কোনো এক প্রবাসী বড়ো আপুর সঙ্গে অনলাইনে চলছিল আলাপ। কথা প্রসঙ্গে বলেন- ‘তোমার বইগুলো পড়তে আমি বিশেষভাবে আগ্রহী। আমি নিশ্চিত তুমি গল্প-উপন্যাস লিখো না, হিউম্যান মোটিভ এনালাইসিস কর। মানুষের মোটিভ আর ফ্যাক্ট এনালাইসিস পড়াটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে নির্ঘাত’!
তার সাথে যখন কথা হচ্ছিল ততদিনে ‘চিন্তা এক্সপ্রেস’ জমা দিয়েছি প্রকাশককে। মানুষ কত বিচিত্র কারণে, একক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, অর্থ খরচ করে এবং তাদের প্রত্যাশা কী মূলত সেই এনালাইসিস করা হয়েছে কেইস স্টাডির মাধ্যমে।
তবে কি চিন্তা এক্সপ্রেস ‘মার্কেট ইকোনমিক্স’ বিষয়ক এনালাসিস? একদমই না। তখনই মনে পড়ে আপুর উল্লিখিত শব্দবন্ধটা- ‘হিউম্যান মোটিভ’
সচেতনভাবে এরকম কোনো চেষ্টা ছিল না, তবে বিভিন্ন স্তরের মানুষকে পর্যবেক্ষণের ব্যাপারটা যে ছিল তা তো নিশ্চিতই।
যাপিত জীবনে যাদের সাথে প্রায় নিয়মিত উঠা-বসা তাদের একজনও আমার কোনো বই পড়ে না, কেউ কেউ প্রথমদিকে চেষ্টা করত, লেখার বিষয়বস্তু আর লেখনীশৈলী আকর্ষণীয় না হওয়ায় ‘কঠিন’ আখ্যা দিয়ে আমার থেকে মুক্তি চেয়ে নিয়েছে।
তবে লেখার সূত্রে ২-৫ জন মানুষের সাথে আংশিক সখ্য গড়ে উঠেছে, যারা লেখা পছন্দ না করলেও ভালোবাসার খাতিরে বইটা সংগ্রহে রাখে।
তাই এবারের বইটা লেখাকালীন কেবলই প্রশ্ন জেগেছে- কী বলতে চায় আসলে চিন্তা এক্সপ্রেস? তখন প্রবোধ দিয়েছি এটা মূলত ‘ক্যারিয়ার কনফ্লিক্ট’ বিষয়ক বই। কত এক্সাইটিং, ইন্টারেস্টিং এবং ইন্টেলিজেন্ট প্রক্রিয়ায় উপার্জন করতে পারে মানুষ, তবু সে হয়তবা ক্যারিয়ারটা উপভোগ করতে পারছে না, কারণ আশপাশের বুদ্ধিমান অথবা বুদ্ধিহীন কোনো মানুষকেই বোঝাতে পারছে না পেশার স্বরূপ। এই সমাজে একটা শিশুর পিতৃপরিচয়হীনতা যেরকম কমপ্লেক্সটি তৈরি করে পেশার প্রকৃতিহীনতার জটিলতা কি তার চাইতেও বেশি নয়?
বই প্রকাশের সংবাদ অন্যদের সাথে শেয়ার কেন করি, কিসের আশা-ভরসায়? আমি তো জেনেই গেছি সোস্যাল মিসফিট, ড্রপ আউট, এনার্কিস্ট, সাইকোপ্যাথ, বেয়াদব, ইগোস্টিক কিংবা পারভার্ট শ্রেণির বাইরে সুস্থ্য-সামাজিক মানুষ আমার বই একদমই পছন্দ করে না, সময় আর অর্থনাশের উপলক্ষ ভাবে। শুষ্ক অভিবন্দন বাণী কোন পারপাসটি পূরণ করছে?
