একদা-একসময় আমার জীবনের ২য় টেলিফিল্ম।
বুয়েটজীবনে একদম শখের বশে নির্মাণ করেছিলাম, এবং বলা যায় এই দুটো টেলিফিল্মই আমার পরিণত বয়সে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। কীভাবে সেই আলোচনা এখন নিরর্থক।
বরং কেন একদা-একসময় নির্মাণ করেছিলাম সেই প্রেক্ষাপট ইন্টারেস্টিং হতে পারে।
বুয়েটে লেভেল ৪ এ উঠলে ৪ সপ্তাহের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেইনিংয়ে যেতে হয়। চট্টগ্রামে আমরা পালাক্রমে ট্রেনিং নিয়েছিলাম আবুল খায়ের এবং বিএসআরএম এর ফ্যাক্টরিতে। ট্রেনিং বলতে সারাদিন তাদের বিভিন্ন প্ল্যান্টে ঘুরতে হত, তারা সবকিছু কীভাবে কাজ করে ব্যাখ্যা করত।
মেটালার্জি গ্রাজুয়েটদের জন্য হয়তবা এটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমার জন্য বিভীষিকাময় বোরিং, এত দীর্ঘ সময় কী করা যায় এ নিয়ে চিন্তা কাজ করত৷ আর গুনগুন গাইতাম শিরোনামহীন ব্যান্ডের ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’ গানটি। সেই গানের সুরে কথা বসাতে থাকি নিজের মত করে- মুখের পরে মুখ আসে যায় ঘড়ির কাটা ঘুরে/অচেনা মুখ চেনা মুখের প্রতিবেশি লাগে/ সব মুখেরই একটি আদল, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সবই, ঘড়ির কাটা বদলে গেলেও মানুষগুলো একই/ আমিও হাঁটি মুখের ভিড়ে মুখেরও ছায়ায়, ছিলাম এখানে আমি একদা-একসময়
নকল সুরের এই গান গাইতে গাইতে শেষ শব্দটাতে খটকা লাগে; একদা-একসময় কেন লিখলাম। তখনই প্রথমবার ফিল করি আর কিছুদিন পর ব্যাচমেটরা ভার্সিটি পাশ করবে, কিন্তু আমি গ্রাজুয়েশন করতে পারব না, হলে থেকে যাব; কিন্তু হলেই বা কতদিন! তারপর কী; আমি আসলে করবোটা কী।
এইসকল মনোসংঘাতের মধ্যেই মনে হলো ভার্সিটির হলে থাকার সময়গুলোকে ধারণ করে রাখি। যে মানুষ একমাসের জন্য হলেও হলে থেকেছে শিক্ষাজীবনে, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। হাসি-বিরক্তি-তিক্ত-মধুর কতরকম অভিজ্ঞতা। এবং ভার্সিটি যেটাই হোক, কিংবা ১৯৮০ বা ২০১০ সময়টা যখনই হোক, জীবনের এই সময়টা আসলে লুপের মতো। শুধু মুখগুলো বদল হয়, অভিজ্ঞতা থাকে ধ্রুবক।
এটা মনে হওয়ার পর ট্রেনিংয়ের সময়গুলো দারুণ কাটতে লাগলো। অন্যদের মত আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম খাতা হাতে মেশিনের সামনে, কিন্তু খাতায় লিখি নাটকের একটার পর একটা সিকুয়েন্স। শুধু বন্ধু আরমানই জানত কোন অপকর্ম এতটা সিরিয়াসলি করছি।
ট্রেনিংয়ে থাকাকালীনই স্ক্রিপ্ট রেডি। ঢাকায় ফিরে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করি। কাছাকাছি সময়ে অঞ্জন দত্ত এর চলো লেটস গো ফিল্মটা দেখেছিলাম, ন্যারেশনে সেই প্যাটার্নটা ব্যবহার করি। দুটো চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমার নিজের হল লাইফের অভিজ্ঞতাকে দেখাতে চেয়েছি- আদনান এবং অতি অবশ্যই মূল প্রটাগনিস্ট মিশা।
