সৈয়দ সামি যেদিন বিসিবি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পায়, ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম একটা মকারিপূর্ণ স্ট্যাটাস লিখে যেখানে সামিকে বিশেষায়িত করা হয়েছে ‘স্ক্যাম আর্টিস্ট’ হিসেবে।
আমার ফ্রেন্ডলিস্টে একজন রিপোর্টার আছে, তারিকুল ইসলাম সজল। সামি উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেয়ার পরে সে স্ট্যাটাস লিখেছিল- ছেড়ে দিয়েছে, নাকি বের করে দিয়েছে৷ ১ দিন বাদে আরেক স্ট্যাটাস- পদত্যাগ করার আগে নাকি বিসিবির কাউন্সেলরশিপ বাগিয়ে নিয়েছে।
যে ২ ব্যক্তির রেফারেন্স দিলাম তারা পলিটিকাল কারেক্টনেস দেখিয়ে বলতে পারে সামির নাম কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, সুতরাং আমার অভিযোগ মনগড়া। আমরা শেয়াল এবং কুমিরের গল্পটা জানি। একই বাচ্চা ৬ বার দেখিয়ে কুমিরকে হয়তবা বুঝ দেয়া যায়, তাতে শেয়ালের ধূর্ততা বৈধতা পায় না, মোরাল গ্রাউন্ডেও তা সঠিক হয়ে যায় না।
সৈয়দ সামির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনো। পরিচয়ও ছিল না। একবার এক পোস্টে আরেকজনের রেফারেন্স দিয়ে লিখেছিলাম শুনেছি সে শেখ জামাল মাঠে করা ভিডিওগুলো সরিয়ে ফেলেছে। তার স্ত্রী সেখানে কমেন্ট করে মামলার হুমকি দিয়েছিল।
সেদিন রাতে সামি ফোন করে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে, এবং স্ত্রীর ওভার কনছার্ন হওয়ার বিষয়টিকে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হিসেবে দেখতে অনুরোধ করে।
এরপর থেকে প্রায়ই চ্যাটিং হয়৷ এটুকুই।
যারা ক্রিকেটকে রিলিজিয়াসলি ভালোবাসে এবং শিক্ষিত, তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাবস্ক্রাইবারের কাছে ‘জেরাড কিম্বার’ একজন সিগনিফিক্যান্ট ক্যারেক্টার। তার পডকাস্ট শো ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে শোনে অনেকেই। ইংরেজিতে হওয়ায় কেউ কেউ ইচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে পারে না।
বাংলা ভাষায় কেন জেরাড কিম্বার তৈরি হয় না? মার্কেট কিন্তু রেডি। রেডি না রিসোর্সফুল পারসন।
মার্কেটে কয়েকজন আছেন যারা ক্রিকেট কনটেন্ট বানান। এই মুহূর্তে ৫ জনকে মনে পড়ছে- নোমান মোহাম্মদ, দেব চৌধুরি, রিয়াসাদ আজিম, দেবব্রত মুখার্জী এবং সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামি।
শেষোক্তজনের প্রসঙ্গে পৃথকভাবে বলবো, প্রথম ৪ জনের প্রসঙ্গে বলি।
নোমান মোহাম্মদ একসময় প্রিন্ট মিডিয়ায় সাংবাদিকতা করতেন। প্রথম আলো এবং কালের কন্ঠতে তার লেখা পড়েছি।
