সাকিব আল হাসানকে ক্রিটিককালীন দুটো প্রশ্নকে ভীষণ ভ্যালিড ধরে এগুতে হবে
১. মুক্তিযুদ্ধের পরে গত ৫৩ বছরে ভীষণ জনপ্রিয়তা পাওয়া বাঙালিদের প্রায় প্রত্যেকেই করুণ পরিণতি কেন বরণ করলো। বাংলাদেশীরা কি জনপ্রিয়তা ডিলিংয়ে প্রস্তুত নয়?
২. সাকিব যখন ১০-১২ বয়সে বিকেএসপিতে ভর্তি হলো মাগুরা থেকে, ২০০৫ এ বাংলাদেশ যেদিন ওয়ানডে ক্রিকেটের অন্যতম আপসেট ঘটিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিল ওয়ানডেতে, ১৭ বয়সী সাকিবের ভাবনার ল্যান্ডস্কেপ কত বড় ছিল? সেই ল্যান্ডস্কেপকে সমকালীন বাংলাদেশী সোশিও কালচারাল-সোশিও পলিটিক্যাল দৃষ্টিকোণে বসালে সাকিব কি দানবের বাইরে অন্য কিছু হতে পারত আদৌ?

প্রথম প্রশ্নটার ভিত্তিতে গত ৫৩ বছরে সারাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ব্যক্তিত্বদের নাম এবং পরবর্তী পরিণতি সাজানো যাক
১. শেখ মুজিব- সেনা বাহিনীর একাংশ কর্তৃক সপরিবারে নিহত
২. জিয়াউর রহমান- সামরিক ক্যু তে নিহত
৩. কাজী সালাউদ্দিন- বাফুফে সভাপতি হিসেবে অপরিমেয় নিন্দিত
৪. রাজ্জাক- নায়ক ইমেজ শেষেও জোর করে মার্কেটে প্রাসঙ্গিক থাকতে চাওয়া
৫. হুমায়ূন আহমেদ- কন্যার বান্ধবীকে বিবাহ করে সামাজিকভাবে নিন্দিত
৬.সালমান শাহ- মাত্র ২৭ এ বিতর্কিত মৃত্যু
৭. মান্না- মাত্র ৪৩ বয়সে হার্ট এটাকে মৃত্যু
৮. শাকিব খান- বহুবিবাহ এবং সন্তান কান্ডে বিতর্কিত, পরবর্তীতে প্রিয়তমা, তুফান প্রভৃতি সিনেমার মাধ্যমে ফাইটব্যাক
৯. জেমস- গত ১৫ বছরে সিগনিফিক্যান্ট গান করছেন না, তবে কনসার্টে এখনো প্রথম চয়েজ। দ্বিতীয় বিয়ে ইস্যুতে জেলে যেতে হয়েছিল তাকেও। কনসার্টে একই প্লে লিস্ট বাজাতে বাজাতে চার্মলেস হয়ে পড়েছেন।
১০. মমতাজ- প্রশ্নবিদ্ধ ইলেকশনের এমপি হয়ে নিন্দিত। নির্বাচনী এলাকায় দুর্নীতির কারণে সমালোচিত, বর্তমানে পলাতক
১১. দেলোয়ার হোসেন সাঈদী- মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতার অভিযোগে কারাদন্ডপ্রাপ্ত এবং সেখানেই মৃত্যু।
১২.জাফর ইকবাল- ফ্যাসিস্ট সরকারের দালালি করে গণবয়কটের শিকার
১৩.আশরাফুল- ম্যাচ ফিক্সিংয়ে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া
১৪. মাশরাফি- জাতীয় দলের অধিনায়ক থাকাকালীন দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে সমালোচিত, বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে মাত্র ১ উইকেট পেয়ে হাসির খোরাকে পরিণত হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়ন পরম্পরায় বাড়িতে হামলা এবং অগ্নি সিংযোগ
১৫. আসিফ আকবর- মাদক মামলায় জেল, এবং গানের কপিরাইট ইস্যুতে সমালোচিত
১৬. সাকিব- বলাই বাহুল্য।
জনপ্রিয়তা উপযোগ নির্ভর মার্কেট ধারণা। মার্কেটের রুচি এবং চাহিদা সময়ের সাথে বদলায়। মার্কেটে আসে নতুন মুখ। শাসনক্ষমতা যেমন হস্তান্তর করতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের পরে, ফেসভ্যালুও হস্তান্তর আবশ্যক। শাসনক্ষমতা কালেক্টিভ, ফেসভ্যালু ইনডিভিজুয়াল— কিন্তু দুয়ের সাবস্ক্রাইবার ম্যাস মার্কেট, যেখানকার রুচি মেয়াদসাপেক্ষ।
প্যাটার্ন এনালাইসিস করলে দেখা যাচ্ছে ১৬জনের তালিকায় মাত্র ১ জন (রাজ্জাক) ফেসভ্যালু হস্তান্তরে সক্ষম হয়েছেন,৩ জন হস্তান্তরের রিয়েলিটি মানছেন না (জেমস, শাকিব খান, আসিফ)। অর্থাৎ বাংলাদেশের মার্কেটে জনপ্রিয়তা মানেই মর্মান্তিক পরিণতি অনিবার্য!

