২ দিন আগে সোস্যাল মিডিয়ায় একটা লেখা পড়লাম, এক শিক্ষিকা লিখেছেন তার ক্লাস থ্রি পড়ুয়া ছাত্র তার উদ্দেশে প্রেমপত্র লিখেছে।
কেজি বা প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন ম্যাডামের প্রেমে পড়ার মধ্য দিয়েই বাঙালি পুরুষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের প্রেমের হাতেখড়ি হয়, দীর্ঘদিনের ইন্টারভিউ অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি৷ আরেকটু বড় বয়সী শিশু বা কিশোরদের ফ্যান্টাসির কিংবদন্তীতুল্য ফিল্ম ‘ম্যালেনা’
৪০ বা ৪৫ এর পরে ঘড়ির কাঁটা বিপরীতমুখী হতে শুরু করে। তখনকার ফিল্ম হয় ‘ললিতা’!
সোস্যাল মিডিয়ায় পড়া ছোট্ট স্ট্যাটাস, আমার সামনে আনে ১৯৯৪ সাল, মানিকগঞ্জ মডেল স্কুল, এবং অনিবার্যভাবেই কবিতা ম্যাডাম!
কবিতা ম্যাডামকে পেয়েছিলাম মাত্র ১ বছর, এরপরই স্কুল বদলানোসূত্রে হারিয়ে ফেলি তাকে। তবে ২য় শ্রেণির এক শিশুর মনোজগতে তার ভয়েস গভীর এবং স্থায়ী প্রভাব রেখেছিল, যে কারণে অদ্যাবধি মানুষের ভয়েস আমার প্রথম আকর্ষণ।
জীবনের প্রথম লেখাও ম্যাডামকে ভাবতে গিয়েই, যদিও সেটা ছিল আধাভৌতিক গল্প, রোমান্টিক নয়।
৯৯ তে যখন জেমসের কন্ঠে শুনি ‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিয়ো না’, ৭ম শ্রেণিতে উঠে গেছি, লিখেছি ডায়েরি ভরতি ছড়া-কবিতা, নাটক এবং গল্প— কবিতা ম্যাডামের সঙ্গেও দেখা নেই ৫ বছর, কিন্তু কবিতা নামটা তখনো রয়ে গিয়েছিল মনের গহীনে কোথাও।
কবিতা ম্যাডামকে শেষ ৩০ বছরে দেখিনি কোথাও, হয়ত অবসরে গিয়েছেন। বেঁচে আছেন নাকি লোকান্তরিত, জানিও না।
‘ম্যাডাম ফ্যান্টাসি’ এর যে দীর্ঘ যাত্রা সেখানে তিনিই একমাত্র নন, অনেকের মধ্যে প্রথম।
নটরডেমে ইংরেজি ক্লাস নিতেন রিতা জোসেফিন ম্যাডাম। ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার ২ বছরই। পড়াশোনার প্রতি মন উঠে যাওয়ায় নটরডেমের কিছুই স্পর্শ করেনি, তবে রিতা জোসেফিনের ভয়েস এতোটা হৃদয়স্পর্শী ছিল তাকে চিঠি লিখতে শুরু করি। ডায়েরিতে জমে যায় ৭০-৮০টি চিঠি। পোস্ট করার দু:সাহস হয়নি তখনো। পরবর্তীতে বুয়েটের হল থেকে ডায়েরি সমেত চিঠিগুলো লাপাত্তা চিরতরে!
কলেজ ত্যাগের পরে ত্যাগের তালিকায় স্থান পায় সেও৷ তার পড়া ধরার নিজস্ব ধরন ছিল। হঠাৎ বলতেন রোল ৪৪ পড়া বলো, এরপরই আচমকা ১২৩; বহুবার চেষ্টা করেছি প্যাটার্ন বের করতে, সম্ভবত পুরোটাই রেন্ডম!
কবিতা ম্যাডামের মতো অব্যক্ত থেকেছে রিতা জোসেফিন ম্যাডামও।
তবে বুয়েটে দানে দানে ৩ দান হয়নি। ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে ডিপার্টমেন্টের স্যারদের পাশে এক তরুণীকে বসে থাকতে দেখে তার নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হই। এতগুলো চেয়ার ফাঁকা, সে স্যারদের পাশে কেন বসলো!
