বাংলাদেশী সিনেমায় প্লেব্যাক সিঙ্গিংয়ের দীর্ঘ ইতিহাসে অসংখ্য গুণীশিল্পী সিনেমার গানকে সমৃদ্ধ করতে কন্ট্রিবিউট করেছেন কণ্ঠের মাধ্যমে। তবু একজনমাত্র পছন্দের শিল্পী বেছে নিতে বললে আমি তেমন কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই যাকে বেছে নেব তিনি সৈয়দ আবদুল হাদি। জনপ্রিয়তা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্লুয়েন্স, কমার্শিয়াল ইমপ্যাক্ট এসব বিবেচনায় নিলে এন্ড্রু কিশোরের চাইতে তিনি অনেকখানিই পিছিয়ে থাকবেন, কিন্তু আমি যেসব ক্রাইটেরিয়া দিয়ে তাঁকে পছন্দ করেছি সেখানে এন্ড্রু কিশোরকে পাশ কাটিয়ে তিনি বেশ ভালোমতোই অবস্থান করে নিয়েছেন। আমি এই লেখায় আবদুল হাদির প্রসঙ্গ বিভিন্ন প্যারাতেই নিয়ে আসবো, ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য পুরুষ শিল্পীও চলে আসবেন, মূলত প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রিটাকে বুঝবার একটা প্রয়াস হিসেবে।

সৈয়দ আব্দুল হাদিকে প্রথম চিনি বিটিভির ঈদপ্রোগ্রামসূত্রে। দুটো কিশোর-কিশোরীকে পাশে নিয়ে তিনি একটা গান গাইতেন ‘চাঁদের পালকি চড়ে, আসলো সবার  ঘরে আজকে খুশির ঈদ, বলো ঈদ মুবারক, ঈদ মুবারক ঈদ’। এই গানটা অনেকদিনই হলো বিটিভিতে আর দেখানো হয় না, কিন্তু আমাদের শৈশবে এটা বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তখনই পরিচিত বয়ঃজেষ্ঠ্যদের মারফত জানতে পারি এই ভরাট কণ্ঠের গায়কের নাম সৈয়দ আব্দুল হাদি, তিনি সিনেমায় গান করেন।
গুগলসূত্র বলছে, আব্দুল হাদি ১৯৬০ সালে প্রথম প্লে ব্যাক করেন, তাই ধরে নেয়া যায় বাংলা সিনেমার আতুরঘর যুগ থেকেই এই বিকাশমান ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত হন তিনি। তাঁর সমসাময়িক অন্য গায়কদের সম্পর্কে একটু লিখি।
প্রথমেই বলবো, খন্দকার ফারুক আহমেদের কথা। তাঁর রোমান্টিক গানগুলো দারুণ আকৃষ্ট করেছিলো তৎকালীন সিনেমাপ্রেমীদের। ‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা’, ‘কাছে আসো যদি বলো, তবে দূরেই কেন থাকো’ কিংবা ‘আমি কার জন্য পথ চেয়ে থাকি’– এই গানগুলো বোধহয় এখনো ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানে বা ওল্ড ইজ গোল্ড সেকশনে মাঝেমধ্যেই প্রচার করা হয়। ক্যারিয়ারে যতটা খ্যাতি পাওয়া উচিত ছিলো, সেটা না পাওয়ার পেছনে সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়া একটা ফ্যাক্টর ছিলো।
আরেকজন খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল শিল্পী মাহমুদুন্নবী। ‘ও মেয়ের নাম দেব কী ভাবি শুধু তাই’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ সহ আরও অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি। তাঁর সন্তানেরা (ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, পঞ্চম) প্রায় সবাই গানের সাথে জড়িত হয়ে তাঁর লেগাসি ধরে রেখেছে। কিন্তু অকালপ্রয়াত হওয়ার কারণে বোধকরি জনপ্রিয়তার একটি স্পেসিফিক বলয়ে তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

