রাহুল নামটা শৈশব থেকেই আমার চিন্তা পরিমণ্ডলে ঘূর্ণায়মান। আমাদের ছেলেবেলায় কিশোর-তরুণদের বিশেষ এক ধরনের হেয়ার স্টাইল দেয়ার ফ্যাশন চালু হয়েছিলো, যার নাম ‘রাহুল কাট’। অনেক পরে জেনেছি, এই হেয়ার স্টাইল রাহুল রায় নামের এমন একজন নায়কের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে এসেছে যে নায়ক হিসেবে আহামরি কিছু করতে না পারলেও শুধুমাত্র হেয়ারস্টাইলের কারণে অদ্যাবধি স্মরণীয় হয়ে আছে।
মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি, আজ হায় রুবি রায় ডেকে বলো আমাকে তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি। শিমুল মুস্তাফার আবৃত্তি শুনতাম, ব্যাকগ্রাউন্ডে গানটা বাজতো । তখন শুনেছিলাম, এই গানের গায়কের নাম রাহুল দেব বর্মণ। বড়ো হয়ে পরিচিত হই কম্পোজার আরডি বর্মণের সাথে যিনি আদতে আমার শৈশবে শোনা সেই রুবি রায় গানের গায়ক রাহুল দেব!
কলেজে ওঠা পর্যন্ত আমার কাছে সুন্দর নারীর একমাত্র রেফারেন্স পয়েন্ট ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কোনো মেয়েকেই সুন্দর বলতে পারতাম না এই ব্যক্তিত্বের কারণে। যে কোনো সুন্দরীর কথা উঠলেই আমি প্রশ্ন তুলতাম ‘সে কি ইন্দিরা গান্ধীর চাইতেও সুন্দরী’? তাকে নিয়ে পড়াশোনাসূত্রে জানতে পারি তার দুই পুত্র রাজিব গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী। রাজিবের ২ সন্তান; মেয়ের নাম প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, ছেলে রাহুল গান্ধী!
ভিসিপি/ভিসিআর যুগে বাসায় আত্মীয়-স্বজনের গ্যাদারিং মানেই দোকান থেকে ভিসিপি ভাড়া আনা। আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে শাহরুখ খান আর মাধুরীর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো বেশি। একটা সিনেমা আনে দিল তো পাগল হ্যায়। তার কয়েক বছর পর শাহরুখ খানের আরেকটা সিনেমা মেগাহিট করে- কুচ কুচ হোতা হ্যায়। দুই সিনেমাতেই শাহরুখ খানের চরিত্রের নাম রাহুল।
ফলে রাহুল নামের বেষ্টনী বেশ সক্রিয় ছিলো। ক্রিকেট খেলা দেখি একদম বল বাই বল। খাওয়া-দাওয়া টিভির সামনে, খেলা থাকলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ, ইনিংস বিরতিতে গোসল; টয়লেট পেলেও সেটা ইনিংস বিরতি পর্যন্ত আটকে রাখা। ক্রিকেটারদের স্টিকার সংগ্রহ করা পছন্দের কাজ। টেন্ডুলকার, লারা, ওয়াকার, ওয়াসিম, সাঈদ আনোয়ার, মার্ক ওয়াহ, নাথান এস্টল, এলান ডোনাল্ডের স্টিকারে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার ভরতি করে ফেলেছি। এরই মধ্যে ৯৭ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে এক ম্যাচে টেন্ডুলকার চামিন্দা ভাসের আউটসুইঙ্গারে ক্লিন বোল্ড হয়ে গেলো, সৌরভ গাঙ্গুলীও টিকতে পারলো না বেশিক্ষণ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষে অধিনায়কত্ব হারানো এবং দল থেকে বাদ পড়া আজহারউদ্দিন ব্যাট করতে নেমেছে গলায় বিশাল এক তাবিজ ঝুলিয়ে; তার সাথে পার্টনারশিপ গড়েছে নতুন এক ক্রিকেটার, পড়ি ক্লাস ফাইভে, ইংরেজি পড়তে হয় বানান করে, সেভাবে নামটা উচ্চারণ করি ‘রাহুল ড্রাভিড’! আজহারের খেলাই মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম, কিন্তু ড্রাভিড যতক্ষণ ব্যাটিং করেছে দেখতে ভালোই লাগে।
