ক্রিকেট খেলা বোঝার ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, প্রধান প্রতিপক্ষ স্ট্যাটিসটিক্স, যদিও এটা দিয়েই শেষ পর্যন্ত সবকিছু মেজার করতে চাওয়া হয়। এই প্রবণতা যে ফাঁকিঝুঁকিপূর্ণ সেটা বোঝার জন্য এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পারফেক্টতম উদাহরণ হাথুরুসিংহে। পরিসংখ্যান বলবে, তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের সফলতম কোচ, তার সময়ে দল বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে, পাকিস্তানকে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ করেছে, সাউথ আফ্রিকা, ভারতের মতো পরাক্রমশালী দলকে সিরিজ হারিয়েছে, এশিয়া কাপ টি২০ তে ফাইনালে উঠেছে, ইংল্যান্ড আর শ্রীলংকাকে টেস্টে হারিয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যানে কোথাও লেখা নেই, ২০১২ সাল থেকেই ওয়ানডেতে যে বদলের ইঙ্গিত, সেটি বিকশিত হয়েছে ২০১৫তে। এতে হাথুরুর অবদান কতটুকু, বা তার ইমপ্যাক্ট কী? সেসব নিয়ে অনেক কিছু বলতে চাই বলেই পরিসংখ্যানের প্রতি নিজের বিকর্ষণের প্রসঙ্গটি দিয়ে শুরুর ভূমিকা লেখা।

হাথুরুসিংহের ক্যালকুলেটিভ বিজনেস প্রেজেন্টেশন ফ্রেমওয়ার্ক:
• হাথুরুসিংহের এক্টিভিটি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি। সেই আলোকে তার থট প্রসেস নিয়ে আমি একটি ডিসকোর্স তৈরি করতে চাই। হাথুরু ক্রিকেটের চাইতে বেশি বোঝে মেজরিটি পপুলেশন সাইকোলজি এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা। এদেশের ক্রিকেট ফলোয়ারদের বৃহত্তম অংশটি মনে মনে বিশ্বাস করে বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি ম্যাচ জেতার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু খেলোয়াড়দের খামখেয়ালি আর আম্পায়ারের পক্ষপাতিত্বে পেরে উঠে না। এই বিশ্বাসের কনক্লুডিং পয়েন্ট হলো, আমাদের খেলোয়াড়রা বিপুল প্রতিভার অধিকারী, তারা কোনোভাবেই হারতে পারে না, স্রেফ নিজেদের মধ্যে কলহ, উশৃঙ্খলতার কারণে প্রতিপক্ষকে জয় উপহার দিয়ে বসে। যাদের কাছে ‘জয়’ই একমাত্র অপশন, সেই সমর্থকদের মনোরঞ্জনের জন্য এগ্রেসিভ খেলাটাই যথেষ্ট, তাতে জয় আসবে, আবার হেরে গেলে খেলোয়াড়রাই গালি খাবে।
• বাঙালির সংগঠনের ইতিহাস খুবই নড়বড়ে। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইসূত্রে জানা যায় হীনম্মন্যতা, স্বার্থসর্বস্বতা প্রভৃতি কারণে বাঙালির সংগঠনগুলো কীভাবে ধুকতে থাকে। বিসিবিও একটি সংগঠন। কিছুদিন কাজ করার পরই হাথুরু বুঝে গেছে, এই সংগঠনটিও চিরায়ত বাংলা সংগঠনের প্রতিরূপ। এখানেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং এবং লুটপাটের কালচার বর্তমান। এখানে ক্রিকেট বোঝার মানুষ নেই, কিন্তু ক্রিকেটকে ভাঙিয়ে বিত্ত-বৈভব বাড়ানো আর টিভি পর্দায় সরব উপস্থিত হতে চাওয়া দুধের মাছির আনাগোণা বিস্তর। সুতরাং এই বিশৃঙ্খলতার সুযোগ নিয়ে নিজের পজিশনটা সংহত করা যায়।