কেন এমনটা হয়। আমার অনুমান ছিল প্রাইস সেনসিটিভিটি এক্ষেত্রে গুরুতর নিয়ামক হতে পারে।

চ্যাটজিপিটিতে একটা প্রশ্ন রাখি- ‘জনসংখ্যা ১০ কোটির বেশি, শিক্ষার মান দুর্বল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন ভঙ্গুর, কূপমন্ডুকতায় ভরপুর, আয় বৈষম্য অত্যধিক, জনসংখ্যার ঘনত্ব– এই শর্তের অধীনে ২০০৫ পূর্ব পৃথিবীতে সবচাইতে প্রাইস সেনসিটিভ মার্কেট কোনগুলো’? উত্তরের প্রথম নামটি বাংলাদেশ৷

পর্যায়ক্রমে ভারত, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়া। রেফারেন্স হিসেবে একটি বইয়ের উল্লেখ পাওয়া গেল- “The Political Economy of Development in Bangladesh” (Stanley Kochanek, 1993)

মার্কেট অতি প্রাইস সেনসিটিভ হলে সেখানে কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট নয়, লক্ষ্য থাকে ‘কোনমতে কাজ চালানো’ এর দিকে। ফলে সেখানে ব্রিলিয়ান্ট মানুষ তৈরি হয় কদাচিৎ, এবং ১০ কোটি থেকে ৫০-৬০ জন যদি হয়ও, সেটা নিছকই স্ট্যাটিসটিকাল ডেটার নিয়মানুসারে, সিস্টেমেটিক কিছু নয়। জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া কিংবা জাপানে ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্ট মানুষ বেশি পাওয়ার মূল কারণ ইকোসিস্টেম।

আর্গুমেন্ট টেস্ট করতে চ্যাটজিপিটিতে একটা প্রশ্ন রাখলাম- ‘বাংলাদেশে বসবাসকারী কয়েকজন ব্যক্তির নাম বলুন যারা নিজ অঙ্গনে অবদানের জন্য বহির্বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত’, মাত্র ৩টি সাজেশন এলো
১. ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস
২.ড. ফিরদৌসি কাদরি: আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পেয়েছেন সংক্রামক রোগ, বিশেষত কলেরা এবং টাইফয়েড প্রতিরোধে গবেষণার জন্য
৩. সাকিব আল হাসান

দুটো শর্তকে ইন্টিগ্রেট করলে জনপ্রিয় এবং গ্লোবালি রিকগনাইজড, শর্তে বাংলাদেশে একমাত্র ব্যক্তি আসলে সাকিব!

ডক্টর ইউনুসের গ্লোবাল রিকগনিশন সাকিবের তুলনায় মিনিমাম ৫০ গুণ, কিন্তু বাংলাদেশে জনপ্রিয়তায় তিনি আবার সাকিবের ৫০ ভাগের ১ ভাগ হবেন অনুমান করি। ফিরদৌসি কাদরির নাম আজই প্রথম শুনলাম, ফলে জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গটা অবান্তর।

এরকম প্রাইস সেনসিটিভ মার্কেটে ক্রিকেটের মতো একটা টাইম কনজিউমিং কমোডিটি, যেখানে আমাদের একমাত্র এচিভমেন্ট টেস্ট প্লেয়িং নেশন হওয়া, এবং দল হিসেবে মেজর ট্রফি জেতার সম্ভাব্য দাবিদার প্রশ্নে যাদের কেউ কখনো ৫ নম্বরেও রাখে না (১০ দলের মধ্যে), সেখান থেকে সাকিবের এত বড় ফিগার হওয়াটা বিস্ময়কর নয়, মিরাকল!

