টি২০ বিশ্বাকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা আমার সামাজিক সমীক্ষণে দুর্দান্ত সহায়তা করেছে। আমার হাইপোথিসিস ছিল তরুণ এবং মধ্যবয়সী বাঙালিদের এথিকাল সেন্স অতি দুর্বল, যার খেসারত দিতে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, সর্বত্র। সামষ্টিকভাবে দুর্বল এথিক্স তৈরির কারণ কী?
প্রথমত স্যাডিস্ট মানসিকতা, অর্থাৎ কারো দূরাবস্থা দেখলে প্রকাশ্যে অথবা পরোক্ষে আনন্দ বোধ করা।
দ্বিতীয়ত, ‘তাতে আমার লাভ কী’ জাতীয় কথা-বার্তাকে মুদ্রাদোষ বানিয়ে ফেলা। খেয়াল করে দেখবেন যে কোনো আর্গুমেন্ট বা ডিসকাসনে ‘লাভ কী’ ফ্রেজটা আসবেই এক পর্যায়ে।
এথিক্স সেন্সের সাথে এই দুই কারণের কোরিলেশনটা কী, এবং এদের মূল উৎসটা কোথায়, উপলব্ধিতে আরো দীর্ঘদিন ব্যয়িত হয়ে যাবে নিশ্চিত।
কিন্তু এর সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ দিয়ে এথিক্স সেন্স পরিমাপ কতটুকু যৌক্তিক? ক্যাপিটালিস্ট এবং ইনডিভিজুলিস্ট পৃথিবীতে স্পোর্টস এ পুরোপুরি অনাগ্রহী যুবাশ্রেণিদের বিরাট অংশ, ক্যারিয়ারচিন্তার বাইরে হয়তবা সকল কিছুর প্রায়োরিটিই তলানীতে। স্পোর্টস নাহয় ফলো করে না, কিন্তু সিনেমা, মিউজিক, ভিডিও টিউটোরিয়াল, টেকনোলজি, ভারচুয়াল গেম কোনোটাই কি কনজিউম করে না? উল্লিখিত ফিল্টারের কোনো একটাতে একুশ শতকের মানুষকে আটকা পড়তে হবেই। এগুলো সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্ন ভোগবাদীতা তো বটেই। ভোগবাদীতার সুবিস্তৃত কারেন্টজালে ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকারূপে ধরা পড়ি আমি, আপনি, আমরা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের পূর্বে অসংখ্য ফেসবুক পেজ এবং মধ্যমসারির কিছু ই-কমার্স একযোগে ঘোষণা করে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান লিটন দাস যত রান করবে তাদের প্রোডাক্টে তত পারসেন্ট বা টাকা ডিসকাউন্ট। পলিসিটির ব্যাকগ্রাউন্ড ঘুরে আসা যাক। টি২০ তে লিটন দাস ২০২১ সালের প্রায় পুরোটাই স্ট্রাগল করছে। বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরে ৩ ইনিংসের কোনোটাতেই সিঙ্গেল ডিজিট পার করতে পারেনি, একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হোম সিরিজে ৫ ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোর ৩৩, এবং ৩টাতেই আউট হয়েছে সিঙ্গেল ডিজিটে। বিশ্বকাপেও প্রথম ৫ ইনিংসে সর্বোচ্চ ২৯ সহযোগি সদস্য পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে, এবং এখানেও ৩ ইনিংসে সিঙ্গেল ডিজিটে আউট। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে শ্রীলংকার বিপক্ষে মূল পর্বের প্রথম ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ সময় দুটি ক্যাচ ড্রপ করা, যা বাংলাদেশের হারার ক্ষেত্রে মূল ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে দলীয় খেলায় খারাপ পারফর্ম করলে যত বড়ো তারকাই হোক, সমর্থকরা রোষবশত তাদের রসাতলে পাঠাবে, ভালো পারফর্ম করলে মাথায় তুলে রাখবে। অর্থাৎ বিনোদন তারকাদের বসবাস পুরোপুরি ভিন্ন এক স্বতন্ত্র পৃথিবীতে যেখানে অন্য পৃথিবীর ভোক্তাদের সাথে একমাত্র ডিলিংস ‘প্রত্যাশা পূরণ’। ভোক্তাদের অন্তহীন প্রাপ্তিক্ষুধা, যতদিন মেটাতে পারে সে মার্কেটে রাজত্ব করে, অর্থ-বৈভবের মধ্যে হাবুডুবু খায়; ক্ষুধা মেটাতে ব্যর্থ হলে ভোক্তা আপনাকে খুবলে খেয়ে মেটাবে ক্ষুধার জ্বালা। পেলে-ম্যারাডোনা, টেন্ডুলকার-ওয়াসিম আকরাম, মেসি-রোনালদো সকলেই ভোক্তাক্ষুধার নিয়তিতে বন্দী। এমনকি ভোক্তাক্ষুধায় প্রাণ হারানোর দৃষ্টান্তও রয়েছে। সম্ভবত কলম্বিয়ার এক ফুটবলার বিশ্বকাপে ভুলবশত আত্মঘাতী গোল দেয়ার কারণে সমর্থকদের গুলিতে নিহত হয়েছিল।