আব্দুল হাদির সমসাময়িক সবচাইতে রকিং গায়ক খুরশীদ আলম। চটকদার প্রায় সব গানের গায়ক মানেই খুরশিদ আলম। ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘চুপি চুপি বলো কেউ জানে’ কিংবা ৮০ এর দশকে ‘হায়রে হায় মিস লংকা’ গানগুলো সময়ের বিচারে মারাত্মক লেভেলের রকিং। সিরিয়াস মেলোডিয়াস গানেও খুরশিদ আলমের খ্যাতি ছিলো। ‘মাগো মা’, ‘তোমার নামে শপথ নিলাম’ গানগুলোও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু ৯০ এর দশকে এক সঙ্গে প্রচুর প্লেব্যাক সিঙ্গার চলে আসায়, বিশেষত আধুনিক গান নামে অডিও বের করতো যেসব শিল্পীরা তারাও প্লেব্যাকের দিকে ঝুঁকে পড়লে খুরশিদ আলম নিজের পজিশন হারাতে শুরু করেন। সেই সাথে বয়সের একটা ব্যাপার তো ছিলোই।

আব্দুল হাদির প্রথম যে গানটি আমার ভালো লেগে যায় সেটা হলো ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিলো না’। এই গানটি অসংখ্যবার শোনা হয়েছে জীবনে, একটা লাইন খুবই ফিলোসফিকাল লাগে ‘লালন মরলো জল পিঁপাসায় থাকতে নদী মেঘনা, হাতের কাছে সোনার কলস তৃষ্ণা মেটে না’। সম্ভবত এই লাইনের এন্টারপ্রেটেশন বুঝবার উদ্দেশ্যেই গানটা এতোবার শোনো হয়েছে। তবে আমার স্মৃতিতে আব্দুল হাদির অন্য একটা গান ‘ আছেন আমার মোক্তার’– এটা বেশি আগে আসে। জীবনের প্রথম আট বছর গ্রামে থাকা হয়েছে। সেই সময়ে রেডিও শুনতো বয়সে বড় কাজিনরা; তখন গানটা শোনা হয়েছিল। যে ইমেজটা মাথায় এসেছিল সেটা হলো, একজন আসামীর বিচার হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অন্যায় করা হচ্ছে, এমন কোনো সিচুয়েশনে গানটা করা (পরে অবশ্য ভুল ভেঙ্গেছে)। অনেকদিন পর জেনেছি এটা আব্দুল হাদির গান। ততদিনে তাঁর গাওয়া আরও অসংখ্য গানের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে আমার। মাঝখানে কিছুদিন দুটো গান অনেক গেয়েছি (প্রোগ্রামে নয়, নিজের ভালো লাগা থেকেই নিজেকে গান শোনাই)। ‘কথা বলবো না, বলেছি, শুনবো না শুনেছি’ আর ‘মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে, বাত্তির নিচে অন্ধকার’। বিশেষত, শেষের গানটা এখনো গাওয়া হয়। ‘প্রেম কইরো না দেহের সনে, আত্মার সনে ছাড়া’– এই লাইনটার এন্টারপ্রেটেশন বুঝার চেষ্টা করি, বেশিরভাগ সময়ই ধরতে পারি না। প্লেটোনিক প্রেম বলতে সত্যিই কি কিছু এক্সিস্ট করে, নাকি প্রেমের এক পর্যায়ে তা দেহজ হবে এটাই নিয়তি- এই ফিলোসফিকাল ক্রাইসিস সলভ করতে পারি না। দেহজ এবং অদেহজ- দুয়ের মধ্যকার মিস্ট্রিটা বরং আরও গভীর এবং জটিল হয়ে পড়ে। বাংলা সিনেমার সস্তা সাদামাটা লিরিকে আমি এরকম গভীর ফিলোসফি খোঁজার চেষ্টা করি, এটা এলিট বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর চোখে এক ধরনের স্থূল রুচি এবং