প্রান্তিক পেশাজীবী হিসেবে ডাব-বিক্রেতাদের বিশেষ কদর করি আমি। সফট ড্রিংক স্বাস্থ্যহানি ঘটায় যতটা, তার বিকল্প হিসেবে ডাব যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। তবে দামের তারতম্য, সহজলভ্যতা, সাপ্লাই চেইন এবং ‘উদ্দাম তারুণ্য’ নামক মার্কেটিং কী-ওয়ার্ড প্রভৃতি নিয়ামক বিবেচনায় ডাব প্রান্তিক পেশাজীবীর ভ্যান থেকে সুপার শপের এসিযুক্ত স্পেসে জায়গা পেতে সমর্থ হয়নি।

 

প্রাইমারি স্কুলের মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,ডাব না খেলে কী হয়? আমি বলেছিলাম, জন্ডিস। স্যার বলেন, ‘আরে বোকা ছেলে ডাব না খেলে নারকেল হয়’।

 

ডাব বিষয়ক এই সকল হাইপোথিসিস চিন্তা করতে করতে নিজেকে আবিষ্কার করি রিংরোডস্থিত প্রিন্স বাজারের সামনে, অদূরেই এক ভ্যানে জমায়েত হয়েছে অনেকগুলো ডাব।

 

‘মামা ডাব কতো– জিজ্ঞেস করতেই বিক্রেতা জানালো ৮০, ১০০, ১২০ টাকা- ৩ দরের ডাব রয়েছে, কোনটা নিবো। দাম বলার সময় তার কণ্ঠের উঠা-নামা আর মুখের এক্সপ্রেসন লক্ষ্য করলাম। দুটো যোগ করে উপলব্ধি করি, তার কাস্টমার সার্ভিস ভালো, সুতরাং ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা তার রয়েছে। কিন্তু আমাকে তার সাথে প্রায় ২০-২৫ মিনিট সময় কাটাতে হবে, ডাব না কিনলে তার কাছ থেকে যা বুঝতে চাই সেই বোঝাপড়ায় গড়মিল থেকে যাবে।

 

‘কী বলো মামা, ৪০-৫০টাকার ডাব ১২০ টাকা হয়ে গেছে; তোমার ডাব কি দুবাই থেকে আনছো নাকি’।- তার সাথে আমি বারগেইন বা দামাদামিতে যাইনি, আবার পণ্যের দামও যে বেশি সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছি। সে যদি ব্যবসার মৌলিক যোগ্যতা ধারণ করে, নিজেকে ডিফেন্ড করতে চাইবে।

 

‘ ডেঙ্গু রোগীগো ডাক্তাররা ডাব খাইতে দেয়, এজন্যই দাম এত বাড়তি, ২ সপ্তাহ আগে ১৫০ টাকাতেও একই ডাব বেচছি’।- সে স্বীকার করে নিচ্ছে পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাহিদা বৃদ্ধি এবং সামাজিক ইস্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

 

‘ঠিক আছে ১০০ টাকার একটা ডাবই কাটো। শাস হইছে এমন একটা দিয়ো’। – চাইলে ৮০ টাকার ডাব নিতে পারতাম, কিন্তু তুলনামূলক বেশি দামের একটা নেয়া এবং সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ( শাসযুক্ত) পণ্য বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়ায় তার মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি হবে।

 

দা দিয়ে যেভাবে ডাব কাটে, সেই স্কিলের প্রশংসা করি। ‘মামা তুমি কত বছর ধরে এই বিজনেস করতেছো। আমরা বাসায় যখন ডাব কাটি কত কসরত করতে হয়, তুমি মাত্র ২ কোপে সাইজ করে ফেললা। সব ডাবওয়ালাও কিন্তু তোমার মতো করে কাটতে পারে না’

 

‘সারাদিনে ৭০-৮০ টা ডাব কাটি, হাত চালু না হইলে চলবো নাকি’।- কথাটা সে যেভাবে বলে তাতে আমার প্রশংসাটা তাকে প্রভাবিত করেনি বুঝতে পারি। তবে এর মধ্যে সে তার বিজনেসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, সেলস ডেটা, আমায় দিয়ে ফেলেছে। তার দৈনিক উপার্জনের সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া গেল। আমি ভাবতে থাকি, কেন সে তার সেলস ডেটা আমার সাথে শেয়ার করলো। একজন মুদি দোকানীর সেলস ফিগার কি শুধু তার স্কিলের প্রশংসা করে জানতে পারতাম? বোধহয় না। কিন্তু তার পেশায় যে কাজটি সবচাইতে বেশিবার করতে হয়, এবং যার সাথে অতি অভ্যস্ততার দরুণ দক্ষতাটি গড়ে উঠেছে সে বিষয়ে কথা বললে সে যে বিজনেস সংক্রান্ত কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিবে এ ব্যাপারে নিঃসংশয় হলাম।