খেলোয়াড়রা এটা জেনেই মাঠে নামে।
তবে ভারতীয় উপমহাদেশের বেল্টে (ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ) ধর্মীয় আইডেন্টিটির রাজনীতি নিয়েও ডিল করতে হয়। ইউরোপ বা আমেরিকায় চামড়ার রঙ যেমন সাংঘাতিক রাজনীতি হয়ে উঠে, তার চাইতেও এখানেও ভয়ানক হয়ে উঠে ধর্মীয় রাজনীতি। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ চলতি বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। ভারত তাদের প্রতিবেশী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০ উইকেটে হেরে গেছে। পাকিস্তানের জয় উদযাপন করায় স্কুল শিক্ষিকা চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে। সমগ্র ভারতীয় দর্শক ফুঁসছে, বিশ্বকাপ জিতলেও সম্ভবত তা প্রশমিত হবে না। রোহিত শর্মা, কেএল রাহুল, ভুবনেশ্বর সহ অনেক ক্রিকেটার খারাপ পারফরম্যান্স করেছে; তাদের বাদ দেয়ার দাবি তোলা হচ্ছে, নানা তীর্যক মন্তব্য ছুটে আসছে চারদিক থেকে। ওই ম্যাচের আরেকজন বাজে পারফরমার মোহাম্মদ শামি, যিনি ভারতকে অসংখ্য ম্যাচ জয়ে অবদান রেখেছেন। কিন্তু যেহেতু তার ধর্মীয় আইডেন্টিটি ভিন্ন তথা মুসলিম যা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাথে মিলে যায়, হারামাত্র তাকে সমর্থকেরা পাকিস্তানের চর আখ্যা দিচ্ছে।
অনুরূপ দৃষ্টান্ত পাই ২০১৯ এ বাংলাদেশ-ভারতের গোলাপী বল টেস্টে। সেই ইনিংসে বাংলাদেশের দুজন ব্যাটসম্যান মাথায় আঘাত পেয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে- উইকেট কিপার লিটন দাস এবং স্পিনার নাঈম হাসান। কিন্তু যেহেতু লিটন সনাতন ধর্মাবলম্বী, তাই ফেসবুকজুড়ে দেখতে পাই লিটন ভারতকে জেতানোর উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত মাঠ থেকে উঠে গেছে।
যে কোনো খেলায় খারাপ পারফরম্যান্স হবেই, কোনো কোনো প্লেয়ারের দীর্ঘ ব্যাডপ্যাচও আসে। মাশরাফি, তামিম, সাকিব বা যে কোনো প্লেয়ার খারাপ খেললে তারাও ট্রলের শিকার হয়। কিন্তু লিটন দাস বা সৌম্য সরকার খারাপ করলে অন্যান্য রুটিন ট্রলের চাইতেও অনেক বেশি শুনতে হয় ‘মালাউনের বাচ্চা, কোটার প্লেয়ার’ প্রভৃতি অশালীন এবং আপত্তিকর অভিযোগ।
এই উপমহাদেশের সিংহভাগ মানুষের সংবেবদনশীলতার জায়গা ধর্মীয় অনুভূতি। অন্য যে কোনো ইস্যুর চাইতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তারা ক্ষুব্ধ এবং মনোঃক্ষুন্ন উভয়ই হয়। আপনি সংখ্যাগুরু বলে ধর্মীয় অনুভূতির সোল-ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিয়েছেন, সংখ্যালঘুর ধর্ম বানের জলে ভেসে গেছে— এটা অসভ্য এবং কুরুচিপূর্ণ মানসিকতা।
ফিরে আসি লিটন দাস প্রসঙ্গে। টানা অফ ফর্ম, এবং শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচ হারায় ভূমিকা রাখা মিলিয়ে সমর্থকরা তার উপর তেতে আছে। অন্যদিকে মাত্র ৮-১০ দিন পূর্বেও দেশ সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন ইস্যুতে উত্তাল ছিল, তার রেশ কাটেনি পুরোপুরি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, অনিরাপত্তা আর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এরকম পরিস্থিতিতে বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং ফেসবুক পেজগুলোতে একযোগে লিটন দাস অফার দিল।
উদ্দেশ্যটা কী?