• হাথুরু কী চায়, কেন চায়? এই প্রশ্নটা খুব গভীর। সে কি চায় দল হেরে যাক, বা খারাপ করুক? কিংবা উল্টো করে বললে, বিসিবি হাথুরুকে প্রশ্রয় দেয় কেন? তার এমন সর্বেসর্বা হয়ে উঠার নেপথ্য শক্তি কী? হাথুরু প্রফেশনাল কোচ। প্রফেশনাল শব্দটার মধ্যেই কী এবং কেন এর উত্তর নিহিত। বিসিবি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, হাথুরু সেখানে একজন বেতনভূক্ত কর্মকর্তামাত্র। যে কোনো কর্মীর লক্ষ্য থাকে নিজের ক্যারিয়ার গ্রোথ, এবং তারপর বেটার অফার নিয়ে অন্য কোথাও সুইচ করা; এজন্য সিভি ভারি করা যায়, এসব এক্টিভিটি করতে হয়। হাথুরুর ক্যালকুলেশন মতে, টেস্টে বাংলাদেশের ভালো করার তেমন কোনো সম্ভাবনাই নেই, বা থাকলেও সেটা তার ক্যারিয়ার গ্রোথে ভ্যালু এড করবে কম। কারণ, এদেশে টেস্ট সেভাবে জনপ্রিয় নয়, টি২০ তথা আইপিএল এর ক্রেজ আছে। টি২০ আর ওয়ানডে ফরম্যাটে যদি সমীহজাগানিয়া একটা অবস্থানে পৌঁছুতে পারে, সেক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে অন্য কোথাও বেটার অপরটুনিটি পাওয়া যাবে, আর যদি সেটা নাও হয়, এখানেই বেতন-ভাতা বহুগুণ বাড়িয়ে নেয়া যাবে। সে বিসিবির প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না, বাংলাদেশ দলে চিরদিন চাকরিও করতে পারবে না, ৩টা সিরিজ ফ্লপ করলেই অবস্থান টলমলে হয়ে যাবে, সুতরাং জিততে হবে, জিততে হবে, এবং জিততেই হবে- এই চর্চা যদি করা যায়, অন্তত চাকরিকালে ফায়দা লুটে নেয়া যাবে। এটা তো খুব সিম্পল কথা, প্রত্যেক কোচই এটা করার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন সময়ে। হাথুরুর আগে ডেভ হোয়াটমোর বা জেমি সিডন্সের কার্যক্রম স্মরণ করলেও একই চিত্র পাওয়া যাবে। তবু হাথুরুর ব্যাপারে চোখ বড় করার কারণ সম্ভবত, তার আমলে ওয়ানডেতে ৩টা বড় দলের বিপক্ষে সিরিজ জেতা গেছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়া অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে এখন বেশি একটিভ, এবং ২০১২ পর্যন্ত যদি ক্রিকেট ফলোয়ার ১০ লাখ হয়ে থাকে, ২০১৫ এর পরে সেটা অন্তত ২ কোটি হয়ে গেছে। মাত্র ৩ বছরের মধ্যে সংখ্যার এই বিশাল জাম্পটা কোনো মেথডোলজিকাল প্রসেস অনুসরণ করে হয়নি, যে কারণে হাথুরুর সাথে বাকিদের তেমন কোনো পার্থক্য না থাকলেও সে লাইমলাইটে বেশি এসেছে। ডেভ হোয়াটমোরের মাল্টি স্কিলড প্লেয়ারের তত্ত্বে জামাল বাবুর ঢুকে যাওয়া, জেমি সিডন্সের আশরাফুলকে ৭ নম্বরে পিওর হিটার হিসেবে খেলানোর ট্যাকটিক্স- এগুলো আলোচনায় নেই, পার্থক্য এটুকুই। বিসিবি কেন প্রশ্রয় দেয়, কারণ না দিয়ে তাদের কিছু করারও নেই। যে তাদের জয় এনে দিতে পারবে, তার সতেরো হাজার খুন মাফ। ক্রিকেট সেন্স বলতে যা বোঝায় তার লেশমাত্রও বিসিবি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; ‘ভিশন’ বলতে কিছু নেই, অথচ রেভিনিউয়ের লোভ ষোল আনা। বোর্ড অব ডিরেক্টরস এর মিটিংয়ে সিইও যেভাবে বছরের বিজনেস প্ল্যান পাশ করিয়ে নেয়, এবং রেভিনিউ ফোরকাস্ট করে, কোচের কাজটাও আমাদের এখানে তেমনই। কোচ কয়েকটা রিস্ক নিয়েছে, সেগুলো পে-অফ করেছে, এবং এটাই তাকে আরও আগ্রাসী করে তুলেছে। মাত্র ১০ লাখ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের এখানে যে কোনো অনৈতিক কাজে রাজি করানোর মানুষ ভুরিভুরি, সেখানে ক্রিকেট ইনফ্র্যাস্ট্রাকচার গোল্লায় যাক, যে কোনোভাবে কিছু ম্যাচ জিতে রেভিনিউ বাড়িয়ে নেয়াই আসল কথা। ক্রিকেটারদের বরাবরই শ্রমিক হিসেবে ট্রিট করা হয়েছে, মূল ডিলিংসটা কোচ আর বিসিবির মধ্যে, অথচ মাঠের সাফল্যটা আসে ক্রিকেটারদের বদৌলতেই। ক্রিকেটাররা স্টারডম পাচ্ছে, অল্প বয়সে প্রচুর টাকা উপার্জন করছে, বিসিবি ওদের সুযোগ দিচ্ছে এতেই তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এই মনোভাব আরও জোরালো হয় ক্রিকেটারদের