 

ডাবের ফুটোয় স্ট্র ভরে সে  যখন আমার হাতে দিল, একবার ভাবলাম ধন্যবাদ বলি, এতে কাজ হতে পারে। কারণ ডাব খাওয়ার সময় কোনো কাস্টমার সাধারণত তাকে ধন্যবাদ দেয় না, এতে সে খুশি হতে পারে। পরে ভাবলাম, এটা যদি তার চাকরি হতো, সেক্ষেত্রে ধন্যবাদ যতটা ইফেক্টিভ হবে, নিজের ব্যবসার ক্ষেত্রে ততটা কাজ নাও করতে পারে। বরং ব্যবসা নিয়ে কথা বললে উদ্দেশ্য পূরণ সহজ হতে পারে।

 

‘বাহ, ডাবের পানি তো বেশ সুস্বাদু। কুষ্টিয়ার ডাব নাকি, তোমার অবশ্য জানার কথা না’।– এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ট্রিক প্রয়োগ করেছি। তার প্রোডাক্টের কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছি, এতে সে খুশি হবে, কিন্তু তার খুশিকে একটি সীমার মধ্যে রাখছি সাপ্লাই চেইন প্রক্রিয়া নিয়ে সে কিছুটা অজ্ঞ থাকতে পারে সে সংক্রান্ত সংশয় প্রকাশ করে, যেটা তার ইগোকে হার্ট করতে পারে।

 

‘জানুম না ক্যান। এইগুলা বরিশাল থিকা আসে, কুষ্টিয়ার ডাব অত ভালো না। মহেশখালির ডাব খাইয়া দেইখেন, ওইটা আরো ভালো। বরিশালের থিকা ওইগুলাতে দাম একটু বেশি পড়ে, আমি আনি কাওরানবাজার থিকা’

 

‘তাইলে তো তোমারে অনেক সকালে উঠতে হয়’।- মানুষ প্রশ্নকে ভয় পায়, সন্দেহের চোখে দেখে; গোয়েন্দা অথবা সাংবাদিক ভেবে নেয়, উত্তর দিতে গিয়ে সতর্ক হয়ে পড়ে। তাই প্রশ্নবোধক বাক্যের পাশাপাশি এসার্টিভ সেন্টেন্সেও কথা বলতে হয়, এতে তার বলার আগ্রহ কাজ করে। আমার বাক্যের মধ্যে একটি ইংগিতসূচক নির্দেশনা আছে, আমি তার দিন কীভাবে শুরু হয় সে ব্যাপারে জানতে চাইছি। কিন্তু তার প্রতি সহমর্মী হচ্ছি (আহারে, কত সকালে উঠতে হয়), এতে সে নিরাপদ বোধ করবে, এবং এমন কিছু বলবে যা প্রশ্ন থেকে উঠে আসবে না।

 

‘ ফজরের আজানের আগে ৬০০০ টাকা পুঁজি নিয়া কাওরানবাজার যাই, দাম বুইঝা কোনোদিন ১০০টা, কোনোদিন ১৫০ টা ডাব নিয়া আসি। দিনভর বেচি’। -তার প্রতিদিনকার মূলধন, এবং প্রতিটি ডাব সে কত টাকায় কেনে সে সংক্রান্ত তথ্যও পাওয়া যায়।

আমি ভাবি সব ব্যবসায়ী তো কো-অপারেটিভ হবে না, এতো কথাও বলবে না, তাহলে বিভিন্ন স্যাম্পলের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবো কীভাবে। তখনই নিজেকে আশ্বস্ত করি, এই ডাবওয়ালাও তো অনেক কিছু বলছে না, ২-১ বাক্যেই উত্তর দিচ্ছে, আদতে আমি তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিচ্ছি।

কিন্তু সে বলছে কেন? এই প্রশ্ন মাথায় আসতে খেয়াল করলাম আমি ছাড়া তার গ্রাহক মাত্র ২ জন; তার মানে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ; কাস্টমার বেশি, এরকম সময়ে কথা বলা যাবে না; কোন্ বিজনেসের কখন অফপিক আওয়ার সেটা মাথায় রাখতে হবে।

