লিটন দাস বাদ পড়েছে টি২০ স্কোয়াড থেকে। ২০২১ সালে তার যা পারফরম্যান্স টিকে গেলেই সেটা হত অন্যায্য সুবিধা। পঞ্চপাণ্ডবের বাইরে সে-ই ছিল একমাত্র ক্রিকেটার যে সব ফরম্যাটেই নিয়মিত ম্যাচ পেত। নিজের দোষেই সুযোগ হারালো। তবু লিটনের বাদ পড়ায় কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করছে। ২০১৬ এর পুরোটা, এবং ১৭ এর বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকার পর শেষ ৩ বছরে প্রথমবার বাদ। বাংলাদেশের যে কালচার তাতে কোনো প্লেয়ার এক ফরম্যাট থেকে বাদ পড়া মানে অন্যান্য ফরম্যাটেও নড়বড়ে হওয়া, আগে যে ব্যর্থতাকে লঘু দৃষ্টিতে দেখা হত, একই ব্যর্থতায় সেটি নিয়ে আসে নির্বাসন। ২০১৫ থেকে সবচাইতে আলোচিত সৌম্য, এবং ২০১৮ থেকে লিটন, সবমিলিয়ে বাঙালি দর্শকের বিরক্তি অথবা আক্ষেপ যোগানো সৌম্য-লিটন যুগল পাস্ট পারফেক্ট টেন্স হওয়ার পথে কি আরেকটু এগুলো? সৌম্য অনেকদিন আগে থেকেই টেস্টে ব্রাত্য, ওয়ানডেতেও জায়গা হারিয়েছে, একমাত্র অপশন ছিল টি২০; বিশ্বকাপ ব্যর্থতায় সেটিও হারিয়ে গেছে।
লিটন টেস্টে এখনো নিরাপদ, তবে সামনেই তার দুঃস্বপ্নের নিউজিল্যান্ড সফর, এবং ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে, তারপর? দেখা যাক।
লিটনের কেইসটা নিয়ে প্রায়ই ভাবি।
১. ইতোপূর্বে শুনেছিলাম নেইল ম্যাকেঞ্জি কোচ থাকাকালেন লিটনকে একাধিকবার টেস্টে ওপেন অথবা ৩ এ ব্যাট করার পরামর্শ দিয়েছে, সে নাকি রাজি হয়নি, উপরে ব্যাট করতে কমফোর্টেবল না।
২. অন্য একটি সোর্স থেকে শুনেছিলাম লিটনকে কোচিং স্টাফ ওয়ানডে আর টি২০ তে মিডল অর্ডারে খেলতে বলে, সে নাকি ওপেন করতে চায়।
৩. গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের পূর্বে লিটনের এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম তার প্রিয় ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল ক্লার্ক, তার মতো সেও ছিল ছোটবেলায় মিডল অর্ডার, পরে এক কোচ বলেন টপ অর্ডারে ব্যাট না করলে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় না, তার পরামর্শেই মূলত তার ওপেনার বনে যাওয়া। ২০১২ এবং ১৪ দুটি অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে মোটামুটি সাফল্য পেলেও স্ট্রাইকরেট ছিল ৭০এর সামান্য বেশি। লিটনকে বুঝতে তার যুব বিশ্বকাপের স্ট্রাইকরেট অতি গুরুত্বপূর্ণ ইনডেক্স।
৩টা পয়েন্ট নিয়ে ভেবে একটা খটকামূলক প্রশ্ন আসা অবধারিত- যে প্লেয়ারকে কোচরা বলা সত্ত্বেও টেস্টে ওপেন করে না শোনা যায় সেই একই প্লেয়ার সাদা বলের ক্রিকেটে মিডল অর্ডারে কেন খেলতে চাচ্ছে না, এবং যুব বিশ্বকাপে যার স্ট্রাইকরেট ৭০ এর আশপাশে টপ লেভেলে সে ওয়ানডেতে ৯০ আর টি২০ তে ১৩৫ উঠিয়েছিল কীভাবে!
