মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ভক্তের সঙ্গে সংলাপ
আজ দুপুরে এক তরুণের তীব্র জেরার মুখে পড়ি Whatsapp এ। আমার মৌনতা ক্লাব আর রঙপ্যাথি বই পড়ে যতটা মুগ্ধ হয়েছিল ফেসবুকে ক্রিকেটকেন্দ্রিক লেখা পড়ে ক্ষুব্ধতা বেড়েছে কয়েকগুণ। যার মানসিকতা এতটা কুরুচিপূর্ণ তার লেখা কোনো বই আগামীতে সে আর পড়বে না যতই ব্যতিক্রমী হোক সেটা। উত্তর দিই বই পড়তে বা কিনতে কি আমি অনুরোধ বা প্রলুব্ধ করেছিলাম; সেটা যেহেতু আমাকে না জানিয়েই করেছে, পড়বে না তা এত ঘটা করে জানানোর কী হলো!
এক কথায় দু কথায় সময় আগাতে থাকে যার বেশিরভাগটাই তামিম ইকবাল আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকেন্দ্রিক। আলাপটা ইন্টারেস্টিং ছিল বিধায় পরিপাটি করলাম।
[অনিবার্য কারণেই তরুণের প্রকৃত নাম প্রকাশে বিরত থাকলাম; ধরা যাক তার নাম মোকসেদ!]
মোকসেদ: আপনি সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রতি এতটা ডিসরেসপেক্টফুল কেন, তারা কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কিছুই করেনি?
আমি: রেসপেক্ট বলতে কী বোঝো আগে বোঝাও আমাকে। পারফর্মিং আর্টে প্রশংসা আর নিন্দার বাইরে কমপ্লিমেন্ট তো থাকবে না সচরাচর। কোটি কোটি লোক টেন্ডুলকারের অন্ধভক্ত, কোটি না হলেও লাখখানেকের বেশি লোক তার নিন্দুক অথবা সমালোচক। ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত না হলে কোনো ব্যক্তির প্রতি সম্মান তৈরি কীভাবে হয় বোঝাও আমাকে। যার সাথে কখনো ইন্টারেকশনই হয়নি, মাঠের বাইরে যার সম্বন্ধে জানার উপায় পত্রিকায় প্রকাশিত ফিচার বা ইন্টারভিউ যেগুলো প্রায় সবটাই আরোপিত আর মেকি ভাবধারার, তার ভিত্তিতে একজন ব্যক্তির প্রতি সম্মান-অসম্মান কোনোটাই আসা উচিত না। তোমাকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে তুমি ব্যক্তি মাশরাফিকে সম্মান করছো, নাকি এথলেটকে। ব্যক্তি মাশরাফির সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা বা কথাই হয়নি, তাকে সম্মানের প্রসঙ্গই অবান্তর। এথলেট মাশরাফিকে তার পারফরম্যান্সের কারণে কখনো এপ্রিসিয়েট করবো, কখনো সমালোচনা। এই ইমপ্রেসনটা স্থায়ী না,কারণ বিশ্বক্রিকেটের মানদণ্ডে সাকিব আর মুস্তাফিজ বাদে বাকিরা বিলো এভারেজ; এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়া যদি অসম্মানের হয় তাহলে অসম্মানই তারা ডিজার্ভ করে।
মোকসেদ: হুমায়ূন আহমেদ বা রনে দেকার্তকেও তো ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তার মানে কি তাদের প্রতিও সম্মান তৈরি হবে না?
