ওয়ানডেতে একজন ক্রিকেটারের ইমপ্যাক্ট বোঝার জন্য ২টি খুব শক্তিশালী প্যারামিটার নির্ধারণ করেছি সম্প্রতি।
প্রথমত তার খেলা মোট ম্যাচ আর ম্যান অব দ্যা ম্যাচ পুরস্কার পাওয়ার অনুপাত। একই সাথে তার খেলা সিরিজসংখ্যা আর ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার অনুপাত।
দ্বিতীয়ত, সে যদি ব্যাটসম্যান হয় তার ৫০+ ইনিংসের সংখ্যা আর মোট ইনিংস সংখ্যার অনুপাত। সেই সাথে তার ক্যারিয়ারের মোট রানের কত পারসেন্ট বাউন্ডারিসূত্রে পাওয়া। এছাড়া ৫০ আর ১০০ সংখ্যার মধ্যে পার্থক্যকেও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
(তবে টেস্টের ক্ষেত্রে এই প্যারামিটারগুলোতে সামান্য পরিবর্তন আসবে।।সেটা অন্য কোনো আলোচনায় উল্লেখ করা যাবে।।)
এই প্যারামিটার দিয়ে একজন ক্রিকেটারের ইমপ্যাক্ট যত ভালো বোঝা যায়, ব্যাটিং গড়, স্ট্রাইকরেট বা মোট রান দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল পারসপেক্টিভ তৈরি হয়।
সৌরভ গাঙ্গুলীকে যদি উল্লিখিত প্যারামিটার দুটোতে পরিমাপ করতে যাই, দেখা যাক চিত্রটা কী পাই
প্যারামিটার ১: মোট ম্যাচ ৩১১, তবে ইনিংস সংখ্যা ৩০০, সুতরাং আমরা ৩০০ কেই রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করবো। ম্যান অব দ্য ম্যাচ ৩২ বার, অনুপাত ৯.৩৭৫, অর্থাৎ
প্রতি ৯ ম্যাচে তিনি একবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন। (সিরিজসংখ্যার পরিসংখ্যান জানি না বিধায় সেই হিসাবটা উহ্য রাখা হলো)
প্যারামিটার২: ৩০০ ইনিংসে তার ৫০+ ইনিংস সংখ্যা ৯৪ ( ফিফটি ৭২, সেঞ্চুরি ২২), অনুপাত ৩.১৯, প্রতি ৩ ম্যাচে ৫০+ ইনিংস খেলার সামর্থ্য ছিল। তবে ৫০ আর ১০০ এর মধ্য পার্থক্য অনেক বেশি, যে ব্যাটসম্যান ৭২ টি ফিফটি করতে পারে তার সেঞ্চুরি সংখ্যা মাত্র ২২টি হওয়াটা অবাক করার মতো। এই ব্যবধান থেকে দুটো ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে- ১. তার ফিটনেসে/টেম্পারমেন্টে সমস্যা ছিল, যে কারণে বেশিক্ষণ ব্যাট করলে হাঁপিয়ে উঠতেন। ২. তার সিঙ্গেলস বের করার ক্ষমতা তুলনামূলক কম ছিল, যে কারণে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন তুলে নিলে রানের প্রবাহ বজায় রাখতে সমস্যা হতো, বাউন্ডারি আদায় করতে গিয়ে আউট হতেন।
তার ক্যারিয়ার রান ১১৩৬৩, বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি থেকে ৫৬২৮( চার:১১২২, ছক্কা :১৯০), যা মোট রানের ৪৯.৫%, আমরা যদি ব্যাটিং পজিশন বিবেচনায় নিই তিনি ১ থেকে ৩ এর মধ্যেই ব্যাট করেছেন ক্যারিয়ার জুড়ে।
ওয়ানডের তুলনায় টেস্টে তার পারফরম্যান্স অনেকটাই সাদামাটা। যদিও অভিষেকের পরে টানা ২ টেস্টে সেঞ্চুরি পাওয়া তার ক্যারিয়ার ভাগ্যলিপি লিখতে দৈবযোগের ভূমিকা পালন করেছে।
প্যারামিটার দুটির সাপেক্ষে বিবেচনা করলে গাঙ্গুলী ওয়ানডে ফরম্যাটে একজন লিজেন্ড।
যদিও গাঙ্গুলীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, ক্রিকেট খেলাটার ইতিহাসে তার ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করাই মূখ্য, তবু একজন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সই হলো জ্বালানী। সেই জায়গায় কমতি থাকলে বাকি ব্যাপারগুলো আর প্রাদপদীপের আলোতেই আসে না ( বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবশ্য এই নিয়ম খাটে না, কোনোভাবে ৪-৫ বছর পারফর্ম করে কিছু অন্ধভক্ত যোগাড় হয়ে গেলেই সেটা দিয়ে চাকিরি বাঁচিয়ে রাখা যায়)