দেব চৌধুরিকে ছোটবেলা থেকেই চিনি, স্কুলের বড় ভাই। ব্যাংকে চাকরি করতেন, সেখান থেকে একাত্তর টেলিভিশনে স্পোর্টস রিপোর্টিং করতেন, এক পর্যায়ে অলরাউন্ডার নামের অনলাইন প্লাটফরমে জয়েন করেন। লীগ সরকার পতনের পরে সেটা বন্ধ হওয়ায় প্রাইম ব্যাংকে জয়েন করেছেন
রিয়াসাতের ট্র্যাক রেকর্ড জানি না। অনুজ রুহুল আমিনের বরাতে শুনেছি সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র,বিতর্ক করত। তাকে প্রথম দেখি ২০১৯ বিশ্বকাপ চলাকালে, উল্টাপাল্টা নিউজ করত। শুনেছি সে একাত্তর টেলিভিশনে নেই আর, বর্তমানে ইউটিউবে কনটেন্ট বানায়
দেবব্রত মুখার্জি আমার বইয়ের ক্যারেক্টার। চিন্তার এবং চয়েজের বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও তাকে পর্যবেক্ষণে রাখি। প্রথম আলো, ভোরের কাগজ, ইত্তেফাক তিন মিডিয়ায় কাজ করেছেন জানি, কিছুদিন খেলা71 এও যুক্ত ছিলেন, সর্বশেষ নগদে জয়েন করেছিলেন। তারপরের স্ট্যাটাস জানি না।
৪ জনকে পিনপয়েন্ট করলাম ব্যাকগ্রাউন্ড এনালিসিস এবং কনটেন্ট মেরিট ম্যাপিং থেকে ক্রিটিকাল রিজনিং মডেল দাঁড় করাতে।
দেবব্রতের কনটেন্ট বাকি ৩ জনের চাইতে একটু আলাদা। সেগুলো খানিকটা ব্যক্তিগত ডায়েরি ধরনের৷ কিছুটা ক্রিকেট, কিছুটা বৈঠকি আড্ডা।
অন্য ৩ জনের কনটেন্টগুলো পুরোপুরি ‘ক্রিকেট গসিপ’, সেখানে ক্রিকেট থাকে শূন্য পারসেন্ট, ক্রিকেটার এবং বিসিবির কতিপয় ডিরেক্টর বা এমপ্লোয়ি আসে স্ক্রিপ্টের ক্যারেক্টার হয়ে।। শাকিব খানের সাথে পূজা চেরির স্ক্যান্ডাল, সুনেরাহ বিনতে কামাল আরাভ খানের সাথে কেন লংড্রাইভে যায়— এসব কনটেন্টের সাথে তাদের তথাকথিত ক্রিকেট কনটেন্টের ক্যাটেগরিকালি কোনো পার্থক্য নাই।
কয়েকটা উদাহরণ দিই
১. ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মাত্র ৩টি ফ্রেজিং- দায়িত্বহীন ব্যাটিং, রেকলেস শট, শেষ ৫ বা ১০ ইনিংসে কয়টা ফিফটি। ব্যাটসম্যানের ওয়াগন হুইল নাই, কোন জোনের ডেলিভারিতে বেশি আউট হয় তার চিত্র নাই, হেড পজিশন, বডি ব্যালেন্সের কোনো কথা নাই, প্রতিপক্ষ বোলারের লেন্থ, ফিল্ডারের এন্টিসিপেশন নাই। এখানে ক্রিকেট কি শুধু মিরাজের ৫ ম্যাচ ধরে উইকেট না পাওয়া অথবা মুশফিকের রিভার্স সুইপ খেলাতে? এই একটা শট নিয়ে মুশফিকের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে৷ কোনোদিন দেখলাম না মুশফিক তার ক্যারিয়ারে সুইপ আর রিভার্স সুইপে কত রান করেছে তার ডেটা, কিংবা সাকসেসফুল রিভার্স সুইপের সময় তার হেড পজিশন কী থাকে যেটা আউট হওয়ার সময় মিসিং— এসব কিচ্ছু নাই, বলে দিলাম দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং, গেম এওয়ারনেস প্রভৃতি pseudo cricketing word!
