নিবন্ধের শুরুতেই দুটো কেইস উল্লেখ করতে চাই, যা এই নিবন্ধের কনটেক্সট বুঝতে অতিমাত্রায় সহায়ক হতে পারে:
কেইস১: অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ, সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ মৌসুম। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মার্ক টেলর ৩৩৪ রানে অপরাজিত, ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ড থেকে দূরত্ব মাত্র ৪১ রানের, যা ভেঙ্গে ফেলা খুবই বাস্তব সম্ভাবনা তখন। কিন্তু মার্ক টেলর বিশ্বরেকর্ডের প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করে নিজে ৩৩৪ রানে অবস্থায়ই ইনিংস ডিক্লেয়ার করে বসেন। কারণ ডন ব্র্যাডম্যানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস ৩৩৪ রানের, তিনি ব্র্যাডম্যানের নামের পাশে থাকতে চেয়েছেন, ব্যক্তিগত রেকর্ডকে মনে হয়েছে তুচ্ছ! ট্রিবিউট শব্দের বাংলা অর্থটা কী?
কেইস২: টেন্ডুলকারের ১৪ বছর বয়সে গাভাস্কার তাকে একটি হালকা প্যাড উপহার দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সেটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো। মুম্বাই এসোসিয়েশন যখন উদীয়মান ক্রিকেটার হিসেবে টেন্ডুলকারকে পুরস্কার দেয়নি তখন গাভাস্কার তাকে এক চিঠি লিখেন- ‘তোমার মন খারাপের কিছু নেই। তুমি পুরস্কার না পাওয়াদের তালিকায় এমন একজনের নামও পাবে (গাভাস্কার স্বয়ং) যার টেস্ট রেকর্ড খুব খারাপ না’। টেন্ডূলকার গাভাস্কারের রেকর্ড ভেঙ্গে কোথায় গিয়ে থামবেন এ নিয়ে যখন প্রায়ই কথা হতো তখন গাভাস্কারই এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন – ‘ও যদি ক্যারিয়ার শেষে kহাজার (সঠিক সংখ্যাটা মনে পড়ছে না বিধায় k ব্যবহার করলাম) রান করতে না পারে আমি ওর টুঁটি চেপে ধরবো’। ক্যারিয়ারজুড়ে যার সাথে তার তুলনা সবচাইতে বেশি হয়েছে সেই ব্রায়ান লারার মন্তব্যটা স্মরণ করা যেতে পারে- ‘বাস্কেটবল এ মাইকেল জর্ডান, বক্সিংয়ে মোহাম্মদ আলী, ক্রিকেটে শচীন’।
গতকাল কোহলি যখন দ্রুততম ১০ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন, টেন্ডুলকার টুইট করেছেন- The intensity and consistency with which you bat is just amazing. @imVkohli, congratulations on achieving 10,000 runs in ODIs. Keep the runs flowing.
২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাদের সবচাইতে সিম্বলিক সেলিব্রেশন দৃশ্যটা এখনো ইউটিউব বা গুগলে বর্তমান। টেন্ডুলকারের হাতে ভারতের পতাকা, তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছে সতীর্থরা। হরভজন সিং, ইউসুফ পাঠান, সুরেশ রায়না এর সহায়তায় যে ব্যক্তিটি মূলত তাঁকে কাঁধে চাপিয়েছেন তিনি ভিরাট কোহলি। মাইক্রোফোনের সামনে তাঁর সেই বক্তব্যটা এখনো মনে পড়ে- ‘this man has carried the burden of the nation for 21 years. It is time we carried him on our shoulder’!
আমরা সিনেমা কেন দেখি? অধিকাংশ মানুষ কখনো গভীরভাবে চিন্তাই করেনি কারণটা; সিনেমা দেখার প্রধানতম কারণ ‘কনফ্লিক্ট’। যে ভাষারই সিনেমা হোক, কনফ্লিক্টবিহীন সিনেমা মানুষ দেখবে না। কনফ্লিক্ট মানে কিন্তু তামিল-তেলেগু সিনেমার কোপাকুপি, কিংবা বলিউড-ঢাকাই সিনেমার নায়ক-ভিলেন ঢিসুম-ঢুসুম নয়; কনফ্লিক্ট মানে সাইকোলজিকাল মিসম্যাচ যার প্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত আমরা নড়েচড়ে বসি এবং কাহিনীতে ঢুকে পড়ি। কনফ্লিক্ট নেই, আমরাও নেই!
এই আমরা আসলে কারা? যে কোনো শিল্প অথবা বিনোদন মাধ্যমের ভোক্তাশ্রেণী। আমাদের ভোক্তা অধিকারের প্রধানতম দাবিই কনফ্লিক্ট। নইলে আমরা তর্ক করতে পারি না, আড্ডা জমে না, চিন্তা আসে না, উপাত্ত পাই না। গুণীজনের মুখে শুনেছি- মানুষের জিনে নাকি কোঅপারেশন আর কম্পিটিশন দুটো প্রবণতাই সক্রিয়। তাদের বক্তব্যকে আরো সরলীকৃত করলে, কোঅপারেশন কিংবা কম্পিটিশনের মূল উৎস কিন্তু কনফ্লিক্ট!