লিটনের অফফর্ম, সংখ্যালঘু ইস্যুর অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বিক্রি বাড়ানো। অনলাইনে আমি কোনো পেজ, প্রোফাইল কিছুই ফলো করি না, ফলে ব্যাপারটা জানতাম না একদমই। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিংকালে যখন সাময়িক স্ট্যাটাস লিখি ১-২ লাইনের, সেখানে কমেন্টসূত্রে জানতে পারি লিটন দাসের রানের উপর ম্যাচের পূর্বেই অফার দিয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান/পেজ। অত্যন্ত অরুচিকর লাগে। কিন্তু অপেক্ষায় থাকি পাবলিক রিএকশনের। ফেসবুকে আমার বন্ধুসংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি, এদের মধ্যে যারা ক্রিকেট নিয়ে লেখালিখি করে তাদের প্রোফাইল চেক করলাম, বিষয়টা নিয়ে কিছু লিখছে কিনা। কেউ লিখেনি। সিদ্ধান্ত নিই ম্যাচের রেজাল্ট যা-ই হোক, লিটন ১০ করুক বা ৪০, এটা নিয়ে লিখতে হবে। যথারীতি লিখি। লিটনের স্ত্রী সঞ্চিতা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড, লেখাটাতে তার রিএকশন দেখতে পাই এবং আমার লেখার ঘন্টাখানেক পরে কয়েকজন অনুরাগী ইনবক্সে তার স্ট্যাট্যাসের স্ক্রিনশট পাঠায়।
অর্থাৎ এই জঘন্য এক্টিভিটি যে লিটনের পরিবারকেও মর্মাহত করেছে, স্পষ্ট হয়। অন্যদিকে ঢাকা পোস্ট, ডেইলি বাংলাদেশ সহ আরো কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে দেখতে পাই লিটন অফারে দুর্দান্ত সাড়া পাওয়া গেছে, লিটনের স্ত্রীর ক্ষুব্ধতার সংবাদ এসেছে, কিন্তু বিজনেস এনটিটি থেকে এ ধরনের কর্মকান্ড কতটা এথিকাল সেই প্রশ্ন পেলাম না, বরং একেও বৈধতা দেয়ার জন্য যুক্তি হাজির। তারা বলছে ভারতীয় পুলিশ নাকি বিলবোর্ড এ নো-বল এর ছবি দিয়ে বলেছে অসাবধানতা থেকে কতবড় দুর্ঘটনা হতে পারে।
যুক্তির বাহারে আমি স্তম্ভিত! প্রথমত, নো-বল এর কারণে ভারতীয়রা ম্যাচ হেরেছে, তার সাথে কোরিলেট করে মানুষকে সতর্কভাবে রাস্তা পার হতে বলেছে; সেখানে কি সুনির্দিষ্ট কোনো ক্রিকেটার সম্বন্ধে বলা হয়েছে? অনেক সময় ভারতীয় দলকেও ট্রল করে কোনো কোনো কোম্পানি, সুনির্দিষ্ট ক্রিকেটার যার ব্যাডপ্যাচ চলছে এবং দেশ সংখ্যালঘু ইস্যুতে টালমাটাল, সেরকম কোনো দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন কেউ?