হয়তবা অতি সঙ্গোপনে প্রত্যাশা করি এসব লেখা পড়ে আগেরবারের চাইতে ৩ জন বেশি মানুষ নতুন বইটি সংগ্রহ করবে।
তাতে কী হবে আসলে? বাসা ভাড়া নিতে গেলে কিংবা ডাক্তার দেখাতে বা অফিসে গেলে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে আপনি কী করেন, এবং উত্তর দিই আমি একজন লেখক, দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাই- ১.আগে যতটুকু পাত্তা দিচ্ছিল মুহূর্তের মধ্যে পাত্তা বন্ধ ২. কোথায় লিখেন বা বই বিক্রি করে কি পর্যাপ্ত ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট পান।— কিন্তু যদি লেখক হিসেবে পরিচিতি থাকতো, ২ প্রতিক্রিয়ার কোনোটাই হয়তবা ভ্যালিড হত না আর।
চিন্তা এক্সপ্রেস বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সঞ্চিতা দে, এবং সারা বইতেই সঞ্চিতা নামের একজনকে পত্র লিখেছি, পত্রের মাধ্যমেই সমস্ত ফ্যাক্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছি। স্টাইলটা অত্যন্ত অনাকর্ষণীয়, সুখপাঠ্য তো নয়ই। তবে বই লেখার সময় এই স্টাইলটাই আমাকে ঘোরগ্রস্ত করেছিল। ঘোর ব্যতীত লেখা অসম্ভব আমার পক্ষে। বরং কৌতূহলী জিজ্ঞাসা হতে পারে প্রচ্ছদশিল্পী সঞ্চিতা দে আর চিঠিতে উল্লিখিত ‘সুপরিচিত সঞ্চিতা’ একে অপরের থেকে কতটা দূরত্বে অবস্থান করে, নাকি নৈকট্যই দূরত্ব!
বইটি প্রকাশককে দেবার পর ঘোষণা দিয়েছিলাম ৭৯ টাকা দিয়ে প্রি-অর্ডার করলে বিশেষ ছাড় পাবেন। ভেবেছিলাম অন্তত ৬৭ জন প্রি-অর্ডার তো দিবেই, বাস্তবে সংখ্যাটা মাত্র ১৪ জন। তাই প্রকাশককে রাজি করিয়ে উক্ত ১৪ জনকে ৩০% ছাড়ের বন্দোবস্ত করেছি। তাদের নাম প্রকাশনীতে ফরোয়ার্ড করেছি, আদর্শ প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ এ অর্ডার করে শুধু বলতে হবে সে একজন প্রি-অর্ডারকারী।
১৪ জনের মধ্যে ৪ জনের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল অল্পবিস্তর। তাই অনুমতির তোয়াক্কা না করে তাদের কপিগুলোতে চিঠি লিখে দিয়েছি স্মারক হিসেবে। নতুন করে যদি কারো খেয়াল জাগ্রত হয় চিঠি নিবে, সে Arichill এর ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করতে পারে।
গতকাল একটা রিক্রুটমেন্টে বলছিলাম আমার যদি ক্রিকেট নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাসিনেশন কাজ না করত হয়তবা জীবনে এচিভমেন্টের পাল্লা সামান্য ভারি হত, কারণ ক্রিকেট প্রচুর সময় খেয়ে দেয়। রাতে প্রশ্ন জাগে, যদি জীবন থেকে ক্রিকেট মাইনাস করে দেয়া হত আমি কি এখনকার মানুষ হতে পারতাম? ইমাজিনেশন, অবজার্ভেশন আর এন্টারপ্রেটেশন ক্ষমতার কারণে যে গুটিকয় মানুষ আমার উপর বিনিয়োগ করে সেইসব স্কিলের উৎস তো ক্রিকেটই। চিন্তা এক্সপ্রেস বইতে সেই প্রসঙ্গগুলোও স্থান পেয়েছে নানা ক্যাপাসিটিতে।
বাসায় বই আনার পরে কন্যা তেইশের উচ্ছ্বাস সহসা ভোলা কঠিন হবে, বইতে নিজেদের ছবি দেখে তার মন্তব্য- ‘বাবা এটা উনিশ-তেইশের বই, সবগুলো বই বাবা লিখেছে’! প্রতিটি বইতেই উনিশ-তেইশ স্থান পায় বর্ধিত বয়সে। আজ বই নিয়ে ওদের সাথে ছবি তুলবার ক্ষণে ভাবছিলাম ওদের বয়স যখন ৩৭ হবে, তখনও যদি সুস্থ্য-সবল থাকি ওরা কি নিজেদের বাচ্চা-কাচ্চাসহ ছবি তুলবে বাবার বইয়ের প্রচ্ছদে স্থান পেতে?
বইয়ের উপশিরোনাম- চিত্তবিত্তের নির্মাত্রিক লাটিম। চিন্তা এক্সপ্রেস লাটিম নাকি ঘুড়ি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলাম না, তবু যাত্রী হলাম; দেখি কতদূর যেতে পারি।
যারা চিন্তা এক্সপ্রেস কেনার ব্যাপারে ন্যূনতম আগ্রহ বোধ করছেন না তাদের প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা নিঃশর্তে উইল করে দিলাম। যারা ভুলবশত কিনেছেন বা কিনবেন অনাগত ভবিষ্যতে, তাদের প্রতি সমবেদনা।