এর মধ্য দিয়ে কনফ্লিক্টকে মহিমাণ্বিত করছি কিনা এই প্রশ্ন জাগ্রত হওয়ার পূর্বেই আপনাকে আমি অন্য এক সত্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে উদ্বুদ্ধ করবো যখন জানবেন কনফ্লিক্ট আদতে ২ প্রকার- হেলদি কনফ্লিক্ট, আগলি কনফ্লিক্ট। মানুষের যা কিছু সুন্দর সৃষ্টি দেখেন এগুলোর জ্বালানী আদতে হেলদি কনফ্লিক্ট। কিন্তু চটকদার, গ্ল্যামারাস কিংবা সাময়িক হাইপ জাতীয় যে কোনো কার্যক্রমর মূল ফ্যাক্টর সেই আগলি কনফ্লিক্ট। মানবজাতির দুর্ভাগ্য আগলি কনফ্লিক্টের ম্যাজিকে হেলদি কনফ্লিক্ট নিষ্ক্রিয় হতে হতে নপুংসকতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নইলে পৃথিবীটা হয়তোবা আরো বাসযোগ্য হতো।
যে কোনো সেক্টর, হোক সেটা শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র কিংবা রাজনীতি-অর্থনীতি, তার একটা পরম্পরা বা লেগাসি রক্ষার দায় থাকে, যার সঙ্গে জড়িত থাকে সম্মান এবং মূল্যায়ন। এই ধারাকে আমরা বলতে পারি ‘আইডল ফিগার’। তবে আইডল ফিগার মানা আর অনুসরণ/অনুকরণ করার মধ্যে তফাত বিস্তর। আইডল ফিগারের সাথে আপনার মত আর পথের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু আপনি জীবনে যা হয়েছেন তা হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বা তারাই আপনার অনুপ্রেরণার উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে। আর কাউকে অনুসরণ করা মানে আপনি তার মতো হতে চেয়েছেন। দুইয়ের মধ্যে দুর্যোধন-ভীম পর্যায়ের ব্যবধান।
আইডল ফিগার কখনো আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, তার সাথে যোগ্যতা নিয়েও তুলনা চলতে পারে না। তাতে আইডল ফিগারের কিছুই যায় আসে না, আপনি নিজে চোরাবালিতে আটকে পড়বেন। আপনার স্বতন্ত্র আইডেন্টিটি হবে না; উঠতে-বসতে আপনি কেবল তার সাপেক্ষে উচু নাকি নিচু সেই নিখুঁত-নির্ভুল মাপামাপির গিনিপিগ বৈ কিছুই হতে পারবেন না। অমিতাভ বচ্চনকে বলা হয় বিগ বস, তিনি নিজে বহুবার বলেছেন দিলীপ কুমারকে আইডল মানতেন। অনুরূপভাবে শাহরুখ খান-আমির খান হয়তোবা অমিতাভ বচ্চনকে আইডল মানেন না, কিন্তু তারা অন্য কোনো না পেশায় গিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসে মেগাস্টার হয়েছেন এর পেছনে অমিতাভ বচ্চনের অনস্বীকার্য এবং অনিবার্য অবদান রয়েছে। বচ্চনের সিনেমা দেখেই হয়তোবা তাদের মধ্যে সিনেমার ভূত ভর করেছিলো। দিলীপ কুমার-অমিতাভ বচ্চন-শাহরুখ/আমির, এভাবেই আইডল ফিগার তত্ত্ব কাজ করে। কিংবা কলকাতা সিনেমায় কত নায়কই তো এলো-গেলো, কিন্তু উত্তম কুমারের যে ইমেজ তার আগে-পরে সেই জায়গায় কেউ উঠতে পেরেছেন, নাকি পারবেন কখনো?
ক্রিকেটের লেখায় সিনেমার আলোচনা কেন? স্পোর্টস আর ফিল্ম কি একই ধারায় চলে? কখনোই না। স্পোর্টস সাইকোলজি আলাদা; এর সাথে ন্যাশনালিজম এমনভাবে জড়িত আপনি চাইলেও রেশনালিটি দিয়ে এখানকার সবকিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। সঞ্জয় দত্ত বোমা হামলা মামলার আসামী হওয়া সত্ত্বেও মুন্না ভাই সিরিজ দেখে মানুষ তার ফ্যান হবে নতুন করে, অন্যদিকে মোহাম্মদ আমির বাজিকরদের যোগসাজশে ওভারস্টেপিংয়ে নো-বল করে ঘৃণিত-নিন্দিত। ক্রিকেট খেলায় নো-বল করেনি এমন পেসার খুঁজেই পাওয়া যাবে না হয়তো, নো-বল হলে ওভারে একটা ডেলিভারি বেশি করতে হয়। এটা কি বোমা হামলায় মানুষ মারার চাইতেও গুরুতর এবং গর্হিত অন্যায়/অপরাধ? এখানেই স্পোর্টসের সাথে অন্য যে কোনো এন্টারটেইনমেন্ট কিংবা ইন্টেলেকচুয়াল মিডিয়ামের প্রভেদ। স্পোর্টস এতোটাই শক্তিশালী!
একারণে আইয়ুব বাচ্চু আর জেমসের মধ্যে কে সেরা, আমির খান নাকি শাহরুখ খান, টম ক্রজ নাকি ব্রাড পিট, মাধুরী নাকি জুহি চাওলা- কে এগিয়ে এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, তর্কাতর্কি চললেও সেটা কখনোই পেলে নাকি ম্যারাডোনা, মেসি নাকি রোনালদো, কিংবা শচীন নাকি লারা সেই ইনটেনসিটিতে উঠে না- এইসব তর্ক নিছক কথার লড়াই থাকে না, সেটা হয়ে উঠে মান-সম্মান, আভিজাত্য রক্ষার দায়। জেমসের ফ্যান আইয়ুব বাচ্চু ফ্যানকে মারধোর করেছে এই ঘটনা খুবই বিরল, কিন্তু ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে রীতিমতো শারীরিক সংঘর্ষে বেঁধে যায়, এককালে ঢাকার ঘরোয়া লীগেও আবাহনী-মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে অহরহ মারামারি লাগতো।
তার মানে স্পোর্টসের ক্ষেত্রে কনফ্লিক্টটা হেলদি থাকে খুব কম ক্ষেত্রেই, মোটাদাগে দেখলে সেখানে আগলি কনফ্লিক্টই চোখে পড়বে। কনফ্লিক্ট আরো তীব্র হয় তুলনাতত্ত্বে। সেই তুলনার রসদ যোগাতে দিন-রাত একাকার করে ফেলে মিডিয়া। কনফ্লিক্ট বিক্রি করেই অস্তিত্ব রক্ষা করে মিডিয়া নামক মধ্যস্বত্বভোগী কর্পোরেশনটি। দেশ-ভাষা যেটাই হোক, স্পোর্টস-রাজনীতি কিংবা এন্টারটেইনমেন্ট সেক্টর যা-ই হোক, পৃথিবীর সর্বত্রই মিডিয়ার আচরণ কম-বেশি একই। ২৯% যদি পজিটিভ ইমপ্যাক্ট রাখে, ৭১%ই খরচ করে কনফ্লিক্ট প্রমোট করতে। অবশ্য কনফ্লিক্ট না থাকলে মিডিয়াই বিলুপ্ত হয়ে যেতো। অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে অনেক কিছুই করতে হয় আমাদের, কিন্তু ‘এথিকাল বাউন্ডারি’ সম্বন্ধে বোধ থাকা খুবই জরুরী। সেটা না থাকলে ট্যাপা মাছ আর টেংরা মাছের মধ্যে পার্থক্য করতে না পেরে ট্যাপা মাছ খেয়েই মরতে হয়।
