অনলাইন লেখালিখি, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং অন্যদের মুখে শোনার অভিজ্ঞতাসূত্রে সর্বশেষ কয়েক বছরে একটি হাইপোথিসিস তৈরি হতে দেখছি, এবং যারা এই হাইপোথিসিসের প্রবক্তা প্রায় প্রত্যেকেই প্রবল ব্যতিক্রমী মেধার প্রখর ননলিনিয়ার মানুষ। থিসিসের দৃশ্যমান স্টেটমেন্ট হলো, তারা বাচ্চাকে স্কুলে না দেয়ার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাচ্চারা যে ভোঁতা হয়ে যায় এর প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে তারা ত্রুটিপূর্ণ স্কুলিং সিস্টেমকে দায়ী করেন। তাদের মতে, বাচ্চা ঘরে বসে অনলাইন স্কুলিংয়ের মাধ্যমেই পর্যাপ্ত স্মার্ট হয়ে যাবে, ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া, ভালো কলেজ-ভার্সিটিতে এডমিশনসহ প্রভূত ইঁদুর দৌড়ে বাচ্চাকে তারা ঠেলে দেবেন না। তবে একটা ছোট্ট পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে যুক্ত করা উচিত; যারা এই থিসিস-হাইপোথিসিসের সঞ্চারক, বেশিরভাগেরই বাস্তবে সন্তান লাভের অভিজ্ঞতা হয়নি, অথবা বাচ্চার স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি এখনো। যে ধ্যান-ধারণা তারা পোষণ করছেন, সত্যিই সেটা বাস্তবায়ন করবেন কিনা দেখার জন্য হয়তো আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে, কিংবা কেউ কেউ হয়তোবা ইতিমধ্যে বাচ্চাদের বয়স ৮-৯ বছর হওয়া সত্ত্বেও ফরমাল স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত আছেন। তবু সামগ্রীক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, এই প্রবণতা কি সমর্থনযোগ্য আদৌ?

৯০% মানুষই শোনামাত্রই একে ওভার-স্মার্টনেস, আঁতলামি/পাগলামি বলে স্রেফ উড়িয়ে দেবেন। সঙ্গে দুটো বাড়তি টিপ্পনি থাকবে- ‘স্কুলে না গেলে বাচ্চার ভবিষ্যৎ কী? কিংবা, তোমার বিষয়-সম্পদ আছে, বাচ্চা স্কুলে গিয়ে কী করবে; কিন্তু আমরা যারা দিন এনে দিন খাই তাদের বাচ্চার স্কুল ছাড়া গতি নেই। এইসব ঢঙ্গী চিন্তায় জীবন চলবে না’!

যেহেতু ১০ জনে ৯ জনই বলবে স্কুল ছাড়া চলবে না, সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই প্রবণতা সমর্থনীয় নয়, কিন্তু বিরোধীতার কনটেক্সট যদি হয় বাচ্চার ভবিষ্যৎ আর বিষয়-সম্পদের প্রাচুর্যহেতু উপেক্ষা, তখন মনে হয় ওই ১০%ই আসলে সত্যিকারের সাহসী এবং গড্ডালিকা এড়ানো মানুষ।

স্কুলিং সিস্টেমের ফিলোসফি যেটাই হোক, এর ইমপ্লিমেন্টেশন এবং এক্সিকিউশনের চিত্র দেখে বিরক্তি আসে না, এমন মানুষ বিরল। কিন্তু বিরক্তিই কি আলটিমেট এক্সপ্রেশন হতে পারে? অন্তত ব্যক্তিগত আয়নার বাইরে বার্ডস আই ভিউতে যারা বিচার করতে চায়, তাদের সেনসিটিভিটি আরও পরিশীলিত হওয়ার দাবি রাখে বোধহয়। বৌধিক দায় বলেও একটা ডিভাইন রেসপনসিবিলিটি থাকে মানুষের!

ধরলাম, বাংলাদেশের ফরমাল স্কুলিং সিস্টেম মানুষকে কাঠামোবদ্ধ এবং ক্ষুদ্র বানিয়ে দেয়, কিন্তু সমগ্র বিশ্বেই কি পারফেক্ট ফরমাল স্কুলিং সিস্টেম এক্সিস্ট করে কোথাও? ১-২ পৃষ্ঠা গুগল ঘাঁটলে ফিনল্যান্ডের উদাহরণ পাওয়া যাবে, কিংবা বিকল্প হিসেবে মন্টেসরি মেথডের নামও আসবে হয়তো। কিন্তু একটু ইনটেনসিভ স্টাডি করলেই বোঝা যাবে, ফরমাল স্কুলিংয়ের পারফেক্ট কোনো সল্যূশনে কেউই পৌঁছুতে পারছে না, কোথাও একটা গ্যাপ থেকেই যাচ্ছে। ঢালাওভাবে রেফারেন্স দিয়ে নয়, একটু গভীর আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জায়গা থেকে পর্যালোচনা করতে হবে। ফরমাল স্কুলিং কনসেপ্টটাই এক্সপেরিমেন্টাল, ফলে ক্রমাগত এদিক-ওদিক করে কনসেপ্ট দাঁড় করানোর প্রয়াস চালানো হয় মাত্র, স্পেসিফিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়, এটাই আদর্শ ফরমাল এডুকেশন সিস্টেম কিনা।