পরদিন পত্রিকায় রিপোর্ট পড়তে গিয়ে নাম দেখি রাহুল দ্রাবিড়; নিজের জ্ঞানের প্রতি প্রশ্ন জাগে- আমি তো স্পষ্ট দেখলাম Dravid, এর উচ্চারণ দ্রাবিড় হয় কোন্ যুক্তিতে! এই খটকাটা ভাঙতে ভাঙতে কলেজ পার হয়ে যায় যখন যুগোস্লাভিয়ার বানান দেখি। দ্রাবিড়ের প্রতি আমার প্রাথমিক আগ্রহের সূচনা হয়েছিলো নামের উচচারণজনিত বিভ্রান্তি থেকেই। তবে ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়ের প্রতি ইমপ্রেসন তৈরি হয় ১৯৯৮ এর অক্টোবরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের পর থেকে। পিচ রিপোর্টে বলেছিলো- টসে জিতলে ফিল্ডিং নেয়া উচিত, আগে ব্যাট করলে জেতার সম্ভাবনা কম। তবু টসে জিতে ব্যাটিং নেয় ভারত। শুরুতেই গাঙ্গুলী লেগ সাইডের বলে কট বিহাইন্ড হয়, ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের বলে আজহারও শূন্য রানে এলবিডব্লিউ; পিচ রিপোর্টের কথাটা মনে পড়ছিলো খুব করে। সেই সময়ে টেন্ডুলকার কাউন্টার এটাক শুরু করে, তাকে সঙ্গ দেয় দ্রাবিড়। টেন্ডুলকারের ঝলমলে সেঞ্চুরি আর বোলিংয়ে ৪ উইকেটের কারণে দ্রাবিড়ের ৮০ বলে ৪৮ রানের সময়োপযোগী ইনিংসটা নিয়ে কারো মুখে কথাই শুনি না কোনো। ইনজাস্টিস মনে হয়। পরের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেন্ডুলকার দ্রুত আউট হয়ে যায়, দ্রাবিড় ৫৪ বলে ২০ রানের ধীরগতির এক ইনিংস খেলে সমালোচিত হন। সমালোচনাটা প্রকাশ্যে আসে পরের সিরিজ শারজাহতে আজহারউদ্দিনের সেই সময়ের বিচারে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়ার মাইলফলক স্পর্শ করার ইনিংসে অজিত আগারকার যখন স্লগিং করে ম্যাচ জিতিয়ে দেয়, তার পরবর্তীতে প্রেস ব্রিফিংয়ে আগারকারের প্রশংসা করতে গিয়ে আজহার বলে বসেন- ‘ঠুকঠুক করে খেলার নাম ব্যাটিং নয়’। এই মন্তব্যটা যে দ্রাবিড়কে খোঁচা মেরে করা হয়েছে পত্রিকাতেই তা উল্লেখ করেছিলো।
তবে দ্রাবিড়ের প্রতি আগ্রহ জাগার আগে থেকেই দ্রাবিড় নামটির সাথে পরিচিত ছিলাম। সাঈদ আনোয়ারের খেলা দুর্দান্ত লাগতো; সে যে ম্যাচে ১৯৪ রানের রেকর্ড গড়ে ডাবল সেঞ্চুরির মিস করে সেই ম্যাচে ভারতের পক্ষেও একজন ব্যাটসম্যান ১০৭ রানের খেলেছিলো, অনেক পরে জেনেছি সেই ব্যাটসম্যানটি রাহুল দ্রাবিড়!
রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে সবচাইতে প্রচলিত ধারণা হলো সে ক্রিকেটের সবচাইতে আন্ডাররেটেড ক্রিকেটারদের একজন যার সকল কীর্তি আড়ালে চলে গেছে সতীর্থ বা প্রতিপক্ষের অন্য কারো অসাধারণ কীর্তিতে, তাকে বলা হয় আনসাঙ হিরো। ২০১৬এর জুন পর্যন্ত আমিও সেই দলে ছিলাম, কিন্তু জুলাই থেকে সবকিছুকে দেখা ও বোঝার ক্ষেত্রে ভিন্ন এক ভিউ পয়েন্ট গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি, যার প্রেক্ষিতে রাহুল দ্রাবিড় আনসাঙ হিরো কথাটাকেই বরং খোঁড়া আর চিন্তার সীমাবদ্ধতা মনে হতে থাকে। রাহুল দ্রাবিড় এমন এক ইউনিক ক্রিকেটার যার রিপ্লেসমেন্ট আজো পায়নি ভারত, আগামী ২৯ বছরে পাবে কিনা সে বিষয়েও সংশয় আছে ঘোরতর।
ক্রিকেট ইতিহাসের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার টেন্ডুলকার, তার অর্জনও ঈর্ষণীয়। সেই টেন্ডুলকারকেও কী দারুণভাবে রিপ্লেস করে দিয়েছে কোহলি। শেওয়াগের মতো বিধ্বংসী ক্রিকেটারের অভাব বুঝতে দেয় না রোহিত শর্মা (ওয়ানডে), সৌরভ গাঙ্গুলীকেও মনে পড়ে না শেখর ধাওয়ানের কারণে। কিন্তু টেস্ট বা ওয়ানডে, এমন কোনো ক্রিকেটার কি আছে যাকে দেখে মনে হয় দ্রাবিড়ের রিপ্লেসমেন্ট হতে পারে? চেতেশ্বর পুজারা, অজিঙ্কা রাহানে টেস্টে ঝলসে উঠে, কিন্তু তারা বড়োজোড় ভিভিএস লক্ষণের রিপ্লেসমেন্ট হতে পারে; দ্রাবিড়ের কি?
