১৮ বছর বয়সে (২০০৩-০৪ এর দিকে) একজন মানুষের সাথে খোশগল্প করেছিলাম (বা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বলা যায়), তিনি বলেছিলেন ‘একদিন সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়বো, এই বস্তুবাদী জীবন ভালো লাগে না’। সেই বয়সে এরকম ফিলোসফি খুবই এট্রাকটিভ এবং ইনফ্লুয়েন্সিং লাগার কথা, তার ওপর ১০-১১ বছর বয়সে গৌতম বুদ্ধের জীবনি পড়াসূত্রে জানতাম, ‘সংসারের প্রতি চরম উদাসীনতা দেখে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে করানো হয়, ১৯ বছর বয়সে রাহুল নামে এক সন্তানের পিতা হন; রাহুলের মায়া সংসারের প্রতি তাঁকে আরও আকৃষ্ট করে ফেলছে এই ভাবনায় তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন’। ফলে বাস্তব জীবনে যখন সত্যিই এরকম বিশ্বাস ধারণ করা একজনের সাথে কথা বলি, খুবই অবসেসড হই, ঘর ছাড়ার বাসনা তীব্রতর হয়।

সেই ভদ্রলোকের সাথে পরবর্তীতে আর কখনো দেখা হয়নি, তবে ১৯৯৯ থেকে ২০১৭- এই ১৮ বছরে আমি ২০০০+ জন আলাদা মানুষের সাথে খোশগল্প করেছি, মতান্তরে সাক্ষাৎকার নিয়েছি। মজার ব্যাপার হলো, ‘একদিন সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়বো’- এই কথাটা বলার মতো মানুষ অন্তত ৩০০-৪০০ জন পেয়েছি (বেশিও হতে পারে সংখ্যাটা); রিকশাওয়ালা, চাওয়ালা, মেথর যেমন এই ধরনের কথা বলে, তালিকায় ভার্সিটির টিচার, ব্যাংকের কর্মকর্তা, বড় ব্যবসায়ী, লেখক, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও আছেন। তাই ১৮ বছর বয়সে যে বয়ানে বিমোহিত-অভিভূত হয়েছিলাম, ৩০ বছরে এসে সেটাতেই মুচকি হাসি। কারণ এখন আমি কনফার্ম হয়েছি ‘বেরিয়ে পড়বো’ একধরনের মিডলক্লাশ সিনড্রোম বা অস্তিত্ববাদী ফ্যান্টাসি, যার মধ্য দিয়ে বিত্তশালী, চিত্তশালী বা নিরেট ভবঘুরে সব রকম মানুষই যায়; সবার মনের মধ্যেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ময়না দ্বীপ’ বিরাজ করে, এবং সেখানে যাওয়ার কৃত্রিম আহাজারির মধ্য দিয়ে সময় খরচ করে ফেলে অস্থি-হাড্ডির ভাগাড় হয়ে যায় একদিন।

আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত বই ‘প্রযত্নে-হন্তা’ (২০১১), সেখানে একটা গল্প ছিলো ‘গ,ল,হ; তবুও গলগ্রহ’ শিরোনামে। গল্পে একটি চরিত্র ছিলো, যাকে সবাই ‘মাধুকর দা’ নামে ডাকে। লোকটির বয়স ৪০ এর কাছাকাছি, সে সংসার ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিয়েছে, এজন্য ৭৩০ জন মানুষের ডাটাবেস তৈরি করছে। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে সে ২ বছরের জন্য বেরিয়ে পড়বে। প্রত্যেক পরিচিত মানুষের বাসায় ১ দিন করে রাত্রিযাপন করবে, সেখান থেকে আরেকজনের বাসায় যাওয়ার আগে হোস্টের কাছ থেকে যাওয়ার ভাড়া নিয়ে যাবে। এভাবে ২ বছরের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে সে ঘরে ফিরবে। গল্পটা লিখেছিলাম ২০০৯ এর দিকে, কারণ গৌতম বুদ্ধের প্রভাবে আমি নিজেও সেরকম এক বোহেমিয়ান জীবনের সংকল্প নিয়েছিলাম ১০ বছর বয়সে, যেটা ৩০ বছর পূর্ণ হলে কার্যকর করার কথা ছিলো। এবছর ৩০ হওয়ার পর থেকেই একদম মুক্ত মানুষ মনে হয়, মাধুকর দা এর মতো ৭৩০ জন যোগাড় করা আমার জন্য খুব বড় সমস্যা নয়, কিন্তু ‘একদিন বেরিয়ে পড়বো’ এই ফিলোসফিটা এতো বেশিসংখ্যক মানুষের মধ্যে লালিত-পালিত হয় যে, এক পর্যায়ে এটাকে সেলফ হিপোক্রেসির চাইতে বেশি কিছু মনে হয় না। একটা ইমপ্যাক্টফুল লাইফ লিড করা অনেক কঠিন, বোহেমিয়ান হওয়ার মতো নির্বিকারত্ব অর্জন সে তো কবেই হয়ে গেছে, নিরুদ্দেশ যাত্রা করে নির্বাণ বা মোক্ষলাভের চিন্তায় নিজের সাথে প্রবঞ্চনা থাকতে পারে, প্রকৃত প্রাপ্তির ঘরে ডাবল জিরো। ঘোষণা দিয়ে ঘর ছাড়া একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম, বা নিজেকে প্রবোধ দেয়া যে লাইফ ইজ সামহোয়ার এলস! কিন্তু লাইফ আসলে লাইফের মধ্যেই থাকে, অন্য কোথাও বলতে কোনো জায়গা নেই, সেটা নিজের অক্ষমতা জাস্টিফিকেশনের একটি নড়বড়ে ঘাঁটিমাত্র।

‘একদিন বেরিয়ে পড়বো’- এই সিনড্রোমে মানুষ আক্রান্ত হয় কেন, এটা নিয়ে ভাবাভাবি চলে প্রায়ই। ‘সিনড্রোম’, ‘আক্রান্ত’ প্রভৃতি কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করাটা একটু কর্কশ হয়ে যাচ্ছে, আরেকটু মোলায়েম হওয়া উচিত। তার চাইতে ফ্যাসিনেশন বা ইমাজিনেশন অনেক সাবলীল লাগে। কর্কশ বা মোলায়েম যেটাই হোক, সারকথা হচ্ছে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ জীবনভর ‘একদিন সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়বো, জীবন অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে’ মানসিকতা নিয়ে কাটিয়ে দেয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রেসপনসিবিলিটি বাড়ে, বন্ধন দৃঢ় হয়, শেকড়-বাকড় আকড়ে ধরতে থাকে, বের হওয়াটা শেষ পর্যন্ত নিছক বেড়ানোতে গিয়ে ঠেকে। একটা জীবন শেষ করে ফেলার পরও বের হওয়া হয় না, এ নিয়ে আফসোসই বাড়ে কেবল। এই দ্বিত্ব বা ডুয়েলিটি বহন করার কারণ কী তাহলে?

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, প্রাণী হিসেবে নিজের ক্ষুদ্রতা আর অসহায়ত্বের বিপরীতে অজস্র অমীমাংসিত প্রশ্ন, এম্বিগুইটি আর বস্তুবাদী পৃথিবীর সতত সম্প্রসারণশীল চাপের সাথে সঙ্গতি মেলাতে না পেরে সত্তার এক অন্তহীন ভয়েড বা শূন্যতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় মানুষ, যাকে শাব্দিকভাবে আমরা অস্তিত্ব সংকট বলে অভিহিত করি। কিন্তু শব্দটা শুনতে যতো ভারি, এর তাৎপর্য তার চাইতেও বহুগুণ। আগে মানুষ দেখেছি, তারা কোথায় চলে গেল, যাদের দেখিনি তারা কোত্থেকে এলো, কয়েকদিন আগেও স্কুলে যেতাম, এখন রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছি- এই যে গোলকের ক্রমঘূর্ণায়মান দশা, এর মধ্যে একজন মানুষ নিজেকে ফিট করবে কোথায়, যে কোনো চিন্তাশীল এবং সেনসিবল মানুষ এতোসব জটিলতার মধ্যে ত্রাহি মধুসূদন দশায় পড়ে যাবে। এবং সেজন্যই প্রয়োজন পড়ে বস্তুবাদীতার। খাও, দাও, ফূর্তি করো, এবং পরেরটা পরে দেখা যাবে- এই দর্শন যখন একসেপ্ট করে নেয়া যায়, জটিলতা অনেক কম মনে হয়। লিভিং ফর এ পারপাস- এই কথাটা তখন ভেক মনে হবে। আমি জীবনে অন্তত ৭০০ জন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনার জীবনের পারপাস কী, ৫০%ও পাইনি যারা প্রশ্নটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছি, গড় প্রবণতা ছিলো, ভাবুক বা ইমপ্র্যাকটিকাল মানুষেরা এইসব আজাইরা প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামায়, এমন।

