করি।
এক ইন্টারভিউতে তামিমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল মুশফিক আর তার মধ্যে কে সেরা ব্যাটসম্যান। তার উত্তর ছিল মুশফিক বেটার টেস্ট ব্যাটসম্যান, আমি বেটার ওয়ানডে প্লেয়ার।
তামিম নিজের ব্যাপারে কতটা ইলিউশনে ভোগে এই বক্তব্যে তার পূর্ণ প্রতিফলন। মুশফিক তার ক্যারিয়ারের তিন-চতুর্থাংশ সময় ব্যাট করেছে ৬-৭ নম্বরে, তার রানগুলো ব্যক্তিগত স্ট্যাট সমৃদ্ধিতে যতটা কাজে এসেছে, দলের প্রয়োজন মিটিয়েছে কতটা? অন্যদিকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ টেস্ট জয়েই তামিমের ইমপ্যাক্টফুল ইনিংস পাওয়া যাবে। ওয়ানডেতে তামিমের স্মরণীয় ইনিংস বহু বছর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩০০ চেজ করা ম্যাচ আর ২০১৫ তে হোম সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সে তুলনায় মুশফিকের ইমপ্যাক্ট সম্পন্ন ইনিংসের সংখ্যা অনেক বেশি!
ফিটনেস কেন তামিমের জন্য এত বড় ঘাতক, ওয়ানডেতে ৫৬ ফিফটির বিপরীতে মাত্র ১৪ সেঞ্চুরিই সাক্ষ্য দিচ্ছে৷ ফিটনেস যদি বাধা না হতো ১৪ যে ২৪ বা ৩৪ হতো না, কে বলতে পারে! ৫০ পেরুনোর পরে তার আউটগুলো পর্যালোচনা করলেই সেখানে টায়ার্ডনেস ফ্যাক্টরটা জ্বলজ্বল করে উঠবে!
ডিগনিটি বনাম প্রলোভন ম্যাচে মানুষ নাকি রাজনীতি, কার জয় হবে জানি না। তবে আমি ডিগনিটির পক্ষে এবং পাশে আছি সবসময়।