ক্রিকেটের দুটি অমার্জনীয় অপরাধ, যার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ দর্শককে-
প্রথমত একই খেলার তিনটা পৃথক ফরম্যাট। যদি একজন প্লেয়ার ৩ ফরম্যাটেই খেলে, দর্শক শুধু তাকে দেখে, ফরম্যাটভেদে পার্থক্যগুলো মনে রাখে না। কালেক্টিভ ব্রেইন সূক্ষ্ম লেভেলে প্রবেশে ব্যর্থ হয়
দ্বিতীয়ত, খেলাটা পুরোপুরি সংখ্যানির্ভর হওয়ায় ডেটা ম্যানিপুলেট করে যে কোনো ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
লিটন দাস টি২০ তে বাংলাদেশের এযাবতকালের সেরা ব্যাটসম্যান। সর্বশেষ ২০২৩ এ টি২০ তে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, এবং চলতি বছর টি২০ সিরিজেও বাংলাদেশের জেতা ম্যাচটাতে মূল ভূমিকা ছিল তার দেড়শো স্ট্রাইকরেটের ইনিংসের। দুই ম্যাচে সে ব্যর্থ, দলও পরাজিত।
টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রেটিং পয়েন্ট প্রাপ্ত ব্যাটসম্যান লিটন দাস। গত বছর সে টেস্ট খেলেছে মাত্র দুটি, অবশ্য বাংলাদেশেরই টেস্ট ছিল না সেরকম৷ এবছর বাংলাদেশ তাদের সর্বোচ্চ সংখ্যক টেস্ট খেলার কথা। রয়েছে টি২০ বিশ্বকাপ। যে দুটো ফরম্যাটে লিটন সবচাইতে কার্যকর, সেখানেই এ বছর বাংলাদেশের ব্যস্ততা সবচাইতে বেশি!
লিটনের অতি জঘন্য পারফরম্যান্স ওয়ানডেতে। বাংলাদেশ যেহেতু এই ফরম্যাটেই স্বস্তি বোধ করে, আলোচনাও বেশি এটা নিয়েই। ৯০টা ওয়ানডে খেলে লিটনের যা স্ট্যাট, তাতে নেপাল কিংবা ওমান দলেও জায়গা পাওয়ার কথা নয়৷
কিন্তু আমাদের ফাঁকিবাজিভিত্তিক রাষ্ট্রের সর্বত্র যেমন দক্ষ এবং নিবেদিত ওয়ার্কফোর্সের ঘাটতি, ক্রিকেটেও তার ছায়া দৃশ্যমান। যদি বলা হয় জাতীয় দলে খেলার মতো ১১ জন কোয়ালিটি প্লেয়ারের নাম বলুন, দুষ্কর হয়ে পড়বে। যে কারণে একই মুখ ঘুরেফিরে আসে বারবার, প্লেয়ারদেরও পড়তে হয় না শক্ত প্রতিযোগিতার মুখে।
এই ফাঁকিবাজিতার সুযোগে লিটনের ওয়ানডে ক্যারিয়ার এত লম্বায়িত হয়েছে।
ওয়ানডেতে লিটনের রুগ্নতা নিয়ে গত ৭ বছরে বহু হাইপোথিসিস দিয়েছি, গত বছর আয়ারল্যান্ড সিরিজ চলাকালে লিটনের দেয়া এক মিনি সাক্ষাৎকার আমাকে নতুন এক হাইপোথিসিসের দিকে নিয়ে গেছে। সে বলেছিল- ‘ওয়ানডেতে আমার ব্যাটিং শেপ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আজ ম্যাচের আগে আধাঘন্টা নক করেছিলাম, মনে হলো কিছুটা শেপ ফিরে পাচ্ছি’
টেকনিকাল ছোটখাটো ত্রুটি সব ব্যাটসম্যানেরই থাকে, এর মধ্যেও তারা পারফর্ম করে। ওই স্টেটমেন্টের পরে মনে হলো টেস্টে এক ধরনের মেন্টাল সেট আপ এ ব্যাট করতে হয়, সেই সেট আপ এ লিটন অভ্যস্ত। টি২০ মাত্র ১২০ বলের খেলা, সেই সেট আপও সে বুঝতে পারে, কখনো সফল হয় কখনো ব্যর্থ।
কিন্তু ওয়ানডে এমন এক ফরম্যাট যেখানে টেস্ট এবং টি২০ এপ্রোচকে গড় করতে হয়। গড় করতে গিয়ে ডিলেমা তৈরি হয়। ৩ ফরম্যাটেই সফল বিশ্বক্রিকেটে এমন প্লেয়ার আমি দেখি শুধু ভিরাট কোহলিকে। অন্য যত ব্যাটসম্যান সবারই এক বা একাধিক ফরম্যাটে সুস্পষ্ট দুর্বলতা লক্ষণীয়, এমনকি স্বয়ং কোহলিও সাদা বলের ক্রিকেটে যে লেভেলে বিচরণ করে, লাল বলে ডমিন্যান্স তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে।
ফরম্যাটভেদে টেকনিকাল এই এডজাস্টমেন্ট খেলোয়াড়দের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ প্রতিনিয়িত খেলা হয়, গিয়ার শিফটিংয়ের জন্য মানসিক যে প্রস্তুতি, নেয়ারও সময় থাকে না পর্যাপ্ত।
লিটন টাইমিং-প্লেসমেন্টনির্ভর প্লেয়ার। শট কানেক্টেড হলে বিস্ময় জাগে এই শটে ৪ হয় কীভাবে! আবার কানেক্ট ঠিকমত না হলে সফট ডিসমিসাল। বিরক্তি জাগবে, এরকম আলতো শটে কেউ আউট হয়, এত ক্যাজুয়াল কেন, কোনো গেম এওয়ারনেস নেই!