মিডিয়া তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই যুগে যুগে আমাদের কনফ্লিক্ট সরবরাহ করেছে। আমরা গোগ্রাসে গিলি/গিলেছি সেসব, এবং প্রতীক্ষায় থেকেছি আরো রকমারি, সেক্সি কনফ্লিক্টের।
টেন্ডুলকার আমাদের কনফ্লিক্ট অবসেসন কিংবা আসক্তির শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। তার সাথে লারার তুলনা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক; পন্টিং, মার্ক ওয়াহ, সাঈদ আনোয়ার কিংবা ক্যালিস এরাও রেসে থাকতে পারে। কারণ এই সকল হেলদি কনফ্লিক্ট না থাকলে দর্শক খেলা দেখবে কীভাবে? আপনি যখন খেলা দেখতে বসেন, দুই দলের কোনোটা সম্বন্ধেই ধারণা নেই আপনার, তবু ১৭ মিনিটের মধ্যেই আপনি কোনো একটি দলের প্রতি সমর্থন দিতে বাধ্য হবেনই। নয়তো খেলা দেখতেই পারবেন না। সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা না টানলে হাইপ তৈরি করা যায় না। হাইপ না থাকলে ভোক্তাশ্রেণী মেন্টালি এটাচড হবে কীভাবে? আমরা মানুষেরা তো রিলিফের মালের মতো, বণ্টিত হতে তৈরিই থাকি।
কিন্তু অচিরেই মিডিয়া নামক অক্টোপাসটি অনুধাবন করলো, কেবলমাত্র হেলদি কনফ্লিক্ট দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা হবে বড়োজোর, ভুরিভোজ হবে না। কনফ্লিক্টকে আগলি বা কুৎসিত স্তরে উন্নীত করতে হবে। এর ভোক্তাশ্রেণী অনেক বড়ো এবং ব্যাপক। নায়িকা পপি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- সেন্সর বোর্ড না থাকলে অনেক অভিনেত্রী প্যান্টি পরেও শট দিতো। কথাটায় মেরিট আছে। পর্ণো দেখার মধ্যে রুচিবিকৃতি কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিইমেজ নিয়ে সংকট/প্রশ্ন থাকলেও ‘অরিজিনাল সিন’ সিনেমায় এন্টোনিও ব্যান্ডেরাস- এঞ্জেলিনা জোলির যৌনদৃশ্য কিংবা যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিলো সিনেমায় ইন্দ্রানী হালদার-সুদীপ মুখার্জীর যৌনদৃশ্য দেখা দর্শকের সংখ্যা বাড়ে। মানুষ এমনই; পুরোপুরি খোলামেলার চাইতে ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ তাকে আকৃষ্ট করে বেশি।
ফলে সমসাময়িকদের মধ্যে তুলনাটা সাংসারিক প্রেমের মতো বৈধ এবং কিছুটা রষকষহীন, পূর্বসূরী-উত্তরসূরীর মধ্যে তুলনাটা পরকীয়া প্রেমের মতো উদ্দাম। সুতরাং ‘সর্বকালের’ ‘সর্বযুগের’ প্রভৃতি নোংরা শব্দের আমদানী করো, এবং বাঁধিয়ে দাও কনফ্লিক্ট। তাতে কেবলমাত্র একটি প্রজন্ম নয়, সকল প্রজন্ম সম্পৃক্ত হয়ে পড়বে, কনফ্লিক্টের তীব্রতা বাড়বে।
যেমন ডন ব্র্যাডম্যানের সাথে গাভাস্কারের, কিংবা ব্র্যাডম্যানের সাথে টেন্ডুলকারের, কিংবা গাভাস্কার আর টেন্ডুলকারের মধ্যে তুলনা জুড়ে দাও। এই কাজে কয়েকজন পরিসংখ্যান এক্সপার্টকে নিযুক্ত করো, তারপর বসে বসে চাওমিন খাও আর কনফ্লিক্ট দেখো। এক পক্ষ বলবে ওমুকের সময়ে আনকভারড পিচ, তমুকের সময় বাউন্সারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ না থাকা, হেলমেট না থাকা, কিংবা হেনতেন বোলার ছিলো তখন, ট্যাংকের গোলা ছাড়তো বলের বদলে, এখনকার সময়ে তক্তা ফ্ল্যাট পিচ, বোলারদের মৃত্যুকূপ। কাউন্টারে বলবে, প্রযুক্তির উন্নতিহেতু খেলা নিয়ে প্রচুর এনালাইসিস বেড়েছে, ফিটনেস লেভেল নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হচ্ছে, এগুলো আগে ছিলো না। যুক্তি-কুযুক্তির গোলাগুলি-কোলাকুলি শেষ হবে না ৭০৯ বছরেও। আমার চাচা হয়তো ভিভ রিচার্ডসের খেলা দেখেছে, তার কাছে সে-ই ব্যাটিংয়ের শেষ কথা, আমি টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি, সুতরাং ভিভ রিচার্ডস আমার কাছে মিথ। আবার আমার ভাগ্নে কোহলির ব্যাটিং দেখতে বসে থাকে, টেন্ডুলকার তার কাছে কিছুই না। আমিও টেন্ডুলকারকে যতো দেখেছি , তার ১১ ভাগের ১ভাগও দেখতে পারি না কোহলিকে, যেহেতু বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রায়োরিটি লিস্টে পরিবর্তন এসেছে। ফলে ভাগ্নের চোখে দেখা কোহলি আর আমার কোহলি এক না। কিন্তু মিডিয়া নিমেষের মধ্যে আমাদের ৩ প্রজন্মকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসবে- কে সেরা, এমন এক প্রশ্নের মাধ্যমে। আমরা তখন পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিবো, যেই দেখবো পরিসংখ্যানে কুলোচ্ছে না, তখন অস্ত্র হিসেবে আনবো খেলার মান, প্রতিপক্ষ, নিয়ম-কানুন প্রভৃতি ফ্যাক্টরকে; যে কারণে কনফ্লিক্ট আরো বাড়বে!