আমি: হবে না, তাদের চিন্তা বা কর্মের প্রতি ফ্যাসিনেটেড হতে পারি, তার থেকে এপ্রিসিয়েশন আসতে পারে। আবার কোনো চিন্তা বা কর্ম পছন্দ না হলে ক্রিটিক করবো। সম্মান একটি ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়াজনিত অনুভূতি। এখনকার প্রজন্ম মনের দিক থেকে আনসার আর আর্মির নন-কমিশন র্যাংকে চাকরি করে, যে কারণে উঠতে বসতে স্যালুট দেয় বিভিন্ন সেলিব্রিটিকে। তোমার কেইসটাই দেখ, মৌনতা ক্লাব আর রঙপ্যাথি পড়ে এত ভালো লেগেছে বলছো, সেখানে কি ক্রিকেট বিষয়ক আলোচনা ছিল? অথচ তুমি আমার লেখা কোনো বই আর পড়বে না। তার মানে তুমিও আসলে আমার নামে মাজার খুলে খাদেমগিরি করতে চেয়েছিলে, তোমার নিজস্ব কোনো মতাদর্শ নেই।
মোকসেদ: এই যে দেখেন আপনি পারসোনাল এটাক করছেন, এজন্যই আপনাকে পরিত্যাজ্য মনে করি; আপনি অন্যের ইমোশনকে খুব বিশ্রিভাবে অপমান করেন। আমারটা বাদ দিলাম, সিনিয়র প্লেয়ারদের যে ভাষায় অপমান করেন এটা কি আপনার সঙ্গে যায়? রাস্তার ছেলেদের সঙ্গে আপনার পার্থক্য করতে পারি না তখন।
আমি: তুমি যখন বললা আমার মানসিকতা কুরুচিপূর্ণ সেটা ছিল মন্তব্য, আমি তোমার আচরণের প্রেক্ষিতে ফ্যাক্ট ব্যাখ্যা করলাম সেটা হয়ে গেল পারসোনাল এটাক। ঠিক একারণেই মেলামেশা এবং ইন্টারেকশনের ক্ষেত্রে আমি অতি সিলেক্টিভ, কার মতকে আমলে নিব কাকে পাতেই তুলবো না সে ব্যাপারেও মহা খুতখুতে। অবাক হচ্ছি, আমি অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করি না- সমালোচনা নিতে পারি না- প্রচণ্ড অহংকারি এ জাতের কথাগুলো এখনো না বলায়। i don’t like to be liked; অপমানের প্রসঙ্গেই যেহেতু বারবার ফেরত আসতেছ, চলো ফ্যাক্ট এনালাইসিস করি। অনলাইনে তামিম ইকবালকে নিয়ে সর্বাধিক পঠিত এবং শেয়ারকৃত আর্টিকেলের নাম ‘ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর তামিম ইকবাল’, মুশফিককে নিয়ে এনালাইসিসকৃত ‘মুশফিক মোস্টট্রিট’ আর্টিকেলটি পৌঁছে গিয়েছিল স্বয়ং মুশফিকের কাছেই, মুশফিককে নিয়ে আর কোনো লেখা এতটা ভাইরাল হয়নি। ‘কেন ট্যাগ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ’ লেখাটি কতগুলো পোর্টালে ছাপা হয়েছে ইয়ত্তা নেই। সাকিব কেন ও কীভাবে চিন্তা করে শুধু এ বিষয়েই থিসিস লেখা হয়েছে ১৫-১৬ হাজার শব্দের, তার বিকেএসপির কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম স্বয়ং সেসব পড়ে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে মাশরাফি অবসর নিতে পারে খবর প্রকাশিত হলে তাকে ট্রিবিউট জানিয়ে লেখাটা তুমুলভাবে ভাইরাল হয়েছিল, এর বাইরেও মাশরাফি কেন্দ্রিক থিসিসে ব্যয়িত হয়েছে ৯-১০ হাজার শব্দ। প্রতিটি কনটেন্টের লেখক একজনই, মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়! তোমরা তো সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রতি সম্মানের ভারে নুয়ে পড়েছ, বলো কয়টা আর্টিকেল পড়েছ তাদের বুঝতে বা নিজেরা কয়টা শব্দ লিখেছ, সম্মানের বহিঃপ্রকাশটা কোথায়! লাভ ইউ সাকিব, তামিম বস, রিয়াদ সাইলেন্ট কিলার– এসবের মধ্যেই সম্মান?
মোকসেদ: ঠিক আছে মানলাম আপনি তাদের নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, আপনার চাইতে বেশি এপ্রিসিয়েট তাদের কেউ করেনি, তার মানে কি তাদের অপমান করার অধিকারটাও আপনি পেয়ে গেছেন? রিয়াদকে ভুচরা ছাড়া কথাই বলেন না, তামিমের আগে বিশেষণ দিয়েছেন ভটভটি; এগুলো কোন ধরনের শিষ্টাচার?