নির্মাণ ব্যয় ছিল ৬২ হাজার টাকা। ঘনিষ্ঠ সিনিয়রেরা সহায়তা দিয়েছিলেন, যারা বড়ো চরিত্র পেয়েছে এক্টিং করেছে তাদের বেশিরভাগই ১৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিয়েছে। এছাড়া স্পন্সরের জন্য স্ক্রিপ্ট দিয়েছিলাম উদ্ভাসকে, পরিচালক মাহমুদুল হাসান সোহাগ ভাই স্ক্রিপ্ট পড়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, সেখান থেকেই মূলত তার সাথে ৯ বছরের অভিযাত্রার শুরু। পাইল্যাবস থেকেও পাওয়া গিয়েছিল ১৫ হাজার টাকা; এর বাইরে আমি ব্যক্তিগত লোন করেছিলাম ২৫ হাজার টাকা; র্যাগ উপলক্ষে যখন বিভিন্ন স্পন্সর আসে, তখন আমার লোনের টাকাটা ব্যাচ থেকে পরিশোধ করে দেয়।
এবং মজার ব্যাপার হলো নকল সুরের সেই লিরিকে মৌলিক সুরারোপ করেছিল বন্ধু আদনান। বর্তমানে সে ইনটেল এ সেবা দিচ্ছে; গান-বাজনার পেছনে সময় রাখতে পারলে গীতিকার হিসেবে আমি আরেকটু কন্ট্রিবিউট করতে পারতাম। দেখি আরেকটু বুড়ো হই, ওর তখন মন ঘুরতেও পারে।
ফিল্ম নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক নতুন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। তৌহিদ, নাহিদ, সিফাত, তানিয়া, আদনান। ইমু, আরমান, 41, রুশো ডিপার্টমেন্টাল বন্ধু। প্রসুন, রাহুল, জিয়া, প্রিয়ম পূর্বপরিচিত ছিল।
ফিল্মে একটা সংলাপ ছিল, নাহিদের আত্মহত্যার আগের রাতে ইমু বিষন্ন নাহিদের সাথে ফান করে বলছে ‘ফাইনাল ইয়ার চলে, এখন কি আর কনডেন্সড মিল্কের চায়ে মন ভরবে, এখন তো তোমার দরকার….’; এই সংলাপ নিয়ে নীতু আপুর চরিত্রে কাজ করা সিফাত কালামের তীব্র আপত্তি ছিল, এটা অবশ্যই বদলাতে হবে। কিন্তু অন্য যারা ছিল তারা এই সংলাপটা কোনোভাবেই সরাতে রাজি নয়, এমনকি আমিও কনভিন্সড ছিলাম না। বন্ধুরা আড্ডায় কত অশালীন কথা বলে, এটা তো সরাসরি অশালীন নয়, ইঙ্গিতপূর্ণ, বাদ দেয়ার দরকার কী। যে কারণে বাদ দেয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত। এটা নিয়ে ফিল্ম প্রদর্শনের দিন সিফাত কালাম প্রচণ্ড অভিমান করে, যে কারণে পরবর্তীতে সবার সাথে কথা হলেও সিফাত কালামের সাথে সর্বশেষ ১২ বছরে আর কথা হয়নি। এমনিতেই নন ডিপার্টমেন্টাল বন্ধু, তাই জানিও না তার সর্বশেষ স্ট্যাটাস কী!
তবে ব্যক্তিগতভাবে এই ফিল্মে আমি সবচেয়ে কৃতজ্ঞ রুশোর প্রতি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকগুলো যেভাবে সে ম্যানেজ করে দিয়েছে তাতে দৃশ্যগুলো ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।
এবং একদা একসময়ের নির্মাণ থেকেই নিশ্চিত হয়েছি ডিরেকশন পুরোপুরি কোম্পানি সিইও টাইপ কাজ।।কেবলমাত্র ফিল্ম বুঝলেই ডিরেক্টর হওয়া যায় না, আমাকে দিয়ে হবে না এটা। আমি বাকি জীবনে স্ক্রিপ্ট লিখলেও ডিরেকশন এ আর কখনোই চেষ্টা করব না। সংকল্পটা অক্ষুন্ন আছে।
একদা একসময়ের কোনো কপি ছিল না আমার কাছে, মিউজিকের কপিরাইট ইস্যুতে ইউটিউবও মুছে দিয়েছিল। তাই একদা একসময় ভ্যানিশ হয়েছিল দীর্ঘদিন।
অবশেষে প্রসূনসূত্রে আবারো পেলাম। ব্লগে থাকুক এটা। মাঝেমধ্যে টাইম ট্রাভেল করা যাবে