জেনেসিস প্রি-স্কুল এর নাম শোনা দূরে থাক, চলতি পথে কখনো চোখেও পড়েনি, অথচ প্রায় ৫ বছর ধরে বসবাস করছি শ্যামলি এলাকায়, মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ এর সামনে দিয়ে মাসে অন্তত ৪-৫ বার যাওয়া পড়েই বিভিন্ন প্রয়োজনে; অবচেতনভাবেই দেখি কত স্কুলের বিজ্ঞাপন, বা লিফলেট। জেনেসিস এর সাথে সেসব অভিজ্ঞতাও হয়নি কখনো।
হয়তবা বিশেষভাবে আলাপ হবে বলেই আমরা পরস্পরের বিপরীত মেরুতে ছিলাম এতদিন। উনিশ-তেইশের স্কুলিংসূত্রে অবশেষে আমরা সংযুক্ত হলাম।
স্কুলিংয়ের ব্যাপারে আমার ফিলোসফি খুবই সরল। পারসোনালিটি এক্সচেঞ্জ এর প্লাটফরম হওয়া ব্যতীত স্কুলের আর উল্লেখযোগ্য কোনো উপযোগ নেই।
এক্সচেঞ্জটা কীরকম?
একটা স্কুলসূত্রে ৩০ জন একই বয়সের মানুষ একটা নির্দিষ্ট স্পেসে নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় সহাবস্থান করে। ৩০ জন মানুষ মানে ৩০ টি পৃথক পরিবার, যাদের শিক্ষা-দীক্ষা-জীবনবোধ-রুচি-নৈতিকতা ৩০ রকম; আপনি যখন সেই এক্সপোজার পাবেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ব্যক্তিত্বে নতুন কিছু উপকরণ যুক্ত হয়।
নামীদামী স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটি নিয়ে তীব্র ফ্যান্টাসি বা ফেটিশে ভোগাটা জীবনের অন্য যে কোনো চূড়ান্ত মিনিংলেস কর্মকাণ্ডের মতোই একটা।
তবু নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত ফেটিশের হেতু কী? এটা মূলত ‘ইজম’ থেকে উদ্ভূত। নামী প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হয় কঠোর কম্পিটিটিভ পরীক্ষার মাধ্যমে, একটা ফিল্টারিং হয়ে যায়, সেখানে যারা উত্তীর্ণ হয় তারা সমাজের সেটকৃত প্যারামিটারগুলোর ভিত্তিতে গড়ের চাইতে বেশি মেধাবী বা এডাপ্টিভ। চাকরি, ব্যবসা বা উচ্চশিক্ষা সর্বত্রই এদের প্রাধান্য থাকে, এবং এরা একটা লেগাসি তৈরি করে। ধরা যাক আপনি ঢাকা ভার্সিটি গ্রাজুয়েট, যা-ই করতে চান সেই সেক্টরে এলামনাই পাবেন, তাদের কেউ কেউ আপনাকে তথ্য-পরামর্শ-অভিজ্ঞতা দিয়ে মেন্টরিং করবে, আর্থিক সহায়তাও করতে পারে। আমি কোনো প্রতিষ্ঠানকে ছোট করছি না, তবু নিছক উদাহরণবশত বলছি, আপনি শেখ বোরহানউদ্দিন ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনা করেছেন, সেখানকার অনেক বেশি এলামনাই পাবেন না যারা দেশ-বিদেশে খুব সামাজিক সাফল্য দেখিয়েছে। তখন ইজম থেকে উদ্ভূত কানেক্টিভিটি বা নেটওয়ার্কিংয়ের এডিশনাল এডভান্টেজটুকু আপনি পাবেন না।
নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফেটিশ আদতে তাই একটি মিডিওক্রিটিক চিন্তা। আপনি যদি যথেষ্ট স্মার্ট এবং উদ্যমী হন, নিজেই নিজের রেফারেন্স হতে পারবেন।
উনিশ-তেইশের স্কুলিংয়ের ক্ষেত্রে আমার সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পলিসি রয়েছে-