মোটাবুদ্ধির লক্ষণ বলে প্রতীয়মান হতে পারে, হোক, আমি নিজেকে কখনোই চিন্তাশীল মনে করি না বা করলেও অন্যদের চিন্তার সংজ্ঞায়ন মানি না; আমি খুবই লঘু এবং চিপ; আমার কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই। আমি বাংলা সিনেমার গান পছন্দ করি, এতে যদি অগভীর হয়েই যায়, হলাম। আব্দুল হাদির ভীষণ ক্লাসি একটা গান আছে ‘সখি চল, চল না, জলসা ঘরে এবার যাই’; এই গানের সুরটা কানের মধ্যে গভীর সংবেদনের অনুভূতি জাগায়।
৭০ এর দশকের আরও দুজন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল শিল্পীর কথা বলবো। একজন বসির আহমেদ, অপরজন আব্দুল জব্বার। বসির আহমেদ খুব বেশিদিন একটিভ ছিলেন না প্লেব্যাক এ। ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ ‘সজনী গো, ভালোবেসে এতো জ্বালা কেন বলো না’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এতো লাগে ভালো’- এই গানগুলো এখনো টিকে আছে। আব্দুল জব্বারের ব্যাপারটা আমার রহস্যজনক লাগে। তিনি বোধহয় রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন, ঠিক শিওর না। ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’ এরকম কালজয়ী গান যিনি গেয়েছেন, তার তো প্লেব্যাক ক্যারিয়ার আরও দীর্ঘায়ত হওয়ার কথা। হিট লিস্টে আরও অনেক গান ঢোকার কথা ছিলো, কিন্তু সংখ্যাটা অপর্যাপ্ত। বরং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর অবদানের জন্য তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত। তার গাওয়া দেশাত্মবোধক গানগুলো ভিন্ন আবেদন জাগায়। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এই একটা গানই তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। তবু আফসোস জাগে, এরকম কণ্ঠ তো আরও গ্রেটার পারপাস ফুলফিল করতে পারতো।
পরবর্তীতে আধুনিক গানের এলবামে বেশি সময় দিলেও সুবির নন্দী একসময় প্লেব্যাকে খুবই নিয়মিত ছিলেন। তার অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান আছে। ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’, ‘একটা ছিলো সোনার কন্যা’ প্রভৃতি গানের শ্রোতাপ্রিয়তা একটুও কমেনি। তিনি সফটধাঁচের গানই বেশি গেয়েছেন, তারুণ্যের উদ্দামতা হয়তো অনুপস্থিত, কিন্তু অষ্টাদশীর ইনোসেন্স পুরোমাত্রায়ই তাঁর গানে পাওয়া যায়। প্রয়াত জাফর ইকবালের সাথে তার একটা দারুণ কেমিস্ট্রি জমে উঠেছিল।
জাফর ইকবালকে নিয়ে কিছু লাইন লেখা উচিত। তিনি জনমহলে ফ্যাশনেবল নায়ক হিসেবেই পরিচিত, ফলে গায়ক সত্তাটি সেভাবে বিকশিত হয়নি। তবু যে গুটিকয়েক গান গেয়েছেন তার বেশিরভাগই আলোড়ন তুলেছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ৪টি গানের কথা। ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে গেলাম সজনী গো, সেই আগুন চোখে দেখলাম না’। শেষোক্ত গানটি রিমিক্সের কল্যাণে বিভিন্ন জম্পেশ প্রোগ্রামে এখনো আসর জমানোর উদ্দেশ্যে গাওয়া হয়ে থাকে। ইউটিউবে সার্চ দিলে এই গানের কতরকম যে ভারসন পাওয়া যায় ইয়ত্তা নেই। শচীন দেব বর্মনের ‘শোনো গো দখিনা হাওয়া’ গানটা যেমন অনেক শিল্পী কভার করেছেন, তেমনি রুনা লায়লার সাথে ডুয়েট গাওয়া জাফর ইকবালের এই গানটিও কভার করে অধিকাংশ অপ্রতিষ্ঠিত নতুন শিল্পী, যদিও গানের লিরিক বেশ চটুলই বলা যায়।