আমি: তুমি কি এধরনের সংবাদ কখনো পড়েছ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবনে রোগীর মৃত্যু? আমি অজস্রবার পড়েছি। যে কোন প্যাকেটজাত খাবার কিনতে যাও, দেখবে এক্সপায়ার ডেট লেখা থাকে। ওষুধে জীবন বাঁঁচবে, সেই ওষুধই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়লে রূপান্তরিত হয় বিষে। বিষকে কেন ওষুধের মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না এটা তো অভিযোগের বিষয় হতে পারে না। তোমার তথাকথিত সিনিয়রদের জন্য সেই বর্ডারলাইনটা ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত, তার পূর্ব পর্যন্ত কন্ট্রিবিউশন ছিল বলেই তাদের নিয়ে বিস্তর লেখালিখি করেছি। বিশ্বকাপ শেষ, বিদায় হবে কি, উলটো তামিম আর রিয়াদকে বানানো হলো সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অধিনায়ক। আমি এখনো মনে করি টেস্টে তামিমের মানের ওপেনার আমাদের নিকটবর্তী রাডারে নেই। তবে সাদা বলের ক্রিকেটে তাদের ব্যাচের সবারই ইনক্লুডিং সাকিব হিমসেল্ফ মেয়াদ শেষ; প্রত্যেকেই তাদের স্বর্ণসময়ের ছায়া। তুমি বলতে পারো নির্বাচক বা বোর্ড তাদের বাদ দেয় না কেন। বিশ্বকাপের পরে উৎপল শুভ্র এর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাকে বলি ৪টা বিশ্বকাপে ফ্লপ, তামিমকে আর ওয়ানডেতে কন্টিনিউ করা উচিত না। তিনি বলেন- ‘একটা টুর্নামেন্ট খারাপ করলেই তাকে বাদ দিতে হবে? এটা তো মেসি বিশ্বকাপ জিততে না পারার কারণে তাকে গ্রেট প্লেয়ার বলা যাবে না টাইপের লজিক হয়ে গেল’! তার মন্তব্যটা নিয়ে পরে ভেবেছি অনেক। মিডিয়া বা বোর্ডের কাছে ম্যাচ জেতার চাইতেও কোন প্লেয়ার খেলবে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সিনেমায় যেমন মান্না-শাকিব খান থাকলে দর্শক দেখে, অনুরূপ মাঠে তামিম-রিয়াদ-মুশফিক থাকলে দর্শকরা দলটাকে বেশি ঔন করবে, যেহেতু দিনের পর দিন তাদের দেখেই অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট সাংবাদিকতায় উৎপল শুভ্র এর চাইতে বড় ব্রান্ড তো নেই, তিনি যেহেতু এই প্যাটার্নে চিন্তা করেন বা করছেন, তার মানে এটাই এস্টাব্লিশমেন্টের চাওয়া। তখন আমার মনে পড়ে পঞ্চপাণ্ডব, দেশসেরা ওপেনার, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, মিস্টার ডিপেন্ডেবল, সাইলেন্ট কিলার প্রভৃতি ফাঁপরবাজি। দেখ সাকিব আর মুশফিকও খেলার ধার হারিয়ে ফেলেছে, পারফর্ম করছে কিন্তু ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবু এ দুইজনকে নিয়ে সচরাচর কিছু বলি না, বললেও কনস্ট্রাকটিভ উপায়ে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তামিম আর রিয়াদের ক্ষেত্রে আমি নির্দয়, এটাও স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত। দেশসেরা ওপেনার, সাইলেন্ট