ক্রিকেটপ্রজ্ঞাহীনতার সুযোগে। স্টারডমের ধকল সইতে গিয়েই তারা শেষ, প্রজ্ঞা আসবে কোত্থেকে! হাথুরু সেই গ্যাপ এনালাইসিস করে ফাঁকে ঢুকে পড়েছে মাত্র। জাতীয় দলে একজন ক্রিকেটার সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি হয়েই আসে, আর আমাদের ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে এসে তৈরি হয়। অন্য দেশগুলোতে বিভিন্ন প্রদেশের খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে খেলে, আর আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা প্রত্যেকেই ঢাকার ক্লাব খেলে আসা; ময়মনসিংহ বা ঠাকুরগাওয়ের স্থানীয় লীগে খেলে জাতীয় দলে এসেছে, এটা তো চরম অবাস্তব কল্পনা।
• পূর্বাপর কোচদের সাথে হাথুরুর পার্থক্যটা টাইমিংয়ের। তারা শিশু বাংলাদেশকে পেয়েছে, যে কারণে সবরকম চেষ্টা করেও তারা বেশি ফায়দা উঠাতে পারেনি, হাথুরে একটি তৈরি হতে থাকা দলকে পেয়েছে যারা ২৯২ রান চেজ করে বড় দলকে হারানোর আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে ইতোমধ্যে।

হাথুরুর সময়ে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে এতো সম্ভাবনাময় হয়ে উঠলো কীভাবে?
• আমি বরাবরই বলেছি, বাংলাদেশে সেই ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকেই সম্ভাবনাময়। ২০১৪ তে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হেরেছে, কিন্তু অনেকগুলো ক্লোজ ম্যাচে জেতার সম্ভাবনা তৈরি করেও ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনতে পারেনি, এমনকি ৩২৭ করেও হারতে হয়েছে। এগুলো স্রেফ দুর্ভাগ্য, কিন্তু পরিসংখ্যান বলবে ২০১৪ তে আমরা খুবই খারাপ ক্রিকেট খেলেছি। শুরুর দিকে হাথুরুও খুব নিরীহদর্শন ছিলো। ২০১৫ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে হেরে যাওয়ার পর খুব কম মানুষই দল নিয়ে উচ্চাশা করেছিলো, এমনকি প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের সাথে জিতবে কিনা এটা নিয়েও প্রবল সংশয় ছিলো। শ্রীলংকার সাথে বাজেভাবে হেরেছিলো, বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়ার সাথেকার ম্যাচটি না হওয়াতে একটি পয়েন্ট পেয়েছিলো, নিউজিল্যান্ডের সাথে ক্লোজ ম্যাচ হেরেছে, এবং ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে; সেটা তো ৫৮ আর ৭৮ রানে অলআউট হওয়া ২০১১ বিশ্বকাপেও হারিয়েছিলো। ফরম্যাটের কারণে ২য় রাউন্ড মানেই কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে গেছে, নইলে ২০১৫ বিশ্বকাপে আসলেই বড় কোনো সাফল্য পেয়েছে কিনা এটা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার।
• বাংলাদেশের মূল কৃতিত্ব ২০১৫তে ৩টি বড় দলকে সিরিজ হারানো। সেই ম্যাচগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, মোস্তাফিজ আর সৌম্যের বড় প্রভাব ছিলো তাতে। সৌম্য, সাব্বির আর মোস্তাফিজের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে হাথুরুর প্রভাব আছে ধরে নেয়া হয়, এবং তারা ভালো করায় হাথুরু নিজের ক্ষমতার প্রতি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। এবং বিসিবির যেহেতু ক্রিকেটিয়প্রজ্ঞা বিন্দুমাত্র নেই, রাতারাতি হাথুরু পীরবাবা হয়ে গেলেন, তিনি যা বলবেন তা-ই সই।
