ক্ষুদ্রায়ু জীবনে বহু বুলশিট কথা শুনেছি কথিত শিক্ষিত শ্রেণির থেকে, শ্রেষ্ঠ বুলশিট কথাটি উপহার পেয়েছিলাম এক স্প্যানিশ জীববিজ্ঞানীর তরফে, তারিখ ২০২০ এর ১৭ মার্চ। আমার করোনা ডায়েরি ‘ঘোরবন্দী গোল্ডফিশ’ বইতে সযত্নে তা লিখে রেখেছি-
‘তোমরা একজন ফুটবলারকে মাসে বেতন দাও ১ মিলিয়ন ডলার, একজন জীববিজ্ঞানীকে দাও মাত্র ১৮০০ ডলার। সেই জীববিজ্ঞানীর কাছেই তোমরা ওষুধ চাইছো, তো যাও না রোনালদো-মেসিকে গিয়ে বলো করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে’!
২০১২ তে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ইন্টারভিউকালীন একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন- ‘সাকিব একটা ৪ মারলে লক্ষ-কোটি মানুষ যে আনন্দটা পায়, তার সামনে হাজারটা সাইন্টিস্ট বা লেখকের কর্ম নস্যি। একজন ভ্যানচালক বা শিল্প উদ্যোক্তা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের একটা লাইন না বুঝেও জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। একজন লেখক বা বিজ্ঞানীকে অবশ্যই অনেক বেশি লোক চিনবে না, তাদের কাজ-কর্ম বুঝবে না— এটা যে মানতে না পারে তার কোনো অধিকার বা যোগ্যতাই নেই এ লাইনে আসার৷ এন্টারটেইনারদের আবেদনকে কখনো ছোট করতে নেই। সাকিবের খেলা আমারও ভালো লাগে, আমিও হাত তালি দিই’
গত সপ্তাহে একটা তামিল ফিল্ম দেখলাম- TesT। এরা জঁরা বলা যায় স্পোর্টস ফ্যান্টাসি থ্রিলার। দেখার কারণ ছিল তিনটি-
প্রথমত স্পোর্টস এবং মিউজিকাল ফিল্মের প্রতি চিরকালীন ইন্টারেস্ট
দ্বিতীয়ত ২০০৭ এ হিন্দি ‘রং দে বাসন্তী’ ফিল্মে করণ চরিত্রে এক্টিং করা সিদ্ধার্থ সূর্যনারায়ণকে পছন্দ হয়েছিল। ক্যারিয়ারে খুব বেশি সাফল্য পায়নি, কাজের পরিমাণ নগণ্য৷ বহুবছর বিরতিতে তাকে পেলাম, ১৮ বছর পরেও ফিটনেস অটুট
তৃতীয়ত বাংলাদেশে আমার কোনো পছন্দের নায়িকা বা অভিনেত্রী নেই৷ ওপার বাংলায় পছন্দ করি অপর্ণা সেনকে। সবমিলিয়ে নায়িকা পছন্দ মাধুরি দীক্ষিত এবং মনিকা বেলুচ্চি। অভিনেত্রী হিসেবে ভালো লাগে টাবু এবং নয়নতারাকে। শেষোক্তজনকে পাওয়া গেল টেস্ট এ৷
টেস্টের স্ক্রিনপ্লে তে প্রবেশের পূর্বে কয়েকটি কনটেক্সটের প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখের দাবি রাখে-
১. ধোনীর বায়োপিক আমাদের জানায় অধিনায়ক হওয়ার পরে সে শচীন, গাঙ্গুলী, দ্রাবিড়কে একসাথে দলে চায়নি, কারণ বয়সের কারণে তাদের ফিল্ডিং তরুণদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল। সৌরভ গাঙ্গুলী অধিনায়ক থাকাকালে শেওয়াগ, যুবরাজ, হরভজন সিং, জহির খানদের পাশাপাশি ধোনিকেও প্রচুর ব্যাক আপ দিত। তাকে লোয়ার অর্ডার থেকে উপরে ব্যাট করিয়েছে, খারাপ করলেও দল থেকে বাদ দেয়নি। গাঙ্গুলী যখন রিটায়ার করলো তার পেছনে ধোনির সুস্পষ্ট চাপ ছিল, তৎকালীন বিভিন্ন মিডিয়ায় নিউজ এসেছিল। রিটায়ারমেন্টের আগের পরিস্থিতি নিয়ে যদি কেউ ফিল্ম বানায়?
