মাসের নামে ট্যাগ যুক্ত হলো কীভাবে, এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে নিজেদের বাকপটুতা আর ভোলাভালা আবেগের দায় দেখে ভ্রুকুঞ্চিত করে ফেলি। ভাষার মাস, সংগ্রামের মাস, শোকের মাস, বিজয়ের মাস, নববর্ষের মাস, চেতনার মাস- প্রভৃতি ট্যাগ আর ট্যাগ।

২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, সুতরাং পুরো ফেব্রুয়ারিই হয়ে গেছে ভাষার মাস। কমিউনিকেশন যত টুল আছে, ভাষা বোধহয় তার মধ্যে ফান্ডামেন্টাল পর্যায়ের। ভাষার প্রতি গভীর আবেগ কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক, এটা সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবু মাসকে আবেগের সাথে মিলিয়ে ফেলা, এই প্রবণতাকে আরোপিত লাগে। দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি এলে সবাই বাংলা ভাষা নিয়ে কড়াকড়ি আরম্ভ করে; চেয়ারকে কেদারা, সিস্টেমকে ব্যবস্থা লিখতে থাকে, সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার চেয়ে বিশাল ভারাক্রান্ত লেখালিখি করে, এবং সেসময় টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল, ইংলিশ মুভি চলাকে স্খলন বা পাপ হিসেবে গণ্য করে।
আরেকটা প্রবণতা দেখা যায়, ভুল বানান বা ভুল বাক্য নিয়ে ট্রলিং করা। যেমন, আজ প্রথম আলোর রসালোতে দেখলাম ‘ভাষা বাড়া দেয়া হবে’- এরকম একটা ট্রলিং।

ভাষা নিয়ে আমার এক ধরনের ফ্যাসিনেশন আছে। যেমন আমি ইচ্ছাকৃত বাংলিশ হাইব্রিড করে লিখতে পছন্দ করি, আমার প্রায় প্রত্যেক লেখাতেই প্রচুর ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করি, অন্য ভাষা ভালো জানলে সেগুলোও করতাম। এক্ষেত্রে আমি বরারব কনফিডেন্সহীনতা শব্দটার উদাহরণ দিই (অথচ শব্দটা হওয়া উচিত ছিলো আত্মবিশ্বাসহীনতা)। ভাষার সংমিশ্রণ, পরিবর্তন এগুলো খুবই স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, মানুষের মুখে মুখেই এর রূপ বদলে যায়। কিন্তু জ্ঞানীগুণী মানুষদের বড় অংশটাই কেন যেন ভাষার এই প্রবহতাকে মেনে নিতে পারেন না, তারা একে বলে বিচ্যুতি বা বিকৃতি হিসেবে। এই আপাত বিকৃতিকেই আমি বলি ‘ইনোভেশন’। ১৮ শতকে যে বাংলায় কাব্যচর্চা হতো, ১৯ শতকের বাংলা বাক্য সেখান থেকে অনেকখানি সরে এসেছে, এই বাস্তবতা পণ্ডিতরাও উপলব্ধি করেন, কিন্তু কোনো এক্সপেরিমেন্ট বা মিক্সার চেষ্টা করলে সেটাকে অবক্ষয় আখ্যা দিয়ে বিশাল অভিসন্দর্ভ লিখে ফেলেন। এই এলিট মনোভঙ্গি আদতে নতুন কিছু চেষ্টা করার ক্ষেত্রে বাধা। আমাদের এই লোকালয়ে এপ্রিশিয়েশন কালচারটা একেবারেই নেই, শুধু ভুল ধরার এই নিরলস চেষ্টা খুবই পীড়াদায়ক ব্যাপার।