২. বোলিং তারা কিছুই বুঝে না। যে ম্যাচে প্রতিপক্ষ অল্প রানে আউট হয় সেদিন ভালো বোলিং, বেশি রান করলে নখদন্তহীন বোলিং— এগুলো বেসিকালি হাজারিবাগের চামড়া কারখানায় বসে খেলা দেখা দর্শকের কথা, এটা কখনো কনটেন্ট হতে পারে না। ক্রিকেটে পিচ এবং কন্ডিশন সবচাইতে ম্যাটার করে। টেস্টে একজন বোলার দিনে যদি ১৫ ওভার বোলিং করে, তার ট্রাজেক্টরি কোথায় ছিল, পেসার কোন চ্যানেলে আর লেন্থে বেশি বল করেছে, কোন ধরনের ভ্যারিয়েশন ট্রাই করেছে— সে সংক্রান্ত একটাও শব্দ নেই৷ ভালো বোলিংয়ের সব শর্ত পূরণ করেও দেদার রান বিলাতে পারে বোলার, ব্যাটসম্যান হয়ত সেদিন রিদমে আছে। বিপরীতটাও ঘটতে পারে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত হাসান বা তাইজুল না জানে সে বেশিরভাগ ডেলিভারি কোন জোনে করেছে, কতটুকু বাউন্স-সুইং-টার্ন পেয়েছে আপনি কীভাবে বলেন ধারালো অথবা ধারহীন বোলিং!
৩. একজন ব্যাটসম্যান ২০ ইনিংসে ফিফটি বা সেঞ্চুরি পায় না অথবা একজন বোলার ১৩ ম্যাচ ধরে উইকেট পায় না, সুতরাং তাকে বাদ দাও, অমুককে আনো৷ এগুলো ক্রিকেটিয় এপ্রোচ হতে পারে না। একজন ব্যাটসম্যান কোন ধরনের বলে আউট হচ্ছে, তার টেকনিকাল এডজাস্টমেন্ট কোথায় প্রয়োজন, বা কোন টেকনিকাল দুর্বলতাটা প্রতিপক্ষ ধরে ফেলেছে, কারণ এখন কোন প্লেয়ার কয়েকটা সিরিজ খেললেই তার সমস্ত টেকনিকাল ডেটা প্রতিপক্ষ এনালিস্টের ল্যাপটপে চলে যায়৷ অনুরূপ একজন বোলার উইকেট পাচ্ছে না, তার বোলিংয়ের লেন্থ বা ভ্যারিয়েশনে কোনো প্রেডিক্টেবিলিটি এক্সপোজ হয়ে গেছে কিনা, সে ব্যাপারে ডেটা ড্রিভেন ফাইন্ডিংস কই!
৪. আরেকটা কমন টপিক ব্রিলিয়ান্ট ক্যাপ্টেন্সি অথবা পুওর ক্যাপ্টেন্সি। অন ফিল্ড ক্যাপ্টেন্সি কোয়ালিটি মার্কিংয়ের ক্ষেত্রে অপশন কী কী- ব্যাটসম্যান এবং ম্যাচ পরিস্থিতি অনুসারে ফিল্ড প্লেসমেন্ট, হাতে থাকা বোলিং অপশনগুলোকে ব্যবহার করা, মাঝেমধ্যে পার্ট টাইমারদের দিয়ে গ্যাম্বলিং করা৷ অফ দ্য ফিল্ড ক্যাপ্টেন্সিই আসল, সেটা আমরা টিভি স্ক্রিনে বা গ্যালারিতে বসে কোনোদিনই বুঝতে পারব না। কোনো রেগুলার বোলারের বোলিং কোটা যদি বাকি থাকে অথবা নতুন ব্যাটসম্যান এলে স্লিপে ফিল্ডার না রাখা হয়, এবং ম্যাচটা হেরে যায়, শুরু হয় ক্যাপ্টেন্সির বিষোদগার।
৫. দল হারছে, নির্বাচক এবং কোচদের দোষারোপ। যে কোনো সিরিজে দল ঘোষণার সাথে সাথে সেই দলটি কতটা অবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে, সে তো বলবেনই, এর চাইতেও অরুচিকর হলো কোচ এবং নির্বাচকদের বেতন নিয়ে খোটা দেয়া। এর চাইতে কুৎসিত কাজ হওয়া সম্ভব? নোমান মোহাম্মদের অতি সাম্প্রতিক এক কনটেন্টের বিষয়বস্তু ৮ লাখ টাকার কোচ সালাহউদ্দিনকে রেখেও ৫ রানে ৭ উইকেট! সালাহউদ্দিনের বেতন যদি ২ লাখ বা ৮০ হাজার হত, তখন কি ৫ রানে ৭ উইকেট পড়লে জাস্টিফাইড হত? সে যদি ১ মিলিয়ন ভিউ কামাতে পারে সেখান থেকে ১২-১৩ ডলার আসবে হয়তবা। তার ইতরামিপূর্ণ কনটেন্টের জন্য কি বলব ১২ ডলারের নোমান?