২. প্রচন্ড প্যাশনেট প্রকৃতির মানুষ যদি সর্বোচ্চ পরিমাণ সেলফিশ হতে না পারে, পরিবার এবং সন্তান যদি হয়ে উঠে পিছুটান— তাদের প্যাশন পরাস্ত হবেই। সামাজিক অনুশাসন, মূল্যবোধ, রুচিবোধ প্রভৃতি শৃংখলগুলো হয়ে উঠে মাকড়সার জাল। ৯৯% মানুষের জন্যই প্যাশন একপ্রকার বারডেন হয়ে একসময় রূপ পায় শৌখিনতায়। শখ যতক্ষণ addiction না হচ্ছে তাকে প্যাশন বলাও যায় না। ‘selfish to pursue passion’ এ ধরনের আউটলায়ার মানুষরা জীবনে সফলতা পেলে গল্পের ক্যারেক্টার হয়, ব্যর্থ হলে জুটে কুকুর-বিড়ালের জীবন। নাথিং ইন বিটুইন। কুকুর-বিড়ালের জীবন পাওয়া ব্যর্থ মানুষটি হয়তবা সফল হওয়ার স্কিলগুলো রপ্ত করতে পারেনি, কিন্তু তার প্যাশন সফলতা পাওয়া লেজেন্ডের চাইতে কম নয় একচিলতেও। বরং বিজ্ঞানী যখন প্রশ্ন তুলে সামান্য একটা কাঠের ব্যাট দিয়ে বল পেটানোর দক্ষতাতে কেন একজন মানুষ যাবতীয় অর্থ-খ্যাতি-জনপ্রিয়তা-এটেনশনের কেন্দ্রে থাকবে, এবং সেজন্য এন্টারটেইনারকে হিংসা করে, তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় কেন সে সাফল্য পাবে না, কারণ সে কেবল নিজের কাজটিকেই মহাগুরুত্বপূর্ণ গণ্য করছে, মানুষের প্লেজারের চাহিদাটাই ধরতে পারেনি। আক্ষেপে জীবন কাটানোই এদের নিয়তি।
৩. হিরো একটি ক্রিমিনালি মিথ, মানুষমাত্রই ভিলেন, প্রয়োজন সেই নির্দিষ্ট সেটটি ডিজাইন করা যেখানে তার ভিলেনসত্তা উন্মোচিত হয়। প্রত্যেক ভিলেন পরস্পরের সাথে মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শেষতক হিরোর একটি রোল পেতে।
আমরা যদি কনটেক্সটগুলো মনে রাখি টেস্ট ফিল্মটি দর্শনযোগ্য হয়ে উঠে
১. সৌরভ গাঙ্গুলীর ছায়া ক্যারেক্টার সিদ্ধার্থ দুই বছর ধরে অফ ফর্মে, ক্যাপ্টেন-কোচ-নির্বাচক চায় সে রিটায়ার করুক। মিডিয়াবাজির মাধ্যমে সে একাদশে চান্স পায়৷ লর্ডসে সেঞ্চুরির পরে ছেলেবেলার কোচের সাথে দেখা করতে গেলে প্রশংসার পরিবর্তে সে তার ব্যাটিং টেকনিকের নানা দুর্বলতা বলে, রাগান্বিত হয়ে কোচের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে। ঘটনাক্রমে তার ছেলেকে জিম্মি করে আন্ডারপারফরমে বাধ্য করা হয়। তার স্ত্রী বলে ম্যাচ হারলে কিছু যায়-আসে না, ছেলেকে বাঁচাতে হবে। একদম ক্লাইম্যাক্স সিনে সে রিভার্স সুইপে ছক্কা মেরে সকলের চোখে হিরো হলেও বাবা হিসেবে ভিলেন, কারণ এতে তার সন্তানের প্রাণহানির হুমকিকে মেনে নেয়া হয়।
২. মাধবন এমআইটি থেকে ডক্টরেট। ফুয়েল কনজাম্পশন সংক্রান্ত প্রজেক্ট করতে চায় তাতে দেশের এনার্জি খাতে বিপ্লব আসবে। তার পাইলটিং করতে ভুয়া ক্যান্টিনের নামে ঋণ নেয়। প্রজেক্ট পাশ করতে মন্ত্রীর সেক্রেটারি ৫ কোটি ঘুষ চায়। ওদিকে ১০ বছর ধরে সন্তানহীন থাকায় শেষ চেষ্টা হিসেবে IVF ট্রিটমেন্ট করতে চায় স্ত্রী, যে জন্য খরচ ৫ লাখ। স্ত্রীর বাবাই সিদ্ধার্থের প্রথম কোচ, স্ত্রী সিদ্ধার্থের ছেলের স্কুলের শিক্ষকও। স্ত্রীর চরিত্রে নয়নতারা, সে ক্রিকেট ক্রেজি, সিদ্ধান্তের ফ্যান। মাধবনের এ সংক্রান্ত হীনম্মন্যতা কাজ করে৷ যখন সে ivf এর টাকা যোগাড়ে ব্যর্থ হয়, নয়নতারা তাকে সিদ্ধার্থের উদাহরণ দেখিয়ে বলে কেন একজন সফল আর কেন সে সফল। একজন ক্রিকেটারের খেলায় সমাজের কী উন্নতি হয়, তার প্রজেক্ট সফল হলে পুরো দেশ বদলে যাবে, অথচ ক্রিকেটারকে সবাই মাথায় তুলে রাখছে, তাকে গুন্ডারা টাকার জন্য মারধোর করছে, স্ত্রী প্রশ্ন তুলছে পুরুষত্ব নিয়ে।