বাংলাদেশ সহ অধিকাংশ উন্নয়নশীল বা পশ্চাৎপদ অর্থনীতির দেশে ফরমাল স্কুলিংয়ের ভূমিকা জীবিকার সনদ যোগানো। অতিমাত্রায় আউটপুট ওরিয়েন্টেড টার্গেট হওয়ায় এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটি নিরুপদ্রব এবং নিরাপদ জীবনের রসদ হিসেবে স্কুলিংয়ের আশ্রয়াপন্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু জীবিকার ধারণক্ষমতার তুলনায় জীবিকাপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় অস্বাভাবিক কম্পিটিটিভ নেচার ডেভেলপ করে, এবং তার প্রেক্ষিতে সমগ্র সিস্টেমটা কলাপস করে। ঢাকা শহরে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে তার পড়াশোনা চালানো- সমগ্র প্রক্রিয়াটায় যে শ্বাসরোধী প্রতিযোগিতা, তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বলগুলোতেও। প্রাইভেট টিউটর, হোমওয়ার্ক, পরীক্ষা, পজিশন- একেকটি ব্যাপার যেন স্বতন্ত্র মরণফাঁদ। এই নাগপাশ থেকে যে কোনো মননশীল মানুষই মুক্ত হতে চাইবেন, কিন্তু লোকভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। ক্লাস টু এর বাচ্চার জন্য বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট লাগবে টিউটর হিসেবে, তদুপরি স্কুলের টিচারের কাছে পড়তে হবে, নইলে নম্বর কমে যেতে পারে। ঢাকার বাইরেও চিত্রটা কম-বেশি একইরকম।

প্রশ্ন হলো, যদি নামকরা স্কুলে চান্স না পায়, পরীক্ষায় ভালো নম্বর না পায়, তাতে সমস্যা কী? সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর হলো, নামকরা স্কুলে না পড়লে মান থাকে না, এবং পরীক্ষায় খারাপ করলে ভালো ভার্সিটিতেও পড়া হবে না; জীবনের প্রাপ্তি থাকলো কী! এই উত্তরকে পাল্টা প্রশ্নে রিপ্লেস করা যায় যদি এভাবে, ভালো ভার্সিটিতে পড়ে আসলে কী হয়? এক্ষেত্রে উত্তর দুরকম, চাকরি পাওয়া তুলনামূলক সহজ হয়, এবং বিদেশে পড়তে যাওয়া সহজ হয়। ২য় দলে যারা অর্থাৎ বিদেশে পড়তে যাবে, তাদের আসলে ইন্টার পরীক্ষার পরই SAT দিয়ে দেশের বাইরে চেষ্টা করা উচিত, গ্রাজুয়েশনের পেছনে ৪-৫ বছর দেশে থাকাটা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। সেক্ষেত্রে, ভালো স্কুল-কলেজে পড়াটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কনসেপ্ট ভালো থাকা এবং এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিতে এটাচমেন্টই অনেক ভাইটাল রোল প্লে করে। তার মানে, টার্গেট করছি একটা, কিন্তু সময়-এনার্জি খরচ করছি উল্টো ট্র্যাকে। একারণেই, ইঁদুর খেলা প্রতিযোগিতায় অসফলতার হার এতো বেশি।