আমাদের সবচাইতে গ্লোবালি রিকগনাইজড ফিগার ডক্টর ইউনুস গত ১৬ বছরে নানামুখী দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত, কয়েকটায় সাজাও পেয়েছিলেন। সবচাইতে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের পরিণতি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। দুটোর সংমিশ্রণ ঘটা একমাত্র বাংলাদেশী যদি কেউ হয়, তার পরিণতি কেমন হতে পারে— হিস্টরিকাল ডেটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে!

২০২২ বিশ্বকাপের অব্যবহিত পূর্বে ভার্সিটি সিনিয়র সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে আলাপে সাকিব প্রসঙ্গে বলছিলাম- ‘ভাই সাকিবের এত ঘন ঘন দুবাই ভ্রমণ নিয়ে আমার একটা আশংকা তৈরি হচ্ছে। ইনট্যুশন বলছে সে ফেসভ্যালু ভাড়া দিচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, সেই ফেসকে শিখণ্ডি বানিয়ে পেছন থেকে তীর মারার বদলে একটা গ্রুপ বোধহয় ক্রাইম করছে। আচমকা সাকিব যদি বড় কোনো বিপদে পড়ে, অবাক হব না। সে গ্যাম্বলার প্রকৃতির মানুষ, তবে লোভবশত গ্যাম্বলিংটা বোধহয় লিমিট ক্রস করে ফেলছে’!

কিন্তু প্রশ্ন হলো বাঙালির জনপ্রিয়তা কেন মাথা থেকে জুতায় গিয়ে শেষ হয়! কেন সময়ের সাথে সাথে মার্কেট থেকে ফেড আউট হওয়ার সিস্টেমেটিক প্রক্রিয়া একজনের বেলাতেও ঘটলো না?
সেটা অন্য এনথ্রোপলজিকাল ইনভেস্টিগেশন, এই লেখায় প্রাসঙ্গিক নয়। ভবিষ্যতের ভাবনায় জমা থাকুক।

২য় প্রশ্নটা ডিল করা যাক।
রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, কালচারাল বৈচিত্র্য, শিক্ষা— এই শর্তের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ জেলা কোনগুলো? চ্যাটজিপিটি ২০টা জেলার নাম বললো- ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুরা, যশোর, খুলনা, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, মাদারিপুর এবং গোপালগঞ্জ!

একই প্যারামিটারগুলো বহাল রেখে মাগুরা জেলার অবদান ১-১০ স্কেলে কত, চ্যাটজিপিটির মূল্যায়নে তা ৩-৪!
উত্তরটা দেখবার পরে ২০টা জেলায় পুনরায় নজর দিলাম: যশোর-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর-খুলনা, একই বেল্টে অবস্থিত। মাগুরা সেই বেল্টে থেকেও কন্ট্রিবিউশন স্কেল যদি মাত্র ৩-৪ হয়, এবং আমরা ফিরে যাই ৮০ বা ৯০ দশকে, সাকিবের মাইন্ডসেট বুঝবার ক্ষেত্রে নিয়ামক হতে পারে৷ মাগুরা এমন এক জেলা যেখানে নির্বাচনী আসন মাত্র দুটো!

সাকিবের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাশোনা নেই। কয়েকটা ইন্টারভিউতে পড়েছিলাম তার বাবা চাকরি করতেন, ফুটবল খেলার ঝোঁক ছিল৷ মা হোমমেকার। এই ডেটাকে যদি রেফারেন্স ধরি, ৯০ দশকের মাগুরাতে ১৯টা উচ্চবিত্ত কিংবা পুরনো বনেদি কিংবা বিদ্যোৎসাহী পরিবারের নাম বললে সেখানে সাকিবদের নাম আসার চান্স দেখি না৷ একদম টিপিকাল মধ্যবিত্ত।