ঘটনাক্রমে সিদ্ধার্থের পুত্র সেসময় তার বাড়িতে, তাকে জিম্মি করে সিদ্ধার্থকে কব্জায় আনা হয়। ম্যাচ ফিক্সারদের কাছ থেকে ivf এর টাকা তুলে, সেক্রেটারির ৫ কোটি ঘুষ আদায় করে এবং প্রজেক্ট অনুমোদনের ঘোষণা চায়। প্রতিটি কাজ ভিলেনিয়াস, কিন্তু লক্ষ্য হিরো হওয়া। শেষ পর্যন্ত প্রজেক্ট অনুমোদন পেল, দেখবার জন্য বেঁচে থাকা হলো না, সেই ভিলেন হওয়ার দায়েই।
৩. নয়নতারা ক্রিকেট ফ্যান। তার জীবনের একমাত্র চাওয়া মাতৃত্ব। স্বামীকে গুন্ডারা তুলে নিয়ে গেছে, তাতেও সে নির্বিকারচিত্তে টাকার সন্ধান করতে থাকে। মাধবন যখন সিদ্ধার্থের ছেলেকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করে, এক পর্যায়ে সেও কোঅপারেট করে। অর্থাৎ মা হওয়ার লক্ষ্য পূরণে সে নিকৃষ্টম ভিলেন হতেও রাজি।
গল্পটা ৫ দিনের টেস্ট নিয়ে হলেও ক্রিকেট এখানে একটা প্রজেক্টর মাত্র, স্ক্রিনে চলেছে সেই চিরায়ত অনুসন্ধানটাই- ‘ এন্টারটেইনার যে এটেনশনটা পায়, গবেষকের তাকে আনডিউ প্রিভিলেজ মনে হলে সেটা কি তার প্যাশনের টেস্টেই ফেইল করা নয়’?
গুগলে এ ফিল্মের রেটিং ২/৫ মাত্র। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিশ্বজুড়েই অডিয়েন্স ফিল্মে শুধু ধুম-ধারাক্কা খুঁজে, সাইকোলজিকাল কনফ্লিক্ট এবং ক্যারেক্টার বিল্ড আপ এর চাহিদা তলানীতে ঠেকছে।
ফিল্মটা শেষ করে যখন মেমরি রিকল করছি, কয়েকটা ক্লু পেলাম যেখানে ফিল্মটা ধরাশায়ী হলো-
১. স্টোরি আগায় মূলত টেনশনের ভিত্তিতে৷ এত দীর্ঘ ফিল্মে কোথাও কোনো টেনশন পেলাম না৷ প্লেইন স্টোরিটেলিংয়ে কিছুক্ষণ পরই আসলে বোরিং লাগতে শুরু করে। পাকিস্তানের সাথে টেস্ট, ইন্ডিয়ার হার দেখানো হবে না, জয় আসবে সিদ্ধার্থের মাধ্যমে– ফিল্ম শুরুর দৃশ্য থেকেই সকলের জানা। অতি প্রেডিক্টেবিলিটি মেন্টাল এনগেজমেন্ট কমিয়ে দেয়।
২. আড়াই ঘন্টার ফিল্মে একটাও সিকুয়েন্স পেলাম না মনে রেখাপাত করার মতো৷ অতি গতানুগতিক সব সিকুয়েন্সেই ব্যয়িত হলো আড়াই ঘন্টা।
৩. ফিল্মের মূল প্রোটাগনিস্ট সিদ্ধার্থ, তার মিরর ইমেজ মাধবন। নয়নতারা এবং সিদ্ধার্থের ছেলে সাপোর্টিং ক্যারেক্টার। সারপ্রাইজিংলি নয়নতারা প্রটাগনিস্টের চাইতে অনেক বেশি স্ক্রিন প্রেজেন্স পেয়েছে যেগুলো খুবই স্টেরিওটাইপিং সিকুয়েন্স। ফলে স্টোরিলাইন জমাট বাঁধেনি
সাবপ্লট এবং সাব-ক্যারেক্টার প্রাধান্য পায়, সাপোর্টিং রোলগুলো দুর্বলভাবে ডিজাইন হওয়ায় টেস্টে আসলে ৩য় দিন লাঞ্চের আগেই শেষ হয়ে গেল।
তবু বহুদিন বাদে সিদ্ধার্থ সূর্যনারায়বকে দেখে বুয়েটের হলের দিনগুলোকে মনে পড়লো। এও অপ্রাপ্তি নয় মোটেই