অন্যদিকে যারা প্রথম দলে, অর্থাৎ ভালো চাকরি পাওয়ার লক্ষ্যে অন্তহীন অ্যাবনরমাল প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন, তারাও আছেন ভুল ট্র্যাকে। তাদের ভার্সিটির চাইতে বেশি প্রয়োজন একটি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট যেখানে এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, গ্রাফিক্স এনিমেশন, কমিউনিকেশন, পাবলিক স্পিকিং প্রভৃতি স্কিলের ট্রেনিং হবে। অথচ ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভর্তি হয় একাডেমিক স্কুলে তুলনামূলক খারাপ পারফরম করা শিক্ষার্থীরা, আর ভালো ইনস্টিটিউটের ট্যাগ লাগানো শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে গিয়ে আবিষ্কার করে এতোবছর যা পড়াশোনা করেছি, কিছুই তো কাজে লাগছে না। এই গ্যাপ মিনিমাইজের দায় আসলে কার? বলতে পারেন, সিজিপিএ খারাপ হলে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলো ইন্টারভিউতেই কল করে না, স্বনামধন্য ভার্সিটি না হলেও একই অবস্থা। একটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখি; শুধু মানুষের সিভি লিখে দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছে এমন পেশাও তৈরি হয়েছে আজকাল; সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্কিলগুলো আছে এমন মানুষের সাথে কোম্পানীগুলোর ব্রিজিং করিয়ে দেয়ার মতো মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানও আগামীতে তৈরি হয়ে যাবে নিশ্চয়ই; এতো এতো নেটওয়ার্কিং প্রোগ্রাম, ইয়ুথ লিডারশিপ প্রোগ্রাম দেখলেই তো আঁচ করা যায় কেবলমাত্র একাডেমিক রেজাল্ট দিয়ে এম্বিশনের নাগাল মিলবে না। তবু নামকরা ইনস্টিটিউটে পড়তে হবে? নিজেদের সার্কেলে একটা ভাব, একটা ইমেজ লাগবে না? এছাড়া জীবনে আছে কী! অন্যের গল্পের বিষয়বস্তু হওয়ার জন্যই তো জন্মের পর থেকে প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে!

বৈষয়িক মানুষের ভাবনায় ফরমাল স্কুলিং থাকবেই; এটার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝার মতো সময়, ধৈর্য কোনোটাই তাদের নেই। যেহেতু তারাই সমাজ নিয়ন্তা, বেটার অলটারনেটিভ না আসা পর্যন্ত পঙ্গপালের ন্যায় তারা ফরমাল স্কুলিংয়ের দিকে ধেয়ে যাবেনই। তাদের এই ধাবমানতায় কিছু ব্যক্তিগত গালগপ্পের উপকরণ ব্যতিরেকে বিশেষ কিছু জুটবে না, কিন্তু বিপুলসংখ্যক মানুষের থট প্রসেসকে নাড়া দেয়া মানুষগুলো যখন একরৈখিক হতাশা বা বিরক্তি থেকে ফরমাল স্কুলিংয়ের বিপক্ষে অবস্থান নেন, মূলত তখন থেকেই শঙ্কার মেঘ বজ্রনিনাদ ঘটায়।

স্কুলবিরোধীতার সবচাইতে পপুলার কেসস্টাডি হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুল থেকে পালাতেন, এবং বিলগেটস ভার্সিটি ড্রপ আউট, এই দুইয়ের উপসংহারে, স্কুল সিস্টেম এক্সট্রাঅর্ডিনারি মানুষ তৈরি করতে পারে না- স্টেটমেন্ট হাজির করা। রবীন্দ্রনাথ, বিলগেটস সহস্র কোটিতে একজন, দুজন মানুষ, তাদের উদাহরণ দিয়ে আসলে ঠিক কোন্ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া হয়, এই মেসেজটা স্পষ্ট নয় আমার কাছে। ওয়ারেন বাফেট প্রতিদিন ৫০০ পৃষ্ঠা বই পড়েন বলেই পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হতে পেরেছেন, অতএব সাফল্যের জন্য প্রচুর পড়তে হবে, এটাই চূড়ান্ত মন্তব্য। কিন্তু যে মানুষ মাসে ইনকাম করে ১৭ হাজার টাকা, তাকে পৃথিবীর ধনাঢ্য ব্যক্তির গল্প শুনিয়ে আরও বেশি কনফিউজড করে দেয়া ছাড়া আর কোন্ কার্যসিদ্ধি হয়! তাকে বড়জোর ৪৭ হাজার ইনকাম করা মানুষের লাইফস্টাইলের গল্প শোনানো যেতে পারে। ফলে, এইসব গল্পের সাথে কেউই মেন্টালি এটাচড হতে পারে না, জীবনভর শুধু গল্পই শুনে যেতে হয়, যেন রবীন্দ্রনাথ, বিলগেটস, বা ওয়ারেন বাফেট হাঁচি দেয়ার মতোই প্রাত্যহিক ব্যাপার। এই মিসলিডিং উদাহরণগুলোই ফরমাল স্কুলিংকে আরও বেশি প্রয়োজনীয় ও অর্থবহ করে তোলে।

