অঞ্জন দত্ত যদি গান না গাইতেন তাকে নিয়ে কি লিখতো কেউ আদৌ? অভিনেতা কৌশিক ব্যানার্জি কিংবা পরিচালক অরিন্দম শীলকে নিয়ে যতটুকু লেখালিখি হয় গানবিহীন অঞ্জন দত্তের এক্সপোজার কি তার চাইতে একটুও বেশি হত? কমার্শিয়াল সিনেমায় কৌশিক ব্যানার্জি এককালে কিছু নাম করেছিলেন, অফট্র্যাক সিনেমায় অরিন্দম শীলেরও কিছুটা পরিচিতি আছে—এই তথ্যটুকু পাদটীকা হিসেবে জুড়ে দিচ্ছি।

অঞ্জন দত্ত তার বহু সাক্ষাতকারে আক্ষেপ করেছেন তিনি মনেপ্রাণে একজন অভিনেতা হতে চেয়েছেন, অকপটে স্বীকার করেছেন অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চ্যাটার্জি যে অবস্থানে আছেন নিজেকে তিনি সেখানে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণেই সেখানে পৌঁছানো হয়নি, জীবিকার তাগিদে সাংবাদিকতা করেছেন, কবির সুমনকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে গান বেছেছেন, এবং অভিনয়ের প্রতি পূর্বেকার প্যাশন থেকে বিকল্প উপায় হিসেবে সিনেমা পরিচালনায় নেমেছেন। ব্যোমকেশ সিরিজ ব্যতীত পরিচালক হিসেবেও সেই অর্থে কমার্শিয়াল সাকসেস পাওয়া হয়নি।

ফলে অভিনেতা বা পরিচালক অঞ্জনকে নিয়ে বাংলাদেশীদের তিল পরিমাণেও আগ্রহ থাকতো না যদি তার গানের সাথে সংযোগ ঘটতো।

অঞ্জন দত্তকে বুঝতে হলে তার পরিচালিত ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ সিনেমাটা বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। এটা তার আত্মজীবনিমূলক সিনেমা নয়, তবে স্টোরিটেলিংয়ে অনুমান করে নেয়া যায় এটা তার জীবনেরই ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে।পারিবারিক কলহ, নকশাল আন্দোলন, দার্জিলিং থেকে চলে আসা সবকিছুই তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। পরিবার এবং প্রতিবেশের সাপেক্ষে নিজেকে একজন মিসফিট হিসেবে আবিষ্কার করেছেন প্রতিনিয়ত, তার মধ্যে তৈরি হয়েছে নির্বিকারত্ব; সেখান থেকে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ গড়ে উঠেছে, যেখানে ক্ষোভ এবং ভিক্টিমাইজেন অনুভূতিই অধিক সক্রিয়।

ক্ষোভ আর ভিক্টিমাইজেশনের যোগফলে যা দাঁড়িয়েছে, তিনি কিছুই মানতে পারেন না, এবং প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই প্রচলিত জীবনযাপনের প্রতি অভিযোগ বাড়তে বাড়তে এমন এক জীবনের চিন্তা করেছেন যার বাস্তবতা বা সম্ভাব্যতা নিয়ে ক্রিটিকালি দেখার অভ্যাসটাই গড়ে উঠেনি। ভিন্নমতকে উপেক্ষা করা, সইতে না পারা এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রবল অহমে বিদ্রুপ করা—সবটাই কেমন যৌবনের ঔদ্ধত্য; পরিণত বয়সের প্রজ্ঞা বা ধীরস্থিরতা অনেকটাই অনুপস্থিত।