আমি সাধারণত পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করে ক্রিকেট বিষয়ক লেখালিখি করি না, সম্পূর্ণটাই স্মৃতির উপর নির্ভর করি। কিন্তু দ্রাবিড়কে রিপ্লেস করা সম্ভব নয়, এই স্টেটমেন্টের যথার্থতা বোঝার জন্য দ্রাবিড়কে নিয়ে পড়াশোনার চেষ্টা করি। অবশ্য দ্রাবিড়ের ইংরেজি বায়োগ্রাফি আমি কলকাতা থেকে অর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করেছি, তার মানে দ্রাবিড় সংক্রান্ত পড়াশোনায় আগ্রহ আগে থেকেই। কিন্তু আগ্রহ দিয়ে তো আর রিপ্লেসমেন্ট অসম্ভব সংক্রান্ত স্টেটমেন্টকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই নিউমেরিক কিছু পরিসংখ্যানের দ্বারস্থ হতে হলো আমায়:
– টেস্ট এবং ওয়ানডেতে রাহুল দ্রাবিড় ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছে যথাক্রমে ১১ এবং ১৪ বার, কোনোটাই আহামরি রেকর্ড নয়। টেন্ডুলকার ওয়ানডেতে ৬২ বার, ক্যালিস টেস্টে ২৩ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছে। কিন্তু যখন জানবেন দ্রাবিড় ১১বারের মধ্যে ৮বারই ম্যান অব দ্য হয়েছেন দেশের বাইরে, এই ফ্যাক্টটা আপনাকে ইমপ্রেস করবেই, কারণ দ্রাবিড় যে সময়টাতে খেলতেন তখন ভারত সম্বন্ধে জনপ্রিয়তম প্রচলনটি ছিলো –দেশে বাঘ, বিদেশে বিড়াল। বিদেশের ফাস্ট আর বাউন্সি পিচে ব্যাটসম্যানদের এমনই নাজুক অবস্থা ছিলো সেখানে দ্রাবিড়ের এমন বৈশিষ্ট্য তাকে ব্র্যাকেটের বাইরে রাখতে বাধ্য করবে আপনাকে।
– ২৮৬ ইনিংসের টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্রাবিড় বল খেলেছেন ৩১২৫৮টি, এবং ক্রিজে থেকেছেন ৪৪১৫২ মিনিট, যা কোনো ব্যাটসম্যানই স্পর্শ করতে পারেনি এখনো। তার উইকেটটি কত মূল্যবান, এটা বোঝার জন্য আরেকটা তথ্য যুক্ত করা যেতে পারে। ১০০০০ এর বেশি বল খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার পার ডিসমিসাল ব্যাপ্তি ১২৩ বল; একমাত্র জ্যাক ক্যালিস (১২৫) বাদে আরো কোনো ব্যাটসম্যানের উইকেট পেতেই বোলারদের এতো ঘাম ঝরাতে হয়নি।
– দ্রাবিড়কে বলা যায় পার্টনারশিপ মাস্টার। ওয়ানডে-মিলিয়ে তিনি ৭০০ টি পার্টনারশিপ গড়েছেন, যেখানে তার পরে যে আছে সে ৬৫০ এরও নিচে। এর মধ্যে ৮৮ টি পার্টনারশিপ ১০০+ রানের। শেওয়াগের ট্রিপল সেঞ্চুরির ইনিংসগুলোতে পার্টনারশিপ গড়েছেন, টেন্ডুলকার-গাঙ্গুলীর সাথে তিনশো+ রানের পার্টনারশিপ গড়েছেন, এমনকি ২৮১ রানের যে ইনিংসটা লক্ষণকে ভেরি ভেরি স্পেশাল বানিয়েছে, সেখানেও পার্টনারশিপের ব্যাটসম্যানটি কিন্তু দ্রাবিড়ই ছিলেন।
– গাঙ্গুলীর ক্যাপ্টেন্সিতে ভারত ২১টি টেস্ট জিতেছে। ওই ২১ টেস্টে দ্রাবিড়ের ব্যাটিং গড় ১০২.৮৪ (৯টি সেঞ্চুরি, যার ৩টি ডাবল)। তার সময়ে ভারত যে সমস্ত টেস্টে ড্র করেছে সেগুলোতে তার ব্যাটিং গড় ৭৫ এর বেশি।
– টেস্ট ইতিহাসেই তিনি একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি কখনোই গোল্ডেন ডাক মারেননি।
– তার খেলা ম্যাচগুলোতে দলের মোট যা রান সেখানে তার কন্ট্রিবিউশন ৩৫.৬ পারসেন্ট। টেস্ট ইতিহাসে এটা সর্বোচ্চ কন্ট্রিবিউশন। টেন্ডুলকারের কন্ট্রিবিউশন ২৯.৯% এবং ক্যালিসের ৩২.৬%
– স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে তিনি ক্যাচ নিয়েছেন ২১০টি, যা বিশ্বরেকর্ড। ক্যাচকে কেউ আলাদাভাবে মূল্যায়ন না করলেও আমি করতে চাই, কারণ টেস্টে স্লিপ ফিল্ডিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্ক ওয়াহ এবং জয়াবর্ধনের মতো দুজন স্লিপ ফিল্ডার না থাকলে শেন ওয়ান আর মুরালিধরনের টেস্ট বোলিং ফিগার আরো বেশ খানিকটাই পিছিয়ে থাকতো। বাংলাদেশের টেস্টগুলোতে লক্ষ্য রাখলে স্লিপ ফিল্ডিংয়ের মাহাত্ম্য আরো প্রখর-প্রকটভারে উপলব্ধি করা যাবে। অনেকগুলো টেস্টে আমরা ভুগেছি স্লিপে যাচ্ছেতাইভাবে ক্যাচ মিস করায়। স্লিপ ফিল্ডিং গভীর মনোযোগ এবং সতর্কতা দাবি করে, দ্রাবিড় তা পূরণ করেন বলেই ক্যাচের অনন্য রেকর্ডটি তার অধিকারে।