তাহলে আর আইডল ফিগার থাকলো কীভাবে? গাভাস্কার না থাকলে কি টেন্ডুলকার তৈরি হতো, কিংবা টেন্ডুলকার ব্যতীত কোহলি? উত্তরপ্রজন্ম বরাবরই পূর্বপ্রজন্মের চাইতে মেন্টালি টাফ থাকবে, নইলে পরম্পরা কিসের! ৭০ বছর আগে আমার দাদা ৮ টাকা বেতনে চাকরি করতো, আমি যদি ৮ লাখে উঠতে না পারি তাহলে দাদা অবশ্যই আমার চাইতে স্মার্ট। এটাই নিয়ম। কিন্তু ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানা কি তুলনায় আসতে পারে? মানে আমার দাদা ভালো লিখতে পারতেন, নাকি আমি? কিংবা আমার দাদা ভালো শ্রোতা, নাকি আমি? সেটাও নিজের দাদার সাথে হতে পারে না, দাদার সমবয়সী অন্য কেউ হতে পারে। কারণ, দাদার সাথে তুলনা মানে আমি আর দাদা আদতে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নেমে পড়ছি। বাপ-ছেলে যেমন একই মহিলাকে বিবাহ করা উচিত নয়, নিজ বংশে তুলনার ব্যাপারটও তেমন অশোভন। তাতে শ্রদ্ধা আর স্নেহের সম্বন্ধটায় একটা প্রতিদ্বন্দ্বীতার ঝাঁজ চলে আসে। শচীনের সাথে গাভাস্কারের তুলনা কোনোভাবেই হতে পারে না, কারণ তারা একই দেশের পতাকা বহন করছে; তুলনা হতে পারে ভিভ রিচার্ডস, মার্টিন ক্রো কিংবা অন্য দেশের প্রাক্তন লিজেন্ডের সাথে। সেটাও খেলোয়াড়ি দক্ষতার।
তবে সেই দক্ষতার পরিমাপক কখনোই পরিসংখ্যান হবে না। এখন যে স্পিরিটে খেলা হয় ১১ বছর আগে সেই স্পিরিট ছিলো না, তার ১৯ বছর আগে আরও ছিলো না; প্রতি দশকেই খেলার স্পিরিট আর স্পিডে পরিবর্তন আসে। কাছাকাছি সময়ে খেলা শুরু করা খেলোয়াড়দের মধ্যেই তাই কেবলমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে তুলনা টানা যায়। অন্য প্রজন্মের মধ্যে তুলনা করতে হলে সেই সময়ের খেলাটা সম্বন্ধে থিসিস তৈরি করতে হবে, সেই আলোকে লেভেল অব এক্সিলেন্স সেট করে একজন খেলোয়াড় সেই এক্সিলেন্সের মানদণ্ডে কোথায় ছিলেন, আর অন্য প্রজন্মের খেলোয়াড় তার সময়ের খেলার উপর লিখিত থিসিসের প্রেক্ষিতে বানানো লেভেল অব এক্সিলেন্সে কোথায় আছেন, দুই লেভেল অব এক্সিলেন্সের পার্থক্য বা সাদৃশ্য থেকে তুলনাটা হতে পারে। সেইসব না করে পরিসংখ্যান নিয়ে গুতোগুতি করলে সেটা সমকামী বিবাহে সন্তান লাভের মতো নিস্ফল প্রচেষ্টামাত্র। অন্যদিকে লেভেল অব এক্সিলেন্স প্যারামিটারে কোহলির সাথে মেসি, ফেদেরার এমনকি শাহরুখ খানেরও তুলনা হতে পারে, যদিও তাদের ক্ষেত্র আলাদা। তাতে কী! মেসি ফুটবলের লেভেল অব এক্সিলেন্সের যে স্তরে বিলং করে, সিনেমায় শাহরুখ খান, টেনিসে ফেদেরার, ক্রিকেটে কোহলিও কি সেই স্তরে আছে, তাহলেই কিন্তু তুলনাটা খুবই সম্ভব।
অবিসংবাদীভাবেই টেন্ডুলকার ক্রিকেট খেলাটারই জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার। তার আগে বা পরে কেউ সেই জনপ্রিয়তার স্পর্শ পায়নি, অদূর ভবিষ্যতেও পাবে না নিশ্চিত। স্পোর্টসের অন্যতম প্রধান শর্ত- জনপ্রিয়তা; এটা পরিসংখ্যানের কোথাও লেখা থাকে না। টেন্ডুলকারের আন্তর্জাতিক রান ৩৪হাজার+, যেটা ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের মতোই অমানবিক, এবং কারো পক্ষেই সেটা ভাঙ্গা সম্ভব হবে না। কোহলি সর্বশেষ ৩ বছরে যে ধারাবাহিকতায় খেলে যাচ্ছে, একই হারে আরো ৮ বছর খেললেও তার পক্ষে সেই রানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না, পরিসংখ্যানপ্রিয়রা একটু গাণিতিক হিসাব করে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন।
আপনি একটা জরিপ চালাতে পারেন ৭ কোটি ক্রিকেটদর্শকের উপর। মাত্র ১জন ক্রিকেটারের নাম বলতে হবে। বিভিন্ন দেশ, বয়স মিলিয়ে নিতে হবে, যার ৫৯% থাকবে যারা ক্রিকেট নিয়মিত দেখে, এবং ৪১% যারা ক্রিকেট দেখে কিন্তু নিয়মিত নয়। ৭ কোটি অনেক বড়ো স্যাম্পল সাইজ। আমি উত্তরটা প্রেডিক্ট করে দিই; কমপক্ষে ৬১% মানুষ টেন্ডুলকারের নাম বলবে। পছন্দের ক্রিকেটার কে, এই প্রশ্ন না কিন্তু, স্রেফ রেন্ডম একজন ক্রিকেটারের নাম। ক্রিকেট ইতিহাসে টেন্ডুলকারের মতো রাজসিক বিদায় নেয়ার সৌভাগ্য কখনো কি কারো হয়েছে? ভিরাট কোহলির কি হবে, কিংবা ধোনি, এমনকি ব্রায়ান লারার? তাদের বিদায়ে বড়োজোর কিছু টুইট হবে, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা গার্ড অব অনার দেবে; এই তো। কিন্তু স্মরণ করুন টেন্ডুলকারের বিদায়ী অনুষ্ঠানটা। সেটা নিছক ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ ছিলো, নাকি ক্রিকেট ছাপিয়ে চলচ্চিত্র হয়ে গিয়েছিলো?