পরিচালক হিসেবে অসফল থাকার ক্ষেত্রে তার বৃহৎ প্রেক্ষাপটে কোনোকিছুকে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির সীমাবদ্ধতাকেই নিয়ামক বলবো। গানের ভক্তদের একাংশ ভক্তিবশত তার সিনেমা দেখে, কিন্তু অফট্র্যাক সিনেমার নিয়মিত দর্শকও তার সিনেমাকে পজিটিভলি গ্রহণ করতে পারে না তার ন্যারেটিভের অসম্পূর্ণতা এবং পুনরাবৃত্তি বলয়ের আধিক্যহেতু। তার ন্যারেটিভে কোনো উপসংহারে পৌঁছানোর তাড়া নেই, একইসঙ্গে বক্তব্যের পেছন গভীর কোনো কারণও অনুপস্থিত। যে কারণে বিচ্ছিন্ন দৃশ্যচিত্র হয় ঠিকই, সামষ্টিক অর্থদ্যোতনা জাগায় না। কনটেন্ট উতরে গেলেও ন্যারেটিভের দৌর্বল্য ধৈর্য্যের আর সহনশীলতার পরীক্ষা নেয়।

অঞ্জন দত্ত স্বয়ং বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউতে বলেছেন তিনি সিধু জ্যাঠাদের জন্য সিনেমা বানান না, বুড়ো ভাবতে ভয় পান। দুটো স্টেটমেন্টই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সিধু জ্যাঠাদের যদি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ধরি যারা ক্রমাগত পরচর্চায় ব্যস্ত তারা কোনোকিছুকে এপ্রিসিয়েট করতে পারে না, সেটা যেমন একদিক থেকে চিন্তনীয়, অনুরূপভাবে টিনএজারদের মধ্যে সহজে মুগ্ধ হওয়া, ভক্ত হওয়ার প্রবণতা গড়ে উঠে, যা একজন শিল্পচর্চাকারীকে তার প্রকৃত মূল্যায়নের সাথে পরিচিত হতে দেয় না। ফলে অঞ্জন দত্তের সিনেমাগুলো না সর্বস্তরের, না টিনএজের—কোনো শ্রেণিতেই বিলং করতে পারলো না।

এবং আত্মপ্রসাদে ভুগার দরুণ যে সমস্ত সিনেমায় তিনি নিজে অভিনয় করেন, অন্য চরিত্রগুলো সেভাবে বিকশিত হয় না। ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ কিংবা ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’- কোনো সিনেমাতেই তিনি মূখ্য চরিত্র নন, তবু তার চরিত্রকে অতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে মূখ্য চরিত্রগুলো কোনো জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। তিনি কখনো বন্ধু বা সমপর্যায়ের মানুষ চাননি হয়তো, চেয়েছেন সমর্পিত ভক্ত আর অনুসারী।

অঞ্জন দত্তের মিডিয়া ইমপ্রেসন কেমন তা বোঝার জন্য জি-বাংলার কমেডি শো মীরাক্কেলের উপস্থাপক মীরের মিমিক্রিকে বিবেচনায় নেয়া যায়। চোখে কালো সানগ্লাস, একদিকে কিছুটা হেলে দাঁড়িয়ে টেনে টেনে অপ্রিয় কথা বলা, যা সাধারণত চক্ষুলজ্জার কারণে বলে না মানুষ। এভাবেই হয়তোবা অঞ্জনকে ভেবে অভ্যস্ত মানুষ, এবং তার স্টাইল কেউ পছন্দবশত মিমিক্রি করে, কেউ খোঁচানোর উদ্দেশ্যে মিমিক্রি করে।

তাকে ঘিরে মিমিক্রিকে যদি এন্টারপ্রেট করি, তিনি আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন, সেটা গানে হোক, কিংবা ইন্টারভিউসূত্রে রগরগে কথা বলে হোক। তার বক্তব্যের পাবলিক ডিমান্ড আছে।