খেয়াল করে দেখুন, আমাদের ক্রিকেট গসিপ ওরফে ক্রিকেট কনটেন্ট শেষ পর্যন্ত ‘ক্রাইম পেট্রোল’ এপিসোডের চাইতে ভিন্ন কিছু হতে পারে না।
প্রথমত তাদের মেধার ঘাটতি। ক্রিকেটের ডাইভারসিফাইড স্ট্যাট, এবং ডিটেইল ফুটেজের বহু পেইড সাইট আছে। সেগুলো প্রথমত কিনতে হয়, ২য়ত সেগুলো বুঝতে উচ্চ ম্যাথমেটিকাল জ্ঞান থাকতে হয়৷ ব্যাটিং-বোলিংয়ের টেকনিকাল আসপেক্ট বুঝতে বায়োমেকানিক্স সম্বন্ধে আইডিয়া থাকতে হয়। এজন্য স্টাডির বিকল্প নেই। আমাদের ক্রিকেট পাপারাজ্জিদের সে যোগ্যতা আছে? এরা প্রত্যেকেই আর্টস ফ্যাকাল্টিতে পড়েছে নিশ্চিত, ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে পড়বে, সেই ডেডিকেশন থাকলে তো!
দ্বিতীয়ত অর্থ লোভ। রিয়াসাত আজিমের চ্যানেল্ কয়টা স্পন্সরের বিজ্ঞাপন? রিয়াসাতের ১০ মিলিয়ন ভিউয়ের কয়টা কনটেন্ট আছে, বা নোমান মোহাম্মদের! অথচ রিয়াসাত শ্রীলংকায় গিয়ে কনটেন্ট বানাচ্ছে।
আমাদের মানিকগঞ্জে এক সাংবাদিক ছিলেন। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে নিয়ে রিপোর্ট লিখতেন, পত্রিকায় পাঠানোর পূর্বে সংশ্লিষ্ট অফিসে বা ব্যক্তিকে পাঠাতেন, এরপর নেগোশিয়েশন হত। বনিবনা না হলে সেই রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশ করে দিত।
বিসিবি নিজেই ক্রাইমের রেড জোন। কত রকম দুর্নীতি প্রতিনিয়ত হয় বলাই বাহুল্য। যেহেতু কর্তাব্যক্তিদের নৈতিকতা দুর্বল, সুযোগ বুঝে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কেউ কেউ যদি মানিকগঞ্জের সেই সাংবাদিক হয়ে উঠে, একটুও অবাক হব না!