– দ্রাবিড়কে নিয়ে একবার এক আর্টিকেল পড়েছিলাম, সেখানে এক ক্রিকেট সমর্থকের মন্তব্য ছিলো- দ্রাবিড় ক্রিজে থাকলে আমরা নিশ্চিন্তে বাজার-সদাই করে আসতে পারি। এই লেখা লিখবার সময় একটা কুইজের চিন্তা মাথায় এলো। ফেসবুকে একবার একটা প্রশ্ন দেখেছিলাম ‘কোন ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংয়ের ওপর নিজের জীবন বাজি রাখতে চান?’ মানে, আপনি ততক্ষণই বেঁচে থাকবেন যতক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যাটসম্যানটি টিকে থাকবে, সে আউট হলেই আপনার মৃত্যু ঘটবে। আমি উত্তরগুলো দেখার চেষ্টা করেছি। সর্বাধিক মানুষ রাহুল দ্রাবিড়ের নাম উল্লেখ করেছে। ২০০৮ পর্যন্ত যারা নিয়মিত ক্রিকেট দেখতো, আমি নিশ্চিত তাদের বড়ো অংশই এই প্রশ্নের উত্তরে এখনো রাহুল দ্রাবিড়ের নামটিই বলবে।
এতোগুলো শর্তপূরণ করে, কে রাহুল দ্রাবিড়কে রিপ্লেস করবে? যাকে রিপ্লেস করা যায় না সেই তো অমূল্য। এরকম এক ক্রিকেটার কীভাবে আনসাঙ হিরো হয়! বরং তার আনসাঙ হিরো ইমেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে পরিমাণ লেখালিখি হয়েছে, সেই পরিমাণ লেখালিখি ক’জন ক্রিকেটারের ভাগ্যে জুটেছে এটা প্রশ্ন হতে পারে। এবং যারা লিখেছেন কেউই আমজনতা টাইপ সমর্থক নয়, প্রায় প্রত্যেক ক্রিকেটলেখকদের আগ্রহের চরিত্র তিনি। এ প্রসঙ্গে দস্তয়েভস্কির উদাহরণ মনে পড়লো। একবার কোনো এক বিখ্যাত লেখক মন্তব্য করেছিলেন- আমরা হলাম পাঠকের লেখক, দস্তয়েভস্কি লেখকদের লেখক। দ্রাবিড়কেও ক্রিকেটারদের ক্রিকেটার বলা যায়।
প্রায় সমস্ত ক্রিকেট লেখক যাকে নিয়ে আগ্রহী তিনি কোন্ যুক্তিতে আনসাঙ হিরো হতে যাবেন? তার চেয়েও বড়ো কথা হলো, তিনি কি আদৌ হিরো ম্যাটেরিয়াল? হিরো হয় আমজনতার জন্য; ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখতে হিরো লাগে। কিন্তু হিরোদের জন্ম দেয় ডিরেক্টররা। একটা সিনেমা চলে ডিরেক্টরের পরিকল্পনামাফিক; হিরো দর্শকের কাছে বড়ো ফিগার হতে পারে, কিন্তু ডিরেক্টরের নির্দেশে তাকে সারারাত পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে যদি স্ক্রিপ্ট সেটা ডিমান্ড করি। দ্রাবিড়কে আমার ডিরেক্টর ফিগার মনে হয়, যিনি নেপথ্যে থেকে সবকিছুর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন।
দ্রাবিড়ের প্রতি আমার মাত্রাভাঙ্গা আগ্রহের কারণও তার নেপথ্য চরিত্র হয়ে থাকার প্রবণতাই। বাল্যকাল থেকেই আমি পর্যবেক্ষণ করতে আর শুনতে পছন্দ করি, কখনোই পারফরমার ছিলাম না (এখনো নই), কিন্তু অন্যের ভেতর থেকে পারফরম্যান্স বের করে আনার কাজটা উপভোগ করতাম। মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট বা খুচরো কাজ-কর্মে বরাবরই অরুচি ছিলো। এই বৈশিষ্ট্য আমার মধ্যে ঢুকে রাহুল দ্রাবিড়কে দেখে, যতো বেশি তাকে নিয়ে ভাবি আর নেপথ্যচরিত্র হওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকি।
২০০৮ এ সামহোয়ার ইন ব্লগে একাউন্ট খুলি যখন নিজের ব্লগের শিরোনাম রাখি ‘misinterpreted interpreter’ এবং নিজের সম্পর্কে লিখি- ‘কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা কোন ঘটনার উদ্দেশ্য হয় না,বিধেয় হয় না; সকলের অগোচরে মেঠো ইদুরের মত নিজেকে লুকিয়ে বেচে-বর্তে থাকে; এরা শুধুই পর্যবেক্ষক- কোনো অনুভূতি তাদের স্পর্শ করে না….আমিও নেপথ্য চরিত্র হয়ে যাচ্ছি বহুকাল ধরে। এইতো আমি; বেঁচে আছি নিজের নিয়মে: কাউকে ধরে রাখা বা কোথাও ধরা পড়া, দুটো সম্ভাবনাই যার পরম শূন্য। আমি খুব অসাধারণ মেধাবী কেউ নই, আবার এও জানি নিতান্ত সাদা কাগজ নই, এই আমি এক মধ্যবর্তী মানুষ’!
লাইনগুলো লেখার সমগ্র প্রেরণা আসে রাহুল দ্রাবিড় থেকে। এককালে গল্প লেখার ফরম্যাট নিয়ে প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করতাম। একটা ফরম্যাট বের করি যার নাম রাখি ‘৩,৫,৭ সংখ্যামাত্রার রাহুল দ্রাবিড়িয় গল্প’! ২০০১ এ যে টেস্টে লক্ষণ ২৮১ করেছিলো, সেখানে ভারত ফলোঅনে পড়েছিলো, এবং আগের টেস্টে এবং প্রথম ইনিংসে বাজে ব্যাটিং করায় পছন্দের ৩ নম্বর পজিশন হারিয়ে দ্রাবিড়কে নেমে যেতে হয়েছিলো ৬ নম্বরে, এবং সেখান থেকেই লক্ষণের সাথে সেই ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ। দ্রাবিড় সেই ইনিংসে ব্যাট করার সময় গলায় স্কার্ফ বেঁধেছিলো। বহুদিন পর্যন্ত সেই সাদা স্কার্ফটাই আমার কাছে দ্রাবিড়ের ইমেজ হয়ে ছিলো। স্কার্ফ তো শুভ্রতার প্রতীক।
ব্যাটসম্যান দ্রাবিড় কি খুব ফ্যাসিনেটিং?