পারফরম্যান্সের জায়গায় গাঙ্গুলী তাই ১০০ তে ৯০ মার্কস পাওয়ার মতো ছাত্র।
এবার তবে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যেতে পারে।
গাঙ্গুলী সম্পর্কে কয়েকটি বাজারচলতি মতবাদ উল্লেখ করা যেতে পারে-
# তিনি প্রিন্স অব ক্যালকাটা নিক নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের শুরুতে। মধ্যভাগে তার নাম হয়ে যায় ‘দাদা’, এবং সেই নামের প্রতিপত্তি এতোটাই বেশি, খেলা ছাড়ার পরও টিভি এংকরিং করছেন যে প্রোগ্রামে তার নাম ‘দাদাগিরি’
# তিনি অফসাইডে দুর্দান্ত খেলতেন। রাহুল দ্রাবিড়ের বলা ‘ অফে প্রথমে ঈশ্বর, তারপর সৌরভ’ কথাটি এক্ষেত্রে ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে পড়েছে।
#তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থানের কারিগর। ধোনি, যুবরাজ, জহির খান, কাইফ, হরভজন প্রত্যেক ক্রিকেটারকে তিনি প্রোমোট করেছেন। মিডল অর্ডারের গড়পড়তা ব্যাটসম্যান শেওয়াগকে ওপেনে তুলে এনে তার ক্যারিয়ার বদলে দিয়েছেন, যার সুফল ভোগ করেছে ভারতের ক্রিকেটও।
# তিনি বিদেশের মাটিতে ভারতের টেস্ট জেতার অভ্যাস রপ্ত করিয়েছেন।
# তিনি ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি টানা ৪ ম্যাচে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছেন।
# অস্ট্রেলিয়ান কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে বিরোধে জড়িয়ে দল থেকে বাদ পড়েছেন। চ্যাপেলের ষড়যন্ত্রে রাহুল দ্রাবিড়ও নাকি তাকে নিয়ে রাজনীতি করেছেন ( যদিও গাঙ্গুলীর পড়তি ফর্ম আর ফিটনেসের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গেই এটা নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে। বলা যেতে পারে, তারাও আশা করেছিল ফর্ম-ফিটনেস খারাপ থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র অতীত পারফরম্যান্সের কারণে তাকে সুযোগ দিয়ে যেতে হবে। এই জায়গায় বাংলাদেশী আর পশ্চিমবঙ্গের সমর্থকদের মানসিকতা কাছাকাছি)
# বি-গ্রেডের নায়িকা নাগমাকে জড়িয়ে তার এক স্ক্যান্ডাল রটেছিল এবং এ নিয়ে সে সময়ে প্রচুর মুখরোচক খবর প্রকাশিত হতো।
# স্পিন বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে লং অন বা মিড উইকেটের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকানোয় তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
# দ্রুতগতির বলের বিপক্ষে তাকে নড়বড়ে মনে হতো। শর্ট বল একেবারেই খেলতে পারতেন না, লেগসাইডে তেমন কোনো স্কোরিং শট ছিলোই না বলতে গেলে। তবে পেস বলে স্টেপ আউট করে এক্সট্রা কভার আর মিড অফের উপর দিয়ে উড়িয়ে মেরে বাউন্ডারি বের করতে জানতেন।
# ২০০১ এ অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে তিনি ৪ বার টসের সময় দেরি করে উপস্থিত হয়েছেন যা অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহকে বিরক্ত করেছিল। ২০০২ এর ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর তিনি জার্সি খুলে আনন্দ প্রকাশ করে সমালোচিত হয়েছিলেন।
# ক্রিকেট ছেড়ে ধারাভাষ্যে এসে পক্ষপাতমূলক কথা বেশি বলেন ( যদিও ভারতের সমালোচনা করার প্রসঙ্গটা বেশিরভাগেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়)
সৌরভ গাঙ্গুলী সংক্রান্ত বাজারে-বাতাসে ভাসা তাজা খবর সব শেষ। আমরা এবার বাজার থেকে ছুটে গিয়ে মাঠ চক্কর দিয়ে মাথার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবো।
সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্রিকেটিয় কন্ট্রিবিউশন বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের দুটো সিদ্ধান্তের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রথমত, রাহুল দ্রাবিড়কে কিপার বানিয়ে দিয়ে একজন এক্সট্রা ব্যাটসম্যান খেলানো। দ্বিতীয়ত, ৫ম বোলার হিসেবে পার্ট টাইমার আর মিনি অলরাউন্ডার ব্যবহার করা।
সিদ্ধান্ত দুটির গভীরে যাওয়া যাক। ভারতীয় দলে উইকেট কিপার হিসেবে যারা খেলেছে প্রায় সবাই মূলত উইকেট কিপার যারা লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের তুলনায় কিছুটা ভালো ব্যাটিং জানে৷ নয়ন মঙ্গিয়ার পূর্বে যারা কিপার ছিলেন তাদের ব্যাটিংয়ের অবস্থা আরো বাজে ছিল। মঙ্গিয়া টেস্টে ওপেনও করেছেন, আরেক কিপার সাবা করিম ওয়ানডেতে ওপেন করেছেন কিছু ম্যাচ, তবু তাদের ব্যাটিং সামর্থ্য প্রশ্নাতীত নয়।
এই তালিকায় আরো কয়েকজন ভারতীয় কিপারের নাম আসতে পারে৷ বিজয় দাহিয়া, অজয় রাত্রা, দিপ দাসগুপ্ত, সমীর দিঘে, প্রসাদ। কিন্তু কেউই জেনুইন ব্যাটসম্যান হিসেবে কন্ট্রিবিউটিং ছিলো না।
গাঙ্গুলী উপলব্ধি করেন, কিপারকে আগে জেনুইন ব্যাটসম্যান হিসেবে একাদশে জায়গা পেতে হবে, তারপর কিপিং। তার এই উপলব্ধি থেকেই দ্রাবিড়ের কিপার বনে যাওয়া, যিনি সম্ভবত ৭৩টি ম্যাচে কিপিং করেছিলেন।
তার স্মার্ট থিংকিংয়ের ফলাফলস্বরূপ পরবর্তীতে যেসব কিপার দলে এসেছে প্রত্যেকে প্রথমে ব্যাটসম্যান, পরে কিপার। পার্থিব প্যাটেল, দীনেশ কার্তিক, এবং তারই পরিক্রমায় আজকের মহেন্দ্র সিং ধোনি।
তিনি সময়ের চাইতে এগিয়ে গিয়েছিলেন চিন্তাধারায় যার নিদর্শন পাওয়া যায় ৫ম বোলার সংক্রান্ত নীতিতে। তিনি উপলব্ধি করেন, যদি ৪০ ওভার জেনুইন বোলার দিয়ে বোলিং করিয়ে নেয়া যায়, কিংবা ৩০ ওভার জেনুইন ১০ ওভার অলরাউন্ডার করে ফেলতে পারে, বাকি ১০ ওভার বুদ্ধি করে খরচ করলে ওটার জন্য ম্যাচে বড়ো প্রভাব পড়বে না, বরং ব্যাটিংটা শক্ত করে নেয়া যাবে। এই চিন্তা থেকেই পার্ট টাইমার আর মিনি অলরাউন্ডাররা নিয়মিত বোলার হয়ে উঠে। এখনকার ওয়ানডে ক্রিকেট ফিলোসফি পর্যবেক্ষণ করলে গাঙ্গুলীর সেই চিন্তার সাথে অদ্ভুত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অন্য দলগুলো গাঙ্গুলীর রেসিপি অনুসরণ করেছে এমন নয়, কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক এখনকার ক্রিকেট সেই ধারাপাতেই চলছে। এটাকে তার দূরদর্শী চিন্তা হিসেবেই দেখতে চাই।
তবে গাঙ্গুলী তরুণদের প্রমোট করেছেন এই বক্তব্যটার সাথে একমত হলেও এর ব্যাকগ্রাউন্ড থিংকিং বা ইনটেনশন নিয়ে আমার কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। এক্ষেত্রে ফিরে যেতে হবে আরো পেছনে।