সৈয়দ সামি এই গড্ডালিকার পুরোপুরি বাইরে থাকা মানুষ। তার চ্যানেলে যত ভিডিও প্রায় সবই পিওরলি ক্রিকেটিয়। সেখানে কোনো পাপারাজ্জিগিরি নেই।
কয়েকটা উদাহরণ দিই
– বাংলাদেশ শ্রীলংকার বিপক্ষে ৫ রানে ৭ উইকেট হারালো মূলত হাসারাঙ্গার কারণে। সে একটা কনটেন্ট বানিয়েছে বাংলাদেশ কেন লেগস্পিন খেলতে পারে না। সে ডেটা দিয়ে দেখিয়েছে বর্তমানে সাদা বলের ক্রিকেটে যারা ডমিনেট করে সবাই রিস্ট স্পিনার, অফস্পিনারদের ইনফ্লুয়েন্স অতি নগণ্য। বাংলাদেশের লিডিং স্পিনাররা সবসময়ই অফস্পিনিং অপশন। এই এক কনটেন্টই কিন্তু বলে দেয় কেন মিরাজ গত ২৬ ওয়ানডেতে উইকেট পেয়েছে মাত্র ১৩টি!
– যখন যে প্লেয়ার দলের বাইরে থাকে ক্রিকেট পাপারাজ্জিরা তাদেরই বানিয়ে দেয় সেরা খেলোয়াড়। সামির আর্গুমেন্ট যারা দলে আছে তারাও ভালো প্লেয়ার বলেই সুযোগ পেয়েছিল, তাদের স্কিল কেন বাড়ে না প্রশ্ন হওয়া উচিত সেটা। এরপরে সে কোচিং পিরামিড মডেল প্রস্তাব করেছে, যে মডেল অনুসরণ করে ভারত তাদের পাইপলাইন রেডি করে।
– টেস্টে আমাদের ওপেনাররা প্রচুর বল খেলে কিন্তু রান তুলতে পারে না কিছুই, আচমকা আউট হয়ে যায়। এতে দল সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ডেটা ড্রিভেন এনালিসিস দিয়ে বুঝিয়েছে কেন আমাদের টপ অর্ডারে তানজিদ তামিমের মতো এটাকিং অপশন দরকার। আবার আমাদের ওয়ানডে বা টি২০ সেট আপ এ ৬-৭ এ কেন বোলিং জানা ব্যাটসম্যান থাকা প্রয়োজন
সামির এসব ভিডিওতে কিন্তু একাধিক স্পন্সরের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। অর্থাৎ ভিউয়ের জন্য নর্দমায় নামতে হয় না, শিক্ষিত দর্শকরা তার কদর ঠিকই বুঝতে পারে।
সামির সব টেকনিকাল বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সে ভীষণ ব্যাড লিসেনার, অতি মাত্রায় সেল্ফ ব্র্যাগিং করে— এসব মানবীয় সীমাবদ্ধতা মেনেও ক্রিকেটের প্রতি তার প্রচন্ড প্যাশন অনুভব করা যায়। সে যা যা করে সেখানে ক্রিকেট বহির্ভূত প্রায় কিছুই নেই।
তো এমন একজন ব্যক্তিকে যখন বোর্ডে যুক্ত করা হলো, পাপারাজ্জিদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেল। বাংলায় এক প্রবাদ আছে- নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ৷ ইসাম গংদের স্ট্যাটাসগুলো সে ইঙ্গিত দেয়।
সামি নিশ্চিতভাবেই পাপারাজ্জিদের চাইতে বেশি ক্রিকেট কনজিউম করে। জস বাটলারের এক ইন্টারভিউতে পড়েছিলাম সে টি২০ তে ইমপ্রুভ করতে বেইজ বল প্লেয়ারের সাথে সেশন করেছে। ২ দিন আগে জাগো নিউজে পড়লাম পাওয়ার হিটিংয়ে ইমপ্রুভ করতে বিসিবি গলফার সিদ্দিকুরের সাথে সেশন আয়োজন করতে চাইছে। সে রিপোর্টেই দেখলাম আইডিয়াটা সামির!