তার ব্যাটিং পুরোদস্তুর কপিবুক; কোনো ইনোভেটিভ বা ইমপ্রোভাইজড শট নেই, এগ্রেসিভ এটিচুড নেই, যেটা ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানদের থাকে। বিশেষত পন্টিং, ক্যালিস, সাঙ্গাকারা ওয়ান ডাউন পজিশনে ব্যাটিংয়ের একটা লেভেল অব এক্সিলেন্স নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এরা কেউই প্রচলিত অর্থে স্ট্রোকপ্লেয়ার নন, কিন্তু হেলদি স্ট্রাইকরেটে রান করতে জানেন, প্রয়োজনে স্লগ করতে জানেন। তুলনায় দ্রাবিড়ের ব্যাটিং ঝিম ধরানো, অনেকটা মশলাবিহীন মাংসের মতো যা খেতে উপকারী, কিন্তু সুস্বাদু নয়। যা খেতে স্বাদ নয় মানুষ তা পথ্য হিসেবে খেতে পারে, নিয়মিত খাবে না।
এর প্রমাণ পাওয়া যায়, রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে টেস্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে প্রমাণের চেষ্টার মধ্য দিয়ে। এমনকি বহু ক্রিকেটলিখেকই তার ওয়ানডে পারফরম্যান্সকে বিবেচনায় নিতে চান না, কিন্তু আমি তাকে ওয়ানডেতে পন্টিং বা সাঙ্গাকারার চাইতেও এগিয়ে রাখতে চাই। ১৯৯৯-২০০৫ এই সময়সীমায় তার চাইতে সফল ওয়ানডে ব্যাটসম্যান একজনও ছিলো না। এই সময়ে তিনি রান করেছেন ৭১৩৪ যার গড় ৪২.৯৭; ডেমিয়েন মার্টিন, ক্যালিস, আর টেন্ডুলকার ব্যতীত কারোরই গড় এর চাইতে বেশি ছিলো না, কিন্তু রানে তারা পিছিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে মোট রান সংগ্রহে কেবলমাত্র সৌরভ গাঙ্গুলী (৭১৮৫) তার চাইতে এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু গড়ের (৪০.৮২) দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলেন।
তিনি যে ৩৪৩টি ওয়ানডে খেলেছেন তার ১৬০টাতেই জিতেছে ভারত, যেখানে তার গড় ৫০.৬৯! তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনি; ২০০৭ এর বিধ্বস্ত আসরটি সত্ত্বেও বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং গড় ৬১.৪২; ভিভ রিচার্ডস বাদে কেউই তার চাইতে বেশি গড় ধরে রাখতে পারেননি (৬৩.৩১)। এবং সবচাইতে ইন্টারেস্টিং তথ্য হলো, ২২ বলে ৫০ রানের একটি ইনিংস আছে তার, যেটি ভারতের পক্ষে দ্বিতীয় দ্রুততম।
ফ্যাক্টগুলো বিবেচনায় নিলে একটা ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়। পৃথিবী মনে রাখে ক্লাসের ফার্স্টবয়দের, কিন্তু সেকেন্ড বা থার্ডবয়রা কি কম মেধাবী? দ্রাবিড় হলো ক্লাসের সেকেন্ড বয়, যে মাঝেমধ্যে থার্ড হয়, এর বাইরে যায় না কখনো, কিন্তু ফার্স্ট হওয়ার নিয়তি নিয়ে জন্ম হয়নি তার। ফার্স্ট হওয়াটা যোগ্যতার চাইতে নিয়তি বেশি মনে হয় আমার।
১৯৯৯ এর আগ পর্যন্ত তিনি প্রচুর বল নষ্ট করতেন, কিন্তু নিউজিল্যান্ড সফরে বেশ এগ্রেসিভ ২টা ইনিংস খেলে তিনি ১৯৯৯ বিশ্বকাপের জন্য বিবেচিত হন, সেই আসরের সর্বোচ্চ রান(৪৬১) সংগ্রাহকও ছিলেন তিনি। ৩৯+ ব্যাটিং গড়, ১০হাজার+ রান করা একজন ব্যাটসম্যান কীভাবে ওয়ানডের বিবেচনায় না আসেন, এটার অন্যতম কারণ মনে হয় ‘দ্য ওয়াল এবং মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ খেতার পেয়ে যাওয়া। মুল নাম ছাপিয়ে খেতাবগুলো এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছিলো তারা ধরেই নিয়েছিলো দ্রাবিড় মানেই বোধহয় টেস্ট ক্রিকেট। তবে এর চাইতেও গুরুতর কারণ মনে হয় লফটেড শট খেলার ক্ষেত্রে তার অনীহা কিংবা কিছুক্ষেত্রে অক্ষমতা। টেস্টে তিনি ছক্কা হাঁকিয়েছেন মাত্র ২১টি, ওয়ানডেতে ৪২টি, যা একজন ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে দর্শক কোনোভাবেই আশা করে না। ওয়ানডেতে ১০৮৮৯ রানের মধ্যে তিনি বাউন্ডারি মেরেছেন ৯৫০টি, মানে ৩৮০০ রান এসেছে বাউন্ডারি থেকে যা মোট রানের ৩৪.৯% মাত্র, এবং ৪২টা ছক্কাকে ধরলে সেটা দাঁড়ায় ৩৭.২১%; অর্থাৎ তার স্কোরের দুই-তৃতীয়াংশই এসেছে সিঙ্গেলস আর ডাবলস থেকে। যে কারণে তার স্ট্রাইকরেট ৭১.২৪ মাত্র। যেহেতু বাউন্ডারি কম, এখানেই সংখ্যার খেলা। সৌরভ গাঙ্গুলীর ওয়ানডে রান ১১৩৬৩ যার মধ্যে চার ১১২২টি, ছক্কা ১৯০টি, বাউন্ডারিসূত্রে ৪৯.৫% রান আসার পরও তার স্ট্রাইকরেট ৭৩.৭১!