২০১৯ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ৫ নম্বরে ব্যাট করে তার স্কোর ছিল যথাক্রমে ৯৪*, ২০, ২৪ এবং ৩২, এবং প্রতিটি ম্যাচেই তাকে দেখে কনফিডেন্ট মনে হয়েছে, অথচ ওপেন করতে দিলে বরাবরই লাগে শেকি।
মিডল অর্ডার থেকে পরবর্তীতে ওপেনার হওয়ার দৃষ্টান্ত ক্রিকেটে অজস্র। লিটন ফার্স্ট ক্লাস এ ৪৬ ব্যাটিং গড়ে যেসব রান তুলেছে প্রায় সবটাই ওপেনে খেলে। কিন্তু মনে রাখতে হবে লোকাল লীগে কোন বোলারদের বিপক্ষে খেলা হচ্ছে, কোন মাঠে আর উইকেটে খেলছে। লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটে লিটনের ৪ ধরনের ডিসমিসাল খুঁজে পাবেন
১. স্লগ সুইপ খেলে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ
২. ফ্লিক করতে গিয়ে টপ এজড অথবা লেগবিফোর
৩. ডাউন দ্য উইকেটে মিড অফ এর উপর দিয়ে খেলবে, কিন্তু পাওয়ার আর ফ্লাইট কম, যে কারণে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ক্যাচ
৪. বাঁহাতি স্পিন বা পেসারের বলে লাইন মিস করে লেগবিফোর অথবা বোল্ড অথবা কাট করতে গিয়ে পয়েন্টে ক্যাচ।
এর বাইরেও সে আউট হয়, কিন্তু উল্লিখিত ৪ প্যাটার্নে এত বেশি যে এগুলো হয়ে গেছে তার সিগনেচার। ম্যাচের পর ম্যাচ একজন ব্যাটসম্যান এত প্রেডিক্টেবলভাবে আউট হয় কেন? পক্ষান্তরে টেস্টে লিটনের আউটগুলো দেখুন, সেখানে কোনো প্যাটার্ন পাবেন না, অন্য ব্যাটসম্যানরা যেরকম আউট হয় তার ক্ষেত্রেও তাই।
সাদা বলের ক্রিকেটে এই বিপর্যস্ততা পর্যালোচনা করতে হলে আপনাকে দেখতে হবে ফিল্ড রেস্ট্রিকশন তথা পাওয়ার প্লে কালীন ফিল্ড সেটিং; মাত্র ২জন ফিল্ডার থাকে বাইরে, বাকি সব সার্কেলের মধ্যে, যে কারণে ওপেনারদের রান করার অপশন দুটো জোরের উপরে শট খেলা যাতে ফিল্ডার ডাইভ দিয়ে আটকাতে না পারে অথবা এরিয়াল শট খেলা যাতে ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। টেস্টেও প্রচণ্ড অ্যাটাকিং ফিল্ডিং থাকে, কিন্তু সেখানে যেহেতু বলের হিসাব অবান্তর, অনবরত ডট দিলেও সমস্যা তৈরি হয় না। ওপেনারকে ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের সুবিধা নিতে হয়। লিটনের ব্যাটিংয়ের মূল শক্তিমত্তার জায়গা টাইমিং এবং প্লেসমেন্ট, সে রিস্ট পাওয়ার ব্যবহার করে শট খেলে কদাচিৎ। লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটে ওপেনে নামলে তাকে খেলতে হয় নিজের স্ট্রেন্থের বিপরীতে। যদি ৪ বা ৫ এ খেলত, তখন ফিল্ডিং থাকে ছড়ানো, অনায়াসে পুশ করে সিঙ্গেলস নেয়া বা গ্যাপ বের করে ২-৩ নেয়া তার জন্য তখন সহজ হত।
