ক্রিকেট লাভারদের একটা কথা খুব সোজাসুজি বলে দিই, শুনতে খারাপ, তবু বলতে হচ্ছে, কারণ দালালতন্ত্রের দৌরাত্মে নতুন সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

কথাটা হলো- ‘আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হেড কোচ হিসেবে মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল এবং মোহাম্মদ আশরাফুল এর মধ্যে কোনো একজনকে যাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে লক্ষ্যে বিসিবি যেন তাদের গড়ে তুলে’। তারা প্লেয়ার হিসেবে টপ ক্লাস, মডার্ন ক্রিকেটের সাথে কানেক্টেড এবং জাতীয় দলে অধিনায়কত্ব করেছে। তাদের প্রোফাইল খুবই সমৃদ্ধ৷ কোচিং জ্ঞান কম, ওটা আয়ত্ত করতে ২ বছর মোর দ্যান এনাফ সময়।

আমাদের প্লেয়ারদের সাথে কোচদের বন্ডিং তৈরিতে মূল প্রতিবন্ধকতা ভাষা। নিজ ভাষার একজন হেড কোচ পেলে ক্রিকেটাররা উপকৃত হবে।

ভারতের মতো দল ২০১১ বিশ্বকাপেও খেলেছে সাউথ আফ্রিকান কোচের অধীনে। এরপরে তারা কোচ নিয়োগ করে রবি শাস্ত্রীকে, যিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অনিল কুম্বলে, যিনি টেস্টে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেয়া মাত্র ২য় ক্রিকেটার। রাহুল দ্রাবিড়,যিনি নিজেই একটা ইনস্টিটিউট। সর্বশেষ কোচ গৌতম গম্ভীর, যে ২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপ এবং ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য৷

স্থানীয় কোচের গুরুত্ব ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন, তবে ভারতের দেখাদেখি অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে যদি সালাহউদ্দিন বা সুজনের মতো কাউকে কোচ নিয়োগ দেয়া হয়, পরিণাম হবে ধ্বংসাত্মক। ক্লাস টু এর বাচ্চাকে ক্ষমতা খাটিয়ে এরোনিটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করতে পারেন, তাতে এরোনিটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না, কিন্তু ওই বাচ্চার যে ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা হবে, তাতে ভবিষ্যতে উপযুক্ত ব্যক্তি এরোনিটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার আগেও উপদ্রবের শিকার হতে পারে। ওই রেফারেন্স দিয়ে তাকে উপেক্ষা করা হতে পারে।

২০০০ সালের আগে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছে, নির্মোহভাবে যদি বলি সেই দলের একমাত্র বিশ্বমানের প্লেয়ার মোহাম্মদ রফিক। অন্য সবাই, ইনক্লুডিং বুলবুল-আকরাম-পাইলট-আতহার-নান্নু, বিলো এভারেজ, বাংলাদেশের মানদন্ডে যতই মহীরূহ হোক। ওই সময়ের কোনো প্লেয়ার ওয়াসিম আকরাম বা টেন্ডুলকারের সাথে খেলছে, একেই বিরাট কিছু মনে করত।

তাদের ডেডিকেশনকে ছোট করছি না, নিতান্ত অপ্রতুল ফ্যাসিলিটিসের মধ্যেও তারা ক্রিকেট খেলেছিল বলেই সাকিব-মুশফিক হয়ে হালের লিটন-মিরাজ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। আমি মনে করি জাতীয় দলের হয়ে কেউ ১৫ টার বেশি ম্যাচ খেললে রিটায়ারমেন্টের পরে বিসিবির পক্ষ থেকে তাদের পেনশন দেয়া উচিত, কারণ ক্রিকেট খেলতে গিয়ে জীবনের প্রাইম বয়স তারা বিসর্জন দেয়, খেলা ছাড়লে অনেকেরই আর্থিক অস্বচ্ছলতা দেখা দেয়।

তো রফিককে কি কোচ করা যায়? নাহ৷ কারণ সে উদ্ভট কিসিমের। একবার জিম্বাবুয়ে সফরে প্রয়াত মানজার রানাকে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার টিপস নিতে পাঠিয়েছিল বাঁহাতি রেমন্ড প্রাইসের কাছে। রফিক এতটাই জেলাস হয়ে পড়ে, সুমনকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে এবং মারতে উদ্যত হয়। দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয় সিরিজের মাঝপথে।