‘ভাষা বাড়া দেয়া হবে’- এটা যে লিখেছে সে কি ইনোভেশনের মাইন্ডসেট থেকে কাজটা করেছে? কখনোই নয়। সে কি ভাষাকে বিকৃত করার ইনটেনশন থেকে করেছে? অবশ্যই নয়। মানুষকে বিচার করতে হয় তার ইনটেনশন দিয়ে। সে কাজটা করেছে স্রেফ অজ্ঞতাবশত। তার মেসেজ হচ্ছে, বাসা ভাড়া দিবে, সেটা মনে হয় পড়ামাত্রই যে কেউ বুঝতে পেরেছে। ভাষার মূল টার্গেট যদি হয় মেসেজ কনভে করা, সেই গ্রাউন্ডে কিন্তু তার এপ্রোচ ভুল নয়, তবু তাকে নিয়ে ট্রল হয়েছে, এবং হতেই থাকবে। আমরা রাস্তাঘাটে ভুল-ভাল বাংলা লেখা দেখলে সেটার ছবি পোস্ট করে আহাজারি করি, রেস্টুরেন্টের মেনুতে ভুল বাংলা দেখে সেটার ছবি দিয়ে তীর্যক মন্তব্য করি, এবং সেখানেও ভাষা শহীদদের আত্মাহুতি, সংগ্রামকে টেনে আনি। আমরা বড্ড বেশি অসহিষ্ণু; যে কোনোকিছু ঘটলেই মানচিত্র ধরে টান দিই; ঢাকা শহরে মশা বেশি কেন, ভাষা শহীদরা কি এজন্য রক্ত দিয়েছিলো? কিংবা, ঠাকুরগাঁয়ের দীঘিতে শালুক ফুটলো না, এজন্যই কি ৭১ সালে রক্ত ঝরিয়েছিলো বাঙালি?- আমরা এতো একরৈখিকভাবে চিন্তা করি কেন, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। একটাই উত্তর, অতিমাত্রায় ইনসেনসিটিভ। যে ব্যক্তি ‘ভাষা বাড়া দেয়া হবে’ লিখেছে সেখানে নিশ্চয়ই তার ফোন নম্বর ছিলো, তাকে একজন মানুষও কি জানিয়েছে, ভাই আপনি একটি মস্ত ভুল করেছেন, শব্দটা হবে ‘বাসা ভাড়া দেয়া হবে’? কেউ না, অথচ সবাই দেখে তার অজ্ঞানতায় মজা নিচ্ছে, এবং আ মরি বাংলা ভাষা, লিখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে, যেন ভাষার এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ে তার হৃদয় চিড়ে ফেলেছে কেউ! এর চাইতে অনেক কম সময়ে, জানানো যায়, ভুলটা। ভুল জানা সত্ত্বেও কেউ যদি গোয়ার্তুমি করে তখন নিজের দায় এড়ানো যায়, অন্তত তাকে ভুলটা সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেরকমটা বাস্তবজীবনে আদৌ কি হয় সচরাচর? তাহলে এই ঠূনকো ঠাট্টা-মশকরা করে নিজেদের রুচিহীন ব্যক্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে আমরা আসলে কী বার্তা তৈরি করছি?

পারস্পরিক সহমর্মীতা আর সহযোগিতার অভাবের এই যে প্রবণতা, এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। শয়তান ছাড়া সবাই ভুল করে, কিন্তু আরেকজনের অজ্ঞতাজনিত ভুল নিয়ে হাসাহাসির যে বিপজ্জনক লক্ষণ, এটাকে প্রোমোট করা মানে কাউকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য আমরা আরও বেশি উন্মুখ হয়ে থাকবো। কে কার অজ্ঞতা নিয়ে কত বেশি অপদস্থ করতে পারে, এ নিয়ে শীতল যুদ্ধ হবে, ফলে একে অপরের থেকে আমরা যে আরো বেশি দূরে চলে যাচ্ছি, আস্থা, নির্ভরতা আর ট্রাস্টের জায়গাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছি, এই বোধ বিলুপ্ত হবে।

