ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট যারা ফলো করেন, তারা এই ব্যাপারটা নিয়ে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার লিখেছেন, আমার ভাবনা ব্যতিক্রমী কিছু নয়। তবে আমার সুবিধা হলো, আমি সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়ে লেখা ফোকাসড রাখি না, এর সঙ্গে শাখা-প্রশাখা হিসেবে আরও অনেক কিছু চলে আসে।
৯০ এর দশকে ক্রিকেটে বিপ্লব চলে আসে। নিয়মকানুন, প্রযুক্তির ব্যবহারের বাইরেও খেলা হিসেবে ক্রিকেটের আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই দশকের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। ২০০৭ এর পর থেকে ক্রিকেটে ইন্ডিয়ানাইজেশন প্রকট হতে থাকে, তবে এই প্রক্রিয়ার শুরু হয় ৯৬ বিশ্বকাপের পর থেকে, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ৯৮ সালে টেন্ডুলকার যখন ৮-১০টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেন, তার মধ্য দিয়ে শুধু ক্রিকেটার হিসেবে টেন্ডুলকারের আধিপত্যই শুরু হয় না, ইন্ডিয়ানাইজেশন প্রক্রিয়ারও সূত্রপাত ঘটে।
ইন্ডিয়ানাইজেশন ক্রিকেটের জন্য কতটা ভালো এটা নিয়ে বোধহয় বিতর্কের অবকাশ নেই। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ব্যাপক বিস্ফোরণ, ফ্রিল্যান্সার ক্রিকেটার, চিত্রতারকাদের সাথে ক্রিকেটের সংমিশ্রণ ( সেলিব্রিটি এনড্রোসমেন্ট ক্রিকেটের গ্ল্যামার ভ্যালু বাড়িয়েছে সত্যি, কিন্তু অক্রিকেটিয় ব্যাপারগুলোকে প্রোমোট করার ক্ষেত্রে এই এনড্রোসমেন্ট অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে), ড্রাগস এবং ফিক্সিংয়ের ফ্রি-লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া, বাজিকর একটি পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া- এসবকিছুই ইন্ডিয়ানাইজেশনের বাই প্রোডাক্ট। এগুলোকে চাইলে ভালো বলতে পারেন, নির্বিকারও থাকতে পারেন, সেটা একান্তই আপনার চয়েজ।
ইন্ডিয়ানাইজেশনের পূর্বে ক্রিকেট ছিলো অনেকটাই সাদা চামড়ার অধিকারে। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, ক্রিকেটের দুই আদি কুলীন যাবতীয় ক্ষমতা নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। ভারত সেখানে ঢুকে পড়েছে স্রেফ বিরাট মার্কেট হওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে। তাদের দেশে ক্রিকেটের বিপুল চাহিদা, অন্তত ২০-৩০ কোটি দর্শক ক্রিকেট ক্রেজ এ আচ্ছন্ন (১২৫ কোটির দেশে ৩০ কোটি হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু বাংলাদেশ আর পাকিস্তান বাদে বাকি কোনো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশেই সংখ্যাটা ২ কোটি ক্রস করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।) আইসিসির ইনকামের বোধহয় ৬০% এরও বেশি যোগান দেয় ভারত, সুতরাং পরিবারে যে বেশি খরচ দেয়, সেই ছেলে বা মেয়েই ইনফ্লুয়েন্স বেশি খাটায়। জগতের নিয়মই যেখানে এটাই, ক্রিকেটে তার ব্যত্যয় ঘটবে কেন। তবে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য নিয়ে কারো কনফিউশন বা আপত্তি ছিলো না, তারা ক্রিকেটকে বোরিং করে দেয়া ছাড়া বিশেষ ক্ষতি কিছু করেনি, কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে নিজেদের তারা যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো, তাতে অন্যরা এমনিতেই তাদের সমীহ করতো। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে ইন্ডিয়া এখনো পর্যন্ত আহামরি কোনো দল হয়ে উঠতে পারেনি (২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, অস্ট্রেলিয়া-সাউথ আফ্রিকাকে টেস্টে হোয়াইটওয়াইশ করা প্রভৃতি সাফল্য হয়তোবা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আমার কথার অসারতা প্রমাণে তৎপর হতে পারে, কিন্তু এই রেফারেন্সগুলোতে উল্লেখ নেই ক্রিকেটের সৌন্দর্য নষ্টে ভারতীয় ক্রিকেটের কূটচালগুলো।) যেমন, ২০১৫ বিশ্বকাপে সবগুলো দল যেখানে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ঘুরে ঘুরে ম্যাচ খেলে ক্লান্ত, সেখানে ভারতের ম্যাচগুলো হয়েছে এক দেশে। এই এডভান্টেজের উৎস কী? আয়োজকরা বলতে পারে, ভারতের ম্যাচ মানে দর্শকদের আগ্রহ বেশি, সেলিং অপরটুনিটি বেশি, তারা তো এডভান্টেজ পাবেই। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ার কারণে আইসিসি যেরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে পরের আসরগুলোতে বিশ্বকাপের ফরম্যাটেই বদল হয়ে গেলো। বিশ্বকাপে দলসংখ্যা কমিয়ে উঠতি দেশগুলোর ক্রিকেট উন্নয়নে যে বাধা, এটাও ইন্ডিয়ানাইজেশনেরই সাইড এফেক্ট।
অস্ট্রেলিয়া যখন একাধিপতি ছিলো, তারও আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন রাজত্ব করেছে, কেউ মাঠ বহির্ভূত কোনো এডভান্টেজ নেয়নি। সেই প্রেক্ষাপট অবশ্য তাদের ছিলো না। অস্ট্রেলিয়া বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোথাওই ক্রিকেট নিয়ে ক্রেজিনেজ নেই, হয়তোবা জনপ্রিয়তা আছে।
১২৫ কোটির সুবিধা ভারত সবচাইতে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে ক্রিকেট ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনে। ব্যক্তিগত কিছু খেলা যেমন দাবা, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতিতে তাদের সাফল্য থাকলেও দলীয় খেলা, যেগুলো দিয়ে ন্যাশনালিজম প্রোমোট করা যায়, যেমন ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল প্রভৃতিতে তাদের আন্তর্জাতিক সাফল্য উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। ক্রিকেটের পরিসর ছোট, এখানে তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পারটিসিপেট করে, কাজেই ক্রিকেটই হতে পারতো তাদের তুরুপের তাস। সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবল,আর কাবাডির পেছনে প্রচুর ইনভেস্ট করে হাইপ ক্রিয়েটের চেষ্টা চলছে, কিছুটা সাফল্যও আসছে এই উদ্দেশ্যের পথে, কিন্তু তারাও জানে এটা সাসটেইনবেল নয়। কারণ, ইন্টারন্যাশনাল এরিনাতে ভালো করতে না পারলে ঘরোয়া জিনিস নিয়ে মাতামাতি স্থায়ী হয় না।