৯০ দশকের মফস্বলীয় ক্রিকেট কালচারের গল্প বলা যেতে পারে।

আমার বেড়ে উঠা মানিকগঞ্জে।
মানিকগঞ্জও মাগুরার মতোই অগুরুত্বপূর্ণ জেলা, তবে ঢাকার প্রতিবেশি হওয়ায় মাগুরার তুলনায় কিছুটা অগ্রসর হয়তবা। সাকিব সম্ভবত আমার ২-১ বছরের জুনিয়র। তাই আমরা একই টাইমফ্রেমেই বাংলাদেশকে দেখেছি।
আমাদের বয়েসী কিশোররা সে যুগে স্কুল ফাঁকি দিয়ে কিংবা বিকালে প্রচুর পরিমাণে ক্রিকেট খেলত। টেপ টেনিস ক্রিকেটের জোয়ার তৈরি হয়েছিল। এক পাড়া অন্য পাড়ার সাথে মেডেল,কাপ অথবা ২ লিটার কোক বাজিতে ম্যাচ রাখতো। যারা ভালো প্লেয়ার হিসেবে নাম করত তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় হায়ারে খেলতে যেত।
এলাকায় একজন ক্রিকেট কোচ থাকতেন, তিনি বিকালে কিশোরদের ক্রিকেট কোচিং করাতেন, এবং কারা মোটামুটি ভালো প্লেয়ার খোঁজ রাখতেন।
মানিকগঞ্জে তেমন কোচ সাঈদ খান মজলিস। দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে প্র্যাকটিস করাতেন। মানিকগঞ্জের যারা নামী ক্রিকেটার- দুর্জয়, মোর্শেদুল সুমন, মাসুদ, বাশার, সোহাগ, খোকন, শান্তনু– প্রত্যেকের ক্রিকেট কোচ তিনি। আমাদের বয়েসি প্রিন্স, জামিল, নাদিফ চৌধুরি(জাতীয় দলে চান্স পেয়েছিল), হুমায়ূন কবির শাহীন (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের এসিসট্যান্ট কোচ) তাদেরও কোচ তিনি। আমরা তখন গঙ্গাধরপট্টি এলাকায় থাকি। আম্মু আইনজীবী। একদিন চেম্বার থেকে ফিরে বললেন- রাস্তায় একজনের সাথে কথা হলো, ছেলেদের ক্রিকেট শেখায়, টেনিস বলে তোমার ব্যাটিং দেখে পছন্দ করেছে, আমাকে বললো ছেলেকে খেলোয়াড বানানোর আগ্রহ আছে কিনা’
আমরা যখন টেপ টেনিসে খেলতাম, খান মজলিসকে দেখেছি ছেলেদের নেট প্র্যাক্টিস করাতে, আমাদের এমেচার খেলা লক্ষ্য করেছেন জেনে অবাক হয়েছিলাম। এক বিকেলে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র আল আমিনের মাধ্যমে সরাসরি আমাকেই ডাকলেন। শুনেছিলেন আমি জেলা স্কুলের ক্লাস টপারদের একজন। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি। বললেন- সাঈদ আনোয়ার, অনিল কুম্বলে, শ্রীনাথ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জানো? ইমরান খান অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করেছে। পড়াশোনা ঠিক রেখেও খেলোয়াড় হওয়া যায়। তাকে বলেছিলাম- ‘ক্রিকেট খেলি মনের আনন্দে, আমার জীবনের লক্ষ্য লেখক হওয়া’! তিনি হতাশ ভঙ্গিতে বলেন- ‘তাইলে আর কী বলবো, আচ্ছা যাও’!

ওই বয়সে আমার মতো অভিজ্ঞতা হয়নি, টুকটাক ক্রিকেট খেলা এমন কিশোর বিরলপ্রায়। সাকিবও লাখো কিশোরের একজন, আমাদের সাথে তার পার্থক্য সে লোকাল কোচের কথায় কনভিন্সড হয়েছিল।

কিন্তু কতটুকু ছিল তার ল্যান্ডস্কেপ!