দ্রাবিড়ের স্ট্রাইকরেট এখানেই সংখ্যার অসারতা প্রমাণ করে দেয়। ধরা যাক, ১ জন ব্যাটসম্যান ১৯ বল খেলেছে, সে প্রায় প্রতি বলে সিঙ্গেল নিয়ে রান করেছে ১৭, যেখানে বাউন্ডারি নেই একটাও। তার স্ট্রাইকরেট হবে ৮৯.৪৭, অন্যদিকে একজন ব্যাটসম্যান সমানসংখ্যক বল খেলে ৩টা ছক্কা মেরে ১৮ রান করলো, তার স্ট্রাইকরেট হবে ৯৪.৭৩; অথচ ১৬টা বল ডট দিয়ে সে ননস্ট্রাইকিং ব্যাটসম্যানের প্রেসার কত বাড়িয়ে দিলো পরিসংখ্যান তা বলতে পারবে না। ক্রিকেট খেলাটা স্ট্রাইক রোটেট করার, বাউন্ডারি একটা অলংকরণ মাত্র যা দর্শকের তালি যোগানো ছাড়া বিশেষ কাজে লাগে না। স্ট্রাইক রোটেশনের এই অদ্ভুত অতুলনীয় ক্ষমতার কারণেই ক্রিকেট ইতিহাসে তার সমতুল্য পার্টনারশিপ গড়তে পারেনি আর কোনো ব্যাটসম্যান। তিনিও এটা বোঝেন বলেই আমরা তার ট্যালেন্ট বিষয়ক ফিলোসফির সন্ধান পাই এই ভাষায়- ‘I think we judge talent wrong; what do we see as talent? I think I have made the same mistake myself. We judge talent by peoples ability to strike a cricket ball, the Sweetness, the Timing. That’s the only thing we see as talent. Things like determination, courage, discipline, temperament, these are also talent’!
আমি তার এই বক্তব্যকে এক ধরনের চপেটাঘাত হিসেবে দেখি। তাকে জীবনভর শুনতে হয়েছে তিনি টেন্ডুলকার বা গাঙ্গূলীর মতো প্রতিভাবান নন, কিন্তু তিনি বিশুদ্ধ ব্যাকরণসম্মত ব্যাটিংয়ের প্রতীক। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন, তার পক্ষে যদি টেন্ডুলকার হওয়া সম্ভব না হয়, একই কথা টেন্ডুলকারের বেলায়ও প্রযোজ্য। সে পারলে দ্রাবিড় হয়ে দেখাক! টেন্ডুলকার প্রসঙ্গে তার একটা কমপ্লিমেন্ট গুগলে খুবই এভেইলেবল- ‘আমি টেস্ট-ওয়ানডে ২ জায়গাতেই ১০ হাজারের বেশি রান করেছি, তবু আমার নাতি-নাতনীরা বলবে আমি টেন্ডুলকারের সাথে ব্যাট করেছি; এটাই ওর বিশেষত্ব’। এর মধ্যেও কি মানুষের রিকগনিশন এবং এপ্রিসিয়েসন সিস্টেমের প্রতি প্রচ্ছন্ন রসিকতা নেই?
তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি ওয়ানডেতে দুটো ট্রিপল সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ গড়েছেন, তবু তিনি নাকি ওয়ানডেতে চলেন না। রসিকতাই বটে!
তার স্পোর্টসম্যানশিপের উদাহরণ আরো ভালোভাবে মনে পড়ে অভিষেক টেস্টে ৯৫ রানে কট এজড করে আম্পায়ারের অপেক্ষায় না থেকে নিজের ড্রেসিংরুমে রওয়ানা হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- ‘Everybody at the ground had heard the nick’!
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি মাত্র তিনটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, যদিও এর মধ্যে ১টি বাদে বাকি দুইটি ক্ষেত্রে তাকে আমি বেনিফিট অব ডাউট দিতে চাই।
– ২০০৪ এ কোনো এক ওয়ানডেতে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে তার ম্যাচফি এর ৫০% জরিমানা করা হয়েছিলো।
– গ্রেগ চ্যাপেল কোচ হয়ে আসার পর সৌরভ গাঙ্গুলীর সাথে তার এক মনোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়, এবং ফর্ম হারিয়ে গাঙ্গুলী দল থেকে বাদ পড়েন। এর পেছনে অনেকেই দ্রাবিড়ের হাত দেখেন। কিন্তু আমি এখানে দ্রাবিড়ের চাইতে গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয় মানসিকতাকেই বড়ো করে দেখি। তারা স্টিভ ওয়াহ এর মতো অধিনায়ককে ওয়ানডে থেকে বিদায় করে দিয়েছিলো, ডেমিয়েন মার্টিন-মার্ক ওয়াহ এর মতো স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান ফিটনেসের কারণে বাদ পড়ে যায়, এমনকি ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন হোক বা না হোক, মাইকেল ক্লার্কের যে আর দলে থাকা হবে না সেটা তারা আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলো। তাদের কাছে বর্তমানটাই সব, অতীত নিয়ে মাতামাতি বা আগ্রহ কোনোটাই তাদের মধ্যে কাজ করে না। চ্যাপেল হয়তোবা টেন্ডুলকারকেও বাদ দিতো, যেহেতু মাঝে কিছুদিন তার অফফর্ম ছিলো, কিন্তু জনরোষের ভয়ে সেটা পারেনি। গাঙ্গুলী টেন্ডুলকারের পর্যায়ের জনপ্রিয় ছিলো না, ফলে তার ফর্ম খারাপ গেলে বাদ পড়তে হবে, এটা উপমহাদেশের কালচারে যতোই