 

‘ তোমার তো সব ডাব একদিনে বিক্রি হয় না, সেগুলো কী করো। তোমার ভ্যানে এখনো ২০-২৫ টা ডাব আছে, এখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে’। খুবই নিরীহ জিজ্ঞাসা, কিন্তু এটা তার নৈতিকতা পরিমাপের গুরুত্বপূর্ণ ইংগিত।

 

‘ কে বলছে হয় না, আরো ২-৩ ঘন্টা বিক্রি চলবো, এর মধ্যে শেষ হইয়া যাইবো’।- কয়েকদিনের পুরনো ডাবও বিক্রেতারা বিক্রি করে এটা জানা কথা, একে ক্রেতারাও খারাপ দৃষ্টিতে দেখে না, তবে সে অসত্য বললো। তার মানে সে শো-অফ প্রবণ মানুষ, নৈতিকতার ভিত্তি জোরালো নয় সম্ভবত। কিন্তু সে যদি সত্য বলতো, তাহলেই কি নৈতিকতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতাম? অবশ্যই না।

 

ওদিকে আমার ডাবের পানি শেষ, কথা বাড়ানো দরকার। তাকে ডাব ফাড়তে বললাম।

 

‘এই যে রাস্তায় ভ্যানে ডাব বেচো, পুলিশরে টাকা দিতে হয় না’? এই প্রশ্নটা এগ্রেসিভ, কিন্তু একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ির ব্যবসায়িক প্রতিকূলতাগুলো বুঝতে চাইলে আলোচনার মাঝখানে আচমকা এধরনের প্রশ্ন করার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া ইত্যবসরে আমাদের মধ্যে কিছুটা বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে, আলাপনের আবেশেই সে অনেক কথা বলবে, যেটা শুরুতে জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত।

 

‘ বোঝেনই তো মামা। পুলিশ, নেতা, রাস্তা খরচ- কত জায়গায় টাকা দেয়া লাগে। নাইলে রাস্তায় ভ্যান দাঁড়াইতে দিবো নাকি’।

 

এই বিষয়ে আরো কথা বাড়ালে সে সতর্ক হয়ে পড়তে পারে। মাত্র নেগেটিভ বিষয়ে বলেছে, এখন একটা মোক্ষম প্রশ্ন করা উচিত।

 

‘দুনিয়াতে এতো ব্যবসা থাকতে ডাব বেচো কেন?আরো প্রফিটেবল কিছু করতা’। মূলত তার বিজনেস মোটিভ, লাইফস্টাইল, এবং ক্যালকুলেশন প্রবণতা বুঝতে এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট।

 

‘ ডাব তো সারাবছর বেচি না। আমের দিনে আম, আনারসের সময়ে আনারস; মাঝেমধ্যে রাজমিস্তিরির যোগালদারিও করি’। – অর্থাৎ সে একজন ভাসমান চিন্তাধারার মানুষ, মূলত মৌসুমি ফলের হকারি করে, এবং ভাগ্য পরিবর্তনের খুব বেশি চেষ্টা নেই; যে কোনোভাবে টিকে থাকতে পারলেই খুশি। এধরনের মানুষ কমিটমেন্ট এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দুর্বল প্রকৃতির হয়ে থাকে সাধারণত।

 

ডাবের শাস কেটে সে আমার হাতে দিল। আমার সাথে ডিল ক্লোজিংয়ের সময় চলে এসেছে, শাসটা খাওয়া শেষেই টাকা পাবে, সে রয়েছে সেই অপেক্ষায়। আমি তার সাথে আরো আলাপ করতে চাই কিছুক্ষণ। সহজ উপায় হলো আরেকটা ডাব খাওয়া, কিন্তু আমি যদি ২০০ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার উপর পাইলটিং করতে চাই এটা স্মার্ট উপায় হবে না খরচ বিবেচনায়, ভিন্নভাবে এপ্রোচ নিতে হবে।

 

মামা শাস তো বেশি হয় নাই, তোমারে বললাম শাসওয়ালা ডাব দিতে। অবশ্য তুমি তো ডাবের ভেতরে ঢুকে দেখতে পারবে না। যাহোক, তুমি যেহেতু একেকসময়ে একেক বিজনেস করো, এভাবে সংসার চালাইতে সমস্যা হয় না’?— প্রথম অংশটুকু সে মনে রাখতে পারবে না, পরের অংশটাই মাথায় ঘুরপাক খাবে, উত্তরও দিবে এটার ভিত্তিতেই। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনে হুট করে ঢুকে পড়লে অনেক কথাই বলবে না সে, আমি তার অর্থের যোগান ব্যবস্থা এবং পারিবারিক কাঠামো সম্বন্ধে জানতে চাইছি, প্রথমাংশটুকু তার ভূমিকা বা ভনিতা।