তার ডিফেন্স দেখে কোনো কোচের পছন্দ হওয়ার তো কথা নয়।

কৌতূহলটা ছিল। নাজমুল আবেদিন ফাহিমের সঙ্গে গত ৮ বছর ধরে ঘনিষ্ঠতা। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সাকিব বিকেএসপির ট্রায়ালে টিকেছিল কীভাবে, বাংলাদেশী কোচদের থট প্রসেস তো খুবই গড়পড়তা।

৫ বছর সেমি-প্রফেশনাল ক্রিকেট টিম চালিয়েছি, ঢাকার প্রায় সব একাডেমি এবং দেশের ১৮ জেলায় ট্যুর করেছি টিম নিয়ে, ফলে শতাধিক স্থানীয় কোচকে দেখবার সুযোগ হয়েছিল।

ফাহিম স্যারের মন্তব্যটা দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ- ‘সবার হাতের লেখা কি এক হয়? তাহলে ডিফেন্স একইরকম কেন হবে! সাকিবের টেকনিক আনকনভেনশনাল, কিন্তু সেই টেকনিকে সে তো রান করছিল। আমি এজ লেভেলে একটা ম্যাচও মনে করতে পারি না যেখানে সে পারফর্ম করেনি৷ ব্যাটিং-বোলিং কোনোটাতেই হয়নি, দেখবে ফিল্ডিংয়ে রান আউট করে দিয়েছে। অর্থাৎ শত চেষ্টা করেও মাঠে তার প্রেজেন্স উপেক্ষা করা যায়নি, একদম আর্লি দিনগুলো থেকেই’!

ফাহিম স্যার আরেকটা দারুণ মন্তব্য করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম সাকিবের সাথে অন্য প্লেয়ারদের পার্থক্য কিসে।
‘আমাদের অধিকাংশ প্লেয়ারই পরনির্ভর। কোচ, বড় ভাই, বন্ধু নানাজনের বুদ্ধিতে চলে। তুমি দেখবে আমাদের লীগগুলোতে কোচেরা বাউন্ডারি লাইন থেকে ফিল্ডিং সাজিয়ে দেয়, ব্যাটসম্যানকে ইনস্ট্রাকশন দেয়। সাকিব যদি মনে করে তুমি তার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট, মনোযোগ দিয়ে কথা শুনবে, কিন্তু পছন্দ না হলে মানবে না, সে যে ই হোক। একাদশে জায়গা নিয়ে যদি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ থাকতো, সে প্লেয়ার হিসেবে আরো অনেক দূরে যেত’।

২০০৫ এর প্রেক্ষাপটে যদি সাকিবকে চিন্তা করি- ব্যাটিং-বোলিংয়ে কন্ট্রিবিউট করতে জানা একজন প্লেয়ার, লাইক টু লাইক রিপ্লেসমেন্ট ছিল তার ব্যাচেরই সোহরাওয়ার্দি শুভ! যখন দলে ঢুকলো রফিক আর রাজ্জাক মূল স্পিনার। ব্যাটিংয়ে শাহরিয়ার নাফিস, আশরাফুল, আফতাব, হাবিবুল। প্রথম ২ বছরে সাকিবের পারফরম্যান্স মডারেট। তাহলে ২০০৫ এ যখন সে আর সোহরাওয়ার্দি শুভ আড্ডা দিত, দুজনের দৃষ্টির পরিসর আসলে কতটুকু ছিল, কিংবা যদি ভাবনাকে ফাইনান্সিয়াল ফিগারে কনভার্ট করি, কতটুকু হতে পারে? আইসিএল এবং আইপিএল শুরু হবে আরো ৩-৪ বছর পরে।

আমার অনুমান সাকিব যদি শুভকে বলতো- ‘দোস্ত আমি বাংলাদেশ দলে ৮-১০ বছর খেলতে চাই, ১০-১৫ কোটি কামামু’, ২০০৫ এর বাস্তবতায় শুভ তাকে অলীক কল্পনা বলে শুধু উড়িয়েই দিত না, যদি সে দুষ্ট প্রকৃতির হত বন্ধুদের সামনে সাকিবের ক্রেজিনেস নিয়ে রসিকতার উদাহরণ হত- ‘এই হালায় ক্রিকেট খেইলা ১৫ কোটি টাকা কামাইতে চায়। হালারে ইংল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা কর’