ছোটবেলায় যখন কাজিনদের সাথে রেডিও শুনতাম আমার ধারণা জন্মেছিল সিনেমায় পুরুষ কণ্ঠে যত গান গাওয়া হয় তার সবগুলোর গায়ক বোধহয় এন্ড্রু কিশোর। ৭৭ সালে শুরু করে ২০১৬ পর্যন্ত এখনো প্লেব্যাকে আধিপত্য ধরে রেখেছেন, ৪০ বছর ধরে একটা ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে নেয়া, এরকম নিরঙ্কুশ দাপটের ব্যাপারটা বোধহয় বিশ্বরেকর্ড। আমি ঠিক জানি না, তবে ধারণা করতে পারি ৭৭ সালের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত যতগুলো বাংলা সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার ৯০% এই এন্ড্রু কিশোর কণ্ঠ দিয়েছেন। পারসেন্টেজটা আরও বেশি হতে পারে। তার জনপ্রিয় গানের লিস্ট করতে গেলে সব তো মনেও পড়বে না। ৮-১০ টা রেন্ডমলি যা মনে আসে লিখতে থাকি। জীবনে প্রথম শুনেছিলাম ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গানটা। রুনা লায়লার সাথে ডুয়েট গেয়েছেন প্রচুর গান, সাবিনা ইয়াসমীন, কনক চাপা, সামিনা চৌধুরী কেউ বাদ পড়েননি লিস্ট থেকে। ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘তুমি আমার জীবন’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘ এই দিন সেই দিন কোনোদিন তোমায় ভুলবো না’, ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ’, ‘তুমি আমার মনের মাঝি’, ‘প্রেম কখনো মধুর, কখনো সে বেদনা বিধুর’, শচীন দেব বর্মনের ‘তুমি এসেছিলে পরশু’– আরও অনেক অনেক গান। সব মনেও পড়ছে না। সিনেমার গানে ব্যস্ততার কারণে অডিও অ্যালবাম বা টেলিভিশন প্রোগ্রামেও তাঁর উপস্থিতি তুলনামূলক যথেষ্ট কম। পেপার-পত্রিকাতেও তাকে নিয়ে সেভাবে লেখালিখি হয় না, ফলে তাঁর কন্ট্রিবিউশন অনুযায়ী রিকগনিশন বা এপ্রিশিয়েশন বেশ কম। বাংলাদেশ আইডল নামের একটা রিয়েলিটি শো তে বিচারক হয়েছেন, শো-বিজ এক্টিভিটি বলতে এটাই চোখে পড়ার মতো। এছাড়া ইত্যাদিতে বেশ কয়েকবার গান গেয়েছেন, সিনেমার গানগুলো নিয়েই অডিও বের করা হয়েছে, এই তো। কিন্তু ঠিক ক্রেজ তৈরি করতে পারেননি যেটা পেরেছিলেন কুমার বিশ্বজিত।
কুমার বিশ্বজিত সোলস ব্যান্ড এর সাথে ইনভলভ ছিলেন, সোলো ক্যারিয়ার গড়ার দিকে ঝুঁকে রাতারাতি ক্রেজও তৈরি করতে সমর্থ হন। ‘তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে’ এই একটি গান দিয়েই বিশাল হিট। ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘তুমি যদি বলো পদ্মা মেঘনা একদিনে দেব পাড়ি’ এরকম অনেকগুলো শ্রোতাপ্রিয় গান তিনি উপহার দিয়েছেন। তবে এসবেরও আগে তাঁর প্লেব্যাকে অভিষেক হয়। ‘চন্দনা গো’ গানটি সেই ৮০ সালের আগে ফারুক-রোজিনার সিনেমায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে সিনেমার গানে তিনি সিরিয়াস হওয়া শুরু করেন ২০০০ সালের পর থেকে যখন অডিও ইন্ডাস্ট্রি পাইরেসির কারণে অনেকটাই ধ্বসে পড়তে শুরু করে।