• ক্রিকেট বহুলাংশে অধিনায়কনির্ভর খেলা। অনফিল্ড তার লিডারশিপ কোয়ালিটির উপর দলের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়। মাশরাফি অধিনায়ক হওয়ার পর দলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অনেকখানি বদলে গেছে।

প্রিয় খেলোয়াড় তত্ত্ব:
• গর্ডন গ্রিনিজের আমল থেকেই বাংলাদেশী কোচদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি প্রচলিত। যখনই ১০-১৫ জন মানুষ নিয়ে কাজ করা হয় সেখানে ইন্টিমেসি, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটি চলে আসা অবধারিত। হোয়াটমোর যেমন মাশরাফিকে খুব পছন্দ করতেন, গ্রিনিজ রোকন, অপিদের, জেমি সিডন্স তামীমকে ফ্রি লাইসেন্স দিয়েছিলো। হাথুরুর পছন্দ সৌম্য, সাব্বির। অনেক মানুষ নিয়ে কাজ করতে গেলে পছন্দ থাকার ব্যাপারটা যেমন স্বাভাবিক, অনুরূপভাবে অপছন্দের খেলোয়াড়ও থাকবে। কোচরা তখন দলের চাইতে ব্যক্তিকে নিয়ে বেশি আবিষ্ট থাকে, যা সামগ্রীকভাবে দলের পরিবেশ নষ্ট করে। বাংলাদেশের মতো জায়গায় এটা আরও বেশি সমস্যাজনক। আমরা এখানে এমনিতেই সবকিছুতে স্বজনপ্রীতি আবিষ্কার করি। ফলে কোচ অল্পদিনের মধ্যেই শত্রু তৈরি করে ফেলে। কিন্তু কেন এই প্রিয় খেলোয়াড় তত্ত্ব এদেশে এতোবেশি? সব কোচই ছক কষে কীভাবে দলকে জয় এনে দেয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের স্ট্যান্ডার্ড আপ টু দ্য মার্ক না হওয়ায় তারা পড়ে যায় বিপাকে। যাদের মধ্যে কিছুটা প্রতিভা আছে, তাদের প্রয়োজনের চাইতে বেশি ফ্রিডম দিয়ে ফেলে নিজেদের স্বার্থেই, কিন্তু তাদের চোখে প্রতিভাহীন ক্রিকেটাররা এই বৈষম্য মেনে নিতে পারে না; সৃষ্টি হয় ইমব্যালেন্স। হাথুরুর প্রিয় খেলোয়াড় তত্ত্ব নিয়ে কথা কম হয়, কারণ এখনকার দলের এভারেজ স্ট্যান্ডার্ড লেভেল একটু বেড়েছে। হাথুরু প্রধান সমস্যা করেছে জুবায়ের, তানভীর এই ২ জন খেলোয়াড়কে জাতীয় দলে নিয়ে। সেটাও সমস্যা হতো না, কিন্তু তাদের আবার হুট করে বাদ দেয়ার মাধ্যমে নিজের প্রথম সিদ্ধান্তের অসাড়তা প্রমাণ করা করেছেন, যে কারণে ওই ২ খেলোয়াড় কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলেছে। এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত; কোচের ইচ্ছা হলো নিলাম, ইচ্ছা হলো বাদ দিলাম; ফলে যোগ্যতার চাইতে কোষের মনরক্ষার বিষয়টিই মূখ্য হয়ে উঠে; কোচ তখন গডফাদারে পরিণত হন। ইতোপূর্বের কোচদের সাথে হাথুরুর পার্থক্য এখানেই; সে গডফাদার হতে চেয়েছে।

হাথুরু বনাম প্রাইভেট টিউটর সংস্কৃতি:
• আমাদের পরনির্ভরতা সংস্কৃতি শুরু হয় একদম শৈশব থেকে, স্কুলে যাওয়ার মাধ্যমে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারও কয়েকজন টিউটর। ফলে আমরা সবসময় ধরেই রাখি যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য টিউটর আছে, আমাদের কিছুই করতে হবে না। আমরা স্যারের করে দেয়া অংক মুখস্থ লিখে পরীক্ষার খাতায় এ প্লাস পাই, আগে স্টার মার্কস পেতাম; প্রাইভেট পড়িয়ে টিচার ফরমাল বেতনের ৩গুণ উপার্জন করেন। প্রাইভেট টিউটর নির্ভরতা ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিকেট মাঠেও। অন্য দলগুলোতে কোচের ভূমিকা যেখানে ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত, আমাদের দলে কোচ পারলে মাঠে নেমে খেলে দিয়ে আসেন। ক্রিকেট একাডেমিগুলোতেও দেখা যায় কোচ ম্যাচ চলাকালে বাইরে থেকে ক্রমাগত ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে কোচ যে বেত পেটা করেন না, এটাই তো অনেক বড় পাওনা!