গাঙ্গুলীর জন্ম অত্যন্ত স্বচ্ছল পরিবারে। বয়সভিত্তিক দলে তাকে নিয়ে একবার গোলমাল বেঁধেছিল, তিনি দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে ড্রিংকস আর তোয়ালে টানতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন, কারণ এটা নাকি তার সোস্যাল স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। ১৯৯২ এ ভারতের মূল দলে সুযোগ পাওয়ার পরেও তিনি একই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, বলেছিলেন পানি টানা আমার কাজ নয়।
এই দুটো ঘটনার সাথে তরুণদের প্রমোট করাটা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তিনি একজন প্রচণ্ড ইগোতাড়িত মানুষ, এবং কারো অধীনে থাকার চাইতে নিজে কমান্ড করাটা উপভোগ করেন। তার আমলে কোচ ছিলেন জন রাইট, যিনি কঠোর প্রকৃতির ছিলেন না ততটা। পক্ষান্তরে চ্যাপেল ভাইরা আদ্যন্ত মেন্টালি টাফ অস্ট্রেলিয়ান প্রকৃতির, গাঙ্গুলীর সাথে ইগো কনফ্লিক্ট বাঁধাটা অনিবার্যই ছিল। এবং ভারতীয় চিন্তাধারা বা ক্রিকেট সংস্কৃতির সাথে অস্ট্রেলিয়ান মানসিকতার তখনো ব্যবধান ছিলো বিশাল, যে কারণে অন্যদের থেকেও চ্যাপেল সেই সমর্থনটি আদায় করতে পারেননি।।
গাঙ্গুলীর তরুণ প্রমোটের মূল উদ্দেশ্য তাই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিলিপ্সা হিসেবেই দেখি। তরুণরা নিজেদের পায়ের মাটি শক্ত করতে বেপরোয়া থাকে, অধিনায়কের সমর্থন পেলে তারা রিটার্ন দিবে এটাই ভবিতব্য। ভার্সিটির রাজনীতি প্যাটার্নটা খেয়াল করা যেতে পারে এক্ষেত্রে। নেতাদের ক্যাডার বাহিনী বা মিছিলে অগ্রগামী থাকে মূলত জুনিয়ররা, যার অধীনে যত বেশি জুনিয়র আছে সে তত প্রভাবশালী নেতা।
গাঙ্গুলীর তরুণনীতিও সেই রাজনীতির অংশ, যা পরবর্তীতে ধোনিও অনুসরণ করেছে, এবং সাফল্য পেয়েছে।
তবে কি এই রাজনীতিটা আদতে উপকারী?
বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজনীতিকে কাউন্টার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। দুনিয়ার সমস্ত ক্রিকেট দলে যেখানে অভিজ্ঞ আর অনভিজ্ঞ/তরুণ এই দুই ক্যাটেগরিতে বিভক্ত, একমাত্র বাংলাদেশেই সেটা হয়েছে সিনিয়র আর জুনিয়র।
ভার্সিটিতে সিনিয়র-জুনিয়র থাকতে পারে, ক্রিকেট খেলায় এগুলো কোনো অর্থই বহন করে না৷ জুনিয়র রান করবে না, উইকেট নিবে না, তাদের দায়িত্ব কেবল সিনিয়রদের সাহায্য করা— এই মালিক-দাস মনোবৃত্তিই বাংলাদেশের ক্রিকেট রাজনীতির নোংরা চেহারাটা দেখিয়ে দিচ্ছে। যদি ‘অভিজ্ঞ’ ট্যাগটা ব্যবহার করি বাংলাদেশের বর্তমান দলে সৌম্য, সাব্বির, মোসাদ্দেক, মিরাজ, রুবেল, সাইফুদ্দিন, লিটন, সাইফুদ্দিন প্রত্যকের অভিষেক হয়েছে ২০১৭ বা তারও আগে, ক্যারিয়ারের বয়স প্রায় ৩ বছর, ম্যাচ খেলেছে ( সাইফুদ্দিন বাদে) ২০ টিরও বেশি। তবু তাদের অভিজ্ঞতা হয়নি, তারা এখনো অনভিজ্ঞ বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জুনিয়র। একজন ক্রিকেটার কয় বছরই বা জাতীয় দলে খেলে, খুব ধারাবাহিক পারফর্ম করলে ১২-১৩ বছর। সাকিব, মাশরাফি, তামিম, মুশফিক ২০ এর নিচে দলে এসেছিল বলে ক্যারিয়ারের বয়স আরো বেশি হবে হয়তো।