প্রথমত, এক স্কুলে পড়াশোনার সর্বোচ্চ ব্যাপ্তি ২ বছর। কোনো কোনো স্কুলে ১ বছর পরই বদল আসতে পারে। এর কারণ হলো, দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার মানুষের অভিজ্ঞতার গল্প শুনে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছি। যাদের বাবা-মায়ের বদলির চাকরি সূত্রে ছোটবেলায় বছর বছর স্কুল বদলাতে হয়েছে তারা কোনোকিছুকে সহজভাবে দেখা, আবার এনালিটিকালি বোঝা ২ ক্ষেত্রেই সহজাত। কূপমণ্ডুকতা তুলনামূলক কম। তাদের পারসোনালিটিতে বৈচিত্রপূর্ণ উপকরণ তুলনামূলক বেশি থাকে। এক স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে একই গ্রুপ অব হিউম্যানের সাথে মিথস্ক্রিয়ার সুবাদে হয়তবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয় অনেক, কিন্তু ভাবনার স্পেসটা সেইভাবে বড়ো হয় না। কৌতূহল আর এক্সপ্লোরিং মানসিকতা তৈরিতে সহায়ক হয়
দ্বিতীয়ত, এসএসসি এবং এইচএসসি ব্যতীত কোনোরকম পরীক্ষায় ন্যূনতম গুরুত্ব না দেয়া। এমনকি ওই দুটো নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। তবু এ দুটোর উল্লেখ করার কারণ হলো, বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোর যে নকশা তাতে এই দুটো পরীক্ষার ফলাফল বাদে বাকি ক্লাসগুলোতে কে কী করেছে এর কোনোটাই ভার্সিটি পরীক্ষায় কাজে আসে না, বুয়েটে তো এসএসসিরও কোনো দাম নেই। ধরা যাক উনিশ-তেইশের ইচ্ছা হলো নামী প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা নিবে, কিন্তু ওই দুই বোর্ড পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করলো, অপশনটাই তো বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তাদের মনে না হয় বাবার খামখেয়ালিতে বুয়েট বা মেডিকেলে পড়া হলো না। যার যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হবে।
তৃতীয়ত, যেসব স্কুল-কলেজে ভর্তির জন্য প্রচণ্ড কম্পিটিশন, ভর্তি ফি ৫০-৬০ হাজার টাকা, এবং পড়াশোনা নিয়ে প্রচণ্ড সিরয়াস, সেসব কোনো প্রতিষ্ঠানে কখনোই ভর্তি করবো না। বরং সামাজিক বিচারে নাম-যশ নেই সেসব প্রতিষ্ঠানকেই প্রাধান্য দিব বরাবর। ওরা স্কুলে যাবে মূলত মিথস্ক্রিয়া আর সামাজিক বোঝাপড়া তৈরির স্যাম্পল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।
তবে কি উনিশ-তেইশ ক্যারিয়ারের বিষয়ে ক্যাজুয়াল? কখনোই নয়। অন্য যে কারো চাইতে ক্যারিয়ার সচেতন। সময় বদলে যাচ্ছে, পৃথিবীর মানচিত্রে আসছে সংস্কার; এত বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিল নিকট ভবিষ্যতে সেখানে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।
বিভিন্ন স্কিল তৈরি করুক, ক্রিটিকাল পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে শিখুক, নিজেদের ইউনিকনেস বুঝুক, অর্থ উপার্জনের জন্য এগুলোই যথেষ্ট। বরং জীবনের জার্নিটা উপভোগ করতে এমন অনেক কিছু লাগে যা স্কুল-টুল শেখাতে পারে না। সোস্যাল এক্সপেরিমেন্টই মানুষের শ্রেষ্ঠ স্কুলিং, যেসব প্রতিষ্ঠানকে আমরা শিক্ষা খাতের মহীরূহ বলি (স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি) এগুলোও শেষপর্যন্ত সুপারশপ বা সিনেপ্লেক্সের মডিফাইড ভারসন যেখান থেকে আমরা অর্থের বিনিময়ে চাহিদাকৃত পণ্য বা সার্ভিস কিনি। কারো চাহিদা প্রেস্টিজ, কারো স্বীকৃতি, কারো বা এম্বিশন।