সাকিব ৫ থেকে ৩ এ উঠে যাওয়ার পর ওয়ানডেতে ৫ নম্বর পজিশনটা অনেকদিন ধরেই ফাঁকা, বিশ্বকাপে ৫ এ মোটামুটি ধারাবাহিকতা দেখানোর পরে দীর্ঘদিন আর ওয়ানডেই খেলেনি। এর মধ্যে একটা টি২০ টুর্নামেন্ট আর ভারত সিরিজ গেছে, প্রতিটিতেই ফ্লপ। তবু ১ বছর পর জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে পুনরায় ওপেনে পাঠানো হলো। আমরা দর্শকরা যেমন সিরিজ বাই সিরিজ উদ্যমতা দেখাই, টিম ম্যানেজমেন্টও তাই; তারা লেগাসি, পরম্পরা কিছুই মেনে চলে না। নইলে ওপেনে নিয়মিত স্ট্রাগল করা এবং অধিকাংশ ম্যাচে সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হওয়া একজন ব্যাটসম্যানকে মিডলে কমফোর্টেবল লাগা সত্ত্বেও ওপেনে ফেরত পাঠানোর যৌক্তিকতা নাই। নেমে ২ সেঞ্চুরি এবং ২ টি২০ এর প্রতিটিতেই ফিফটি করা তার ক্যারিয়ারের জন্য বড়ো ক্ষতির কারণ হয়েছে। তবে তার ক্যারিয়ারের সবচাইতে ভয়ংকর ঘটনা ২০১৮ তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম এবং অ্যাওয়েতে দুটো বিস্ফোরক ফিফটি। এরপরে আর কখনোই টি২০তে তার সেই ইনটেন্টই দেখা যায়নি। বরং ২০১৯ এর বিপিএল এ আমরা দেখলাম ভিন্ন এক লিটনকে, যে স্ট্রোক খেলছে না, উইকেট ধরে রাখার চেষ্টা করছে, টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান স্কোরার। আপাতদৃষ্টিতে এটা পজিটিভ মনে হলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে বোধ করছিলাম এই অ্যাপ্রোচ নিয়ে ইন্টারন্যাশনালে সে সফল হবে না, হয় ওপেন ছেড়ে দিয়ে মিডলে নেমে যেতে হবে, অথবা উইন্ডিজ বা শ্রীলংকার বিপক্ষে যে বিধ্বংসী অ্যাপ্রোচে খেলেছিল ওটা কন্টিনিউ করতে হবে; টি২০ তে কনসিসটেন্সি বা ব্যাটিং অ্যাভারেজ অতটা জরুরী নয়, বিশেষত বাংলাদেশের মতো টিমের জন্য তো আরো নয় যেখানকার ব্যাটসম্যানরা স্কিলের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এখানে প্রত্যেক ব্যাটসম্যানকেই হেলদি স্ট্রাইকরেটে কন্ট্রিবিউট করে দলের মোট রানকে একটা কম্পিটিটিভ জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
এমনকি জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে যে ২টা ফিফটি সেটাও টি২০ সুলভ ছিল না একদমই। বঙ্গবন্ধু টি২০ তে দেখলাম সে সেইফ ব্যাটিং করছে, এবং কোনো একটা দুর্বল বোলার পেলে (ফরহাদ রেজা, জিয়াউর, পার্ট টাইমার প্রভৃতি) তাকে টার্গেট করে স্ট্রাইকরেট ঠিক রাখছে। কোয়ালিটি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আপনি বোলিংয়ে এরকম উইকলিংক পাবেন? না। তাহলে উপায়? মিডলে নেমে যাও,এবং গ্যাপ বের করে ২-৩ খেলো, বাউন্ডারি চেষ্টা কর, স্লগ সুইপে ছক্কা হবে না। এমনকি সেই ২০১৮ তেই নাহিদ নেওয়াজ নামের এক ক্রিকেট প্যাশনেটকে বলেছিলাম লিটনের সবচাইতে বেশি সম্ভাবনা টেস্টে, এরপর ওয়ানডেতে, টি২০ তে খুবই কম। কিন্তু ওয়ানডেতে ৫ নম্বর ফাঁকা থাকলেও টি২০ তে ওপেন না করলে তার জন্য জায়গাই ছিল না এতদিন। ৩-৫ তিনটা পজিশনই সাকিব, মুশফিক, রিয়াদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া; ৬ বা ৭ এ খেলার জন্য যে মেজাজের প্রয়োজন তার ব্যাটিংয়ের সাথে মিলে না। তাই ওপেনার হিসেবেই কন্টিনিউ করা, এবং ব্যর্থ হয়ে দল থেকে বাদ।
এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে যে স্কোয়াড দিয়েছে দেখলাম তাতে বিপিএল এ ভালো করলেই তার ফেরত আসার সম্ভাবনা পর্যাপ্ত। আগামী অনেকদিন টি২০ খেলাই নেই আর। বাংলাদেশের ক্রিকেটে বাম-ডান কম্বিনেশন এমনই সাংবিধানিক পলিসি হয়ে পড়েছে যে টেস্ট ওপেনার সাইফ হাসান, যাকে ঘরোয়া লীগেও টি২০ তে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় না, সে ঢুকে পড়েছে টি২০ টিমে। তার ছক্কা মারার অ্যাবিলিটি ভালো, কিন্তু আগে তো টিকতে হবে, তার আগেই আউট। মুশফিকের মতো রিয়াদও বাদ পড়বে অচিরে, সেক্ষেত্রে ৪,৫ দুটো পজিশন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে, কিন্তু এমন এক ওপেনারকে নেয়া হয়েছে যে লিটনকে ফিরতে হবে সেই ওপেনার হিসেবেই, এবং আবারো ব্যর্থতাই টানবে।
আমাদের কোচ-নির্বাচক আর ক্রীড়া সাংবাদিকরা বলবে প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ নেই, টেকনিকে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যাটা মানসিক। এর চাইতে গার্বেজ স্টেটমেন্ট দ্বিতীয়টা হয় না। সাইকোলজিকাল সমস্যা আবার কী; সে কি টিভিতে খেলা দেখায় বলে নার্ভাস হয়ে পড়ে, বা স্টেডিয়ামে দর্শকের উত্তেজনা দেখে মনোযোগ বিঘ্নিত হয়, নাকি ম্যাচ খেলতে নামলে হাত ঘামে, ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়? একই কায়দায় একজন ব্যাটসম্যান আউট হলে সেটা স্পষ্ট স্কিলের সমস্যা, সেটার সমাধানে কী কী কাজ করা হয়েছে? ব্যাটসম্যান লিটনের স্ট্রেন্থ এবং লিমিটেশন নিয়ে কোনো ডিটেইল অ্যানালাইসিস করা হয়েছে; তাহলে কোন যুক্তিতে মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার গালভরা বুলি কেন। কিংবা লিটন রুটিন প্র্যাকটিসের বাইরে কতটুকু ট্রেনিং করে তার কোনো কোয়ান্টিটিভ এবং কোয়ালিটেটিভ চার্ট করা আছে? ‘প্রতিভা, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা’ প্রভৃতি বাকোয়াজ কথা-বার্তা মার্কেটে খুব চলে, সেসবই খাওয়ানো হয়।
বরং লিটনের উচিত আসন্ন বিপিএল এ ওপেন ছেড়ে ৩ এ খেলা, যাতে এটা অন্তত স্পষ্ট হয় সে ওপেনে প্রুভেন ফেইলার হওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। কিন্তু সে নিজে মানলে তো হবে না, দেখা গেল খালেদ মাহমুদ সুজন বা হাবিবুল বাশার সুমন বলছে লিটন তুমি বিপিএল এ ওপেন করবা, ২টা ফিফটি করলেই পরের সিরিজে সুযোগ আছে। বা কোচ বললো এবার বিপিএল এ তোমার পারফরম্যান্স দেখব। ফলে সে যদি ওপেন ছাড়তেও চায় সিস্টেম অ্যালাও করবে কিনা সন্দেহ। নইলে নাইম শেখ, সাইফের মতো লিমিটেড অ্যাবিলিটির প্লেয়ার, যাদের আমরাই বাতিল করে দিই কোচ-নির্বাচক যাদের রুটি-রুজিই হলো ক্রিকেট, তারা বোঝে না