বিসিবির দৈন্যে হাথুরু ধন্য:
• হাথুরু নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য, যদিও এটা প্রায় সবাই জানেন, বাকি সদস্যদের একমাত্র কাজ হাথুরুকে সমর্থন জানানো। আমরা যদি সাপ্লাই চেইন সিস্টেম চিন্তা করি সেখানে হাথুরুর কাজ হওয়ার কথা, তাকে যে খেলোয়াড় তালিকা দেয়া হবে তাদের পরিচর্যা করা। কিন্তু দলের সাফল্য-ব্যর্থতার জন্য তাকেই যেহেতু জবাবদিহি করতে হয়, তিনি নিজের চাওয়াটা জানাতেই পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতীয় দলের বাইরে ঘরোয়া লীগের কয়টি ম্যাচ তিনি দেখেন? বয়সভিত্তিক দলের ব্যাপারে তার জানাশোনা কতটুকু? তাহলে কিসের ভিত্তিতে তিনি খেলোয়াড় নির্বাচন করবেন।
• হাথুরুর সাথে মনোমালিন্যের কারণে সাবেক অধিনায়ক দুর্জয়কে বিসিবির একটি পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, মিডিয়াসূত্রে এই কথা আমরা জানলেও আমার ধারণা নিজেদের মধ্যকার গ্রুপিংয়ের কারণেই দুর্জয়কে যেতে হয়েছে, হাথুরু একটি ঢালমাত্র। হাথুরুকে নির্বাচক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, এটা তো বিসিবির সিদ্ধান্ত। আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে মানুষের আচরণের ঠিক থাকে না, মাথা ঘুরে যায়। ২০১৫ সাল পুরোটা ভালো কেটেছে, ২০১৬ গেছে টি২০ এর উপর দিয়ে, আফগানিস্তান আর ইংল্যান্ডের সাথে ওয়ানডে সিরিজ হয়েছে; তাতে ১টায় জিতেছে, ১টায় হেরেছে; এবছর নিউজিল্যান্ড সফরে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে, শ্রীলংকার সাথে সিরিজ ড্র করেছে (২য় ওয়ানডেটা পরিত্যক্ত না হলে ফলাফল অন্যরকমও হতে পারতো); বলা যেতে পারে ২০১৫ তুলনায় সাফল্যের হার কম। হাথুরুর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসার একমাত্র ফ্যাক্টর যেহেতু ‘জয়’ এর পারসেন্টেজ বাড়া (এটা অনেকটা প্রফিট বাড়া-কমার মতো), সেক্ষেত্রে ১টা-২টা সিরিজ ফ্লপ করলেই হাথুরু প্রশ্নবিদ্ধ হবেন, এবং তার কিছুদিন পর চাকরি হারাবেন। বাংলাদেশে এখনো অস্ট্রেলিয়া বা ভারতের মতো ধারাবাহিক হতে পারেনি, তাই সিরিজ হারার ঘটনা ঘটবেই। বিসিবিও তাদের নামের প্রতি সুবিচার করবেই। হাথুরির বিদায় অবধারিত; মাঝখান থেকে একটি সিস্টেমকে নষ্ট করে দিয়ে যাবেন; নতুন কোচ এসে আবার সবকিছু নতুনভাবে শুরু করবেন। বিসিবির সুস্পষ্ট কোনো গাইডলাইন নেই, তাই কোচও জানে না কতটুকু তার সীমানা, এবং সেখান থেকেই একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার চেষ্টা।