আমার চাহিদা এক্সচেঞ্জ। সে লক্ষ্যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখে জানতে চেয়েছিলাম এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ঢাকায় আছে কিনা যেখানে এইসব প্রথাগত পড়াশোনাকে বেইল দেয়া হয় না। আমার মোটিভটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম ছোট্ট সে স্ট্যাটাসে। যে কারণে নালন্দা, সহজপাঠ আর বাতিঘর— এগুলোই ছিল ঘুরেফিরে সাজেশন।
বাচ্চাকে আমি তথাকথিত শিল্পমনা বা প্রগতিশীল বানানোর পরিকল্পনা করি না। আমার সার্কেলে সব পেশার মানুষ আছে, সবার সাথে কম বেশি হৃদ্যতা, কিন্তু কোনোপ্রকার কবি-সাহিত্যিক এবং শিল্পসংস্কৃতির মানু্ষের সাথে ঘনিষ্ঠতা নেই; তাদের সঙ্গ উপভোগ করতে পারি না। নালন্দা/সহজপাঠ বা বাতিঘর জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরেকটা শান্তিনিকেতন হবে বড়োজোর; এগুলোতে কেন আগ্রহ বোধ করব। তবু নিশ্চিত হতে কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলেছিলাম, এবং তার প্রেক্ষিতেই ওসব থেকে সরে গিয়ে নিতান্ত সাধারণ মানের স্কুল অন্বেষণ।
স্কাউটিংয়ের পুরো কাজটিই করেছে আরিফা। ওর মুখে বিভিন্ন স্কুলের অভিজ্ঞতা শুনে দুটোকে শর্টলিস্ট করি, দুটোতেই যাই, এবং তুলনামূলক বেটার ইউজার এক্সপেরিয়েন্সের ভিত্তিতে জেনেসিসকে চূড়ান্ত করি।
জেনেসিসকে ঘিরে একেবারেই বাড়তি প্রত্যাশা ছিল না। উনিশ-তেইশের চিন্তা এক্সচেঞ্জের জন্য x,y,z যে কোনো একটা স্কুল হলেই চলতো, জেনেসিস নিছকই দৈবচয়ন।
তবে গত ৫ জানুয়ারি প্রথমদিনের এডজাস্টমেন্ট ক্লাসে একটা ঘটনা আমার মনে রেখাপাত করে ভীষণভাবে।
একটা বাচ্চা কান্নাকাটি করছিল ক্রেজিভাবে, ম্যাডামরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না, অপেক্ষমান অভিভাবকদের অনেকেই বিরক্ত হচ্ছিল, বাচ্চাটার মা ও বিব্রত। এক বৃদ্ধ, সম্ভবত নাতি বা নাতনী কাউকে ভর্তি করেছেন, তিনি প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন, ওই বাচ্চাটার জন্য অন্য বাচ্চারা হয়ত ভয় পাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর মাস্ক পরিহিত একজন ম্যাডাম এসে অপেক্ষমান সকল অভিভাবকের উদ্দেশে বলেন- ‘আমি একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, প্রত্যেকটা বাচ্চার ইনডিভিজুয়াল ক্যারেক্টার থাকে, নিজস্ব বিহেভিয়ার প্যাটার্ন থাকে; সবগুলো আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু প্লিজ কোনো বাচ্চা নিয়ে কমেন্ট করবেন না, ওদের দেখার জন্য আমরা আছি, সমস্যা হলে আমরা টেক কেয়ার করব, ওরা এখন আমাদের রেসপনসিবিলিটি’