অন্যদিকে পাবলিক ইমপ্রেসন হলো,তিনি ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির মানুষ। কোনো লুকোছাপা নেই, সত্য কথা বলার সাহস রাখেন। তার এরোগেন্স, কালো চশমা, সিগারেট, গিটার প্রভৃতি ভক্তকে হিপনোটাইজ করে ফেলে। ‘মানুষ হলে এরকমই হওয়া চাই’- মনের গহন থেকে এটাই যেন বলে উঠে কেউ। যে কারণে গায়ক অঞ্জনের ব্যক্তিত্বও ক্রমশ আমাদের গোলকধাঁধার পানে ঠেলে নেয়।

অভিনেতা হিসেবে কেন স্বীকৃতি পেলেন না অঞ্জন? যার প্রথম সিনেমাই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেল, পরবর্তীতে অফট্র্যাক সিনেমায় তিনি কেন নিজের স্থান তৈরি করতে পারলেন না এ এক প্রশ্ন বটে। নিদেনপক্ষে সব্যসাচী চক্রবর্তী পর্যায়ের ডিমান্ড তো তার তৈরি হওয়ার কথা। এটা না হওয়ার পেছনে দুটো কারণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। প্রথমত,তার অভিনয়রীতি কলকাতার রীতির সাথে ম্যাচ করেনি। এখনো যদি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ কিংবা ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ সিনেমায় তার অভিনয় খেয়াল করেন, দেখবেন তার সংলাপ থ্রোয়িং, এক্সপ্রেসন স্টাইল ভারতীয় অন্যান্য অভিনেতাদের সাথে মিলছে না। কখনো মনে হবে আরোপিত, কখনো খাপছাড়া, কখনোবা অতিঅভিনয়- যার সাথে অভ্যস্ততা গড়ে উঠেনি দর্শকের। এই অভিনয়রীতি তিনি কোথা থেকে রপ্ত করেছেন জানি না, তবে তিনি সেটা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হননি।
দ্বিতীয়ত,তার আমিত্ব রোগ। তিনি নির্দেশ শুনতে নয়, দিতে অত্যধিক পছন্দ করেন। যে কারণে অভিনয় ক্যারিয়ারে শুরুর ৮-১০ বছর যেভাবে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়, সেই স্ট্রাগলটা নিতে চাননি আমিত্ব হানীর ভয়েই।

তিনি আসলে অভিনেতা কেন হতে চেয়েছিলেন? এই উত্তরটা হয়তোবা নিজেও কনভিন্সিংলি দিতে পারবে না। কোনো এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, আমি ৩০ ভাগ বাঙালি ৭০ ভাগ সাহেবিয়ানায় বড়ো হয়েছি। এই স্টেটমেন্টটাকে খুব গুরুত্ব সহকারে আমলে নিতে হবে। তার সিনেমার স্টোরিলাইনগুলো যদি পর্যালোচনা করি, প্রায় প্রতিটিতেই এক ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস রয়েছে। সিনেমার পাত্র-পাত্রীরা ক্রমাগত সেই ক্রাইসিসে ভুগতে ভুগতে দূরত্ব তৈরি করছে, একাকীত্ব তৈরি হচ্ছে, অদ্ভুত এক ডিস্টার্বড যাতনায় জীবন পার করছে।

অভিনয় মানে যা সত্যি নয়, একইসঙ্গে যা ইচ্ছা তা-ই হতে পারার ক্ষমতা। একজন ডাক্তার সারাজীবনই ডাক্তার, কেরানি সবসময়ই কেরানি, ব্যবসায়ী আদ্যোপান্ত ব্যবসায়ী, রাজনীতিক শয়নে-স্বপনে রাজনীতিবিদ, কিন্তু একজন অভিনেতা মানে এগুলোর সবটাই, আবার কোনোটাই নয়। অঞ্জনের তিক্ত শৈশব-কৈশোর তার মধ্যে কিছুই হবো না,সবই হবো, জীবন থেকে পালিয়ে যাবো ফ্যান্টাসি তৈরি করে থাকতে পারে। ফ্যান্টাসিটাই শেষ পর্যন্ত অবসেসনে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং তার তীব্রতা এতোটাই বেশি ৬৪ বছরে পৌঁছেও অভিনেতা না হতে পারার খেদ কাজ করে তার মধ্যে।