এই সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে লালন করে এসেছে যারা, তারা তো হাথুরুর মতো কোচদের প্রোমোট করবেনই।• বিসিবি কেন তারুণ্য নীতিতে কাজ করে, এবং সিনিয়র ক্রিকেটারদের বরাবরই বিশ্রীভাবে ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়? আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম থেকে শুরু করে আব্দুর রাজ্জাক পর্যন্ত, কেউই ভালোভাবে অবসর নিতে পারেনি। হুট করে কোনো একটি সিরিজের পর বাদ, এরপর আর কখনো দলে ফিরে আসতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়া স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহদের মতো ক্রিকেটারকেও বাদ দিয়েছে, এই যুক্তিতে বিসিবি বলতে পারে খেলাধুলায় আবেগ দেখানোর সুযোগ নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া তো ক্রিকেট অবকাঠামো, দলনির্বাচন প্রক্রিয়া, ক্রিকেট ক্যালেন্ডার, বয়সভিত্তিক দল, সবকিছুতেই অনেক অর্গানাইজড; এসব ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াকে অনুসিরণ করার কথা মনে থাকে না, কেবল সিনিয়র কাউকে বাদ দেয়ার সময় আবেগ কে দোষারোপ? অস্ট্রেলিয়ায় তো অনেকের টেস্টে অভিষেকই হয় ৩০ এর বেশি বয়সে, আর আমরা ৩০ পেরুলে ছুঁড়ে ফেলি। বাংলাদেশীদের ফিটনেস অস্ট্রেলিয়দের মতো না, ৩০ এর পর সেটার আরও অবনতি হয় অনেকেরই, কিন্তু যাদের ফিটনেস ভালো তারাও তো বয়সের কারণে ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যায়।
• একজন খেলোয়াড়কে খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে একাদশ থেকে ড্রপ দেয়া হতেই পারে, কিন্তু একাদশ থেকে বাদ মানে কি দল থেকেও বাদ? তাও সিরিজের মাঝপথে। মাহমুদুল্লাহ টেস্ট স্কোয়াড থেকে বাদ পড়া ডিজার্ভ করে, অনেকদিন থেকেই ফর্মে নেই। কিন্তু একাদশ থেকে বাদ দিয়ে সিরিজের মাঝপথে তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে চাওয়া, এটা ঠিক কোন্ পর্যায়ের ক্রিকেট কোচিং, আমি ধরতে পারিনি। এখন মাহমুদুল্লাহ ওয়ানডে আর টি২০ দলেও ব্রাত্য হয়ে পড়ছে প্রায়, অথচ এই দুই ফরম্যাটে সে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত ক্রিকেটার। কিসের ভিত্তিতে শ্রীলংকা সিরিজে তাকে ৭এ খেলানো হলো, এটা বোধগম্য হয়নি। একজন সুনির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে উদাহরণ হিসেবে টানার কারণটি আরও স্পেসিফিক। কোচের বিরাগভাজন হয়েছো মানে তুমি কোথাও নেই, এবং বোর্ড প্রেসিডেন্ট সেটা সাপোর্ট করে দায়টা নিজের উপর নিচ্ছেন।

হাথুরু কি কেবলই নেগেটিভ?