সিল্কি টাচের প্লেয়ারদের এ এক নির্মম নিয়তি। আউটের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক, প্রশ্ন করা যেতে পারে শূন্য যে পরিমাণ, আনুপাতিক হারে ফিফটি বা সেঞ্চুরি কেন হচ্ছে না। কেন ২০২২ এর পরে লিটন আর সেঞ্চুরি পাচ্ছে না?
সফট ডিসমিসালে আউট হলেই ‘ক্যাজুয়াল’ ট্যাগ দেয়া বা নিবেদনের অভাব বলাটা সরলীকরণ।
একজন ক্রিকেটার ক্যাজুয়াল কিনা বোঝার প্রধান দুটো নিয়ামক তার গ্রাউন্ড ফিল্ডিং এবং রানিং বিটুইন দ্য উইকেট। দুক্ষেত্রেই লিটন সর্বোচ্চ সিরিয়াস।
প্রত্যেক মানুষের ক্যারেক্টার আলাদা। সেই ক্যারেক্টারটা না বুঝলে আমরা তখন জাজমেন্টাল।আচরণ করি।
লিটন রিজার্ভ প্রকৃতির, কিন্তু স্পষ্টবাদী। সামাজিক মানুষের জন্য এর চাইতে ভয়ানক কম্বিনেশন হতেই পারে না। রিজার্ভ মানুষ নিজের জগতে নিমগ্ন থাকবে, একাকীত্ব-নির্জনতার প্রতি আকৃষ্ট থাকবে, তাদের যাবতীয় প্রতিক্রিয়া হয় অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিসত্তায়; ক্ষুব্ধ বা অভিমানী হলেও বাইরে থেকে বোঝা যাবে না।
সেই মানুষ যদি কথা বলতে শুরু করে লাগাম থাকবে না। এরা নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ খুব বিচ্ছিরিভাবে প্রকাশ করে। স্পষ্টবাদীতাকে যতই এপ্রিসিয়েটযোগ্য গুণ ভাবা হোক, সামাজিক জীবনে এটা তেমন মূল্যবান কোনো যোগ্যতা নয়। এতে মিথস্ক্রিয়াগুলো কিছুদিনের মধ্যেই বিষাক্ত হয়ে উঠে।
লিটনের মূল সমস্যা, আমার মতে, খেলাটাকে সে স্রেফ খেলা হিসেবেই দেখে, এবং চিরায়ত মিডল ক্লাস মানসিকতা। আমি যদি নিশ্চিত হয়ে যাই প্রতিদিন অফিসে গেলেই বেতন-ভাতা পাব, চাকরি যাবে না, আমার প্রমোশন বা বেতন বৃদ্ধির দরকার কী!
সরকারি চাকরিতে অপ্রকাশিত উৎস থেকে প্রচুর আয়ের সুযোগ আছে, এটা সর্বশেষ ১০ বছরের ন্যারেটিভ, তার আগে সরকারি চাকরি কেন্দ্রিক প্রধান ন্যারেটিভ ছিল ‘একবার চাকরি পেলে কখনো যায় না, বেসরকারি চাকরি আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে’
মুশফিক গেলে আমি কিপার— লিটনের গ্রো না করার অনেক কারণের মধ্যে এর অবস্থান প্রথম ৩ এ; টপ অর্ডার অপশন আমাদের অনেকগুলোই। তানজিদ, শাহাদাত, শিবলি— সংখ্যাটা আরো বাড়বে, কারণ আমাদের ঘরোয়া বা বয়সভিত্তিক দলগুলোতে প্রমিজিং ব্যাটসম্যানদের প্রায় প্রত্যেকেই টপ অর্ডার।
কিন্তু উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান অপশন অতি অপ্রতুল। ইদানীং জাকের আলি অনিককে চোখে পড়ছে, টেস্ট বা ওয়ানডেতে সে যদি পারেও লিটনকে কি বিট করতে পারবে? যদি পারেও ব্যাক আপ কিপার কই?