অপ্রত্যাশিত হোক, অস্ট্রেলিয়ার কঠিন পেশাদারী মানসিকতায় খুবই মানানসই। দ্রাবিড়ের পারসোনালিটি টাইপ INTJ (Introverted-Intuitive-Thinking-Judging), গাঙ্গুলীর ENFP (Extroverted-Intuitive-Feeling-perceiving); যে কারণে সে যতো সাহসিকতার সাথে বোর্ড বা কোচকে মোকাবেলা করতে পেরেছে, দ্রাবিড়ের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সেটা একদমই নেই। গাঙ্গুলীর সময় কোচ ছিলো জন রাইট, যিনি জেন্টলম্যান হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে চ্যাপেল ভ্রাতৃদ্বয় খোদ অস্ট্রেলিয়াতেই সমালোচিত আন্ডারআর্ম বোলিং কাণ্ডের কারণে। গাঙ্গুলী ক্যাপ্টেন থাকাকালে দ্রাবিড়কে নিয়ে কম এক্সপেরিমেন্ট করেনি। তাকে উইকেটকিপার বানিয়ে ৪জন বোলার একাদশে রেখে এক্সট্রা ব্যাটসম্যান খেলিয়েছে, কিপার হিসেবে ৭৩ ম্যাচ মোটেই হালকাভাবে নেয়ার মতো কোনো পরিসংখ্যান নয়। এমনকি দ্রাবিড়কে ৭ নম্বরে পর্যন্ত ব্যাটিং করানো হয়েছে টিম কম্বিনেশনের কথা বলে। দ্রাবিড় অধিনায়ক হওয়ার পর যদি গাঙ্গুলীর প্রতি কিছুটা বিমুখ হয় সেটাকে খুব খারাপ চোখে আমি দেখতে পারি না, বিশেষত গাঙ্গুলীর ফর্ম যেহেতু তেমন পক্ষে ছিলো না তার। তাছাড়া দ্রাবিড়কে নির্বিবাদী চরিত্রই মনে হয়েছে সবসময়। খেলা ছাড়ার পরও তিনি অনুর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ হন, কিন্তু সিনিয়র দলের দায়িত্ব নিতে চান না। কারণ সিনিয়র দল সামলাতে গেলে স্টারডম আর ইগোর দ্বন্দ্ব কাজ করতে পারে, বয়সভিত্তিক দলে তার নিজের ক্যারিশমা প্রদর্শনের সুযোগ তুলনামূলক বেশি।
– ২০০৪ এর মুলতান টেস্টে নিয়মিত অধিনায়ক গাঙ্গুলীর ইনজুরিতে দ্রাবিড় অধিনায়কত্ব করেন। টেন্ডুলকার ১৯৪ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় ম্যাচের ২য় দিনের শেষ বেলায় তিনি ইনিংস ঘোষণা করে দেন। শেওয়াগ সেই ইনিংসে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন, দলের রান ৫৫০ পেরিয়ে গেছে, এমতাবস্থায় যে কোনো অধিনায়কই ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে পারে যদি সে ক্রিকেট সম্পর্কে সচেতন হয়, কারণ এই অবস্থায় ম্যাচ ড্র হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দ্রাবিড় প্রসঙ্গে বলতে গেলে এই ঘটনাটা আসবেই। টেন্ডুলকার তার আত্মজীবনীতেও সেই ঘটনা নিয়ে নিজের অসন্তোষের কথা লুকোননি। বইয়ে ঘটনার বিবরণ যেভাবে দেয়া আছে তার সারমর্ম হলো- টিব্রেকের সময়ই কোচ আর দ্রাবিড় টেন্ডুলকারকে জানিয়েছিলো, দিন শেষ হওয়ার আগে পাকিস্তানকে ১৫ ওভার ব্যাট করতে দেবে, সে যেন দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করে। টেন্ডুলকার সেভাবেই খেলছিলো, এক পর্যায়ে দ্বাদশ ব্যক্তিকে দিয়ে মাঠের ভেতরে মেসেজ পাঠায় ডিক্লেয়ার করার চিন্তা করছে, এই ঘটনার পর টেন্ডুলকার আর একটা বলও খেলার সুযোগ পায়নি। যুবরাজ সিং ৫টা বল খেলার পর ৬ নম্বর বলে আউট হয়ে যায়। নতুন ব্যাটসম্যান পার্থিব প্যাটেল নামার পর দ্রাবিড় ডিক্লেয়ার করে বসেন’। এটা নিয়ে যথেষ্ট মনোমালিন্য হয়, কোচ-গাঙ্গুলী ২জনই দুঃখ প্রকাশ করে, দ্রাবিড় কথা বলতে গেলে টেন্ডুলকার জানান তিনি মাঠের ভেতরে শতভাগ দেবেন, কিন্তু মাঠের বাইরে আপাতত ‘লিভ মি এলোন’ অবস্থা বজায় রাখতে চান। দ্রাবিড় তাকে দলের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানালে তিনি কিছুদিন আগের সিডনি টেস্টের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন- একই পরিস্থিতিতে দ্রাবিড় ব্যাট করছিলো, তখন গাঙ্গুলী দ্বাদশ ব্যক্তিকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো কখন ডিক্লেয়ার করবে; তখন তো সে দলের কথা ভাবেনি। এই ঘটনায় আমার অনুসিদ্ধান্ত হলো, যুবরাজ আউট হয়েই পরিস্থিতিটা ঘোলাটে হয়ে গেছে। নতুন ব্যাটসম্যান নেমে আরও কয়েক ওভার খেলে ফেলতে পারতো, সেই চিন্তা থেকে তিনি ডিক্লেয়ার করেছেন; টেন্ডুলকার হয়তোবা আর মাত্র ২টা বল পেলেই ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারতেন, কিন্তু মাত্র ২ বলের জন্য একজন ব্যাটসম্যান নামবে এটাই বা কেমন দেখায়! এই ঘটনায় বরং টেন্ডুলকারকে খুবই আত্মকেন্দ্রিক এবং ছোট মনের ক্রিকেটার মনে হয়েছে, যদিও তাকে আমি সবচাইতে মূল্যায়ন করি। তবু ক্রিটিকালি দেখলে দ্রাবিড়কে খুব বেশি দোষী মনে হয় না এক্ষেত্রে, বড়োজোর ছোট্ট একটা ভুল হিসেবে দেখতে পারি।