তাদের অনেকগুলো স্পোর্টস চ্যানেল আছে, দিনভর সেখানে ভারতের পুরনো ম্যাচের হাইলাইটস দেখানো হয়। ক্রিকেট নিয়ে খোঁজ রাখেন না, এমন যে কোনো মানুষ যদি সেই চ্যানেলগুলো ফলো করে তার ধারণা হবে ভারত বোধহয় কখনো হারে না, তারা খেলা মানেই জেতা। অবশ্য পাবলিক ডিমান্ড বলতেও তো একটা ফ্যাক্টর আছে। দেশের মানুষ টিমের জয় দেখতে চায়, হারতে ঘৃণা করে, চ্যানেলগুলো তো কেবল সেই ম্যাসিভ পপুলেশনের ডিমান্ড ফিল আপ করে। কিন্তু এই ডিমান্ড ফুলফিলমেন্টের মধ্য দিয়ে চ্যানেলগুলো যে ক্রিকেট কালচার এবং ক্রিকেট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের মতো বিশাল একটি কাজ করছে, এই জায়গাটিতে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া বা পাকিস্তান অনেকখানিই পিছিয়ে আছে।
ইন্ডিয়ানাইজেশনের ক্রিকেটিয় খারাপ ফলাফল বলবো, খেলাটা পুরোপুরি হোম এডভান্টেজ নির্ভর হয়ে গেছে। এখন প্রতিটি দল শুধু নিজেদের দেশে ভালো খেলে, বাইরের দেশে খাবি খায়। অনিল কুম্বলে সারাদিন বোলিং করে প্রতিপক্ষের উইকেট নিত, এই যে রীতি ভারত শুরু করেছিল সেটা এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াও ফলো করতে শুরু করেছে। একসময় ছিলো, দেশে স্পিন উইকেট বানিয়ে ভারত প্রতিপক্ষকে নাকাল করতো, আর নিজেরা দেশের বাইরে খেলতে গিয়ে নাকাল হতো। অন্য দলগুলো এই কালচার খুব ফলো করতো না। অস্ট্রেলিয়া. ইংল্যান্ড বা সাউথ আফ্রিকায় বাউন্সি উইকেট থাকতো, কিন্তু ইন্ডিয়ানাইজেশনের কারণে তারাও উইকেটের ন্যাচার পাল্টে ফেলেছে। ফলে খেলা হয়ে পড়েছে পুরোপুরি ব্যাটসম্যানসর্বস্ব, ৩৫০ রান করেও দল নিরাপদ থাকতে পারছে না।
তবে ইন্ডিয়ানাইজেশনের সবচাইতে নিকৃষ্ট ফলাফল হলো ক্রিকেট তারকাশূন্য হয়ে পড়া। শচীন টেন্ডুলকার অবসর নেয়ার পর আর কোনো উল্লেখযোগ্য তারকা নেই, ভিরাট কোহলিকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে, এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়েও কথা হয়, কেন উইলিয়ামসন, ডেল স্টেইনকে নিয়েও লেখালিখি হয় টুকটাক, কিন্তু একবার মনে করুন নব্বইয়ের দশক বা ২০০০ এর প্রথম দশক। তখন প্রতিটি দলেই ছিলেন এক বা একাধিক তারকা। জিম্বাবুইয়ের মতো দলেও ছিলেন এন্ডি ফ্লাওয়ার, নেইল জনসনের মতো খেলোয়াড়, অথচ জিম্বাবুইয়ে তখনো ছিলো আন্ডারডগ। সেই জিম্বাবুইয়ে দলটা এখনকার অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড টিমকে হারিয়ে দিতে পারবে যখন-তখন।
অন্য দলগুলোর দিকে তাকানো যাক। অস্ট্রেলিয়া দলটা দেখা যাক। মার্ক ওয়াহ, গিলক্রিস্ট, পন্টিং, বেভান, স্টিভ ওয়াহ, ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লি প্রত্যেকেই ছিলেন বড় তারকা। সাউথ আফ্রিকা। গ্যারি কারস্টেন, গিবস, ক্যালিস, কাল্লিনান, জন্টি রোডস. হ্যান্সি ক্রনিয়ে, শন পোলক, এলান ডোনাল্ড একই দলের হয়ে খেলেছেন। নিউজিল্যান্ডে ছিলেন স্টিভেন ফ্লেমিং, নাথান এস্টল, ভেট্টরি, ক্রিস কেয়ার্নস, শেন বন্ড। শ্রীলংকাতে ডি সিলভা, জয়াসুরিয়া, চামিন্দা ভাস, মুরালিধরন। পরের দিকে জয়াবর্ধনে, সাঙ্গাকার। ইংল্যান্ডে তারকা তেমন কেউ ছিলো না। ফ্লিন্টফ, ট্রেসকোথিক মোটামুটি তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন। পাকিস্তানে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, সাঈদ আনোয়ার, পরের দিকে শোয়েব আখতার। ওয়েস্ট ইন্ডিজে লারা, এমব্রোস, ওয়ালশ। ভারতে টেন্ডুলকার, আজহারউদ্দিন, গাঙ্গুলী, কুম্বলে, দ্রাবিড়।