• হাথুরুর ক্রিকেটপ্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করার অবকাশই নেই। তিনি টেস্ট, টি২০ এবং ওয়ানডের জন্য পৃথক দল করতে চান। বিশেষ করে টি২০ নিয়ে তিনি এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। এটা ব্যক্তিগতভাবে আমি সাপোর্ট করি, কারণ টি২০ কে আসলে সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই। তামীম, মুশফিকদের মতো ক্রিকেটারদের টি২০ খেলে সময় নষ্ট করার চাইতে টেস্ট আর ওয়ানডের জন্য আরও শাণিত হওয়া উচিত। মাশরাফির আরও কিছুদিন ওয়ানডে ক্যারিয়ার টেনে নেয়ার জন্য হলেও টি২০ ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নে হাথুরু যেসব কৌশল অবলম্বন করেন, সেটা একজন গুপ্তঘাতকের প্রক্রিয়া, ক্রিকেট ক্রেজ আছে এমন দেশের কোচের আচরণের সাথে এটি কোনোভাবেই মানানসই নয়। মিডিয়াতে যেভাবে প্রেজেন্ট করা হচ্ছে হাথুরু তামীম, মুশফিককে টি২০ থেকে বাদ দিতে চান, আমি মনে করি বিষয়টা এমন নয় হয়তোবা। তরুণ ক্রিকেটারদের বিশেষত টি২০ স্পেশালিস্টদের বেশি করে খেলানো হোক, সাথে সাকিব, মাহমুদুল্লাহর মতো ২ জন সিনিয়র ক্রিকেটারই যথেষ্ট। এই কৌশল অবশ্যই প্রশংসনীয়। তামীম টি২০ তে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ন; বিরাট কোহলী তিন ফরম্যাটেই দারুণ খেলে, তামীমও সেরকম করতেই পারে। কাজেই সিদ্ধান্তটা তামীমের নিতে পারার ক্ষমতা দেয়া উচিত; হাথুরুর মনে হলো তামীমের টেস্ট আর ওয়ানডেতে মনোযোগ বাড়াতে টি২০ ছাড়া উচিত, সুতরাং ছাড়তেই হবে- এই এপ্রোচ স্বৈরাচারের। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামীম বা মুশফিক যে জায়গায় অবস্থান করেন, হাথুরু এসে সেটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা ভালো লক্ষণ নয়। ব্যক্তির চাইতে দল বড়, কিন্তু বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যক্তিই বড় হয়ে উঠে্ হাথুরু তাই তামীমকে নিজের চিন্তাটা জানাতে পারেন, তাতে রাজি না হলেই যদি ক্ষুব্ধ হতে হয়, এটা তো ভয়ানক ব্যাপার।
• হাথুরুর বড় দোষ স্টারডম বুঝতে না পারা। সাকিব বা মাশরাফি কোটি মানুষের তারকা, তাদের হ্যান্ডল করতে হলে হেড মাস্টারের মতো কড়া শাসন নীতি চলবে না। তিনি ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে ভুগেন। সাকিব বা মাশরাফির মতো তিনিও একজন তারকা হবেন, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবু মনের গভীর কোণে সেরকম কিছু প্রত্যাশা করেন, যে কারণে দলের সাফল্যের ক্ষেত্রে মানুষ বা বোর্ড ক্রিকেটারদেরও আগে তার কথা বলুক, এরকমটা তার আচরণে মনে হয়। বুঝতে হবে, অস্ট্রেলিয়া দল যখন অজেয় ছিলো তখন মানুষ স্টিভ ওয়াহ বা রিকি পন্টিংয়ের কথাই বলতো, জন বুকাননেরটা নয়। এই সিম্পল থিওরি বুঝতে পারেন না বলেই সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে তার ব্যক্তিত্বের সংঘাত ঘটে।

হাথুরুর জন্য কয়েক লাইন:
বিসিবির আনপ্রফেশনালিজম কিংবদন্তী পর্যায়ের। সরকার বদলের সাথে সাথে বিসিবির খোলনলচেও পাল্টে গেছে বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু সংগঠন বিসিবির চরিত্র কিছু বদলায়নি। বিশেষত, কোচ নিয়ে বিসিবির নীতি পাকিস্তান বোর্ডের চাইতেও খারাপ। গত ২০ বছরে সম্মান নিয়ে চলে গেছেন কেবলমাত্র ডেভ হোয়াটমোর (তিনি অন্য দলের চাকরি নিয়েছিলেন)। গর্ডন গ্রিনিজ, এডি বারলো (তিনি অবশ্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন), ট্রেভর চ্যাপেল, আলি জিয়া-মহসিন, জেমি সিডন্স,স্টুয়ার্ট ল, শন জার্গেনসন- কারো ভাগ্যে সুন্দরভাবে বিদায় নেয়া জুটেনি। এই দলে হাথুরুকেও একদিন ঢুকে পড়তে হবে, এটা নিশ্চিত। তবু পূর্বসুরীদের থেকে তিনি কিছু শিখবেন মনে হয় না, বা শিখেও লাভ কী। বিসিবি তো একইরকম থেকে যাবে। হাথুরু খেলাটা ভালো বোঝেন, কিন্তু এটা বোঝেন না তিনি কোনো ক্রিকেট একাডেমি নয়, একটি দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বিসিবি বুঝলেই হাথুরি বুঝে যেতেন। শেষ পর্যন্ত জয়ই যদি একমাত্র টার্গেট হয়, লাল কালিতে লিখে দিতে পারি, এদেশের ক্রিকেট ১০০ বছর পরেও হাথুরুসিংহে টাইপ কোচদের খেয়ালখুশির খোরাক হয়ে থাকবে!