আমাদের মধ্যে কতজন মানুষ ১০০০টি বাংলা শব্দ জানি, ৩০০ ইংরেজি শব্দ জানি? কিংবা ব্যাকরণের জটিল নিয়ম-কানুন প্রোপারলি ব্যবহার করতে পারি, অথচ আমরা তো দিব্যি জী্বন-যাপন করছি, কোনোকিছুই থেমে নেই আমাদের, কারণ কী বলতে চাই, এটুকু আমরা বুঝে নিয়ে কাজ চালাতে পারি। কিন্তু আমাদের সোশ্যাল এবং প্রিন্ট মিডিয়া শেখাচ্ছে, অজ্ঞতা নিয়ে মজা করাটা স্মার্টনেস। জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ কী এই প্রশ্নের আজগুবি উত্তর দিলে ছিঃছিঃ করি, অথচ ওই ঘটনার পর গুগল সার্চ লিস্টে অন্যতম শীর্ষ কী-ওয়ার্ড ছিলো ‘অপারেশন সার্চ লাইট’; তার মানে এই ছিঃছিঃ গোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেরাও জানতো না অপারেশন সার্চ লাইট সম্পর্কে। আপনারা তো যুক্তিবাদী বুদ্ধিমান মানুষ; বলুন তো দেখি, ওই জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থী আর গুগলে সার্চ করা গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্ গ্রুপটি হাস্যকর কাজ করছে আসলে? এভাবেই আমাদের হেয় করার মানসিক প্রতিবন্ধকতাগুলো সিন্দাবাদের ভূত হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে এবং ক্রমাগত দুষ্টবুদ্ধি সরবরাহ করে যায়।

শব্দ নিয়ন্ত্রিত মাসের প্রসঙ্গে ফিরি আবার। নিয়ন্ত্রিত হতে, নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের ভালো লাগে। আমাদের জীবনযাপনের ৯০% ব্যাপারই সেই নিয়ন্ত্রণের বাই প্রোডাক্ট। পরচর্চা আমাদের পছন্দের টপিক। একজনের নামে বিষোদগার করছি, কিন্তু পরদিন থেকেই সে যদি আমার মনমতো আচরণ করে, বিষোদগার কি থেমে যাবে? কক্ষণো নয়, আমরা বলবো, ‘নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে’। এই যে পচনশীল এবং পতনশীল মানসিক আচরণ, সেখানে ব্যক্তিস্বার্থের চাইতে প্রাধান্য পায় না কিছুই, তবু অন্যের চোখে বড় হওয়ার যে প্রবল বাসনা, সেখান থেকেই আমরা ভাষার মাস, স্বাধীনতার মাস নিয়ে শাব্দিক মাতম তুলি। এই মাতমের বসবাস দূরতম মনের দূরতম প্রান্তে, সচেতন মনে তার আবির্ভাব ঘটে কদাচিত, এবং সোশ্যাল মিডিয়া বিস্ফোরিত হওয়ার পর মাতম চলে এসেছে কী-বোর্ডের অক্ষরে, কিন্তু কেন মাতম, কী হলে মাতম বন্ধ হবে তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না সহসা।

ফেব্রুয়ারি মাসে তো বরং বেশি করে তামিল, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেন্স, রাশিয়ান সিনেমা দেখা উচিত, ওইসব ভাষার গান শোনা উচিত। ভাষা একটি ওপেন প্লাটফরম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে কালচারাল এক্সচেঞ্জ তো খুবই উপকারী এবং দরকারী অনুষঙ্গ। এখন এক্সচেঞ্জের বদলে যদি শুধু একপাক্ষিকভাবে আমদানী হয়, সেই দায় তো ব্যবহারকারীর নয়, সমগ্র সিস্টেমের। অনুকরণ-অনুসরণপ্রিয়তা যদি আমাদের পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে, লেগাসি বলেও তো একটা কথা আছে; আমরা আরামপ্রিয়-অলস এবং শ্রমবিমুখ। জি-বাংলাতে সারেগামাপা নামে একটা গানের অনুষ্ঠান হয়; সেখানকার প্রতিযোগিদের কোয়ালিটি আর আমাদের গানের প্রোগ্রামের শিল্পীদের কোয়ালিটির মধ্যে তুলনামূলক চিত্রটা বোঝার চেষ্টা করুন, অনুষ্ঠানে গানগুলো যেভাবে ইমপ্রোভাইজ করা হয়, সেটা নিয়ে ভাবুন; এবার আসুন, বাস্তবতায়, আমরা যদি প্রোগ্রাম বানাতে চাই দেখা যাবে সারেগামাপা স্টাইলকেই হুবুহু অনুকরণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে চরম শিশুতোষ মানের কিছু একটা উপহার দেবো। আমাদের কি মেধার অভাব? আমি তা মানি না। অভাব রুচিবোধ, শিল্পমন আর সবার উপরে, পরিশ্রমের। আর্ট সেক্টর বাদে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিনাতেও একই চিত্র। বড় কোম্পানীর বড় পোস্টগুলো ভারতীয় অথবা শ্রীলংকানদের দখলে; তারা কি জোর করে ঢুকেছে? মোটেই না, দেশে সেই ক্যালিবারের লোক পাওয়া যায়নি বলেই বিদেশীদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। কেন পাওয়া যায়নি? ওই যে, স্কিল ডেভেলপমেন্টে অনীহা! এই মহারোগের তো আরোগ্য নেই। তার পরিবর্তে ভালোবাসার মাস, প্রমিজের মাস, প্রোপোজের মাস, সেলফির মাস- এসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ‘এই কাজটি কেন করছি’- এই সরল প্রশ্নেরই কোনো উত্তর নেই সিংহভাগ মানুষের; তারা তো এসব আগডুম বাগডুম করেই শান্তি স্বস্তি খুঁজে নেবে!