সামিকে সভাপতির উপদেষ্টা ধরনের শৌখিন পদে যুক্ত না করে একটাই এসাইনমেন্ট রাখা উচিত ছিল- ‘পাইপলাইন তৈরি’৷
পাপারাজ্জি রিয়াসাত-নোমানেরা এই যে সোহান-বিজয়দের মাথায় তুলে, পরক্ষণেই ভিউয়ের লোভে আছাড় মারে, যদি ১৫ জন কোয়ালিটি ক্রিকেটার পাইপলাইনে থাকত যারা দলে আসার জোরালো দাবিদার, জাতীয় দলে থাকা প্লেয়াররা পজিশন ধরে রাখতে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করত। এখন কিছুই করতে হয় না। বাদ পড়ে, অন্যদের ব্যর্থতায় আবার ফিরে আসে৷ লিটন দাস ওয়ানডে দলে কেন, ৮ ইনিংসে ৪টা ডাক, তাকে বাদ দাও। তাওহিদের কোনোপ্রকার ডিফেন্স নাই, তাকেও বাদ দাও। গ্যারান্টি সহকারে বলতে পারি মাত্র ৩টা সিরিজ পরে দুজনই ফিরে আসবে, কারণ তাদের জায়গায় যারা সুযোগ পাবে তাদের দেখলে মনে হবে টেপটেনিস প্লেয়ার। এই হলো আমাদের পাইপলাইন!
কিন্তু সামিকে সে সুযোগ দেয়া হবে না। কয়েকটা পারসপেক্টিভ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়
প্রথমত অশিক্ষিত এবং আনস্কিল্ড কোচদের অহমে আঘাত। সালাহউদ্দিনকে প্রথম দিন থেকেই বাগাড়ম্বর সর্বস্ব কোচ বলি, এবং জাতীয় দলে তার নিয়োগের বিরোধীতা করেছি। আধুনিক ক্রিকেটের সম্বন্ধে তার কতটুকু জানাশোনা আছে সে ব্যাপারে আমি সংশয়ী৷ এর চাইতেও গুরুতর সমস্যা সে লো প্রোফাইল প্লেয়ারদের প্রমোট করে। ২০২০ এ বিসিবির অর্থায়নে একটা টি২০ হয়েছিল। সালাহউদ্দিন পায় চট্টগ্রাম দলের দায়িত্ব। লিটন,,সৌম্য, মোসাদ্দেকের মতো প্লেয়ার থাকা সত্ত্বেও দলের ক্যাপ্টেন করা হয় মিঠুনকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স বিপিএল এ সবসময় তারকাঠাসা দল বানায়। সে দলের অধিনায়ক ইমরুল! লো প্রোফাইল প্লেয়ার পছন্দ করা কোচরা সবসময়ই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে থাকে। অনুমান করি ফিল সিমন্স একটি প্রক্সি ক্যারেক্টার, বাংলাদেশ দলের প্রকৃত কোচ আসলে সালাহউদ্দিন। এমন ডাকসাঁইটে কোচের যদি এমন তলাবিহীন বাস্কেট দশা হয়,মিজানুর রহমান বাবুল-সোহেল আহমেদ সহ অন্যদের কোয়ালিটি বলাই বাহুল্য। সামির বয়স ৩২-৩৩ বড়জোর, তার খেলার দৌড় ফার্স্ট ডিভিশন পর্যন্ত– তার পরামর্শ কেন মানবে জাতীয় দলের মহারথীদের সাথে কাজ করা কথিত কোচরা?