সিনেমা আর অভিনয়ে অতি ক্রিটিকাল হতে গিয়ে যে গানের কারণে তিনি অঞ্জন দত্ত সেটা কিছুটা আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। যেহেতু তিনি নিজে গানের চাইতে অভিনয় বা পরিচালনায় ফ্যাসিনেটেড বেশি তার চিন্তাজগত পরিভ্রমণ করার ক্ষেত্রে এ দুটোকে বেশি গুরুত্ব দেয়াই সঙ্গত। তবু গানকে কম গুরুত্ব দিলে ভাইটাল যোগসূত্র মিস হয়ে যেতে পারে।

অঞ্জন দত্তের গান বাণীপ্রধান। তার বেশিরভাগ গানেই গায়কীতে খুব পরিবর্তন নেই,ফ্ল্যাট; মিউজিক কম্পোজিশনও খুব সিম্পল। এরকম বৈশিষ্ট্যের গান সচরাচর জনপ্রিয়তা পায় না, অঞ্জন পেয়েছেন। কারণ তার লিরিক।

কী আছে অঞ্জনের লিরিকে? দুটো লিরিক নমুনা হিসেবে উল্লেখ করি-

লিরিক১:
আকাশের রং কালো হয়ে এলো বৃষ্টি নামবে এখনি জানি তবু
ছেঁড়া ছাতা নিয়ে ভিজে ভিজে আমি থাকবো দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষায়
আরো একবার একই পথে চলে একই কথা বলে কাটবে সন্ধ্যেটা
তবু রাস্তা বদলে যেও না তুমি যেও না ফেলে আমায়
স্বপ্নের রঙ ফিকে হয়ে গেছে ভবিষ্যত আমার অনিশ্চিত
পেছনে আমার কানাগলি আর সামনে শুধুই গাঢ় অন্ধকার
গোলাপ কেনার সামর্থ নেই দেবার আছে শুধুই একটা গান
গানে গানে তাই করে যাই আমি তোমার কাছে একটাই আব্দার
ববি রায়ের সাথে চলে যেও না ছেড়ে যেও না
ববি রায়ের কথায় বয়ে যেও না ফেলে আমায়
জানি টাকা কড়ি আর মারুতি গাড়ির প্রয়োজন আছে
তবু হাল ছেড়ে দিও না
ববি রায়ের সাথে চলে যেও না- এ অসময়।

লিরিক২:
মাগো আমার মাগো জানি অনেক কষ্ট পাবে তুমি
তবু আমার নেই কোন উপায়
যেতেই আমায় হবে সে যে
ট্যাক্সি নিয়ে বসে আছে বাসষ্টপেতে আমার অপেক্ষায়
বিয়ের সাজে ঘোমটা টেনে, বাবা কাকার চোখ এড়িয়ে
যাচ্ছি ছেড়ে ছোট বেলার ঘর
অনেক ভাবনা চিন্তা করেও পারছি না যে মেনে নিতে
তোমাদের পছন্দ করা বর
মাগো মা চললাম আমি করতে নিজের সংসার
মাগো মা ফিরে আসছি না
ইতি তোমার আদরের রমা।