পরবর্তী ৬ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সাকিবের জীবনে সিগনিফিক্যান্ট কয়েকটা ঘটনা ঘটে
১. সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর শাসনক্ষমতায় থাকে।
২. আইসিএল নামে ভারতে একটি টি২০ লীগ শুরু হয়, বিসিসিআই য়ের অনুমোদন না থাকায় সেটি পরিচিতি পায় বিদ্রোহী লীগ হিসেবে। বাংলাদেশ থেকে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে একটি দল অংশ নেয়৷ জাতীয় দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে, বড়সড় ভ্যাকিউয়াম তৈরি হয়।
৩. আশরাফুল অধিনায়কত্ব হারায়, মাশরাফি অধিনায়কত্বের প্রথম ম্যাচে চলাকালেই ইনজুরিতে পড়ে, মাত্র ২২ এ সাকিব অধিনায়কত্ব শুরু করে।
৪. শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামিলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
৫. বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় ব্যাটিং বা বোলিং র্যাংকিংয়ে শীর্ষ দশেও ঢুকেনি ইতোপূর্বে, সাকিব অলরাউন্ডার হিসেবে ১ নম্বর পজিশনে চলে এলো।
৬. আশরাফুল, মাশরাফি, রাজ্জাক আইপিএল এ দল পেলেও ম্যাচ খেলেছে ২-১টা, সাকিব কলকাতা নাইটরাইডার্সে দল পেল, এবং বেশিরভাগ ম্যাচেই মূল একাদশে সুযোগ পেল।

ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও ইন্টারকানেক্টেড। আওয়ামিলীগ ঐতিহাসিকভাবেই শক্তিশালী কালচারাল ফ্রন্ট টিম মেইনটেইন করে। একটা আন্দোলন বা ঘটনাকে নিয়ে গান-কবিতা-নাটক-সাহিত্য সহ যতভাবে ডকুমেন্টেশন করা যায়, করবার মতো ফোর্স তাদের অগণিত। ক্ষমতার এই দ্বিতীয় অধ্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয় জিপিএ ফাইভ নামের প্রহসনে, বাংলাদেশি সিনেমা বহির্বিশ্বের সাপেক্ষে হাস্যোস্পদ হয়ে উঠলো ইউটিউব বিপ্লবে, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার নামে একটি শ্রেণির উদ্ভব ঘটলো, হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুবরণ করলেন!

অর্থাৎ কালচারাল বন্ধ্যাত্ব সহনীয়তার সীমা পেরিয়ে গেল। এন্টারটেনমেন্ট প্রোডাক্ট বলতে ছিল শুধু ক্রিকেট, যেখানে তরুণদের আগ্রহ ছিল কিছুটা। সেখানকার একটা ছেলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লীগে খ্যাপ খেলে বেড়াচ্ছে, এক্সপোজার পাচ্ছে- এই ছেলেটাকে প্রমোট করা যেতে পারে। অর্থাৎ এন্টারটেইনমেন্ট প্রোডাক্টকে রূপ দেয়া হলো কালচারাল প্রোডাক্টে। কালচারের সাথে কমার্সের ব্লেন্ডিং হলে ব্লকবাস্টার ঘটে যাবে। ক্রিকেটকে দেশপ্রেমের ইনডেক্সে রূপ দেয়ার বহু ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল। এই মার্কেটে সবচাইতে বিক্রিযোগ্য প্রোডাক্টের নাম সাকিব আল হাসান। একটা সিম্বলিক বিজ্ঞাপন নির্মিত হয়েছিল- ‘বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান’
বিক্রিযোগ্য প্রোডাক্ট মার্কেটে নিজেকে মিশনারি মডেলে বিজ্ঞাপিত করলো, তাকে কিনতে টাকার বস্তা নিয়ে লাইন দিচ্ছে প্রায় সকল সেক্টরের বেনিয়া বহর!

এবং আমার ব্যক্তিগত অনুমান বিক্রিযোগ্য প্রোডাক্ট মার্কেটভ্যালু বাড়াতে উইন-উইন মডেলে কোলাবরেট করলো শীর্ষ মিডিয়া প্রথম আলোর সাথে। প্রথম আলো প্রতিনিয়ত তাকে যেভাবে ফিচার করেছে, তাতে লাভবান হয়েছে দুপক্ষই। ফলে সাকিবকে লোভনীয় প্রোডাক্টরূপে উপস্থাপনে প্রথম আলোর এনার্জি এফোর্টের বিশাল অবদান। মাশরাফি এবং তামিমের মতো অতি মিডিওকর প্লেয়ারকে নিয়েই তারা ন্যারেটিভ তৈরি করতে বেগ পায়নি, সেখানে সাকিব তো প্রতি ম্যাচেই প্রাসঙ্গিক থাকা প্লেয়ার, তাকে আসমানে তোলা কঠিন কিছু নয়।

সাকিব নিজে এই কালচারাল এবং কমার্সিয়াল প্রোডাক্ট গেমে কতটুকু ইনভলভ মানসিকভাবে?