কিন্তু টেন্ডুলকার কেন ও কীভাবে এতো জনপ্রিয়? সেটা কি ভারতে খেলতো বলেই? তাহলে তো কোহলি, রোহিত শর্মা এদের আরো বেশি জনপ্রিয় হওয়ার কথা। তার ধারেকাছেও তো নেই তারা। অনেকে বলবেন, মহাতারকা হওয়া সত্ত্বেও তার বিনয়ী এবং পরিচ্ছন্ন ইমেজ। কিংবা খেলাটার প্রতি তার ডেডিকেশনকেও ফ্যাক্টর হিসেবে নিয়ে আসতে পারেন। সাধারণ ভোক্তাশ্রেণী সেলিব্রিটিদের লাইফস্টোরি এবং স্টাইল দুটো নিয়েই গভীর অবসেসনে ভুগে। সুতরাং উল্লিখিত ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় আসতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি না এগুলো তার জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান আর ১৯৯৮ এ এক পঞ্জিকা বর্ষে ১৮৯৪ রানের মতো অতিমানবিক রান করাকে যদি তাকে বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম টনিক বলি, প্রধান কারণ বলবো, প্রবল পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে শাসন করা একমাত্র ক্রিকেটার হওয়ার যোগ্যতাকে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার রানার আপ হওয়া ক্রিকেটের ব্যাকরণ এবং কাঠামোগত পরিবর্তনে ঐতিহাসিক এক অধ্যায়। তারই প্রেক্ষিতে মার্ক টেলরকে টেস্ট আর স্টিভ ওয়াহকে ওয়ানডে অধিনায়ক বানিয়ে টেস্ট আর ওয়ানডের জন্য আলাদা দল নীতির সূচনা করে অস্ট্রেলিয়া, যেটা পরবর্তীতে ক্রিকেট বিশ্বে এক যুগান্তকারী রোল মডেল হয়ে উঠে। স্টিভ ওয়াহ এর অস্ট্রেলিয়া ৯৭ এর পর থেকেই ক্রমশ দুর্দমনীয় হয়ে উঠতে থাকে, শুরুতে বোঝা যায় না ব্যাপারটা, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে সাউথ আফ্রিকার সাথের রোমাঞ্চকর ম্যাচের পর ফাইনালে পাকিস্তানকে যখন মাত্র ১৩২ রানে অলআউট করে দিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচাইতে একপেশে ফাইনাল উপহার দেয়, তখনই অকস্মাৎ আমরা আবিষ্কার করি অস্ট্রেলিয়া দলটা বাকি দলগুলোর চাইতে সহস্রগুণ এগিয়ে গেছে।
তার পর থেকে এক দশক পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া যে দাপট দেখিযেছে তার সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের দলও তুলনাযোগ্য নয়। খেলাটা এতোটাই বিরক্তিকর হয়ে পড়েছিলো, অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাটিং-বোলিং যা-ই করুক প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করেই জিতবে। অথচ টেন্ডুলকার ছিলেন সেই ব্যাটসম্যান যিনি অস্ট্রেলিয়ার রাজত্বকে ঔদ্ধত্য সহকারে চ্যালেঞ্জ করেই ক্ষান্ত থাকতেন না, নিয়মিত তাদের নাকাল করতেন। একাধিপত্যবাদ কোনো মানুষই পছন্দ করে না, ভিক্টিমের প্রতি সিমপ্যাথি জন্মাবেই। কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষের বিপক্ষে একজন নির্দিষ্ট ব্যাটসম্যানের এমন নিরঙ্কুশ দাপটের নজির খুব বেশি নেই, বা থাকলেও সেই প্রতিপক্ষের মান কখনোই অস্ট্রেলিযার মতো ছিলো না। ফলে টেন্ডুলকার হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিবাদের প্রতীক। এটাই তার সেলিং পয়েন্ট, এবং কমার্শিয়াল ভ্যালু বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনোকিছু সেলেবল হয়ে গেলে তাকে জনপ্রিয় করার সহস্র মেকানিজম মিডিয়ার জানা আছে।
এটাই যদি কারণ হয়, তাহলে জনপ্রিয়তায় টেন্ডুলকারকে ছাড়ানো যাবে না কেন? তিনি অবসরে গেছেন ৫ বছর হয়ে গেছে, আর ৭ বছর পরেই তো তার খেলা সরাসরি দেখা মানুষেরা ক্রিকেট খেলা দেখা কমিয়ে অন্য কাজে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে, নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি একজন প্রাক্তন কিংবদন্তীর চাইতে বেশি কিছু থাকবেন না। তবু সম্ভব নয় কেন? দিন যাবে আর টেন্ডুলকারকে ঘিরে গল্পের সংখ্যা বাড়বে, ফলে তার কিংবদন্তীতা আরও মজবুত হবে? এটা সত্যি হলে, গাভাস্কার বা ভিভ রিচার্ডস তো তাহলে আরো বেশি জনপ্রিয় হওয়া উচিত ছিলো। মূল কারণ হলো, টেন্ডুলকার যে সময়টাতে খেলতেন সেই সময় (১৯৯০-২০১০) এই দুই দশকে পৃথিবীতে ইয়ুথের সংখ্যা ছিলো সর্বাধিক; এখন ইয়ুথ সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, আগামীতে আরো হ্রাস পাবে। স্পোর্টস চিরকালই ইয়ুথের সঙ্গী, বয়স্কদের নয়। এবং