আব্দুল হাদির গানে চটুলতা কম, রোমান্টিকতা বেশি। এবং তার ভয়েস একদম মনের গভীরে প্রবেশ করে। ‘ এই মিথ্যেটুকু যদি সত্যি হলো কাজ কী আছে আর এই ছলনার’, ‘কে জানে কত দূরে সুখের ঠিকানা’, ‘তুমি ছাড়া আমি একা পৃথিবীটা মেঘে ঢাকা’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’– গানগুলো শুনলে এখনো কৈশোরের অনুভূতি জেঁকে বসে। কণ্ঠে সুমিষ্টা এবং বলিষ্ঠতা বলতে যে দুটো বৈশিষ্ট্য আছে, আমি ওপার বাংলার কিশোর কুমার ছাড়া আর কাউকেই তার পর্যায়ে বসাতে পারি না। হ্যাঁ, আমি বাংলা গান প্রচুর শুনেছি, ইংরেজি গান খুবই কম শুনেছি, হিন্দি গান তেমন একটা শোনাই হয়নি, আমার গানের ভাণ্ডার সীমিত, কিন্তু শুধুমাত্র বাংলা গান যদি বিবেচ্য হয়, আমার ধারণা আমি অনেকের সাথেই কথা চালিয়ে যেতে পারবো, সেটা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বাদে যে কোনো ঘরানার গান হোক। সবকিছু মাথায় রেখেই বলছি, কণ্ঠস্বরের বলিষ্ঠতায় বা ঐন্দ্রজালিকতায় আব্দুল হাদিকে অতিক্রম করতে পারেন এরকম বাংলাভাষী কণ্ঠ আমি শুনিনি।
৮০ এর দশক থেকে বাংলা সিনেমায় ভারতীয় শিল্পীদের প্রবেশ (অনুপ্রবেশ) বাড়তে থাকে। বাপ্পি লাহিড়ী, কুমার শানু, গায়িকাদের আনাগোনা চলতে থাকে। এর মধ্যেও অল্প সময়েই মঞ্চ প্রস্তুত করেছিলেন খালিদ হাসান মিলু। সিনেমার গানের পাশাপাশি ‘আধুনিক গান’ এরিনাতেও তিনি দাপট দেখাতে থাকেন। ‘সেই মেয়েটি আমাকে ভালোবাসে কিনা আমি জানি না’, ‘তোমায় আপন করে রাখবো বলে’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি’ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। অকালপ্রয়াত হয়ে এই সম্ভাবনাময় শিল্পীও একটি উল্লেখযোগ্য পজিশনে পৌঁছুতে পারেননি।
ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদ এরাও মাঝখানে প্লেব্যাক করেছেন কিছুদিন। মাকসুদের ‘ঘর ছেড়েছি দুজনে’, ‘তোমাকে দেখলে একবার, মরিতে পারি শতবার’, ‘ও ও রুবি, বলো না তুমি বলো না’ কিংবা আইয়ুব বাচ্চুর ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ গানগুলো হিট করেছিলো। প্রমিথিউসের বিপ্লব ‘এই মাটি’ গানটিসহ আরও কিছু প্লেব্যাক করেছেন, জেমসও কয়েকটা প্লেব্যাক করেছেন ‘আসবার কালে আসলাম একা’। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু ছাড়া কেউই প্লেব্যাক নিয়ে খুব সিরিয়াস হননি। পরের দিকে আইয়ুব বাচ্চুও প্লেব্যাক থেকে সরে গেছেন।