মাস্ক পরিহিত ম্যাডামের ফিলোসফি পছন্দ হয়, সেই মুহূর্তে অনুধাবন করি বাড়ির বাইরে উনিশ-তেইশের প্রথম সোসিও অফিসিয়াল গ্রুমিংয়ের জায়গা হিসেবে জেনেসিস হয়ত খারাপ পছন্দ নয়। জেনেসিসের প্রতি প্রত্যাশা তো অতি সামান্য। উনিশ-তেইশ বাসার বাইরে ঘন্টা দুয়েক থাকবে, এবং পরিবারের বাইরে ১-২ জন পরিণত বয়সের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হবে যাতে ওরা নিজেরা যখন বড়ো হবে স্মরণ করতে পারে অমুক ব্যক্তি শৈশবে ওদের ইমপ্রেস করেছিল। শৈশবে যারা মুগ্ধ হয় না তাদের প্রথাবদ্ধ জীবনের বাইরে ভিন্ন কিছু চিন্তা করতে বেগ পেতে হয়।
আমি বোধ করি জেনেসিস এ উনিশ-তেইশ সেরকম ফিলোসফিকাল ফিগার অন্তত একজন পাবে, এবং মাস্ক পরিহিত সেই ম্যাডামের ইন্টারভিউ নিয়ে রাখব সময়-সুযোগমতো। তার চিন্তাপ্রক্রিয়া ইন্টারেস্টিং হতে পারে।
আজ ছিল জেনেসিস এ ওরিয়েন্টেশন, অভিভাবকদের যেতে হত। জানলাম মাস্ক পরিহিত সেই ম্যাডামই স্কুলের প্রিন্সিপাল। সেই ১৯৯৫ থেকে তিনি টিচিং পেশায় আছেন, এবং প্রায় পুরোটা সময় বাচ্চাদের নিয়েই কাজ করেছেন, কখনো বড়দের স্কুলে চেষ্টা করেননি। ২৭ বছর পূর্বে যে বাচ্চাকে দিয়ে অভিষেক হয়েছিল ক্যারিয়ারে, সময়ের অতিক্রমণে সে নিজেই হয়তবা অভিভাবক হয়েছে কোনো বাচ্চার, কিন্তু ম্যাডাম তার জায়গায়ই রয়ে গেছেন। অর্থাৎ আরবান বাচ্চাদের ধরনে যে বিবর্তন ঘটেছে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এ সংক্রান্ত ইনসাইট-ইন্টারপ্রেটেশন তৈরিতে তিনি একজন পটেনশিয়াল রিসোর্স হতে পারেন। তার ভাবনাকে ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যতে বইও লিখতে পারি যদি চলতি বছরে আরো এপ্রিসিয়েটিং ফিলোসফির গল্প শুনি আরিফার মুখে। ইদানীং আরিফাও মানুষের চিন্তা আবিষ্কারে উৎসাহ বোধ করছে।
অভিভাবক সমাবেশে স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেদের অনেক বেশি অর্গানাইজড হিসেবে উপস্থাপন করবে এটা অনুমিত ব্যাপার৷ জেনেসিসও করে থাকতে পারে। যে কোনো বিজনেসেই প্রমোশন চালাতে হয়। এসব নিয়ে ভাবিত নই। আমি যে ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কনভিন্সড, প্রিন্সিপালের বাইরেও ২-৩ জন শিক্ষককে পর্যবেক্ষণ করেছি যাদের অন্তত ১ জনকে উনিশ-তেইশ পছন্দ করবেই।
আমি বরাবরই বিশ্বাস করি প্রজ্ঞা গুরুমুখী এবং মিথস্ক্রিয়ামুখী প্রক্রিয়া; বই-পত্র পড়ে কিছু জ্ঞান তৈরি হয়, প্রজ্ঞা নয়। আর্লি শৈশবে এই ধারার সাথে ওদের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়ে গেলে কোয়ালিটি মানুষের সান্নিধ্য লাভের সহজাত আকাঙ্ক্ষা ওদের মধ্যে স্থায়িত্ব পাবে। তাতে জীবনের জার্নিটা কখনো ক্লান্তিকর মনে হবে না।
কতদিন থাকবে ওরা জেনেসিস এ?
হয়তবা এবছরটাই।
তবু সময়গুলো থেকে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে শিখুক। অন্তত ১ জন শিক্ষকের ব্যাপারে বলুক- বাবা উই ক্যান ফিল!
বাকিটা জেনেসিস জানে!