সেই সময়ে একটা ট্রেন্ড ছিলো সমসাময়িক গ্রেটদের মধ্যে তুলনা। শেন ওয়ার্ন বনাম মুরালিধরন, কিংবা সাকলাইন মুশতাক বনাম মুরালিধরন, ম্যাকগ্রা বনাম পোলক, ওয়াকার বনাম ডোনাল্ড, ওয়াসিম আকরাম বনাম এমব্রোস- এরকম কত শত আর্টিকেল যে ছাপা হতো, ইয়ত্তা নেই।
তবে গত ২০ বছরের সবচাইতে পপুলার ডিবেট বোধহয় লারা বনাম টেন্ডুলকার। ওয়ার্ন বাদে সব বোলারই লারাকে সেরা মেনে নিলেও সমর্থক এবং সাবেক ক্রিকেটারদের বিচারে টেন্ডুলকার লারকে পেছনে ফেলেছেন। আমি নিজেও টেন্ডুলকারের পক্ষে। একটা লোক ২৪ বছর খেলে গেলেন বড় কোনো বিতর্ক ছাড়া (বল টেম্পারিং, আজহারউদ্দিনের অধিনায়কত্ব হারানো, ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যুতে চুপচাপ থাকা প্রভৃতি বিষয়ে কথা উঠেছে, কিন্তু বড় বিতর্ক হয়নি), ১২৫ কোটির প্রত্যাশা পূরণের বিশাল প্রেসার মাথায় নিয়ে খেলতে নেমেছেন, বেশ কয়েকটা ইনোভেটিভ শট বানিয়েছেন, এবং সর্বোপরি ইনস্পাইরিং ক্যারেক্টার হয়েছেন, এরকম একজনকে অসম্মান করা যায় না কিছুতেই। পক্ষান্তরে, লারা খেয়ালি প্রকৃতির, প্রতিভার ব্যাপারে অসচেতন, বিতর্কপ্রিয়। এগুলো সবই ব্যক্তি লারা, কিন্তু ব্যাটসম্যানশিপ প্রশ্নে, বোলারের কনফিডেন্স ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষেত্রে, কিংবা একা হাতে ম্যাচ শেষ করে আনার ক্ষমতায় এবং অতি অবশ্যই ব্যাটিং সৌন্দর্যের বিচারে লারার তুলনা বের করা আসলেই কঠিন, ব্যাটসম্যান টেন্ডুলকারকে তখন বড্ড টিমটিমে মনে হয়। তবে এতো সহজে এই আলোচনা শেষ হবার নয়। মহাভারতে অর্জুন আর কর্ণের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ এ নিয়ে যেমন কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না, ক্রিকেটে টেন্ডুলকার-লারার ব্যাপারটাও তেমনই। এক্ষেত্রে টেন্ডুলকার অর্জুন, লারা কর্ণ। সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই কর্ণের চরিত্রের তুলনা নেই, কিন্তু অর্জুনের মতো ক্যারেক্টার সকল সাহিত্যেই থাকে। এই কারণে লারা অনন্য, সেজন্য তাকে শ্রেষ্ঠ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। লারা ওয়ানডের তুলনায় টেস্টে ক্যারিশমাটিক বেশি ছিলেন, খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে, এই দুটো কারণ তার সমর্থক সংখ্যা কম হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
ইন্ডিয়ানাইজেশনের কারণে টেন্ডুলকার এডভান্টেজ পেয়েছেন। ক্রিকেটকে একটা বিশাল সম্ভাবনাময় বিজনেস ফিল্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তার একক কৃতিত্ব আছে বলতে হবে। কারণ, এই উপমহাদেশে স্টারডম লাগে, ম্যাজিশিয়ান চরিত্র লাগে, স্টোরি লাগে একটা কিছুকে জনপ্রিয় করতে। টেন্ডুলকারের মূর্তি ভারতের ঘরে ঘরে থাকে, এরকম একটা মিথ দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিলো।
ক্রিকেট ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের জনপ্রিয়তম তারকা অবসরে চলে গেছেন প্রায় ৫ বছর আগে, তবু এখনো তিনি প্রাসঙ্গিক। ভিরাট কোহলি, নাকি টেন্ডুলকার, কে সেরা, এখনকার ক্রিকেট দুনিয়াতে এটাই হটকেক। এটা যে বর্তমান ক্রিকেটের জন্য কতটা লজ্জাজনক সেটা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। এখনকার ক্রিকেটে তারকা সংকট এতো বেশি যে, নতুন করে একজনকে গ্রেট বানানোর জন্য পুরনো প্রজন্মের একজনকে টানতে হচ্ছে। কোহলি কি ব্যাটসম্যান হিসেবে টেন্ডুলকারের চাইতেও এগিয়ে, এই প্রশ্নের জবাব খুব সহজ আমার কাছে। তবে এই লেখায় সেটা খুব প্রাসঙ্গিক নয় বলে কথা বাড়াতে চাই না। তার চাইতে বরং, এই অকস্মাৎ তারকাহীনতার পেছনে ইন্ডিয়ানাইজেশনের প্রভাবটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