এই লিরিকের সুর যেমনই হোক আমাদের কাছে দুটো নাম- ববি রায় আর রমা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাদের জীবনের গল্প, সাপোর্টিভ চরিত্র, অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস,সোস্যাল ইস্যুগুলো মুহূর্তের মধ্যে আমাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ববি রয় বা রমা এর শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে তা নিয়ে জল্পনা চলে। মনে হয় ৫ মিনিটের গান নয়, ৩ ঘণ্টার সিনেমা দেখছি। অঞ্জনের গানগুলো তাই শোনার চাইতে মনের চোখে দেখার বস্তু হয়ে উঠে।
বেলা বোসের টেলিফোন নম্বর ২৪৪১১৩৯ সম্ভবত বাংলা ভাষার সবচাইতে জনপ্রিয় নম্বর, আমার ধারণা গানটা রিলিজ হওয়ার পর এই নম্বরে অসংখ্য ভক্তশ্রোতা ডায়াল করেছে। কী আছে এই গানে? অঞ্জনের আরো অনেক গানের ভিড়ে এটিকে নিতান্তই সাদামাটা এক লিরিক মনে হয়। তবু অঞ্জন বলতেই মানুষ এই গানকে বোঝে কেন? প্রেম আর মিলনের মধ্যবর্তী যে সামাজিক বাধা, বেকারত্ব তাতে দেয়াল তুলে দেয় যা লক্ষ লক্ষ প্রেমিকের জীবনের কার্বন কপি হয়ে উঠে। আরও ৫০ বছর পরেও প্রেম করে বিয়ের স্বীকৃতি আদায় করতে চাকরির সংবিধান লাগবেই, যে কারণে প্রজন্মান্তরেও এই গান একইরকম প্রাসঙ্গিক। কখনো যদি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়, বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে, এই গানও তার আবেদন হারাবে। বেকার মনের আবেগ আর স্বপ্নের যে কাঁচের দেয়াল, তাকে ফ্যান্টাসাইজ করতে পেরেছে এর চাইতে ভালোভাবে কে!

বেলা বোস পুরনো হওয়ার আগেই আমরা ‘মালা’ এর গল্প শুনি, এবং তার কারণে ১২ই মে দিনটি স্মরণীয় হয়ে উঠে। কিশোর বয়সের ইনফ্যাচুয়েশনকে হয়তোবা সারা জীবনেই ভোলা সম্ভব হয় না মানুষের পক্ষে। মেরিয়েন গানটা শুনলে মনোজগতে এক ঝলকে কার ছবি যেন ভেসে উঠে। কিংবা রঞ্জনার সেই কিশোর প্রেমিক যে পাড়ার দাদাদের ভযে অন্য পাড়া দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়, প্রতিটি গল্পই খুব চেনা মনে হয়। কল্পনা শক্তির কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই তড়তড়িয়ে সমগ্র পরিস্থিতিটাই নিজের খুব আপন লাগে। কিংবা কফি হাউজের আড্ডা শুনে ইমোশনাল হওয়ার পর ‘দাস কেবিন’ এর আড্ডাকে মনে হয় তরুণ বয়সের ভিন্ন এক ডাইমেনশন।
হরিপদ, আলীবাবা, মিসেস মুখার্জী, নীলা, দেবলীনা, জেরিমি, মিস্টার হল, স্যামসন, ছন্দা- এগুলো কেবলই নাম নয়, গল্পের চরিত্র যেন। এরপর যখন কাঞ্চনজংঘা, দার্জিলিং, কলকাতা, পুরনো গিটার এর মতো বিষয়ভিত্তিক বর্ণনা উঠে আসে, সেখানেও নিজেকে কুশীলব হিসেবে অনুভব করে শ্রোতা।
লিরিক৩:
ছেলেটার নেই বাড়ি ফেরার তাড়া
মেয়েটার নেই বাড়িতে টেলিফোন
দুজনেরই নেই নিয়ম ভাঙার বয়েস
তবু দুজনেরই আছে নিয়ম ভাঙার মন
ছেলেটার আছে বুক পকেটে চিঠি
প্রথম প্রেমের বানান ভুল
মেয়েটার আছে যত্ন করে রাখা
খাতার ভেতর চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল
আরো দুটো ছেলেমেয়ের বয়স বেড়ে যাবে
আরো দুটো দিনের অবসান
আমার ছেলেমানুষিটা আঁকড়ে ধরে রেখে
গাইব আমি ভালবাসার গান
এই গানের পাত্র-পাত্রীর বয়স কতো বলুন তো? ১৫ থেকে একেবারে ৫০ পর্যন্ত। ঠিক তার সঙ্গেই প্রাসঙ্গিক আরেকটা লিরিক এরকম-
একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
মনে পড়ে যাবে সব কথা
কথা দিয়ে কথাটা না রাখা
ফেলে আসা চেনা চেনা ব্যাথা
অদূরে কোথাও কোন রেডিওতে
‘এই পথ যদি না শেষ হয়’
আর বৃষ্টির রং হয়ে যাবে নীল
আর আকাশের রংটা ছাই