প্রোগ্রাম শেষে ইলেকট্রিক শক খাই যখন ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ডিপার্টমেন্ট ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব দেয়া হয় সেই আপাত নির্বোধ তরুণীকে, যিনি আদতে জুনিয়র লেকচারার, আমি বেকুবিবশত ভেবে বসেছিলাম ক্লাসমেট!
উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়ার পরে ডিপার্টমেন্টের চাকরি ছেড়ে দেয়ায় কার কী লাভ-ক্ষতি না জানলেও আমি পেয়েছিলাম দায়মুক্তির ছাড়পত্র।।তাকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, বইয়ের ক্যারেক্টার বানিয়েছি, এবং তাকে দিয়ে একটা বইয়ের প্রচ্ছদও করিয়েছি, যদিও সর্বশেষ ১২ বছরে দেখা মাত্র ১ বার!
আমার আর্গুমেন্ট ছিল যাকে শ্রদ্ধা বা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখি তার প্রতি রোমান্টিক অনুভূতি থাকবে না কেন, বাধাটা কোথায়?
সামাজিক অনুশাসন কি তৈরি করেছে কৃত্রিম কারাগার?
সুতরাং এই অনুশাসনকে চ্যালেঞ্জ করলাম।
২০১৬ তে পরিচয় হলো নতুন এক ক্যারেক্টারের সঙ্গে। বাচনভঙ্গিতে আভিজাত্য। পুরনো আর্গুমেন্টের জেরেই তাকে আপু বা অন্য কোনো সম্বোধন নয়, ম্যাডাম ডাকি, বাকি জীবনেও হবে না নড়চড়। আমার কয়েকটা বইতে তিনি আছেন ক্যামিও চরিত্র হয়ে। কোনোদিন কোথাও না পড়িয়েই তিনি কোন দৈববলে হলেন আমার ম্যাডাম, তার সেই কৌতূহল নিবৃত্তির দায়ই বোধ করিনি কোনোদিন!
কনটেক্সচুয়াল ইথিক্স নিয়ে লেখা সিগনেচার সরণ বইয়ের প্রোটাগনিস্ট একজন চিকিৎসক, শিশু বিশেষজ্ঞ।
তাকে বাছাই করার অনেকগুলো কারণের এটাও অন্যতম যখন জেনেছিলাম তিনি এসোসিয়েট প্রফেসর, অর্থাৎ ম্যাডাম!
ক্লাস থ্রি পড়ুয়া যে বাচ্চাটির গল্প তার ম্যাডাম আজ মজার ঘটনা হিসেবে লিখেছে, দুদিন পরে এই বাচ্চাই বড় হবে, আকৃষ্ট হবে সমবয়সী মেয়েদের প্রতি, তারপর স্মৃতিচারণ করে হাসবে৷
কিন্তু ম্যালেনা সিনেমার মতো কেউ কেউ বোধহয় থেকে যায় যারা অকস্মাৎ কবিতা ম্যাডাম বা রিতা জোসেফিন ম্যাডামদের শুধু স্মরণই করে না, লেখালিখির উদ্ভট উষড় চারণভূমিতে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবশত কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করে।
শ্রদ্ধার সঙ্গে রোমান্টিকতার অসমর্থিত দূরত্বকে তারা সর্পিল স্পর্ধায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বসে।
যে কারণে ম্যালেনা সিনেমায় সেই কিশোরের সংলাপ শুনি নিজের কন্ঠে-
I pedaled as fast as I could… as if I were escaping from longing, from innocence, from her. Time has passed, and I have loved many women. And as they’ve held me close… and asked if I will remember them I’ve said, “Yes, I will remember you.” But the only one I’ve never forgotten is the one who never asked… Malena.
রিয়েলিটি এবসার্ড ধারণা, এবং কার্যত একঘেয়ে। রিয়েলিটিকে রিক্রিয়েট করে নিতে পারলে তুচ্ছ এবং নিরর্থক ঘটনাবলীকেও চার্মিং লাগতে শুরু করে। মানবজনম কারাগারের আখড়া, ২০ থেকে ২৫রকমের কারাগারে সে বন্দী। রিয়েলিটি রিক্রিয়েট করার মাধ্যমে কারাগারের সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১৫-১৬ তে আনা যাচ্ছে, এও পরম তৃপ্তি!