লিটন তার ৬০% ক্যালিবার ব্যবহার করে যদি অন্য উইকেট কিপিং অপশনদের ১০০% এর চেয়ে তুলনামূলক বেশি আউটপুট দিতে পারে, সে রাডার থেকে বাতিল কেন হবে?
এজন্য কি লিটনকে দোষারোপ করা যায়? আমাকে যদি আজ কেউ বলে লেখক হিসেবে গ্রো করতে হলে আপনার ক্যারেক্টার বদলে ফেলতে হবে, আমি কি রাজি হব? নাহ। যদি আপনাকে করা হয় একই প্রশ্ন, মন চাইবে হ্যাঁ বলি, কিন্তু ৩ সপ্তাহ পরেই ফেরত আসবেন। কারণ ক্যারেক্টার বদলানো জগতের দুরূহতম কাজ। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ সেই অসাধ্য সাধন করেছেন। ভীষণ ভীষণ চ্যালেঞ্জিং এক কাজ, আমার চোখে তিনি গত ৪০ বছরের শ্রেষ্ঠ ফাইটিং ক্যারেক্টার হয়ে গেছেন।
কিন্তু লিটন সেই ধাচের নন। তার অবধারিত প্রশ্ন আসবে- ‘আমি ক্যারেক্টার কেন বদলাবো; জন্ম থেকে আমি জাতীয় দলে খেলি না, ৫ বছর পরেও খেলবো না– এইটুকু ক্ষুদ্র জার্নির জন্য নিজেকে ভেঙ্গে যা এচিভ করব তা কি আমার সমগ্র জীবনের পথে বিরাট কিছু? ক্রিকেটে আজ হিরো, কাল জিরো; বদলালে কি আমি চিরকাল হিরো থাকতে পারব? খেলা ছাড়লে কেউ তো ফিরেও তাকাবে না’
সে রিজার্ভ, অথচ তার উপার্জনের সবটাই ভিউ ব্যবসা। কোটি দর্শকের উন্মাদনা থেকেই তার বাসার বাজার কিংবা ফ্ল্যাট কেনার অর্থ আসে। সাকিবও রিজার্ভ, কিন্তু তার জাগতিক মোহ এবং বৈষয়িক বুদ্ধি অনেক বেশি, যে কারণে পারফর্ম করার ড্রাইভিং ফোর্স থেকে প্রতিনিয়ত অভিযোজিত হয়েছে। এখানেই লিটন বারেবারে হেরে যায় বা যাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এক ধরনের সারভিলেন্স টাওয়ার। বাংলাদেশি কোনো এন্টারটেইনারের সাধ্য নেই সোশ্যাল মিডিয়াকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার। নিন্দা বা উপহাসে সে আরো ভেঙ্গে পড়ে, যে কারণে খারাপ সময় এলে অন্য যে কারো চাইতে সে আরো ভালনারেবল হয়ে পড়ে। ২০২১ টি২০ বিশ্বকাপের স্মৃতি আজও তরতাজা।
লিটনের সমালোচনা আমিও চাই। তবে কোন লিটন, সেই প্রশ্নটা খেয়াল রাখা জরুরী। টেস্ট বা টি২০ তে সে অসাধারণ কিছু না করলেও নিন্দাযোগ্য থেকে অনেক দূরে। যাবতীয় দুষ্কর্মের ভাণ্ডার ওডিআই লিটন। তাই লিটন সংক্রান্ত যে কোনো নিন্দা বা সমালোচনায় OD কোডটি ব্যবহার করা উচিত। এক ফরম্যাটের ব্যর্থতায় অন্য দুই ফরম্যাটের কীর্তিকে উপেক্ষা করা তার প্রতি অবিচার।
কিন্তু নিন্দা সংক্রামক, কোড-টোড ব্যবহার করে নিন্দা হয় নাকি?
এজন্যই শুরুতে লিখলাম ক্রিকেটের অমার্জনীয় ক্রাইমটা আদতে কোথায়!