এইসকল কাব্যিকতার পাশে আমরা যদি ‘বসে আছি ইস্টিশনেতে’, ‘অসময়’ গানগুলো শুনতে থাকি,সেখানে ছিন্নমূল মানুষ কিংবা বদলে যাওয়া সময়ের অবক্ষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে লিংকড আপ করতে পারি। কোনো কাব্যিক মেটাফর নয়, কেবলমাত্র ভাষাগত মাধুর্য দিয়েই সেই ব্যঞ্জনা তৈরি করেন যা সকল শ্রেণির জন্যই সুবোধ্য। কবির সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানটা শুনতে যতই মধুর লাগুক, এর লিরিক এতো ভারি যে মূল বক্তব্য কী বোঝাই হয়ে উঠে না। অঞ্জনের লিরিকে সেই নিগূঢ়তা নেই; চোখের সামনে যা দেখছি তাই বলছে গানে গানে। ফলে অঞ্জন অনায়াসেই টিনএজ আর তরুণ শ্রেণিতে প্রবেশযোগ্যতা পেয়ে যান। এমনকি শিশু কিশোররাও তার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। ‘টিভি দেখো না’, ‘ডাক্তার বলছে ক্যালসিয়ামটা কম’- শোনার পর কিশোর মনেও মা-বাবার আচরণ কিংবা সামাজিক ধ্যান-ধারণাগুলোকে কঠোর এবং অযৌক্তিক মনে হবে,তাদের মনের কথাই অঞ্জন বলে দিচ্ছেন যেন।
এক লেখায় অনেক বেশি লিরিক উল্লেখ করলে পড়ার ক্ষেত্রে কনসিসটেন্সি ব্যহত হয়, তবু অঞ্জনকে খুঁজতে হলে নমুনাস্বরূপ কিছু লিরিক আসবেই। আমরা লিরিকগুলোর মধ্যে যদি যোগসূত্র খুঁজতে পাই দেখা যাবে ভিন্ন নামে, ভিন্ন প্রেক্ষপটে তিনি আসলে একটিই গল্প বলতে চেয়েছেন, যে গল্প সকরুণ এবং বিয়োগান্তক। এই গল্পে প্রাপ্তির চাইতে বিসর্জন অনেক বেশি। চলতি চিন্তাধারার প্রতি বিরক্তি, কখনোবা নিজেকে নিয়েও মকিং করেছেন।
অঞ্জন আজ থেকে চুরি করবেনা কোন সুর
গান যার গাইবার ঠিক গান গাইবে
যে যা চাওয়ার তা মন থেকে চাইবে
বৃষ্টি নামতে পারে যদিও কড়া রোদ্দুর

যারা বিভিন্ন সংস্কৃতির গান শোনেন তারা মাত্রই জানেন অঞ্জন দত্তের বেশ কিছু গানের সুরই সরাসরি ইংরেজি বা অন্য ভাষার গান থেকে কপি করা। এটাকে কি চুরি বলা উচিত? যেহেতু সুরকার হিসেবে তার নামই যায়, সে হিসেবে চুরিই বলা উচিত। তবে আমি একে খুব বড়ো করে দেখি না। আদতে তিনি একজন গীতিকবি, কথাগুলো বসানোর জন্য তিনি সুর খোঁজেন, কিন্তু সুরের ওপর পর্যাপ্ত দখল না থাকায় সুরগুলো একই ধাঁচের হয়, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যের সুর ধার নিয়ে নেন। একই কথা কবির সুমন, আর নচিকেতা চক্রবর্তীর জন্যও প্রযোজ্য। বাণীটাই আসল, আমার মনে হয় না অঞ্জনের সুরের কারণে কেউ তার গান পছন্দ করে। কিছুদিন আগে তিনি ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ গানের পরের ভারসন লিখেছেন ‘আমি আসবো ফিরে তোমার পাড়ায়’। এই গানটির গায়ক এবং কম্পোজার তার ছেলে নীল দত্ত। কম্পোজিশনের কারণে বোঝাই যায় না এর সাথে অঞ্জনের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে।