মোহাম্মদ রফিক বাতিল। সুতরাং সাবেক যারা আছে তাদের জাতীয় দলের সেট আপ এ আসার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

তবে পুরনো প্লেয়ারদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে অন্যভাবে কাজে লাগানো যায়। যেমন এইচপি টিম, বাংলা টাইগার্স, অনুর্ধ্ব-১৯,১৭ প্রভৃতি বয়সভিত্তিক দলে তারা ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে থাকতে পারেন, একজন অস্ট্রেলিয়ান হেড কোচের তৈরিকৃত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে তারা কাজ করবেন, সেই হেড কোচের কাছে একাউন্টেবল থাকবেন।

এইচপি বা বাংলা টাইগার্সের কোচ হওয়া আর জাতীয় দল— দুয়ের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক! হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ অতি আবেগবশত সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করতে গিয়ে যে বিশাল ক্ষতিটা করেছেন তার মাশুল এখনো গুনতে হচ্ছে। সাইন্স-ইঞ্জিনিয়ারিং-ম্যাথমেটিক্স, এমনকি ইকোনমিক্স এর কোনো ক্রিটিকাল বই বাংলায় লেখা যায় না। ত্রিকোণমিতির Angle of Elevation, Angle of Depression কে বাংলা করা হয়েছে উন্নতি কোণ, অবনতি কোণ! হাহা হা।

ক্রিকেট আমাদের এদিকে একটা মাইগ্রেটেড খেলা। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের আদি পুরুষ। ৩য় প্রাচীন দল সাউথ আফ্রিকা। ইনফ্র্যাস্ট্রাকচার বলতে যা বুঝায় সব আছে। ওদের কোনো তরুণ যদি ফিল করে প্লেয়ার হিসেবে বেশিদূর যেতে পারবে না, কোচিংয়ে ঝুঁকে। যে কারণে লক্ষ্য করলে দেখবেন ক্রিকেটের বিখ্যাত এবং সফল কোচদের অধিকাংশই প্লেয়ার হিসেবে ছিলেন অতি সাধারণ।

ভারতবর্ষে যেহেতু ক্রিকেট মাইগ্রেশনের প্রোডাক্ট, এখানে কেউ কোচ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ক্রিকেটে যুক্ত হয়নি, প্রত্যেকের স্বপ্ন ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়া।।যারা হতে পেরেছে ধরে নিতে হবে খেলাটাকে সে চূড়ান্ত লেভেলের প্যাশন হিসেবে নিয়েছিল। পাকিস্তানেও অনেকদিন ধরে স্থানীয় কোচ কালচার শুরু হয়েছে। একজনও পাবেন না যে জাতীয় দলে খেলেনি, বা প্লেয়ার হিসেবে খুবই লো-প্রোফাইল ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়াতে পাবেন৷

যা বলছিলাম, ২০০০ সালের আগে যারা খেলেছে তারা প্রায় সবাই লো-স্কিল্ড এমেচার ধরনের প্লেয়ার। সেই যুগেও সালাহউদ্দিন জাতীয় দলে ১০টা ম্যাচ খেলতে পারেনি, তার মানে কোন লেভেলের প্লেয়ার ছিল সে!

আমাদের প্রথম গ্লোবাল স্কেল প্লেয়ার আশরাফুল এবং মাশরাফি। কালক্রমে সাকিব, মুশফিক, তামিম, রিয়াদ, মুস্তাফিজ, নাহিদ রানা, লিটন দাস, এবং মিরাজ।

এর বাইরেও আমরা কিছু ভালো মানের প্লেয়ার পেয়েছি, কিন্তু তারা গ্লোবাল স্কেল নয়, বাংলাদেশি গন্ধটা টের পাওয়া যায়। যেমন তাসকিন, ইবাদত, মমিনুল, শাহরিয়ার নাফিস, আব্দুর রাজ্জাক, এনামুল জুনিয়র, আফতাব আহমেদ, তালহা জুবায়ের, অলক কাপালি, রুবেল হোসেন, সৌম্য সরকার, তাইজুল প্রমুখ।