গাভাস্কার বা রিচার্ডস যে সময়টাতে খেলতেন, তখন বিশ্ব রাজনীতিতেই একটা বড়োসড়ো প্যারাডাইম শিফটিংয়ের প্রস্তুতি চলছিলো (সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন)। খেলাধুলা সর্বদাই পলিটিক্যাল। কোহলিরা সেই তারুণ্যকে আকৃষ্ট করতে কম পারবে, কারণ ইয়ুথের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন জীবিকা সচেতন, তাদের লাইফস্টাইলে বিলাসিতা যুক্ত হয়েছে; ক্রিকেট দেখলে টি২০ দেখবে, ওয়ানডে বা টেস্ট নয়। একটা ওয়ানডে দিয়ে দর্শককে যতখানি মানসিকভাবে আকৃষ্ট করা যায়, টি২০ তে নাচানাচি, মাতামাতিতেই শেষ, এটাচমেন্ট খুবই কম। তাছাড়া টেন্ডুলকারদের সময়ে ত্রিদেশীয়. চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টের জোয়ার ছিলো, যেটা এখন মৃতপ্রায় দ্বিপাক্ষিক সিরিজের ঠাঁসা সূচিতে। আইসিসির ইভেন্টগুলো ব্যতীত বহুদেশীয় টুর্নামেন্ট হয়ই না তেমন একটা।
টেন্ডুলকার তাই ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’ থেকে যাবেন চিরকাল। তার সমপর্যায়ে পৌঁছানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, এটা বাস্তবতা। তিনি যতখানি ক্রিকেটার, তার চাইতেও বেশি ‘আইডেন্টিটি’। হোন্ডা কোম্পানীর বিপুল প্রভাবে বাংলাদেশের বেশ বড়ো একটা অংশের মানুষ বাইকের সমার্থক বলতে হোন্ডা বোঝে। তুমি সাইকেল চালাতে পারো; হোন্ডা? এই প্রশ্ন দিয়ে সে কিন্তু হোন্ডা কোম্পানীর সম্বন্ধে জানতে চায়নি, বাইক বোঝাতে চেয়েছে। টেন্ডুলকারও সেই জায়গাটায় পৌঁছে গেছেন। কনফ্লিক্টই যদি মূল উপজীব্য হয় কোহলি কি সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কিনা সেই বিতর্কে ঘি ঢালুন; বহু উপাত্ত যোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু কোহলি কি টেন্ডুলকারকে ছাপিয়ে যাবেন, এই প্রশ্ন কোনো অর্থই বহন করে না। আমি ২৩ বছর ধরে অবিরাম ক্রিকেট খেলা দেখি, কোহলির পর্যায়ের ধারাবাহিক কোনো ব্যাটসম্যান আমার চোখে পড়েনি; তার মতো অবলীলায় চেজ করতেও দেখিনি কাউকে; এসব বলা মানে তো সেখানে শচীন টেন্ডুলকার নামের একজন ব্যাটসম্যানও পড়েন যার মধ্যে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো কোহলির তুলনায় কম ছিলো। কিন্তু টেন্ডুলকারের সমগ্র গল্পে একজন ব্যাটসম্যানশিপ যদি হয় ৫৩%, বাকি ৪৭% তো মাঠের ক্রিকেটের বাইরের অজস্র ফ্যাক্টর। সেইখানে তাকে টলানো যাবে? তাহলে তো ক্রিকেট খেলারই নাম বদলে বেইস বল জাতীয় কিছু একটা রেখে দিতে হবে।
তবে নিছুক ক্রিকেটার হিসেবেও তাকে খুব সহজে বাতিল করতে পারবেন না আপনি। রানের বাইরেও টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে ২০০+ উইকেট আছে তার; এখনো পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন, ৭টা পঞ্জিকাবর্ষে ১০০০+ রান করেছেন, বিভিন্ন প্রজন্মের অসংখ্য খেলোয়াড়ের বিপক্ষে খেলেছেন, এমনকি ১৭ বার নার্ভাস নাইনটিসে আউট হয়েছেন (এখানেও তিনি রেকর্ড হোল্ডার)। এইসকল পরিসংখ্যান হয়তোবা অন্য কেউ নিয়ে নিবে, কিন্তু অফ দ্য ফিল্ড ফ্যাক্টরগুলো?
যেমন, সব ফরম্যাট মিলিয়ে কোহলি ক্রিকেট ইতিহাসের বিরলতম ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান হয়েও তাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে তিনি কি টেন্ডুলকারের চাইতেও এগিয়ে? এই প্রশ্নটাই কি অস্বস্তিকর নয়; পৃথ্বী শ নামের কোন কিশোরের অভিষেক হলো টেস্টে; সে নতুন কোহলি না হয়ে পরিচিতি পাচ্ছে নতুন টেন্ডুলকার হিসেবে। এই বাস্তবতা কি এড়ানো যাবে?
কোহলির এমন ধারাবাহিকতার উৎস কী, কিংবা চেজ করতে গেলে তার এমন অতিমানবিক হয়ে উঠার পেছনে কোন্ বিষয়গুলো কাজ করে? ২০১১ বিশ্বকাপের দলে কোহলি খেলেছেন, তখনো তিনি একজন সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান হিসেবেই বিবেচিত হতেন, ২০১৫ বিশ্বকাপে তিনি তারকা, তবুও ঠিক সেই অর্থে ব্যাটসম্যানশিপের স্বতন্ত্র ব্রান্ড হয়ে উঠেননি। বরং তার তুলনায় এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়ে লেখালিখি বেশি হতো। বিশ্বকাপের পর থেকেই কোহলি এর নিজের সময় ও সহখেলোয়াড়দের ছাড়িয়ে অপরিমেয় উচ্চতায় উঠে যাওয়ার শুরু। কীভাবে হলো এটা ? আমার পর্যবেক্ষণ মতে, টেন্ডুলকারের ‘আইডেন্টিটি’ হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন শেন ওয়ার্নের শক্ত ভূমিকা রয়েছে, কোহলির ক্ষেত্রে সেই বোলারটি হলো মালিঙ্গা। স্লিংগিং একশনের মালিঙ্গাকে খেলতে কম-বেশি সব ব্যাটসম্যানেরই ভুগতে হয়েছে, একমাত্র কোহলির সামনেই মালিঙ্গাকে বরাবরই আনাড়ি টাইপ বোলার মনে হয়েছে। বোলার হিসেবে শেন ওয়ার্ন যে হায়ারারকিতে থাকে, মালিঙ্গা অবশ্যই সেই হায়ারারকিতে ছিলো না কখনোই, তবু যে কোনো ব্যাটসম্যানের একটা স্পার্কিং মোমেন্ট লাগে, যেটা তাকে মিডিওক্রিটি ভাঙতে সহায়তা দেয়।