 

‘ সমস্যা না থাকলে তো ডাব বেচতাম না মামা। তাও আল্লাহ চালাইয়া নিতেছে একভাবে। আমি কিছু  দেই, বউ কয়েক বাসায় কাম করে; আছি আপনেগো দোয়ায়’

 

এবার আমি মানিব্যাগে হাত দিই, ইচ্ছে করে ৫০০ টাকার নোট দিই, যাতে ভাংতি দিতে সে নিজের গাঁটে হাত দেয়। এই সময়ে আরো ১ টা প্রশ্ন করতে পারি।

 

‘ বাচ্চা-কাচ্চা আছে নাকি মামা? গ্রামে বাপ-মায়রে টাকা পাঠাইতে হয় না’? – এটা দিয়ে তার পূর্ব-প্রজন্ম এবং ভাই-বোনের অবস্থান সম্বন্ধে জেনে নিতে পারবো। সেই সাথে ভাই-বোনদের মধ্যকার সম্পর্কের রসায়ন, নিজের সন্তানদের প্রতি ভাবনা সে সম্বন্ধেও ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

 

‘ আমার ২ পোলা, ১ মাইয়া। মাইয়া বড়ো, ১০ বছর। আব্বা নাই, মা  গাজীপুরে বইনের কাছে থাকে, বইন গার্মেন্টস এ কাম করে’’।

 

সে আমাকে ৪০০ টাকা ফেরত দেয়। আমি তার সাথে হ্যান্ডশেক করি।

 

মামা তুমি মানুষ ভালো। এনজিও থেকে লোন নিয়া স্থায়ী কোনো ব্যবসা করো৷ পোলাপানের ভবিষ্যত আছে, কয়দিন পর মেয়ের বিয়ে দিতে হইবো’৷— হ্যান্ডশেক করাটা তাকে ইমপ্রেস করার উদ্দেশ্যে, সাথে ‘মানুষ ভালো’ কমপ্লিমেন্ট দিয়ে তাকে মূল প্রস্তাব (ঋণ সংক্রান্ত) দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা সে ব্যাপারে তার ভাবনা কী, এবং সন্তানদের নিয়ে তার অর্থনৈতিক কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা তাও বুঝতে চাওয়া। এর মাধ্যমে একজন মানুষের শৃংখলা এবং সিনসিয়ারিটি বোঝা সহজ হয়।

 

‘ ঋণ নিয়া বিপদ বাড়ামু নাকি মামা? মাসে মাসে কিস্তির টাকা দিয়া কূল পামু না। বউ ২ডা ডিপিএস চালায়, ব্যবস্থা একটা হইবো। দোয়া কইরেন’’। 

 

আমাকে আরো কিছুক্ষণ অবস্থান করতে হবে। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে হবে।

 

মামা তুমি আরো ১০ টাকা রাখো, তোমারে ভালো লাগছে আমার। আমি বারিধারা যাবো, এখান থেকে সিএনজি পাওয়া যাবে না’?

 

অতিরিক্ত ১০ টাকা দিয়ে আমি আদতে তার আত্মসম্মান এবং আত্মসচেতনতা বুঝতে চাই, এবং সিএনজি এর জন্য অপেক্ষা করার বাহানায় তার সাথে আমি এখন চাইলে আরো ঘন্টাখানেক কথা বলতে পারবো; ১০০ টাকা তার প্রাপ্য ছিল, ওটা ইমপ্রেসন তৈরি করেনি। কিন্তু অতিরিক্ত ১০ টাকাটাকে সে তার চারিত্রিক সনদ এবং মেডেল পাওয়া হিসেবে দেখছে।

 

১০ টাকাটা প্রথমে সে নিতে চাইলো না, পরের বার বলতেই নিয়ে নিলো, এবং আমাকে জানালো এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই সিএনজি পেয়ে যাবো।

 