জীবনের অর্থহীনতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং কঠোর বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো মানসিক শক্তির অভাব- এই দুই প্যারাডক্সিয়াল সিচুয়েশনই মূলত ‘বেরিয়ে পড়বো’ প্রবণতাকে ধারণ করে থাকে। যে মানুষগুলো মনে মনে অনেক বড় কিছুর স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সেটা অর্জন করার জন্য অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করার মতো মানসিক-শারীরিক প্রস্তুতি রাখে না, তারাই প্রবোধ হিসেবে এটাকে মনের মধ্যে জিইয়ে রাখে। এটা দিয়ে তারা আসলে নিজেদের কনভিন্স করতে চায়। পরিবার. দায়িত্ব, বন্ধন প্রভৃতিকে বাহানা হিসেবে দাঁড় করায়, এবং সমগ্র জীবনটাই তাদের কেটে যায় বাহানার সাথে মিছে বচসার মিটমাট করতে করতে।

আরেকটা বড় কারণ বাউলিয়ানা এবং আরামপ্রিয়তা। পৃথিবী জুড়েই বাউলিয়ানা নানা রূপে বিরাজ করে, তাদের লাইফস্টাইল, বক্তব্যকে অনেকের কাছে লোভনীয় লাগে। গৃহী জীবনকে মনে হয় খাঁচাবন্দী, এক ধরনের দোটানা কাজ করে; এ ধারে নাকি ও ধারে – কোথায় যাবো!

‘বেরিয়ে পড়বো’ মানসিকতার মানুষদের মধ্যে চারপাশ নিয়ে, জীবনব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা প্রভৃতি নিয়ে গভীর হতাশা কাজ করে। তারা এক ইউটোপিয়ান পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে, সেখানে তাদের ভূমিকা কী হবে, বা কতদিনের জন্য বেরিয়ে পড়বো, কেন পড়বো, এসব প্রশ্নের দার্শনিক কোনো উত্তরও তাদের জানা থাকে না। বরং বস্তুবাদী মানুষদের জীবনবোধ, আর যাপিত জীবন নিয়ে এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল বিদ্রুপ করে তারা প্রশান্তি লাভ করে। এই ধরনের মানুষের মনোজগতে ‘বস্তুবাদীতা’ এক ধরনের গালি বা ক্রাইম। অথচ বস্তুবাদীতা, বিলাসীতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা প্রতিটি কনসেপ্ট যে আলাদা এবং বড় স্কেলে পার্থক্যসূচক, সেটা নিয়ে ভাবার চাইতে ‘এই যান্ত্রিক জীবন আর ভালো লাগে না, বেরিয়ে পড়বো, জীবন দেখবো’- এই শ্লোগানকে শাণিত করাতেই যেন সার্থকতা। যেহেতু আমি ২০০০+ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি ১৮ বছরে, আমি দেখেছি ঘুষখোর, লম্পট, ব্যভিচারী, সন্ত্রাসী প্রভৃতি খারাপ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের ফিলোসফিকাল ক্রাইসিস আছে, ভোগবিলাসে মত্ত মানুষটিও গভীর জীবনবোধ দ্বারা তাড়িত হয়। সে হয়তো নির্বিকার হতে পারেনি বা হতে চায়নি, মোটা দর্শনের বই পড়েনি, বা দ্যরিদা, ফুঁকো, রুশোর কোটেশন জানে না, সিম্পলিসিটিকে তাচ্ছিল্য করেছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেও ভীষণ অন্যরকম একটা জগতকে এক্সপ্লোর করছে, যেটা আপাত অবস্তুবাদী মানুষেরা নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ ভাবনা থেকে বেরোতে না পেরে ধরতে পারেনি।
ইগো, শো-অফ, স্বস্তামি, ইতরামি এইসব নেগেটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট আছে বলেই পৃথিবীটা বাসযোগ্য লাগে, জীবনটাকে অদ্ভুত ঠেকে। সত্যি বলছি, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব মানুষের জীবনে নেই, এগুলো সবই ‘বেরিয়ে পড়বো’ মানসিকতার বিপন্ন কোনো কবির ডিফেন্স মেকানিজম।