ছোট মাঠ, ভারি ব্যাট, ফ্ল্যাট পিচ, টি২০ এর সুযোগে চার-ছক্কাপ্রিয় দর্শক আর প্রচুর টাকার লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় ক্রিকেটে গ্ল্যামার বেড়েছে, ক্রিস গেইল টাইপ কিছু ক্রিকেটারের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু সেটা সাসটেইন করছে না, কারণ ক্রিকেট নিয়ে সত্যিকারে যারা ফ্যাসিনেটেড তারা এসবে বিরক্ত হচ্ছে, ক্রিকেটাররা ফিটনেস বা স্কিল ডেভেলপমেন্টের চাইতে পাওয়ার ক্রিকেট, ডিফেন্সিভ বোলিং এসবে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে শুটিং আর ক্রিকেটের মধ্যে ফারাক থাকছে না বিশেষ। বহুদেশীয় টুর্নামেন্টের জায়গা নিচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ, দর্শকরা তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছে কম। কোহলি, ভিলিয়ার্স বা কেন উইলিয়ামসন একই আসরে খেলছে হয় বিশ্বকাপে অথবা আইপিএলের মতো ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে, ফ্রিকোয়েন্ট ইন্টারেকশনের অভাবে ক্রিকেট পর্যবেক্ষকরাও পুরোপুরি স্ট্যাটিসটিক্স নির্ভর হয়ে পড়ছেন। ফুটবল খেলায় অনেকে যেমন পা বাঁচিয়ে খেলে, তেমনি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কারণে তারকা হওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত ক্রিকেটাররা ইনজুরি বাঁচিয়ে সেফ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকছে, স্ততঃস্ফূর্ত ক্রিকেট রূপান্তরিত হচ্ছে ভিডিও গেমস এ। এর মধ্যে তারকা তৈরি হবে কীভাবে?
ইন্ডিয়ানাইজেশনের প্রভাবে ভিরাট কোহলি তারকা হওয়ার দৌড়ে আছেন, কিন্তু মাঠের বাইরের এক্টিভিটি তাকে বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মিশেল স্টার্ক ২০১৫ বিশ্বকাপে তারকা হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন, কিন্তু ঘন ঘন ইনজুরিতে পড়ে সেই সম্ভাবনা স্তিমিত। একসময় প্রত্যেক দলে অলরাউন্ডের আধিক্য ছিলো, এখনকার দিনে আশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজাকেও অলরাউন্ডারের প্রক্সি দিতে হচ্ছে। এতোটাই আকাল পড়েছে অলরাউন্ডারের!
তারকাশূন্য এই যে ইন্ডিয়ানাইজড ক্রিকেট এটা শেষ পর্যন্ত কোন্ পরিণতি নিয়ে আসবে তা দেখার জন্য বড়জোড় ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। খেলাটির বিকাশলগ্নে কৈশোর পার করেছি, পতনটাও বোধহয় বার্ধক্যের আগেই দেখতে হবে চোখে। কমার্শিয়াল ভ্যালু যখন এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালুকে অতিক্রম করে যায় তখন মুড়ি আর মুড়কি একই দরে বিক্রয় হয়। দুঃখজনক হলো, মুড়কির বাজারদর মুড়ির চাইতেও কয়েকগুণ বেশি হয়ে গেছে। আমরা ক্রিকেটপ্রিয় মানুষেরা নিষ্কর্মার মতো বসে বসে মুড়ি খাওয়া আর আঙুলের নখ চিমটানো ছাড়া কিই বা করতে পারি!