৯০ এর দশকে সালমান শাহ এর সাথে সাথে আগুনেরও অভিষেক ঘটে প্লেব্যাক। ‘ও আমার বন্ধু গো’– এক গানেই সালমানের সাথে তার অদ্ভুত সুন্দর একটা কেমিস্ট্রি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সালমানের মৃত্যুর পর আগুনও যেন ট্র্যাকচ্যুত হন, তখন বরং ভিলেন ডিপজলের অশ্লীল গানগুলোতেই কণ্ঠ দিয়েছেন বেশি। এখন বোধহয় প্লেব্যাকে আগের মতো আর একটিভ নেই তিনি।
আরেকজন শিল্পী পলাশও অডিও আর প্লেব্যাকের মধ্যে ব্যালেন্স রক্ষার চেষ্টা করেছেন বেশ কিছুদিন। কিন্তু কোনো মাধ্যমেই আলোচনায় আসার মতো কিছু করতে পারেননি।
চট্টগ্রামের শিল্পী আব্দুল মান্নান রানা সিনেমাতে অল্প কিছু গান করেছেন। এরকম স্বল্প ক্যারিয়ারের তালিকায় আরও যুক্ত হবেন মনি কিশোর (কে অপরাধী সিনেমায় ‘কী ছিলে আমার বলো না তুমি’), জোনাক, আদনান বাবু, এসডি রুবেল।
অডিও শিল্পী মনির খান, আসিফ, এসআই টুটুল ২০০০ সালের পর থেকে প্লেব্যাকে যথেষ্ট সক্রিয়, এবং এখনো তা বজায় রেখেছেন। রিয়েলিটি শো থেকে আসা রাজিব, কিশোর, মুহিব, ইমরান- এরাও চেষ্টা করছেন। তবে অন্য সবকিছুর মতো, সিনেমার গানেও কোয়ালিটির ব্যাপক অবনমন হয়েছে। আগে সুন্দর লিরিক এবং সুন্দর সুরের গানের অভাব ছিলো না, এখন প্রোডাকশন বেশি বলেই বোধহয় আনুপাতিক হারে কোয়ালিটি ধরে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। সামগ্রীকভাবেই কালচারালি চরম ইনফারটিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে। এর থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে বা আদৌ মিলবে কিনা বলা মুশকিল।

আব্দুল হাদির জন্ম ১৯৪০ সালে, সে হিসেবে বর্তমানে ৭৬ বছর বয়স চলছে তাঁর। সঙ্গত কারণেই, জীবনের সোনালী সময় পেরিয়ে এসেছেন, এখন পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করেই সময় কাটে হয়তোবা। তিনি রবীন্দ্রসংগীত এর অ্যালবাম করেছেন, তাঁর গাওয়া দেশাত্মবোধক গানগুলোও অসাধারণ। ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’– আপাতত এই দুটো গানের কথা মাথায় আসছে। তিনি একজন কমপ্লিট শিল্পী। রকিং গান হয়তোবা সেভাবে গাননি। তবে চেষ্টা করলে নিশ্চিতভাবেই সফল হতেন, তার কণ্ঠে সেই বোল্ডনেস ছিলো। সঙ্গীত পরিচালকরা কেন তাঁকে দিয়ে সেই চেষ্টা করেননি, এটা আমার বোধগম্য হয় না।

সৈয়দ আব্দুল হাদি তাঁর প্রতিভার বেশিরভাগটাই খরচ করেছেন সিনেমার গান গাওয়ার মধ্যে। তবু বিভাজন ছাড়াই তাঁকে একজন পারফেক্ট আর্টিস্ট হিসেবে স্বীকার করে নিতে আমার কোনো কুণ্ঠা নেই। আমি পারসোনালি লালনগীতি অনেক বেশি পছন্দ করি, ফোক গানের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে, ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়েও ফ্যাসিনেটেড ছিলাম, তবু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কারো কথা ভাবলে আশ্চর্যজনকভাবে সেই মানুষটি চলে আসেন যিনি বলেন ‘কথা বলবো না, বলেছি, শুনবো না শুনেছি; মনে মনে চুপি চুপি তোমারে রে ভালোবেসিছি, আমি…”

LikeShow More Reactions

Comment