সময় হিসেবে ২০ বছর যথেষ্টই দীর্ঘ, অন্তত যার বয়স ৩০ তার জন্য তো বটেই। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময়ই আমি আচ্চন্ন ছিলাম আশ্রমে যাওয়ার ফ্যান্টাসিতে। যেহেতু ৩০ এ পৌঁছে গেছি, যে কোনোদিন আশ্রমে চলেও যেতে পারি, কিন্তু গিয়ে আসলে কোন্ উদ্দেশ্যটা পূরণ হবে? একদিন নিজের অজ্ঞাতে পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার একদিন হারিয়ে যাব আমার পূর্বপুরুষদের মতো করে; কাজেই মধ্যবর্তী সময়টুকু এক্সপেরিয়েন্স আর এক্সপ্লোর করি, আশ্রমে গিয়ে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে সত্তার অমার্জনীয় অপচয়ের চাইতে আর কোনো প্রাপ্তিযোগ আদৌ কিছু আছে বলে মনে হয় না।

‘বেরিয়ে পড়বো’- ধারণা পোষণা করা মানুষেরা আদতে প্রচণ্ডরকম অসুখী আর ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষ। তারা দায়িত্বকে বোঝা মনে করে, প্রায়োরিটি পেতে চায় সর্বোচ্চ পরিমাণে, এবং অন্যদের ব্যাপারে অতিমাত্রায় উদাসীন থাকে। ফলে আমিত্বের বিশাল ডাইনোসর তার ভেতরে বড় হতে থাকে, বিলুপ্ত হওয়ার আগেও সেই ডায়নোসর গ্রাস করতে চায় যেন। সাবজেক্টিভিটি আর অবজেক্টিভিটির মধ্যকার চিরন্তন দ্বন্দ্বে সে গিরগিটির মতো ক্রমাগত অবস্থান বদল করে। এক জীবনে সে যতটুকু পৃথিবী বা জায়গা দেখে, তার চাইতেও বহু বড়ো তার কমফোর্ট জোন। সেই জোনের আঁধারে ঢাকা মেঘ ভেদ করে সূর্য উকি দেয় না কখনো।

তাহলে ‘বেরিয়ে পড়বো’ এই হাপিত্যেশ কেন? সম্ভবত বাজারে যাওয়ার আলসেমি থেকে বাঁচতে, বা পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি বা ত্রিশ পেরুনো নারীটির চোখে ব্যতিক্রমী সাজার অভিলাষে। জোকস এপার্ট, বেরিয়ে পড়া আসলে এমন তুচ্ছ বা লঘু ব্যাপারই, একে মহিমাণ্বিত করতে চাওয়া অনেকটা ভূট্টা ক্ষেতে ইক্ষুবিপ্লবের মতো ব্যাপার।

মানুষ বাই ন্যাচার হিপোক্রেট, নিজেকে দিয়ে এটা সবসময়ই বুঝি। একটা হিপোক্রেট ক্লাব করতে পারলে মন্দ হতো না, যাদের কথা আর কাজের মধ্যে কোনোই মিল থাকবে না। ফুরিয়ে যাবার আগে, বুড়িয়ে যাওয়ার পরে অন্তত এটুকু স্মৃতিচারণ করতে পারবো, কী ভীষণ দুর্দান্ত এক হিপোক্রেট জীবন পার করে দিলাম নিঃসঙ্কোচে। পরবর্তী পৃথিবীতে রেখে যা্ওয়ার মতো কিছু যেহেতু খুঁজেই পাচ্ছি না, কিছুটা হিপোক্রেসিই জমিয়ে রাখি।

হিপোক্রেসি লাগবে, হিপোক্রেসি? খুচরা, পাইকারী, ভাঙতি, চলতি সবরকম হিপোক্রেসি, একেবারে জলের দরে…………