দ্রাবিড়কে অধিনায়ক হিসেবেও যথেষ্ট আন্ডাররেটেডই বলবো। ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেয়ার ব্যর্থতা দিয়েই মানুষ তার অধিনায়কত্বকে বিচার করে, অথচ ৫০টির বেশি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছে ভারতের এমন অধিনায়কদের তালিকায় ধোনির পরেই সফলতার দিক থেকে দ্রাবিড় থাকবে। তার ৭৯টি নেতৃত্বের ম্যাচে ভারতের জয় ৪২টি, হার ৩৩টি। জয়-পরাজয় অনুপাত ১.২৭, যেখানে কেবলমাত্র ধোনিই তাকে ছাড়িয়ে গেছে। সুনীল গাভাস্কার এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন- ‘ভারতের সেরা অধিনায়ক কে এই প্রশ্নে অনেকেরই নাম শুনি, কিন্তু সেখানে কেউ দ্রাবিড়ের নাম বলে না। অথচ তার অধীনেই আমরা ৩০ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতে হারিয়েছি, ইংল্যান্ডের মাটিতে ২১ বছর পর টেস্ট জিতেছি’। এছাড়া, সাউথ আফ্রিকার মাটিতে তাদের টেস্টে প্রথম হারানো দলের অধিনায়কও তিনি।
বিরাট কোহলি আসার পর ভারতকে বলা হচ্ছে চেজনির্ভর দল, যাদের বিপক্ষে কোনো রানই নিরাপদ নয়। অথচ মানুষ ভুলে গেছে কোহলির অভিষেকেরও আগে ভারত টানা ১৪ ম্যাচ চেজ করে জিতেছে, যেই দলের অধিনায়ক ছিলেন দ্রাবিড়। ধোনিকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় গাঙ্গুলীকে। এটা মিথ্যা নয়, তবে অর্ধসত্য। প্রতিটি খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট থাকে, যে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়। ধোনির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলবো শ্রীলংকার বিপক্ষে ১৮৩ রানের ইনিংসটি যেটি সে খেলেছিলো ওয়ান ডাউনে নেমে। তার আগ পর্যন্ত মিডল-লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করাই দায়িত্ব ছিলো ধোনি। শ্রীলংকার ৩০০+ চেজ করতে গিয়ে তাকে ৩ নম্বরে প্রমোশন দিয়েছিলো কে? গুগলে দেখে নিয়েন, দ্রাবিড় বন্দনা হয়ে যাবে নইলে!
দ্রাবিড়কে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে তার প্রতি ফ্যাসিনেশনের আরো কিছু যোগসূত্র খুঁজে পেলাম। তার ওয়ানডে জার্সি নম্বর ১৯, টি২০ জার্সি নম্বর-৩৮, ওয়ানডে ক্যাপ নম্বর-৯৫, অর্থাৎ ১৯ এর ছড়াছড়ি। অন্যদিকে তার টেস্ট ক্যাপ নম্বর ২০৭, যা ২৩ এর গুণিতক। আমার জীবন কাটে মৌলিক সংখ্যার সাধনায় আর অবসেসনে। জগতের প্রায় সবকিছুকেই মৌলিক বা বিজোড় সংখ্যা দিয়ে ইন্টারপ্রেট করার চেষ্টা করি। সেই অনুসারে ১৯ হলো অস্তিত্বের ইন্টারপ্রেটেশন, ২৩ সংযোগ বা কানেক্টিভিটির। আমার জমজ কন্যাদের নামও উনিশ আর তেইশ!
দ্রাবিড়ের এই সাংখ্যিক ইন্টারপ্রেটেশনে আরো বিস্মিত আর পুলকিত হই। উপলব্ধি করি দ্রাবিড় কেবলমাত্র ক্রিকেট মাঠ নয়, আরো দূরবর্তী কোনো মাধ্যমে আমার সাথে সংযুক্ত। তিনি শেখান, লাইমলাইটে থাকা সাধনার পক্ষে ক্ষতিকর, পৃথিবীর ১১% মানুষ বাকি ৮৯% কে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ১১% কে কি কেউ চোখে দেখে? মূল্যবান তো অনেকেই হয় মহামূল্যবান হয় ক’জনা!
দ্রাবিড় শেখায় শো-অফ না করে নিজের কাজটাতে কত বেশি ফোকাসড থাকা যায়। খেলার মানুষ হয়েও লাগেজে ব্যাট-প্যাডের সঙ্গে সবসময় বইও রাখতেন তিনি। বই একটা প্রতীক, যা বলে শেখার আর জানার চর্চায় গাফিলতি রাখা যাবে না। ব্রেটলি বা শোয়েব আখতার দুরন্ত গতির বলকেও সুন্দরভাবে ডিফেন্স করার মধ্য দিয়ে ক্রাইসিস জয়ের সাহস দেখান। দ্রাবিড়ের সমগ্র লাইফসস্টাইলই একটি ইউনিভার্সিটি। তার পুরো নাম রাহুল শরদ দ্রাবিড়। আমি তাকে দেখি আমার চিন্তা আর কমের ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবে। একারণে শরদ সরিয়ে সেস্থানে চলে আসে রাহুল ড্রাইভ দ্রাবিড়! তিনি খেলা ছেড়েছেন ৬ বছর আগে, কিন্তু আমি তাকে এখনো মাঠে দেখি, কখনো ফাস্ট বোলিং সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কখনোবা স্লিপে দাঁড়িয়ে আছেন সুযোগের অপেক্ষায়!
যেদিন দ্রাবিড় মাঠ থেকে বেরিয়ে যাবেন, আমার উদ্যমেরও ভবলীলা সাঙ্গ হবে। দ্রাবিড় থাকুন আপনি!মাঠ থেকে মনের দূরত্ব ২২ গজেরও কম!