[মাত্র ৪ টেস্ট খেলা নাহিদ রানাকে গ্লোবাল স্কেল বলায় অনেকে আপত্তি তুলতে পারে। ১৫০ গতিতে এবং বিপজ্জনক লেন্থ এ বল তুলে ব্যাটসম্যানকে অস্বস্তিতে ফেলবার মতো পেসার বাংলাদেশে সে ই প্রথম। টেস্টে এরকম একজন বোলার গেম চেঞ্জার হতে পারে যে কোনো মুহূর্তে ]

সুতরাং ভবিষ্যতে এই উল্লিখিত ১২ জনের কেউ যদি কোচিংয়ে আসতে চায় তাদের বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। তার আগ পর্যন্ত মিডিয়া যতই ফাপরবাজি করুক, এদের শক্তভাষায় প্রতিহত করতে হবে।

স্কুলের অনেক শিক্ষক যেমন প্রাইভেট পড়ান, তেমনি প্রাক্তন ক্রিকেটারদের অনেকেই ব্যক্তিগত কোচ হিসেবে চলতে পারে। যেমন সাকিব বা তামিম সালাহউদ্দিনের সাথে কাজ করে, লিটন মন্টু দত্তের সাথে।

জাতীয় দলে হেড কোচের কাজ স্কিল শেখানো নয়, গেম প্ল্যান-স্ট্র্যাটেজি-প্লেয়ার পটেনশিয়ালিটি এনালাইসিস। সেজন্য মডার্ন ক্রিকেটের সাথে সরাসরি এক্সপেরিয়েন্স থাকা আবশ্যক। আমাদের ঘরোয়া লীগের মান নেপাল বা নেদারল্যান্ডের চাইতেও হয়তবা নিম্নমানের। এখানে আবাহনী বা প্রাইম ব্যাংকের কোচ হয়ে সুজন কিংবা সালাহউদ্দিনের পক্ষে একটা টুর্নামেন্ট বা টেস্ট ম্যাচের সিচুয়েশন এনালাইসিস করবার এবিলিটিই তৈরিই হবে না। অস্ট্রেলিয়ান বা ইংলিশ কোচদের এসব সিচুয়েশন মুখস্থ। পক্ষান্তরে তামিম, আশরাফুল বা মুশফিকেরও এগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে।

কিছুদিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম অনলাইনে। টেন্ডুলকারের আয়োজিত কোনো একটা প্রোগ্রামে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট লিজেন্ড আমন্ত্রণ পেয়েছে, বাংলাদেশের কেউ নেই কেন প্রশ্নে বলেছিলেন- বাংলাদেশে তো কোনো লিজেন্ড নেই, সাকিব রিটায়ার করলে আমন্ত্রণ পেত।

গল্পের সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে বাস্তবতা সত্য।।আপনি কপিল দেব-সুনীল গাভাস্কার-ইমরান খান-জাভেদ মিয়াদাদের পাশে সমকালীন রকিবুল হাসান-গাজী আশরাফ লিপুদের বসান; পরের ধাপে আজহার-টেন্ডুলকার-ওয়াসিম-ইনজামামদের পাশে আকরাম-বুলবুল; হাসি আটকে রাখা মুশকিল হবে।
কিন্তু ধোনি-যুবরাজ-আফ্রিদি-সৈয়দ আজমলের পাশে আশরাফুল-মাশরাফিকে বসালে অন্তত হাস্যকর লাগবে না৷ পরের জেনারেশনে সাকিব-মুশফিককে অনায়াসে বসিয়ে দিতে পারবেন, কোনো গোঁজামিল লাগবে না!

সুতরাং সালাহউদ্দিন বা বশিরউদ্দিন নয়, আমরা তামিম-মুশফিকদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অপেক্ষায় থাকি। বর্তমান সেট আপ থেকে কেউ হেড কোচ হয়ে গেলে ব্যাপারটা হবে ফাইভ পাশ ছাত্র মব জাস্টিসের উছিলায় বুয়েট বা ঢাবির ভিসি হয়ে যাওয়ার মতো।
প্রোপাগাণ্ডা স্পেশালিস্ট মিডিয়া রাখালদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।