এমনটা অন্তত আমি কখনোই ভাবি না। ফ্লিক আর কাট এর বাইরে নাঈমের কোনোরকম শট নেই, শরীরে বল না দিলে এমনকি সিঙ্গেলসও বের করতে পারে না, কোয়ালিটি বোলিংয়ের বিপক্ষে সে টিকবে এটা অসম্ভব। বিশ্বকাপের মূল পর্বে তার ব্যাটিংগুলো দেখুন, ব্যাটিং প্যারাডাইসে ৫২ বলে ৬২ করে দলের অন্তত ১৫ রান কমিয়ে দিয়েছে শ্রীলংকার বিপক্ষে, বাকি ম্যাচগুলোতে শরীরে বল পায়নি, রানও নেই। ফলে দুটো লেইম ওপেনার দলে, এবং ডমিঙ্গো বরখাস্ত হচ্ছে, নতুন কোচ এলে নিশ্চিতভাবেই নাইম-সাইফে আস্থা রাখবে না; যে কারণে লিটনকে ফিরতে হলে সেই ওপেনেই। অথচ ৪,৫ এখন ওপেন, এই পজিশনটার জন্য ফাইট করলে লিটনের ক্যারিয়ারের জন্য বিরাট টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। তার আরেক অ্যাডভান্টেজ কিপিং করা; পাকিস্তানের বিপক্ষে একটা সম্ভাব্য একাদশ দেখুন; নাইম-সাইফ-শান্ত-রাব্বি-সোহান, অর্থাৎ প্রথম ৭ জনের ৫ জনই ফিক্সড ব্যাটসম্যান যারা বোলিং করে না। ৫ম বোলারের অভাব পূরণ করতে হবে আফিফ আর রিয়াদকে, এবং নিয়মিত বোলারদের কেউ খারাপ করলে কোনো ব্যাক আপ বোলার নেই। সোহানের ব্যাটিং স্কিল অতি নিম্নমানের, কোনোরকম প্রোপার ক্রিকেটিং শট নেই হাতে, একমাত্র স্কোরিং অপশন স্কুপ এবং সেটাও ভালো পারে না। ফলে সোহানের জায়গায় খুব সহজেই একজন মিনি অলরাউন্ডারকে খেলানো যেত যদি প্রথম ৫ এ ব্যাট করার মতো একজন উইকেটকিপার থাকত। সোহান টিমের কম্পোজিশনে মারাত্মক সমস্যা করছে। সোহানের বদলে যদি শামীমকে খেলানো হয় ৩জন পার্ট টাইমার মিলে ব্যাক আপ দিতে পারত।
টিম ম্যানেজমেন্ট কেন এভাবে চিন্তা করে না, এখানেই প্রশ্নটা। লিটন নিজে কি গাটস দেখিয়ে বিপিএল এ ৩ এ ব্যাট করবে? সম্ভবত না। ইতোপূর্বে বহুবার লিখেছি তার যা পারসোনালিটি প্যাটার্ন এর সাথে সবচেয়ে ভালো মিলে পেইন্টার এবং মিউজিশিয়ানের, ক্রিকেটের মতো কঠোর এবং কমপ্লিকেটেড প্রসেসের এক অ্যাথলেটিক্স এ তার সারভাইভ করা ভীষণ দুরূহ। তাসকিন যেমন ৩ বছর দলের বাইরে থেকে পরিশ্রমের মাধ্যমে ফেরত এসেছে, লিটনের মধ্যে কি সেই তাগিদটা আছে আদৌ? হয়ত সে চিন্তা করে একজন প্লেয়ারকে জাতীয় দলেই খেলতে হবে কেন, ঘরোয়াতে বা ক্ষ্যাপ খেললে সে কি আর ক্রিকেটার থাকে না; কিংবা সব ফরম্যাট মিলে জাতীয় দলের হয়ে ১০০ এর বেশি ম্যাচ খেলেছি, আর কত; মানুষের জীবনে সাফল্যই কি সব!—- এধরনের ইম্যাটেরিয়াল চিন্তাকে জয় করার তাড়না যদি না কাজ করে সে এনার্জাইজড কেন হবে, বরং কোনোমতে টিকে থাকাকেই ধরে নিবে সার্থকতা! স্রেফ বাঁহাতি স্পিনার নাসুমের কেইসটা নিয়েই পর্যালোচনা করা যায়। ওভারপ্রতি ২টা লং হপ দেয়া নাসুম যখন লিটনকে বোলিং করে সে পুরোপুরি অন্য এক বোলার, তার বিপক্ষে কী ভয়ানক শেকি। কিংবা উইন্ডিজের আকিল হোসেনকে অন্যরা পাত্তাই দেয় না সেভাবে, লিটন বিশ্বকাপে তাকে যেভাবে