বাংলাদেশের ৯০% কর্পোরেট অফিসে কমিউনিকেশন ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরেজি; চাকরির ইন্টারভিউ, বিজ্ঞাপন সবই হয় ইংরেজিতে। এমন নয় যে, তাদের ক্লায়েন্ট বাইরের দেশের। দুজন বাঙালি কথা বলবে নিজেদের মধ্যে, অথচ সেজন্য বেছে নেয়া হচ্ছে ইংরেজি। কারণ, ইংরেজি বলতে পারা স্মার্টনেসের সার্টিফিকেট দেয়; বাংলায় ইমেইল লেখা রীতিমতো অপরাধ। ইংরেজিকে ভাষার চাইতে লারনিং টুল বলা শ্রেয়; সুতরাং ইংরেজি জানতে হবে, ফ্লুয়েন্সি থাকা অবশ্যই বাড়তি যোগ্যতা, কিন্তু যেখানে বাংলা দিয়েই নির্বিঘ্নে কাজ চালানো যায়, সেখানে ইংরেজি টেনে আনাটা কি আদিখ্যেতা, নাকি পরিচয় সংকটে ভোগা মানসিকতার পরিচায়ক? কিছুদিন আগে ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখার্জীর একটা সাক্ষাৎকার নিলাম। আলাপের এক পর্যায়ে জানতে পারলাম, তিনি একবার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক হেড কোচ জেমি সিডন্সের একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলেন। দেবব্রতের স্পোকেন ইংলিশ খুবই দুর্বল (তার ভাষ্যমতে), ফলে সিডন্সের সাথে কমিউনিকেট করতে সমস্যা হচ্ছিল, সিডন্স বেশ অসন্তোষই প্রকাশ করেন, এতে দেবব্রত বিব্রত হন। তখন তৎকালীন ট্রেনার তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ইংরেজি তো তোমার ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ না, তুমি চেষ্টা করে তবু কিছু বলতে পারছো। সিডন্সের ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরেজি, সে সেই ভাষায় ফ্লুয়েন্ট তো হবেই, কিন্তু সে তো তোমার বাংলা ভাষায় একটা কথাও বলতে পারবে না। তুমি ওর ল্যাঙ্গুয়েজ জানো, কিন্তু ও তোমার ল্যাঙ্গুয়েজ কিছুই জানে না; কাজেই বিব্রত যদি হতে হয়, সেটা সিডন্স হবে, তুমি কেন?’ পানির নিচ থেকে মাছ যেমন আমাদের দেখে, আমরাও তো মাছকে দেখি উপর থেকে। কিন্তু কোনটা নিচ আর কোনটা উপর; সেটা নির্ভর করছে, আমি কোথায় আছি সেই পজিশনের প্রেক্ষিতে।