কোহলি মাঠের ভেতরে প্রচণ্ড এগ্রেসিভ, এরকম দুর্দান্ত একজন ব্যাটসম্যান হয়েও নিন্দুকের সংখ্যা বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে তার শরীরী আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। তিনি হারতে ঘৃণা করেন, এক ধরনের ড্যাম কেয়ার এটিচুড প্রকাশ পায়। মনে পড়ে আইপিএল এর এক আসরে কেভিন পিটারসেন আর তিনি একই দলে খেলেছিলেন। পিটারসেন তখন বিশ্বক্রিকেটে ডাকসাঁইটে ব্যাটসম্যান, কোহলির ক্যারিয়ার মাত্র শুরু হয়েছে, সেই সময়ে এক ম্যাচে ব্যাটিংকালে পিটারসেন আর কোহলি একই প্রান্তে চলে এসেছিলেন ভুল বোঝাবুঝিসূত্রে; ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী পিটারসেনের উইকেটে থাকা জরুরী বেশি ছিলো, কিন্তু কোহলি অনড় থাকেন, রান আউট হয় পিটারসেন, এবং কোহলি তার দিকে যে দৃষ্টি দেন, তাতে কোথাও সমীহ ছিলো না। এই আচরণগুলো আসে প্রচণ্ড সেল-বিলিভিং সিস্টেম থেকে। সেলফ-বিলিফ আর কনফিডেন্স এক না। কনফিডেন্সের সাথে ফলাফল জড়িত থাকে; এর তারতম্য হেতু কনফিডেন্স লেভেলও পরিবর্তন আসে, যে কারণে এটা আরোপিত একটা মানসিক যোগ্যতা। পক্ষান্তরে সেলফ-বিলিভ এক ধরনের মৌলিক প্রবণতা যার সাথে রেজাল্টের সংযোগ নেই; ভালো-মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই একই থাকে।
কোহলির সেলফ-বিলিভ সিস্টেম যে কোনো ক্রিকেটারের চাইতে অনেক বেশি সক্রিয় এবং সংবেদনশীল। এর প্রমাণ পাবেন আপনি তার চার বা ছক্কা মারা দেখলে। আপনাকে শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই, মিডলিং বা মাঝব্যাটে খেলা বলতে যা বোঝায়, কোহলির চাইতে বেশি কারো ক্ষেত্রে ঘটতে দেখেছেন। তিনি সিঙ্গেল নিলেও সেটা মাঝব্যাটে লাগে। টপ এজড এ তিনি যে আউট প্রায় হন-ই না বলতে গেলে এর কারণ কী? মাঠ ছোট-বড়ো যেমনই হোক, মাঝব্যাটে লাগলে বল সীমানা পার হবেই; একারণেই কোহলিই বোধহয় একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি কোনোরকম পাওয়ার হিটিং ব্যতিরেকেই ছক্কা হাঁকাতে পারেন স্রেফ প্লেসমেন্ট যোগ্যতায়।
টানা একই জায়গায় বল করতে পারার কারণে বহু বোলারকেই প্রশংসা পেতে দেখেছি। ম্যাকগ্রা, ওয়ালশ, আসিফ, ব্রড; কিন্তু ব্যাটের একই জায়গায় সব বল খেলার জন্য কোনো ব্যাটসম্যানের নাম আলাদাভাবে শুনিনি কখনো। নাকি ব্যাটসম্যানদের পক্ষে সব বল ব্যাটের একই জায়গায় খেলা সম্ভব নয়, এটা অনেকটা কনভেনশনের মতো? এরপর কোহলির যে কোনো ইনিংস দেখবেন, আমার কথার সত্যতা-অসারতা তখনই প্রমাণ করিয়েন নাহয়।
সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া যে কারণে অনেকের অপছন্দের তালিকায় ছিলো, কোহলির ক্ষেত্রেও কিছু ব্যাপার অভিন্ন। টেন্ডুলকার যে দলে খেলতেন, তারা রেঙ্কিংয়ে বেশিরভাগ সময়ই ৬ এর আশপাশে থাকতো, বিশ্বকাপ ব্যতীত অন্য যে কোনো আসরে চিরশত্রু পাকিস্তানের বিপক্ষে নিয়মিত হারতো। কিন্তু কোহলির ভারত টেস্ট-ওয়ানডে দুটোতেই রেংকিংয়ে ১ এ উঠার স্বাদ পায়/পেয়েছে, ৩ এর বাইরে রেংকিং যায়ই না সচরাচর; অর্থাৎ তিনি একটি চ্যাম্পিয়ন টিম চালান, যার প্রধান পারফরমার তিনি নিজেই। কিন্তু টেন্ডুলকার নিজে অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন যাচ্ছেতাই প্রকৃতির; আজহার-গাঙ্গুলী-দ্রাবিড়-কুম্বলে- ধোনি, যে-ই থাকুক অধিনায়ক, প্রধান পারফরমার তিনিই। যে কারণে টেন্ডুলকার সারাজীবন মহাভারতের অর্জুন হয়ে থেকেছেন, যুধিষ্ঠির বা দুর্যোধন হতে পারেননি। কিন্তু কোহলি নিজেকে নিয়ে গেছেন মহামহিম ভীষ্মের জায়গায়, যিনি স্বয়ং পরশুরামকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে জানেন!