তার ব্যাপারে আমার ম্যাপিং করা শেষ। আমার পর্যালোচনা বলে এই লোককে টাকা দিলে সে তার উপযোগিতা বুঝতে পারবে না, সে কিছুটা ভাদাইম্মা কিছিমের মানুষ, এবং শর্টকাট খোঁজে। তবু তার ব্যাপারে আরো পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। ডাবের মূল্য পরিশোধ করেছি, একটা ইমপ্রেসন তৈরি হয়েছে, এবার আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়ে কথা বলি।

 

মামা তোমার নামই তো জানলাম না, ভাষা শুনে মনে হচ্ছে ময়মনসিংহের ওদিকে বাড়ি। আমার এক খালার বিয়ে হইছে ওদিকে’। আঞ্চলিকতা মানুষ পছন্দ করে, এ বিষয়ে কথা বলতে দিলে সে সিগনিফিক্যান্ট কিছু তথ্য শেয়ার করে। সবচাইতে ভালো হয়, সেই আঞ্চলিকতার সাথে যদি নিজেকে কোরিলেট করা যায় কোনোভাবে, তাতে গল্প আরো ভালোভাবে আগায়।

 

আমার নাম শাহীন মোল্লা। জামালপুরের সরিষাবাড়ি থানায় বাড়ি। বাপের জমি-জিরাত আছিল, কিন্তু চাচাগো সাথে মামলায় সব বেইচা দিতে হইছে’

 

‘তোমারে দেইখা কিন্তু বোঝা যায় না তোমার ১০ বছরের মেয়ে আছে। বড়োজোর ৩০ বছর মনে হয়’।- এটা একটা ট্রিকি প্রশ্ন, একই সাথে ফ্ল্যাটারিংপূর্ণও। তার বৈবাহিক বৃত্তান্ত, পড়াশোনা এবং লাইফস্টাইল সংক্রান্ত বেশ কিছু সূচক এর মাধ্যমে বোঝা যাওয়া উচিত।

 

‘ ৮৮ এর বন্যার সময় আমার ৩ বছর, তাইলে এখন কত হইলো বয়স মামা? ৩৪-৩৫, খুব একটা তো আসলেই বেশি না। বিয়া-শাদি আগে কইরা ফালাইছি আরকি’।— প্রত্যাশা অনুযায়ী উত্তর না আসায় বাড়তি প্রশ্ন করতে হলো।

 

‘তখনো কি ডাবই বেচতা, নাকি অন্য কিছু করতা’?— এটাই শেষ প্রশ্ন। তার পারসোনালিটি ম্যাপিংয়ের জন্য এটা জানা দরকার। তার মানসিক স্থিতিশীলতা সম্বন্ধেও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

 

ডাব তো বেচতেছি ২-৩ বছর হইলো। টেম্পু চালাইছি, হেল্পারি করছি, বাসা বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ড আছিলাম; যখন যেডা পারছি, করছি’’।

 

আরো কথা বাড়ালে খেজুরে আলাপই হবে, তার ব্যাপারে ডিসিসিভ ফ্যাক্টর পেয়ে গেছি, এবার থামা উচিত। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কথা চলতেই থাকবে। সুতরাং আগাতে হবে।

 

‘মামা এইদিকে ডাচ বাংলার এটিএম বুথ আছে নাকি? আগাই দেখি। তোমার কোনো ফোন নাম্বার আছে? আমার নম্বরটা রাখো,  কখনো বারিধারার ওইদিকে গেলে ফোন দিয়ো’’

 

শাহীন মোল্লার সাথে আমার আলাপনকে যদি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়, মাত্র ১০-১৫ মিনিটেই তার ব্যাপারে মিনিংফুল এবং ইনসাইটফুল সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। কেবল প্রশ্নের ক্রমধারা সাজানো এবং প্রশ্নের ভেতরকার ক্রিটিকাল রিজনিং, উত্তরের তাৎপর্য পর্যালোচনা করতে পারলেই যথার্থ অনুমানের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। ১৫০-২০০ জন মানুষের উপর স্যাম্পলিং করলে নির্ভুলতার পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

 

দেখা যাক। শাহীন মোল্লার ডাবের দোকান থেকে আপাতত আমার গন্তব্য ফিরোজ আলীর চায়ের দোকান, কিংবা যুধিষ্ঠির হালদারের আখের সরবতে। সুনির্দিষ্ট ঠিক কোন্ জায়গায় মানুষ থাকে? মাথার অভ্যন্তরে। মানুষ তাই কয়েক আউন্স ওজনের মস্তিষ্ক ভিন্ন কিছু নয়; শরীরটা কেবল সেই মস্তিষ্কের খোলস মাত্র।