তিনি যে সুর করতে খুব কমফোর্টেবল এর আরেকটা প্রমাণ পাওয়া যায় দীর্ঘদিন নতুন গান তৈরি থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে। তিনি নিজেও বোধ করছিলেন, সব একইরকম হয়ে যাচ্ছে।

তবে নতুন কম্পোজিশনেও তার বাণীপ্রধান গানগুলো যে দুর্দান্ত লাগে তার প্রমাণ ‘রঞ্জনা’ গানের নতুন ভারসন, কিংবা ‘তুমি না থাকলে’ গানের লিরিক আর কম্পোজিশন বদলে সম্পূর্ণ রকিং ধাঁচের এক গানে রূপান্তরিত করে ফেলা। রবীন্দ্রনাথের গান কেন রবীন্দ্রনাথের মতো করেই গাইতে হবে, এই প্রশ্ন করার সাহসই শুধু রাখেন না, সোমলতাকে দিয়ে ‘তোমায় গান শোনাবো’ গানটাকে যেভাবে ফিউশন করিয়েছেন, সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ রবীন্দ্রভক্তকে আহত করলেও ফিউশনটা আমি ব্যক্তিগতভাবে উপভোগ করেছি। যত বেশি ফিউশন, তত বেশি উৎকর্ষের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।

বাঙালি জন্মগতভাবেই ফিক্সড মাইন্ডসেট এর; একজন অঞ্জন ক্রমাগত গ্রোথ মাইন্ডসেট এর যে পরীক্ষা দেন। তিনি যে মাত্র ৩০% বাঙালি এটাই হয়তোবা সেই সাহসে রসদ যুগিয়েছে।

অঞ্জনকে যতোই অকপট মনে হোক, আমার পর্যবেক্ষণ বলে তিনিও কপটতার আশ্রয় নেন, ভোল পাল্টে ফেলেন। গনেশ টকিজ সিনেমার প্রচারণায় মীরাক্কেল এ এসে নানা কথা বলছিলেন হিট সিনেমার রেসিপি বিষয়ে, নিজের পূর্বচিন্তাধারায় গলদ ছিলো সেসবও বলেছিলেন, কিন্তু সেই ছবিও যখন কমার্শিয়ালি ফ্লপ করলো, বললেন ‘ভুল করেছিলাম’। যে কবির সুমনকে গান শুরুর ইনস্পাইরেশন বলেন, তার সাথেও দীর্ঘদিন ধরে দূরত্ব রয়েছে, এবং এক্ষেত্রে সুমন তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কিছু অভিযোগ করেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। সেসবেরও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। কিংবা নিজের পলিটিক্যাল ওরিয়েন্টেশন বিষয়েও কিছুটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থানে থাকেন সবসময়। এটাও আদতে সুবিধাবাদী মানসিকতাই।

মানুষমাত্রই পতিত ঈশ্বর, কিন্তু আমরা পতনগুলো মানতে পারি না, অথবা পতনকে মহিমাণ্বিত করতে চেষ্টা করি। যে কারণে আমরা কখনোই মুক্তমনে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে পারি না।অঞ্জনের বিচ্যুতিকে আমি খুবই স্পোর্টিংলি নিতে পারি বলে তার প্রতি আগ্রহ বা ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি দুটোই সক্রিয় থাকে একই রকম।