এর চাইতেও প্যাথেটিক অভিজ্ঞতা আমার সেই স্ট্যাটাসের কমেন্ট সেকশন, ইনবক্স এবং হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। দীর্ঘদিন ধরেই আমার প্রোফাইলে পাবলিক কমেন্ট বন্ধ, মিউচুয়াল ফ্রেন্ড না থাকলে বাইরের লোকেরা কমেন্ট করতে পারে না। তবে ইনবক্সে মেসেজে বা হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে তো সে নিষেধ নেই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অধিকাংশ মানুষ লিটন অফারকে সমর্থন করছে। কেউ কেউ লিটনের স্ত্রীর স্ট্যাটাস শেয়ার করে ক্যাপশন লিখছে- এসব সমালোচনা সহ্য করতে না পারলে খেলার কী দরকার! কেউ কেউ এক কাঠি সরেস হয়ে লিখছে- ব্যাপারটা উল্টোভাবে দেখলেও তো হয়, লিটন যাতে রান করে সেজন্য কোম্পানীগুলো উৎসাহ দিচ্ছে।
আরেক দল বলছে- ফান করেছে, এত সিরিয়াস হওয়ার দরকার কী! আরেক গ্রুপ লিটনের প্রতি আমার বায়াসনেসকে ইঙ্গিত করছে। আমার প্রোফাইল অনুসরণ করা যে কোনো ক্রিকেট অনুসারী জানে লিটনের ব্যাটিং দেখতে পছন্দ করি, এবং সে ঘরোয়া বা ইন্টারন্যাশনাল যেখানেই রান করুক,ইনিংসটা যদি দেখি তার বিপরীতে মানুষকে উপহার দিই; এভাবে গত কয়েক বছরে ১৫-১৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছি লিটনের পারফরম্যান্সে। পক্ষান্তরে ইমরুল কায়েস, ২০১৯ বিশ্বকাপ পরবর্তী তামিম ইকবাল (ওয়ানডে, টি২০), মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (সব ফরম্যাট) কে জাতীয় দল থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য লেখালিখি করি। যে কারণে তাদের বক্তব্য হচ্ছে অফারটা যদি লিটনের বদলে রিয়াদ বা অন্য ক্রিকেটারকে নিয়ে দেয়া হত রিএক্ট করতাম কিনা। ২-১ জন ইনবক্সে লিখেছে আকাশ ডিটিএস তো মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ এর রান নিয়ে অফার দিয়েছে, সেটা নিয়ে কিছু বললেন না তো। তাকে বললাম খেলা চলাকালে আকাশ ডিটিএস এর বিজ্ঞাপনে মাহমুদুল্লাহ বা মুশফিককে দেখেছেন কিনা, তার মানে আকাশ মুশফিক-রিয়াদের সাথে চুক্তি করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান লিটনকে নিয়ে অফার দিয়েছে তাদের ১ জনের সাথেও লিটন চুক্তিবদ্ধ, নজির দেখাতে পারবেন? কপিরাইট সম্বন্ধে আইডিয়া আছে, কিংবা মানহানি মামলা সম্বন্ধে ধারণা রাখেন? কিছুই জানেন না অথচ রেফারেন্স নিয়ে হাজির, আপনাদের দেখেই বুঝি এদেশের মানুষ কতটা নির্লজ্জ এবং স্যাডিস্ট। সে প্রত্যুত্তর করে- আপনাকে অনেক অন্যরকম ভাবতাম, এখন দেখছি কোনোরকম ভদ্রতাজ্ঞানই নেই!