কিলার কমপ্লিমেন্টগুলোর বিপরীতে একটা এন্টি এস্টাব্লিশমেন্ট বা কাউন্টার ফোর্স কমপ্লিমেন্ট এর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিলাম, ভুচরা বা ভটভটি সেই প্ল্যানেরই অংশ। একদম ম্যাচ বাই ম্যাচ গ্রাফিকাল প্রেজেন্টেশনে দেখিয়েছি বাংলাদেশের জয়ে তামিম-রিয়াদের চাইতে সৌম্য-রুবেল-মুস্তাফিজের আনুপাতিক কন্ট্রিবিউশন বেশি, সেগুলো কয়জনের চোখে পড়েছে! কিন্তু যখনই ভুচরা আর ভটভটি উদ্ভব করলাম নির্বিচারে আক্রমণের শিকার হলাম, এক পর্যায়ে পাবলিক কমেন্ট বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন তুমি যে কোনো ক্রিকেট গ্রুপে ঢুকো, রিয়াদের নামের পূর্বে মেয়াদোত্তীর্ণ অথবা ভুচরা পাবেই। মিডিয়া যে ব্রেইনওয়াশড অবস্থার সৃষ্টি করেছে ৫ প্লেয়ারকে ঘিরে সেই মিথ বাবল ভাঙার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভুচরা-ভটভটির অবদান আছে। তাতে আমি নিজে নিন্দিত হয়েছি, গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছি। কিন্তু তুমি তো বুঝতেই পেরেছ ফেসবুকের জনতাকে আদতেই গোনায় ধরি না। তামিম আর রিয়াদকে অধিনায়ক বানিয়ে বিসিবি ভয়ংকর আত্মবিধ্বংসী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৩টা বিশ্বকাপ, ১টা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি টানা ৪ বছরে— সেখানে যদি মেয়াদোত্তীর্ণদের অধীনে খেলে দল, রেজাল্ট কেমন হবে ২০১৯ এই কিন্তু দেখেছি।
মোকসেদ: আপনি যে সব সিনিয়রকে বাদ দিতে বলেন শ্রীলংকা দলের বর্তমান অবস্থা দেখেও কি শিক্ষা হয় না যে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার না থাকলে পরিণতি কেমন হতে পারে?
আমি: শ্রীলংকা-উইন্ডিজ এই দলগুলোর সাথে ভুলেও বাংলাদেশকে মেলাতে যেও না, সেটা হবে উৎকৃষ্ট নির্বুদ্ধিতা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দীর্ঘদিন ক্রিকেটের পরাশক্তি ছিল, বিশ্বকাপ জিতেছে, টেস্ট জিতেছে— তাদের যা যা অর্জন করার ছিল প্রায় কিছুই আর বাকি নেই। কিংবদন্তী ক্রিকেটারের লিস্ট করতে বসলে কাকে রেখে কাকে বাদ দিবে। পরের প্রজন্মের তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার জায়গা নেই, যে কারণে পতন হতেই পারে। শ্রীলিংকা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ৩ বার ফাইনাল খেলেছে, টি২০ বিশ্বকাপ জিতেছে, মুরালিধরন টেস্টে যে পরিমাণ উইকেট পেয়েছে নির্দ্বিধায় বলা যায় সেই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে না। জয়াসুরিয়া, ডি সিলভা, ভাস, জয়াবর্ধনে, মালিঙ্গা, সাঙ্গাকারা, হেরাথ, দিলশান কত কত লিজেন্ড; পরবর্তী প্রজন্ম তাদের ছাড়িয়ে আসলে কতদূর যাবে। সেখানে দল হিসেবে বাংলাদেশের অর্জনের খাতা পুরোটাই ফাঁকি, ৬টা বিশ্বকাপ খেলে কোনোটায় ৩টার বেশি ম্যাচ জিততে