তবু গুরুতর প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। মাত্র ৫ মিনিটের গানে যিনি এতো বিশাল ক্যানভাসের স্টোরি সেট আপ করেন,সিনেমাতে সেই স্টোরিটেলিংটা পাই না কেন? এর উদাহরণ পাওয়া যাবে ক্রিকেটসূত্রে। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল টি২০ তে একজন বিধ্বংসী ক্রিকেটার, কিন্তু টেস্টে তাকে সচরাচর বিবেচনাই করা হয় না, বা টেস্ট যা খেলেছেন ঔজ্জ্বল্য কম।গানের গল্পগুলোকে শ্রোতা নিজের মতো করে কল্পনা করে নেয়, সিনেমার ক্ষেত্রে পুরো কল্পনার দায়িত্বই পরিচালককে নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়; তখনই তার ব্যক্তিগত অন্তর্দৃষ্টি, লাইফ স্টাইল, চিন্তাপ্রক্রিয়া, জীবনবীক্ষণ প্রভৃতি ম্যাক্রো লেভেলের উপকরণগুলো প্রকট হয়ে উঠে। এখানেই অঞ্জন ম্যাক্সওয়েল হয়ে যান।

হয়তোবা একই কারণে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর অঞ্জনের গান আর সেভাবে টানে না শ্রোতাকে। ৫০ বছর বয়সী কেউ হয়তোবা ‘বয়স আমার মুখের রেখায় শেখায় আজব ত্রিকোণমিত, কমতে থাকা চুলের ফাঁকে মাঝ বয়সের সংস্কৃতি’ গান শুনবে, কিন্তু ‘মাসের প্রথম দিনটা এই ধর্মতলার মোড়ে’ গান তাকে আকৃষ্ট করবে না। তবু ত্রিশের নিচের মানুষেরই যেহেতু গান শোনার সময় বেশি, প্রোগ্রামগুলোতেও তাদেরই আনাগোনা বেশি, সেই নিরিখে অঞ্জনের গ্রহণযোগ্যতা অন্যদের তুলনায় ঈর্ষণীয় পর্যায়ের বেশি। কিন্তু দিনশেষে একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ একটি নির্দিষ্ট বয়সের মানুষের সীমায় আটকে থাকতে চান না,সেকারণেই হয়তোবা অঞ্জনের হতাশাও বেশি-
“কত কি করার ছিল যে, কত কি বলার ছিল রে
কত কি পারি নি হতে, আমার কত কি হবার ছিল যে
এই কথাটাই মনের ভেতরে ভেতরে গুমরে গুমরে গুমরে মরে
হবে হবে বলে আর হল না কিছুই দাদা
এ পাড়া বে পাড়া সে পাড়া ঘুরে”

অঞ্জন দত্তকে তাহলে কেন মনে রাখবো আমি? একটা গভীর উপলব্ধির জন্য। ছোট থাকতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট কত কিছু হয় একজন মানুষ। বয়স ২০ হওয়ার আগেই অপশনগুলো ক্রমশ কমে আসতে থাকে, ৩০ এর পরে অপশন প্রায় শেষই হয়ে যায়। তখন সে কী হতে চেয়েছিল তার চাইতে যা হয়েছে সেটাই বয়ে নিয়ে জীবন পাড়ি দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত এক মিডিওক্রিটির জীবন নিয়েই অস্তিত্বের সমাপ্তি ঘটে। অঞ্জনের গান প্রতিনিয়ত সেই মিডিওক্রিটিকেই গ্ল্যামার দিয়ে পরিবেশন করে, তাতে হৃদয় ক্ষরিত হয়, কিছুটা হলেও মিডিওক্রিটির গারদখানা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্দীপনা বোধ করি। এই কন্ট্রিবিউশনকে নিছক হালকাচালে নেয়াটা নির্বোধের পরিচায়ক হবে।