অথচ এতজন মানুষ যাদের বয়স ২০ থেকে ৪৫ সীমায়, কাউকেই বোঝাতে পারলাম না সমর্থকদের ট্রল আর প্রতিষ্ঠানের ট্রল দুটো আকাশ-পাতাল তফাৎ; আপনি ২ হাজার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মিঠুন, লিটন, সৌম্য, সাকিব, পাপন যাকে ইচ্ছা গালিগালাজ করতে পারেন; তাতে ক্রিকেট টিম কিছু স্পন্সর হারাবে, এর বেশি কিছু নয়। কিংবা লর্ড, স্যার, ষাঁড়, ব্রো সহ হাজারো উপমা তৈরিতেও নিজের প্রতিভা খরচ করতে পারেন। ক্রিকেটাররা এগুলো মেনেই খেলতে নামে, প্রতিটিতে কর্মখাতে প্রফেশনাল হ্যাজার্ড থাকে, বিনোদনকর্মীদের ক্ষেত্রে আপনার/আপনাদের ট্রলগুলো সেই প্রফেশনাল হ্যাজার্ড।
কিন্তু আপনার এই বন্ধুরাই যদি একটি ট্রেড লাইসেন্স করেন পণ্য বা সার্ভিস বিক্রির বিপরীতে, আপনি বাসাকেই অফিস বানিয়েছেন নাকি বহুতল ভবন ভাড়া নিয়েছেন অফিস হিসেবে ম্যাটার করছে না, আপনার তখন পৃথক প্রটোকলে ঢুকতে হবে। ঢাকা শহরেই কিছু জায়গায় দেখবেন রেসিডেন্টশিয়াল এরিয়া লেখা, আবার কিছু জায়গাকে কমার্শিয়াল এরিয়া লেখা। ট্যাক্স দেবার সময়ও ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানের নিয়ম আলাদা। এমনকি আপনারা দুই ভাই যদি একই অফিসে চাকরি করেন এবং ডেজিগনেশন আলাদা হয়, বাসা আর অফিসের আচরণে বিশাল পার্থক্য! যে কারণে আপনি দিন-রাত অমুক মন্ত্রী, তমুক নেতাকে শাপ-শাপান্ত করলেও অফিসের প্যাডে বা প্রচারণায় সেটা লিখতে পারবেন না নানা লিগ্যাল ইস্যুতে।
এগুলো একদমই বেসিক লেভেলের আন্ডারস্ট্যান্ডিং; কী আশ্চর্য, পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যেও সেটা নেই। বরং এই হিউমিলিয়েশনকে তাদের অনেকেই অ্যাপ্রিসিয়েট করছে, অর্থাৎ কপিরাইট, ইমেজ রাইটসহ বিভিন্ন টেকনিকাল বিষয়ে জ্ঞান তো রাখেই না, পারসন আর প্রতিষ্ঠানের প্রটোকলও বুঝে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো যে বেশিরভাগই ব্যর্থ ও অকার্যকর, এবং দক্ষ জনবলের এতটা সংকটের হেতু কী— এই সুনির্দিষ্ট ঘটনার পোস্ট-মর্টেম থেকে আরো প্রকটভাবে প্রমাণিত হয়। নিজের দায়িত্ববোধ সম্বন্ধে সামান্যতম সচেতনতা রাখি না, অথচ দেশের সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে দিই ৫ মিনিটে! তারা এও ভাবে না, সে ১ লক্ষ নিকৃষ্ট গালি দিলেও সেটা পার্ট অব দ্য প্রসেস, কিন্তু তার কোম্পানি মাত্র ১টা গালি দিক বা একজন পাবলিক সেলিব্রিটির নাম ব্যবহার করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম করুক, সেই ব্যক্তি আদালতে ছোট্ট একটা মামলা করে দিলেই কত বড়ো অংকের জরিমানা গুনতে হয় বা ট্রেড লাইসেন্স বাতিল/স্থগিত হয়ে যাবে ধারণাও নেই।
ধারণা তৈরি হবে কীভাবে; এরা দেখে অভ্যস্ত অমুক রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী তমুক পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা দায়ের করেছে, পত্রিকার সম্পাদকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, সে আগাম জামিন নিয়ে নেয়। ইমেজ রাইট ইস্যুতেও উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নেই। যে কারণে ব্যক্তি থেকে ব্যবসায়ী সর্বত্রই শোচনীয় নৈতিকতার চর্চা, এবং মেধার অপুষ্টিতে ভুগা। মূল কারণ অবশ্যই কূপমণ্ডুকতা। ভাবছি ইথিওপিয়া, সুদান, সোমালিয়াসহ চরম দারিদ্রসীমার দেশগুলোর কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা শুনবো, তাতে হয়তবা বুঝতে পারব কূপমণ্ডুকতার সূচকে বাংলাদেশীরাই অবিসংবাদী সেরা কিনা!