খেলেছে মনে হচ্ছিল প্রতি বলে আউট হওয়ার ভয়। এমনকি জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ১৭৬ এর সেই অভিশপ্ত ইনিংস (যার কারণে তার ক্যারিয়ার আটকে গেল) সেখানেও ৫৪ রানে পার্ট টাইমার শেন উইলিয়ামসনের বলে প্লাম্ব এলবি থেকে বেঁচে গেছে কেবলমাত্র রিভিউ না নেয়ার কারণে। যদি জেদ থাকতো সে বলতো বাঁহাতি স্পিনাররে পিটাইয়া ছাতু বানাইয়া দিব, উল্টো সে-ই পোষ মানা প্রাণীর চেহারা ধারণ করে। আজ পর্যন্ত নিজের কোনো একটা পার্টিকুলার উইকনেস সে দূর করতে পেরেছে বা দূর করার চেষ্টা করেছে কতখানি? নেইল ম্যাকেঞ্জি তার ব্যাটিং নিয়ে এত কাজ করেছে শোনা যায়, যদি এতটাই ডেসপারেট হতো ব্যাটিং ভিডিও করে ম্যাকেঞ্জিকে পাঠিয়ে অনলাইনেও তো গাইডলাইন নিতে পারতো, প্রয়োজনে টাকা খরচ করত। বা নিজে ১-২ সপ্তাহের জন্য সাউথ আফ্রিকাতেই চলে যেত। মূল বিষয় হলো, দুর্বলতা কাটাতে লেভেল অব ডেসপারেটনেস। সেই জায়গায় লিটন কি পাশ মার্ক পাবে? অবশ্যই না।
আর্জটাই নেই হয়ত। কারণ সাইফ, নাইম, শান্ত দের মধ্যে কেউ কেউ বা সবাই ব্যর্থ হবে, দর্শক তাদের নিয়ে ট্রলিংয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন এনসিএল থেকে আবারো ফেরত আনা হবে লিটনকে। একবার বাদ পড়লে ফিরে আসাটা যদি ভীষণ দুরূহ হত, এতটা রিল্যাক্স হওয়ার চিন্তাই আসতো না। বাংলাদেশ বলেই লিটন, সৌম্য বা ইমরুল বারবার ফিরে এসেছে। ভারত বা পাকিস্তান বাদ দিলাম, এমনকি শ্রীলংকায় হলেও এতদিনে হয় লাইনে আসতো অথবা হারিয়ে যেত।
লিটন বাদ পড়েছে তাতে খারাপ লাগার কারণ কী? আমি জানি ব্যাটসম্যান হিসেবে সে মাঝারি মানের, প্রাইম টাইম প্রায় শেষের পথে, আর ২-৩ বছরের মধ্যেই রিফ্লেক্স খারাপ হতে শুরু করবে, তবু লিটনের ব্যাটিংয়ের পেছনে কেন বিনিয়োগ করি। প্রথমত তার নিরাসক্তি অভিব্যক্তিটা আমাকে কৌতূহলী করে তোলে, দ্বিতীয়ত তার ব্যাটিংয়ের নান্দনিক দিকটা উপভোগ করি, আমাকে ক্রিটিকাল থিংকিংয়ে হেল্প করে, এমনকি আমার প্রকাশিতব্য বই ‘চিন্তা এক্সপ্রেস’ এ লিটনের কেইসটা নিয়ে টুকটাক আলোচনাও করেছি। আশরাফুলের প্রতি কৈশোরে সংযোগ বোধ করতাম, কিন্তু কিছুই করার সামর্থ্য ছিল না। লিটনের প্রতি সংযোগটা আশরাফুলের চাইতেও বেশি। যেহেতু বয়স ৩৫ হয়ে গেছে, এখন সংযোগের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ লেখালিখি আর আর্থিক বিনিয়োগ করি। লিটন খারাপ খেললে মন খারাপ হয় না, ভালো খেললেও খুশি লাগে না, হোয়াট আই লাইক টু অবজার্ভ হিম ইনসাইড দ্য গ্রাউন্ড। এইসব অবজার্ভেশন আমাকে অসংখ্য বইয়ের কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে, যদিও সেগুলোর একটাও ক্রিকেট সংক্রান্ত বই নয়।
জেদি হও লিটন, ৩০ এর আগে যে কোনো স্বভাব পাল্টানো বা নতুন অভ্যাস রপ্ত করা তুলনামূলক সহজ, ৩০ পেরুলে ক্লোজ টু ইমপসিবল!