টেন্ডুলকার যেহেতু মিডিওকর টিমের সদস্য ছিলেন ক্যারিয়ারজুড়ে, তার প্রতি এটাচমেন্ট বেশি মানুষের; একদিন সে জয় করবে কিছু একটা, সেই প্রত্যাশায় থেকেছে মানুষ। কিন্তু কোহলির উত্থানকালে বিসিসিআইয়ে সভাপতি শ্রীনিবাসন কমার্শিয়াল ভ্যালু বিষয়টাকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন; বিগথ্রি থিওরির জন্ম দিয়েছেন। যে কারণে ভারত অভ্যন্তরীণ ক্রিকেট অবকাঠামোতে ভিশন এবং দূরদর্শীতা দেখিয়ে প্রচুর পরিমাণে কোয়ালিটি ক্রিকেটার তৈরি করেও গণরোষের মুখে পড়েছে; মাঠের ভেতরেও মাসল পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই যা তাদের আরো বেশি জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ফলে যোগ্য দল হিসেবে ম্যাচ জিতলেও ফ্ল্যট পিচ, অন্যায্য সুবিধা প্রভৃতি অভিযোগ তুলে তাদের সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। শ্রীনিবাসন ভারতের ক্রিকেটে কতখানি ক্ষতি করেছেন বা আদৌ করেছেন কিনা সেটা হয়তো আরো গভীর বিশ্লেষণের বিষয়, কিন্তু তার মস্তিস্কপ্রসূত নীতিতে যে ক্রিকেটার কোহলি ‘ব্রান্ড কোহলি’ হতে পারলো না, একে ক্ষতি বলা যায়।
ফ্ল্যাট পিচই যদি সবকিছুর উত্তর হয়, তাহলে অন্য দেশের ব্যাটসম্যানরাও কেন কোহলির কাছাকাছি পারফরম করতে পারে না? কিছুদিন আগে মাশরাফির একটা মন্তব্য পড়লাম যার সারমর্ম হলো- ‘মুশফিক শ্রীলংকার বিপক্ষে দেড়শো মারলো, পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রায় সেঞ্চুরি করে ফেললো; জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তো তাহলে ওর ২০০ করার কথা, মুস্তাফিজের ৭-৮ উইকেট পাওয়ার কথা। ক্রিকেট খেলাটা এভাবে হয় না আসলে’।
এটাই মূল সত্য। ক্রিকেট খেলায় ৩টা জিনিস অত্যাবশ্যক- রিদম, রিফ্লেক্স, সেলফ-বিলিভ। এই ৩টার সর্বোৎকৃষ্ট সংমিশ্রণেই পারফরম্যান্সের ১০০% আসে। কারো রিদম৫%, রিফ্লেক্স ২৩% হলে, সেলফ বিলিভ যদি ৭২% ও হয়, পারফরম্যান্স সন্তোষজনক হবে না। কারণ, সংমিশ্রণ ইমব্যালান্সড। আমার ধারণা কোহলির ক্ষেত্রে সংমিশ্রণ চার্টটা এমন- রিদম ২৩%, রিফ্লেক্স ৩৩%, সেলফ বিলিভ ৪৪%, যে কারণে তার কনসিসটেন্সি এতো বেশি। বয়স বাড়লে রিদম আর রিফ্লেক্স দুটোই ব্যালেন্স হারাতে শুরু করে যার প্রভাব পড়ে সেলফ-বিলিভ সিস্টেমে, এবং পারফরম্যান্স নড়বড়ে হয়ে যায়। ২টা সিরিজ রিদম একটু এদিক-সেদিক হোক, রিফ্লেক্সেও টান পড়বে। ফলে তখন কেবলমাত্র সেলফ-বিলিভ সিস্টেম দিয়ে পারফরম্যান্স কার্ভ একই রকম রাখা সম্ভব হবে না, এবং কোহলির ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিটা আরো বেশি, যেহেতু সে রিদম এবং রিফ্লেক্সকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে এর চাইতে আর খুব বেশি উপরে উঠানো হয়তোবা সম্ভব হবে না; তার তখন ধরে রাখাটাই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ধরে রাখা ধারণাটাই ডিফেন্সিভ। ইটালি যে কারণে অজনপ্রিয়, দাবা খেলায় যে কারণে ডিফেন্সিভ খেলে ম্যাচ জেতা যায় না, একই কারণে কোহলি তার রিদম-রিফ্লেক্স ধরে রাখতে গিয়ে যখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তখনই মূল মজাটা হবে; তখন প্রবল সম্ভাবনা আছে দ্রাবিড় বা গাঙ্গুলীর মতো বাদ পড়ে যাওয়ার। ফলে ধোনি যেমন ৩৭ বছর বয়সেও খেলে যাচ্ছে ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলা সত্ত্বেও, কোহলি সেটা নাও করতে পারে। কারণ, আপনি যখন নিয়মিত ফাইভ স্টার হোটেলে যাতায়াত করতে থাকবেন, টানা কিছুদিন সাধারণ রেস্টুরেন্টে যাওয়া পড়লে আপনার মনস্তত্ত্ব আপনাকে বাধা দেবে।
চ্যাম্পিয়ন মাইন্ডসেট এভাবেই কাজ করে। কোহলি নিজেকে যে উচ্চতায় তুলে ধরেছেন, সেই স্ট্যান্ডার্ড থেকে সামান্য বিচ্যুত হলেই নিজের মধ্যে প্রবল খচখচানি কাজ করবে। ‘আমার ক্যারিয়ার আর মাত্র কয়েক বছর বাকি আছে’- কিছুদিন আগে কোহলির দেয়া এই স্টেটমেন্টকে যে যেভাবেই নিক আমি একে ইন্টারপ্রেট করি ‘বাঁচলে রাজা, নয়তো আত্মাহুতি। প্রজা হওয়ার গলগ্রহ নেয়ার অভিরুচি নেই’- এরকম এক অমোঘ নিয়তি হিসেবে যা সম্পর্কে কোহলি স্বয়ংও ওয়াকিবহাল!
একারণে টেন্ডুলকারের সাথে কোহলির জার্নিকে তুলনা করতে যাওয়া কুৎসিত কনফ্লিক্টের কদর্যতম রূপ। আমরা নিজেরাই এর ভুক্তভোগী, আবার আমরাই এর ভোক্তাশ্রেণী। কী অদ্ভুত তাই না! টেন্ডুলকারকে অনুসরণ করতো কোটি-কোটি চোখ, সেখানে তার নিজের চোখ থাকতো কিনা নিশ্চিত নই, কারণ তার আত্মজীবনী পড়ে কিংবা বিভিন্ন এক্টিভিটি পর্যালোচনা করে বোঝা যায় তিনি একজন ইনডিভিজুয়াল বা সলো আর্টিস্ট। কিন্তু কোহলিকে অনুসরণ করছে তার নিজেরই ৩য় চোখ, সাথে কোটি-চোখ তো থাকেই, যে কারণে ইনডিভিজুয়ালেরও আগে তিনি একজন ব্যান্ড মেম্বার। সোলো আর্টিস্ট আর ব্যান্ড মেম্বারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, চলন-বলন সবই আলাদা।
আমি তাই কোহলি আর টেন্ডুলকারের গল্পে রানগুলোকে নিছক সংখ্যা হিসেবেই দেখি, যেখানে পিচ, মাঠ, মিডিয়া, কোচ, টিম প্রতিটির সংজ্ঞা একে অপরের বিপ্রতীপ কোণে অবস্থান করে!