বাংলাদেশ দলে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের অভাব না থাকলেও জুনিয়র ট্যাগের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না সিনিয়র সিন্ডিকেট রাজনীতিতে। দলে তরুণ ক্রিকেটার নেই বললেই চলে, অথচ সারা বছর আমরা খেলি নিচের টায়ারের দলগুলোর বিপক্ষে, তাদের সাথেও যদি তুলনামূলক কম অভিজ্ঞদের বাড়তি দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ না দেয়া হয়, এবং তরুণ ক্রিকেটারদের না খেলানো হয়, অভিজ্ঞতা বাড়বে না, তরুণও আসবে না, কেবল হাহাকার শোনা যাবে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ চলে গেলে আমাদের দলের অবস্থা কেনিয়ার মতো হবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচাইতে স্মার্ট সিদ্ধান্ত ছিল ২০০৩ বিশ্বকাপের পরে বুড়োদের সরিয়ে ফ্রেশব্লাডদের সুযোগ দেয়া, যার ফল পেয়েছিল ২০০৭ বিশ্বকাপে। এখনো পর্যন্ত সেই বিশ্বকাপকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি পারফরম্যান্সের ওজনে।
সৌরভ গাঙ্গুলী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট রাজনীতি ঢুকে পড়েছে মূলত গাঙ্গুলীর বাঙালি পরিচয় আর সেটার সোস্যাল এন্টারপ্রেটেশন বুঝতে।
৯০ এর দশকে বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন আজহার উদ্দিন। জীবনে একটিও ক্রিকেট ম্যাচ দেখেনি এমন মানুষও আজহারের নাম জানতো। হিন্দু অধ্যুষিত ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক একজন মুসলিম এটা বহু বাংলাদেশী মুসলমানকে আনন্দিত করতো।
অনুরূপভাবে, সৌরভ গাঙ্গুলী তারকাখ্যাতি পাওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টেস্ট আর ওয়ানডে ম্যাচের পার্থক্য না জানা মানুষও এক বাঙালি ছেলে ইংল্যান্ডের মাটিতে ২টা সেঞ্চুরি করেছে সেই সংবাদে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। পরবর্তীতে, বাংলাদেশী মিডিয়া যখন আবিষ্কার করলো গাঙ্গুলীর পূর্বপুরুষের কেউ বাংলাদেশে বসবাস করতো, তিনি তখন আরো আপন হয়ে উঠেন, এবং টেন্ডুলকার আর গাঙ্গুলীর মধ্যে কে বড়ো ব্যাটসম্যান সেই মিনিংলেস বিতর্কেও সময় খরচ করেছে। প্রসেনজিত আর যীশু চ্যাটার্জি অভিনীত এক সিনেমায় দেখা যায়, যীশু ভারতের মূল দলে সুযোগ পেয়েছে, বাজিকরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে ম্যাচ ফিক্সিং করেছে। টেন্ডুলকারের এক রান আউট ফুটেজ দিয়ে বোঝানো হয় তিনি ম্যাচে রান আউট হয়ে গেছেন, তারপর গাঙ্গুলীর সেঞ্চুরি করা ম্যাচের ফুটেজ দেখিয়ে যীশু আর বাজিকর দুজনের মুখ দিয়েই সংলাপ বলানো হয় ‘ গাঙ্গুলী বাঘের মতো খেলে ভারতকে জিতিয়ে দিয়েছে’
মনে হতে পারে তুচ্ছ ঘটনা, তবু টেন্ডুলকারকে রান আউট করার বিপরীতে গাঙ্গুলীর পূর্বে ‘বাঘ’ বিশেষণ ব্যবহারের মাধ্যমেই বোঝা যায়, বাঙালি ( পশ্চিমবঙ্গের পুরোটা+ বাংলাদেশের আংশিক) মননে গাঙ্গুলী কেবল একজন গ্রেট ওয়ানডে ব্যাটসম্যান হিসেবে থাকলেই চলবে না, তাকে টেন্ডুলকারের চাইতেও গ্রেটের মর্যাদায় থাকতে হবে। গাঙ্গুলীর আগে-পরে মিলিয়ে আর কোনো বাঙালি ক্রিকেটার তার পর্যায়ের প্রভাবশালী ভারতের ক্রিকেটে হতে পারেনি বিধায় তিনি আরো মহিমাণ্বিত হয়ে উঠেন।
তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনকার পর্যায়ে থাকলে গাঙ্গুলী নিশ্চিতভাবেই আমাদের জনপদে এতোটা গুরুত্ব পেতেন না, যতটা এখন পাচ্ছেন।
ভারতের ক্রিকেটে গাঙ্গুলীর অবস্থান কোথায় হতে পারে?