দ্বিতীয়ত, সংগঠকদের অনাস্থা। বাংলাদেশে যারা বড় সংগঠক হিসেবে স্বীকৃত তাদের একটা কমন টেম্পলেট থাকে
– পেছনে বিএনপি বা আওয়ামিলীগের সীলমোহর
– নামে বা বেনামে বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অথবা শিল্পপতি
– এক বা একাধিক সংঘের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদার
– বয়স ন্যুনতম ৪০
ব্ল্যাক মার্কেট ইকোনমি বিষয়ে স্টাডি করলে জানবেন স্পোর্টস আর ফিল্মে ইনভলভমেন্টের অন্যতম ইন্টারেস্ট হলো ব্ল্যাক মানি হোয়াইটকরণ। এসব সংগঠকের পাইপলাইন টাইনে কিছু যায় আসে না। তাদের দরকার ক্ষমতা, এক্সপোজার, এটেনশন এবং কমিশন। সামি তাদের জন্য থ্রেট নয়, অপরচুনিটিও নয়, নোবডি৷ কিন্তু এসব কথিত সংগঠকের কতিপয় শেফার্ড থাকে, যাদের তারা প্রতিপালন করে। সেই শেফার্ডদের অনেকেই হয়তবা সামিকে অপছন্দ করে।
তৃতীয়ত কথিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের আপত্তি। কিছুদিন আগে মোহামেডানের ম্যাচ চলাকালে তাওহিদ হৃদয়ের সাথে আইসিসির এলিট প্যানেল আম্পায়ার সৈকতের কথা কাটাকাটি হয়। ম্যাচ শেষে হৃদয় প্রেসে বলে উনি আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হলে আমরাও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। দুই-একজন বাদে অধিকাংশ ক্রিকেটারের মেন্টালিটিই এমন। সামি যখন ভিডিও তে ডেটা দিয়ে দেখায় হৃদয় এবং জাকেরের লেগ সাইডের বাইরে কোনো স্কোরিং শটই নেই, কিংবা লিটনের ট্রিগার মুভমেন্ট ঠিক নাই, বা শান্তর ব্যালেন্সেই সমস্যা, তাদের ইগো আহত হয়। প্রশ্ন করে বসতেই পারে আপনি কোন লেভেল পর্যন্ত খেলেছেন! অথচ প্রশ্ন হওয়া উচিত আপনি কোন লেভেল পর্যন্ত কোচিং করেছেন বা কী কী শিখেছেন! সে কি নিজস্ব কোনো থিওরি দিচ্ছে, সবকিছু তো এনালিটিক্স থেকে নেয়া।
কিন্তু এসব কারণ প্রকাশ্যে বলাও সম্ভব নয়। তাই নিরাপদ অপশন হিংসা। যেজন্য মার্কেটে আনা হয়েছে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’!
নান্নু, সুমন, রকিবুল হাসান বিসবির বেতনভুক্ত কর্মচারী। অথচ টিভি টকশোতে গিয়ে তারা দল নির্বাচনের সমালোচনা করছেন, স্পেসিফিক প্লেয়ারের সমালোচনা করছেন। পাইলট বা জাভেদ ওমর বিসিবি থেকে বেতন পায় না, তারা সমালোচনা করতেই পারে। কিন্তু নান্নু বা হাবিবুল কেন?
সামি কনটেন্ট আপলোড করলে সেটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট!
আমি সৈয়দ সামিকে মহা ক্যালিবার সম্পন্ন বলছি না। তবে আদ্যোপান্ত অপগণ্ডতে ভরা ক্রিকেট ইকোসিস্টেমে সে ই একমাত্র মানুষ যে ক্রিকেটটাকে সাইন্টিফিকালি বুঝবার চেষ্টা করে, গসিপ নয় ক্রিকেটিয় গ্রাউন্ড থেকেই ফ্যাক্ট বিশ্লেষণ করে। জেরাড কিম্বার হওয়ার ক্যালিবার তার নেই ইন্টেলেকচুয়াল হাইট খানিকটা কম হওয়া এবং ইমপালসিভ নেচারের কারণে। তবে বাংলাদেশে যদি কেউ কোয়ালিটি ক্রিকেট কনটেন্ট প্রোডিউস করতে পারে সেটাও একমাত্র সে ই। ইউটিউবেই একটা ভিডিও পেলাম মাত্র ২৮ বয়সে স্ট্রোক করে সে দেড় মাস আইসিইউতে ছিল, লাইফ সাপোর্টেও পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে ফাইটব্যাক করে পুনরায় দিনভর রোদে পড়ে মাঠে থাকাটা প্রমাণ করে ক্রিকেট তার অন্তরের কতটা!