এঙ্গেলটা বুঝতে আপনাকে শুনতে হবে মানিকগঞ্জের ঠাকুরকান্দি গ্রামের জলিল মুন্সীর নাতিদের গল্প। জলিল মুন্সি কৃষি কাজ করত, ৪-৫টা ছেলে, তারাও বিয়ে-শাদি করলো। মুন্সীর নাতিরা ঢাকায় এলো কর্মের খোঁজে, এরপর আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেল। তারা গ্রামে যায় মাইক্রোবাসে, যেখানে যে জমি বিক্রি করে কিনে নেয়। গ্রামে এলে অমুক আত্মীয়, তমুক মুরুব্বি, বন্ধু গিয়ে ভিড় জমায়, নানা ব্যবসার লোভ দেখায়। যেহেতু কাঁচা টাকার ঝনঝনানি, নাতিরা ইনভেস্ট করে।

সাকিবের মতো কেউ কি বাংলাদেশে ছিল আগে? নাহ৷ ফলে তার কোনো রেফারেন্স পয়েন্ট নেই, সে নিজেই রেফারেন্স! আমার কাছে তার পরিচয় ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ বিউটিশিয়ান’, যার কাজ বিভিন্ন চেহারার আর বৈশিষ্ট্যের ফেস তৈরি করা এবং উচ্চমূল্য মার্কেটে বিক্রিযোগ্য বানানো। বিক্রির দায়িত্ব পালন করে থার্ড পার্টি। ফেস তৈরির কাঁচামাল অনেকরকম। যেমন বিজ্ঞাপন, সাক্ষাৎকার, কন্ট্রোভার্সি, সংবাদ সম্মেলন, ক্রিকেট প্রভৃতি। ফেস তৈরির কোনো ফরমাল স্কুলিং তার নেই, কিশোর কুমার যেমন গানের তালিম ছাড়াই ২০ বছর হিন্দি ফিল্মের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নেয়া গায়ক ছিলেন সহজাত প্রতিভায়, সাকিবও ফেস ম্যানুফ্যাকচার করে স্বত:স্ফূর্তভাবে, সে বুঝে গেছে বাঙালি জাতি শুধু ফেসের উপরে ‘সাকিব’ ব্র্যান্ডের সিল দেখলেই কিনবে, সৌন্দর্য-কদর্যতা বিবেচ্যই নয়!
এরকম প্রেডিক্টেবল ভোক্তা মার্কেট থাকলে, সেখানে ম্যানিপুলেশন এবং এক্সপ্লোয়টেশন হবেই৷ বছরে ৫ লাখ টাকা ইনকাম না থাকা ব্যক্তি যদি কোনোদিন ৫০ কোটি টাকা পেয়ে যায়, তার মনোবৈকল্য ঘটবেই।
সাকিবকে লীগের দোসর বলায় ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। সাকিব যদি ঘুনাক্ষরেও আঁচ করতে পারত নিকট ভবিষ্যতে বিএনপি, এমনকি জামাত ক্ষমতায় চলে আসবে, সে সেখানেই ভিড়ত। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ তার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবার কারণ নেই। একটা ছোট্ট রেফারেন্স দেয়া যেতে পারে- কানাডা গ্লোবাল টি২০ লীগে ফিল্ডিং করাকালে জনৈক দর্শক প্রশ্ন করছে সাকিব ভাই পদ আছে না গেছে, সে অবলীলায় উত্তর দিচ্ছে- ‘গেছে গা’!
যদি তার ক্যারিয়ারের আরো ৪-৫ বছর বাকি থাকত, সে ফেইক ইনজুরি নিয়ে ৬ মাসের বিরতি নিত, ২-৩টা সিরিজ খেলে এক ফাঁকে বিএনপির সাথে লিয়াজো করে ২ বছর পরে তারেক জিয়ার সাথে গলফ খেলার ছবি তুলতো। ১০-১১ বয়সে যে ছেলে ঘর ছেড়েছে, জীবনের বেশিরভাগ সময় উড়ে বেরিয়েছে এদেশ-সেদেশ, সে একাকী চিন্তা করার সময়টুকু কি পেয়েছে বা চেয়েছে সময়? বন্ডিং, এটাচমেন্ট, অবিডিয়েন্স— কোনোকিছুই তার প্রায়োরিটি নোটবুকে সমাদৃত নয়। তার পজিশনে থাকলে এসব কোয়ালিটি বরং পিছুটান, বা নেগেটিভ ড্রাইভিং ফোর্স!