পারলো না, টেস্টে এখনো পর্যন্ত ইনিংসে হারে, ১৫ জয়ের মধ্যে ১২টাই জিম্বাবুইয়ে আর উইন্ডিজের বিপক্ষে। সাকিব এত বড়ো প্লেয়ার, কই সে ক্রিজে থাকলে প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে তো কখনো বিচলিত দেখলাম না বা তার বোলিং খেলার সময় ব্যাটসম্যানকে বাড়তি সতর্কতাও নিতে দেখলাম না ১৫ বছরে, তামিম-মুশফিক-মাশরাফিকে বাদই দিলাম। অথচ মিডিয়া এখনই সর্বকালের সেরা ওয়ানডে-টেস্ট দল বানায়, সেখানে আবার বিশেষজ্ঞরাও থাকেন। একবার ভাবো ভারত অথবা ইংল্যান্ড যদি সর্বকালের ওয়ানডে-টেস্ট একাদশ গঠন করতে চায় প্রতিটি পজিশনের জন্য কমপক্ষে ৪-৫ জনের নাম আসবে, কত কিংবদন্তী বাদ পড়ে যাবে। বাংলাদেশে এই কাজটা করতে দাও, ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া কিশোর আর দেশের অভিজ্ঞতম কোচ উভয়ের লিস্টেই ৯টা নাম কমন থাকবে, এবং বেশিরভাগই এখনো খেলছে।
মোকসেদ: তাই বলে অভিজ্ঞতার দাম নেই, বড়ো ম্যাচে তো অভিজ্ঞতাই কাজে দেয়। গত বছরের টি২০ টুর্নামেন্টে দেখেন লিটন-সৌম্যদের দল টুর্নামেন্টজুড়ে কেমন দাপট দেখালো, ফাইনালে মাহমুদুল্লাহ ক্যামিও খেলে ঠিকই খুলনাকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দিল।
আমি : অভিজ্ঞতার মূল্য অবশ্যই আছে। তবে এও মনে রাখা দরকার ১৫ বছরের কেরানিগিরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউকে দিয়ে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতে চাওয়া বরং বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। তুমি টি২০ এর উদাহরণ দিয়ে ভালো করেছ। আফগানিস্তান সরাসরি বিশ্বকাপে খেলছে, সেখানে আমরা স্কটল্যান্ড, ওমান, পাপুয়ানিউগিনির সঙ্গে খেলছি বাছাইপর্ব। স্কটল্যান্ডে যে মানের স্ট্রোকপ্লেয়ার আছে ওরা আগে ব্যাটিং পেলে এমনকি হারিয়েও দিতে পারে বাংলাদেশকে। ৪ জন অভিজ্ঞ সেনানী রেখে এই ফলাফল কেন; টি২০ তে তাদের সিগনিফিক্যান্ট পারফরম্যান্স তো হাতে গোনা। অর্থাৎ তাদের স্বর্ণালী সময়েই তারা অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে, এই পড়ন্ত বেলায় তারা আর কী করবে! বাংলাদেশের নির্বোধ দর্শকেরা খেলা বলতে ব্যাটিং-বোলিংয়ের বাইরে কিছু বুঝে না, কিন্তু সীমিত শক্তির দলগুলো যে ফিল্ডিং দিয়েই পার্থক্য গড়ে দিতে পারে সেসব অনুধাবনে পর্যবেক্ষণ আর এনালিটিকাল এবিলিটি থাকতে হয়। হুজুগে বাঙালির জন্য এই প্রত্যাশা তো রীতিমত জুলুম। রিয়াদের কথা আলাদাভাবে বলতে চাই। ২০১৯ বিশ্বকাপের পরেই ক্রিকবাজ এ আর্টিকেল এসেছিল রিয়াদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ সেই রিয়াদ হয়ে গেল টি২০ ক্যাপ্টেন। তুমি নিদহাস ট্রফির সেই ছক্কার পরে রিয়াদের কোনো ইফেক্টিভ ইনিংস মনে করতে পার? হ্যাঁ জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একটা ৪২ বলে ৬০ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটা কুইক ফায়ার ছিল, দুটো ম্যাচেই লিটনের স্কোরটা দেখে নিয়ো, তাহলেই মোমেন্টামের ব্যাপারটা ধরতে পারবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কতগুলো টি২০ খেললো; কোথায় রিয়াদ! অথচ এত খারাপ পারফরম্যান্স সত্ত্বেও ২০১৮ পূর্ব গল্প বেচে তাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ক্রিকেটে যে বর্তমান ফর্ম, ফিটনেস আর রিফ্লেক্সই আসল কথা এই সরল ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া হয়। টেন্ডুলকার বা লারার যা রেকর্ড তাতে তাদের অবসরে পাঠানোর চিন্তা করাটাও পাপ, এমনকি গত বছর ইন্ডিয়াতে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের টুর্নামেন্টে শেওয়াগ-টেন্ডুলকার যেভাবে ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশের রানিং প্লেয়াররাও ওভাবে পারবে না। তবু তারা সরে গেছে। রিয়াদ আগে রাইজিং ডেলিভারিতে অবলীলায় ওভার দ্য টপ খেলতে পারত, আউটসাইড অফ লেন্থের বলে এক্সট্রা কভার দিয়ে উড়িয়ে মারতো, এখন তার একমাত্র হিটিং জোন প্যাডের বল, ওইসব শট চেষ্টা করেও টাইমিং হয় না। এটাই বুঝিয়ে দেয় কখন একজন ক্রিকেটার ফুরিয়ে যায়। রিয়াদ এখনো ৩০ বল খেলে ৩৪-৩৫ করে দিতে পারবে, কিন্তু তাতে কি দল জিতবে? এজন্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তামিম বা রিয়াদ খেলাটা জরুরী, নাকি দল জেতা। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং এটাক নিয়ে তো প্রশ্নের অবকাশ নেই, ২ ম্যাচেই আফিফ যে সাহসিকতা নিয়ে খেলেছে রিয়াদ পারবে এই বয়সে? ক্রিকেট রানের খেলা, তবে অনেক সময় রান করাটাও হারের কারণ হয় এই ফ্যাক্টটা উপলব্ধি করতে হবে। তামিম বা রিয়াদ যদি এখন ম্যাচের অধিকাংশ বল খেলে, নিশ্চিত থাকো দল হেরে যাবে।
মোকসেদ: আপনি প্রচণ্ড বায়াসড। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতেও তামিম ৮৭ বলে সেঞ্চুরি করলো, এটা লিটন বা আফিফ করলে তো থিসিস লিখতেন, অথচ মাত্রই বললেন তামিম-রিয়াদ বেশি বল খেললে ম্যাচ হারবে।
আমি: বাংলাদেশের দর্শকের আরেকটা সমস্যা, এরা ভুলে যায় ক্রিকেটে ফরম্যাট ৩টা, এবং একটার সঙ্গে অন্যটার ব্যাপক ব্যবধান। তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল টি২০ নিয়ে। ওয়ানডের জন্যও যে ভুল তা বলা যায় না। তামিম যেহেতু রান করছে, আমি তাকে একেবারে বাদ দেয়ার পক্ষে না, তবে তাকে ওপেনেও দেখতে চাই না। এংকর রোল শব্দটার চরম ভুল প্রয়োগ ঘটিয়েছে তামিম আর স্বার্থাণ্বেষী মিডিয়া। এংকর হলো সেই প্লেয়ার যে প্রচুর স্ট্রাইক রোটেট করতে পারে, চাইলে স্ট্রোক খেলতে পারে। মুশফিককে তুমি এই ক্যাটেগরিতে ফেলতে পার। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ লিটন দাস। সে গ্যাপ বের করে প্রচুর সিঙ্গেলস নিতে পারে, মারতেও পারে। তামিম আগাগোড়া বাউন্ডারি নির্ভর প্লেয়ার, স্ট্রাইক রোটেশন অতি বাজে, রানিং বিটুইন দ্য উইকেট বলাই বাহুল্য। সে ৫৫-৬৫ রানের প্লেয়ার; এটুকু করতেই ফিটনেস নিয়ে যেরকম স্ট্রাগল করে। সেলফিশ ইনিংস সব। আরও দেখবে সে সিরিজের একটা ম্যাচে ফিফটি করে, বাকি ২টাতে ডাবল ফিগারে পৌঁছায় কদাচিৎ,তবু প্রতি সিরিজে একটা ফিফটি খারাপ না। এরকম একজন প্লেয়ারকে এফোর্ড করাই যায় ৩ নম্বরে, কিন্তু ওপেন স্লটটা তাকে ছাড়তেই হবে। সেখানে লিটনের সঙ্গে একজন ডেস্ট্রাক্টিভ ওপেনার থাকবে যে আসলে বোনাস উইকেট, তার একমাত্র টার্গেট প্রতিপক্ষের স্ট্রাইক বোলারকে খুন করা অথবা নিজে খুন হওয়া। সে যদি ১০ ম্যাচেও ব্যর্থ হয় কিচ্ছু বলা যাবে না৷ রানের স্ট্যাবিলিটি আনবে বাকি ৫ ব্যাটসম্যান। কিন্তু তামিম বলবে আমি ওপেন ছাড়া কোথাও খেলতে পারি না, মিডিয়া বলবে যে প্লেয়ার সারাজীবনে ওপেনের বাইরে ব্যাট করেনি এই পড়ন্তবেলায় তাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট না করলেই কি নয়! অর্থাৎ কোনটা দলের জন্য ট্যাকটিকালি এডভান্টেজ দিবে তার চাইতে কিসে তামিমের উপকার হবে সেটা বেশি জরুরী। এজন্য তামিমের নির্বাসন ব্যতীত সমাধান নেই।
মোকসেদ: টি২০ বিশ্বকাপের আগে সিরিজ আছে মাত্র ১টা, পৃথিবীর কোনো প্রফেশনাল দল এই অবস্থায় অধিনায়ক পালটায় না, দল থেকে বাদ দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
আমি: ‘প্রফেশনাল’ শব্দটার মধ্যেই সমাধান আছে। বাংলাদেশ দলকে প্রফেশনাল মনে হয় তোমার; কেন ও কোন এঙ্গেলে মনে হয়? গত ২ বছর ধরে কোনো ফরম্যাটে ভাইস ক্যাপ্টেন নেই, বিশ্বাস হয়! এই টিমে কোচ বা ক্যাপ্টেনের রোলটাই বা কী! তুমি দেখছো ২ বছর ধরে একটা প্লেয়ারের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই, অন্যদিকে লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করার মতো ৪-৫ জন অপশন রেডি হয়ে আছে, তবু তারা বেঞ্চে বসে থাকবে ক্যাপ্টেনকে জায়গা দিতে। তাহলে বোর্ডের করণীয় কী হওয়া উচিত? জেনেশুনে একটি ক্যাপ্টেন কোটা তৈরি করে সেখানে একজন প্রুভেন ফেইলারকে বহন করা, নাকি নতুন অধিনায়কের অধীনে নিউজিল্যান্ড সিরিজ খেলে বিশ্বকাপের জন্য সঠিক কম্বিনেশন আবিষ্কার করা। জিম্বাবুইয়ে এবং অস্ট্রেলিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দল, তবু দেখ উভয় সিরিজেই পারফরম্যান্সে ডমিনেট করছে তারাই যাদের দলে জায়গা নড়বড়ে। সাকিব কিছুটা কন্ট্রিবিউট করলেও রিয়াদ কিন্তু কোথাও নেই, বরং ৩য় টি২০ হারিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠেছিল, শামীমের কৃপায় বেঁচে গেছে। তবুও কি বার্তা পাচ্ছো না তামিম-মুশফিক-রিয়াদদের আসলে সময় শেষ!