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসেই গাঙ্গুলী-টেন্ডুলকার সফলতম ওপেনিং জুটি, তবু আইরনি হলো ভারতের সর্বকালের ওয়ানডে একাদশ করলে সেখানে গাঙ্গুলীর ঠাঁই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শেওয়াগ আর রোহিত শর্মা এমন সব কীর্তি গড়ে ফেলেছেন টেন্ডুলকারের সাথে ওপেনিং স্লটে এই দুজনেরই কেউ একজন জায়গা পাবে। খেলোয়াড়ি জীবনে শেওয়াগকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজের ৩ এ নেমে যাওয়া থেকেই সুস্পষ্ট হয়। তবে ব্যাক আপ ওপেনার হিসেবে তিনি অবশ্যই স্কোয়াডে থাকবেন।
এ তো গেল, একাদশ। ভারতীয় ক্রিকেটের মাত্র ৫ জন গ্রেটের নাম করলে গাভাস্কার, কপিল, টেন্ডুলকার এর পরে যে ২টি জায়গা বাকি থাকে কোহলি, দ্রাবিড়, ধোনি, কুম্বলে, আজহার, শেওয়াগকে ঠেলে সেখানে কি তিনি ঢুকতে পারবেন?
এটাও জটিল এবং বিতর্কিত মনোনয়ন।
তবে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র ৩ জন অধিনায়কের নাম জমা দিতে বললে হয়তোবা ৯৭% ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট মানুষই তার নাম সেখানে রাখবেন।
অধিনায়ক সৌরভ কি তবে ব্যাটসম্যান গাঙ্গুলীর চাইতেও বড়ো হয়ে গেল?
পরিস্থিতি তা-ই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
তার রাজনৈতিক মস্তিষ্ক, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ব্যক্তি হিসেবে তাকে প্রশ্নসাপেক্ষ করলেও লিডারশিপ যোগ্যতা আর সাহসিকতায় প্রশ্নগুলোও ডাউন দ্য উইকেট ছক্কায় গ্যালারিতে আঁছড়ে পড়ে।
কিন্তু গাঙ্গুলী যা পারলেন তা আজহারউদ্দিন কেন পেরে উঠলেন না? গাঙ্গুলী যেমন বাঙালি হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটে স্ট্যাটাসের দিক থেকে মাইনরিটি, আজহারও তো ধর্মীয় কনটেক্সট এ মাইনোরিটিই। প্রথমত, দুজনের ব্যক্তিত্বের ধরন পুরোপুরি আলাদা। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিকতা কনটেক্সট এ মাইনোরিটি ধর্মীয় পরিচয়ে গাঙ্গুলী মেজরিটির মধ্যেই ছিলেন।
আগামী ১০ বছরে ভারতের ক্রিকেট যে অবস্থানে পৌঁছাবে তাতে ক্রিকেট ইতিহাস জেনুইন ব্যাটসম্যান আর জেনুইন বোলারদেরই বিশেষভাবে মূল্যায়ন করবে, অধিনায়কত্ব ফ্যাক্টির খুব প্রাধান্য পাওয়ার কথা নয়। ব্র্যাডম্যানের দলের অধিনায়ককে কতজনে মনে রেখেছে।
গাঙ্গুলীর প্রাসঙ্গিকতা তাই ফিঁকে হয়ে যাবে হয়তো। একারণেই লেখার শুরুর সেই ২ ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার, যা কালনিরপেক্ষ, এবং তার বদৌলতেই ওয়ানডে ক্রিকেটে গাঙ্গুলীকে উপেক্ষা করে কোনো ইতিহাস লেখা সম্ভব তা বিশ্বাস করি না।