আপনার ৭ লাখ টাকার মোরালিটি ফ্রেম সাকিবের এই ক্যারেক্টারকে অপছন্দ করবার ৯৭টি যৌক্তিক কারণ রয়েছে, তবে যেহেতু আমি লেখক, মানুষের ক্যারেক্টারের লেয়ার এবং ডাইভার্সিটিতে কৌতূহল বোধ করি, তাই কেবলমাত্র পছন্দ আর অপছন্দ দিয়ে মানুষকে বুঝতে চাওয়া বোরিং লাগে। it’s you চিতল*দা people who made him monster, now pay for it!

সাকিবের ব্যাপারে সবচাইতে সুন্দর মন্তব্য করেছিলেন দেবব্রত মুখার্জি, ২০২১ এ মোহাম্মদপুরে চা খেতে খেতে- ‘আমার কি মনে হয় দাদা, সাকিব বাংলাদেশের সবচাইতে misinterpreted ক্রিকেটার। আমরা বলি সাকিব অহংকারী, কথা বলে না। কিন্তু আমাদের মধ্যে কয়জন সাংবাদিক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে সাকিবকে ওই লেভেলের মিনিংফুল প্রশ্ন করতে পেরেছে? ইন্টেলেকচুয়াল হাইটে ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে গেলে আলাপ চালানোটা কঠিন। শুভ্র দা এর সঙ্গে তো সে প্রচুর কথা বলে, নিজ থেকেও যোগাযোগ করে। ফাহিম ভাইয়ের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখেন, কোন লেভেলের আলাপ করে। আমার ধারণা সাকিব আপনার সঙ্গও পছন্দ করবে খুব। কিন্তু আমরা অন্য সাংবাদিকরা তো নিজেদের আপগ্রেড করি না। তার চাইতে সাকিব টাকার লোভী, অহংকারী- এরকম একটা নিউজ করে দিলে অল্প এফোর্টে বেশি আউটপুট পাওয়া যায়’!

২০০৫ থেকে ২০১১ মাত্র ৬ বছর, অথচ সাকিবকে কেন্দ্র করে টাইম ট্রাভেল করলে মনে হয় ৬০০ বছর পাড়ি দেয়া হলো!

আমি ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ বিউটিশিয়ান’ সাকিব আল হাসানকে অনেক হাইরেট করি, মার্কেটটা গারবেজ না হলে হয়তবা ফেস তৈরির যথাযথ তালিম নিত! নিল না, তাতেও তার ব্রান্ডকে আমি এনডোর্স করি! আপনি একজন ক্রিকেটারকে ভেবে কয়েক হাজার শব্দের আর্টিকেল লিখলেন, অথচ একটিও ক্রিকেটিয় শব্দ নেই, এটাই ক্যারেক্টারের ম্যাগনিফিসেন্স। সাকিব হওয়া যায় না, সাকিবরা সাকিব হয়েই জন্ম নেয়৷

অঞ্জন দত্তের ‘জোয়ান অব আর্ক’ গানের একটা অংশ প্রাসঙ্গিক লাগছে-

আমি তোমার জন্য রেখে গেলাম নর্থদামের বেল
বাদল সরকারের মিছিল
রেখে গেলাম আমার একটা পুরনো ভিনাইল
তুমিও বলতে পারো ‘লেট ইট বি’
থাকবে তোমার জন্য অন্তহীন ইঁদুর দৌড়
মধ্য মেধার বিভ্রান্তির জীবন।
তাই তোমার জন্য রেখে গেলাম জন অফ আর্ক
আমি তোমার জন্য রেখে গেলাম জন।