মোকসেদ: শুধু তরুণ দিয়ে দল হয় না, অভিজ্ঞ দিয়েও না; ব্যালেন্স থাকতে হয়। আপনি যেভাবে বলছেন মনে হচ্ছে বিশ্বকাপজয়ী অনুর্ধ্ব১৯ দলটাকে নামিয়ে দিলেই সবচাইতে খুশি হবেন।
আমি: এগুলো তোমাদের মতো উগ্রপন্থী তরুণদের চিন্তাভাবনা। একটা প্লেয়ার ১০-১৫ টা ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেললেই অভিজ্ঞ। লিটন, মুস্তাফিজ, আফিফ, মাহেদি, শরীফুল কাকে অনভিজ্ঞ মনে হয় তোমার? এমনকি শামীমও বিশ্বকাপ আসতে আসতে ১০-১২টা ম্যাচ খেলে ফেলবে। শান্তরাও সব ফরম্যাট মিলিয়ে ২০ টার বেশি ম্যাচ খেলে ফেলেছে। কোন যুক্তিতে এরা অনভিজ্ঞ? নাকি ১৫ বছর ধরে জাতীয় দলে না খেললে তারা অভিজ্ঞ হয় না? আফিফ তার ২০-২৫ ম্যাচের ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারে ৫ বার দলকে উদ্ধার করেছে; তোমার ভুচরাদের খেলা ম্যাচের অনুপাতে উদ্ধারের পারসেন্টেজ হিসাব কর,তাহলেই বুঝতে পারবে ভুচরাদের সামর্থ্য কত কম। আমি বরং লিটন- মুস্তাফিজদের অভিজ্ঞ ধরে জয়, হৃদয়, রাব্বিদের তরুণ হিসেবে বিবেচনা করতে চাই। তামিমদের প্রজন্ম যা দেয়ার দিয়ে ফেলেছে, এর বেশি আর তাদের সামর্থ্য নেই।২০১৬ এর পরে সাউথ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডের বাইরে বাংলাদেশ কোয়ালিটি অপোনেন্টের বিপক্ষে খেললোই বা কই; সেই তো জিম্বাবুইয়ে-উইন্ডিজ আর শ্রীলংকা! সামনে সব কঠিন সিরিজ, তামিম-রিয়াদরা এমনিতেই এক্সপোজড হয়ে যাবে। সময় থাকতে এদের অপসারণ না করলে সবগুলো টুর্নামেন্টেই মহাভরাডুবি সুনিশ্চিত।
মোকসেদ: আপনি যাদের নিয়ে বাজি ধরছেন তাদের তো কনসিসটেন্সির বালাই নাই। কোন ভরসায় সিনিয়রদের অপসারণ করবে?
আমি:কনসিসটেন্সি মানে কী? ৭০ বলে ৪৫ করা, নাকি ৩১০ চেজ করতে গিয়ে পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে ২৬৫ তোলা যেখানে একাধিক ব্যাটসম্যানের ফিফটি থাকবে? এধরনের কনসিসটেন্সি দলের জন্য অভিশাপ। তুমি আমাকে বলো টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টার্গেট কী? তোমার বলতে হবে না, রিয়াদ-মুশফিক-তামিমকে জিজ্ঞেস কর; তারা বলবে নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে চাই। এর চাইতে ছ্যাবলামিপূর্ণ মন্তব্য স্পোর্টস এ হয় না। এবার সাকিব-আফিফ-শামীম-শরীফুলকে জিজ্ঞেস কর, প্রত্যেকেই বলবে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। ওই ধরনের মাইন্ডসেটের প্লেয়ারদের প্রমোট করলে দল ১০ নম্বরেই থাকবে। তুমি দেখবে তামিম আর মুশফিক নিজেদের স্ট্যাট নিয়ে যে পরিমাণ কনছার্ন, দলের স্ট্যাট নিয়ে তার কণা পরিমাণও চিন্তা নেই। বরং ওপেন করবো, কিপিং করব ধরনের পাড়ার দাদাগিরি মানসিকতা। টিম কালচারটা তাই এত জরুরী। তামিমরা ২০০০ দশকের প্লেয়ার, ২০২০ এর দশকের সঙ্গে শারীরিক-মানসিকভাবে এডজাস্ট করার যোগ্যতা তাদের নেই। রাজ্জাক ৬০ বয়সেও কলেজ ছাত্রের চরিত্রে অভিনয় করতে পারে, ধূর্ত মিডিয়া আর কতিপয় সিস্টেমবাজ বোর্ড পরিচালকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তামিম-রিয়াদকে নিয়েও সেই হাস্যকর খেলা চলছে; বুড়ো ভাম, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কাণ্ডারি!
মোকসেদ: আপনার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। দুনিয়ার সব বুঝ আপনি একাই বুঝেন, অন্যরা ঘাস খায়
আমি:অন্যদের খাদ্য তালিকা তো জানি না, তবে তুমি যে ভুসি খাও সে ব্যাপারে অনুমান করা যাচ্ছে। ডেইরি ফার্মে ভর্তি হয়ে যাও, ভুসির চিন্তা ঘুচে যাবে।