ফরমাল স্কুলিংয়ের সাথে আর্থ-সামাজিক ও ভৌগলিক ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের যোগসূত্র রয়েছে। শুনতে যেমনই লাগুক, মানতেই হবে ফরমাল স্কুলিংয়ের একমাত্র টার্গেট কর্মী তৈরি করা। কর্মী মিডিওক্রিটির নিয়তি, এবং বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকেই তা বরণ করে নিতে হবে, এটা স্ট্যাটিসটিকালি প্রমাণিত সত্য। যারা স্মার্ট তারা এর মধ্য থেকেই স্বকীয়তা তৈরি করে নেয়। স্মার্টনেস থাকে আত্মবিশ্বাস আর লোকভয়কে উপেক্ষা করার মানসিকতা থেকে। চাপের পাপেই ভেঙ্গে পড়ে নির্বোধ সত্তা। যদি ১৫ লক্ষ মানুষের জন্য একই এভালুয়েশন সিস্টেম ডিজাইন করা হয়, শহর-উপশহর-গ্রাম প্রভৃতি ফ্যাক্টর প্রবলভাবে বিবেচনায় রাখা না হয়, মেরুকরণ ঘটবেই, চরম প্রান্তিকতা সৃষ্টি হবেই; সেখান থেকে মিনিংফুল কিছু আশা করতে হলে নিজ দায়িত্বে আউটপুট নিয়ে আসতে হবে; সিস্টেম শুধু রেজাল্টটাই দেখাবে। একটা বাচ্চা যদি বাংলা ব্যাকরণ পরীক্ষার খাতায় লিখে শব্দ মানে কোনোকিছু দিয়ে আঘাত করলে আওয়াজ সৃষ্টি হওয়া, সেটার ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট করে শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য নিয়ে হাহুতাশ করার লোকই বেশি হবে, কিন্তু বাচ্চাটা যে নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর বোধ প্রয়োগ করে একটি বাস্তবসম্মত সিচুয়েশন ব্যাখ্যা করেছে, এজন্য ওকে এপ্রিশিয়েট করার মানুষ পাওয়া যাবে না একজনও। সমস্যাটাও এখানেই। আমরা শুধু হাসাহাসি আর উপহাসে ব্যস্ত থাকি, কনটেক্সট বোঝার তাড়না বোধ করি কম; নিজেরাও তো ওই সিস্টেমেরই বাই প্রোডাক্ট।

ফরমাল স্কুলিংকে বিরোধীতা করার ক্ষেত্রে আরেকটি বিকল্প ভাবনা হলো, অনলাইনেই এখন এতো বেশি রিসোর্স এভেইলেবল যে স্কুলের বোরিং এনভায়রনমেন্টে না গেলেও লারনিং সামান্যতম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন মাত্র শিক্ষক- এই বণ্টন কোনোভাবেই সুষম নয়, এবং সেলফ লারনিংই আসল, একাডেমিক পড়াশোনা মানুষকে সমৃদ্ধ করতে পারে না। প্রথমবার শুনলে কথাগুলো মোহনীয় লাগবে, আরেকটু ভাবলেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ চলে আসতে পারে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ফরমাল স্কুলিংয়ের প্রধান এক্সিলেন্সের জায়গা সারভাইভাল এবং সোস্যালাইজেশন, যেটা অন্য কোনো সূত্রে এতো ব্যাপকমাত্রায় অর্জন করা সম্ভব নয়। যোগ বিয়োগ, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এগুলো শেখার জন্য ইন্টারনেট আর একটা ডিভাইসই যথেষ্ট, এজন্য ১৫ বছর ধরে এতো ক্লাস, এতো কনটেন্টের পেছনে সময় দেয়ার কোনো প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু দিনের পর দিন বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড আর মানসিকতার মানুষের সাথে মেশা, মানিয়ে চলা, ভাবনার আদান-প্রদান এই বিষয়গুলো ইউটিউব শেখাতে পারবে না, হয়তোবা ‘হাউ টু গেট এডজাস্টেড উইদ পিপল অব ডিফারেন্ট মাইন্ড সেটআপ’ শিরোনামে অজস্র টিউটোরিয়াল পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা প্রয়োগের জন্য প্লাটফরম কোথায়? একটু নামকরা ইনস্টিটিউট হলে মেধার ডেনসিটি তুলনামূলক বেশি থাকে, ফলে পারসোনালিটি ডেভেলপমেন্টে কিছুটা এডভান্টেজ পাওয়া যায়, এইটুকু নামমাত্র পার্থক্য ব্যতিরেকে ইনস্টিটিউটের বিশেষ কোনো ভ্যালু নেই। মানুষের জীবনে আউটসাইডারের প্রভাব অনেক বেশি; হয়তোবা স্কুলে গিয়েই এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কারো সংস্পর্শে আসা হলো যা তার চিন্তাজগতে গভীর রেখাপাত করলো। বিপরীতটাও ঘটতে পারে। এখানেই স্মার্টনেস, সারভাইভাল ইস্যু। খারাপ সঙ্গে মিশলে খারাপ হয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় গুঁটিসুটি হয়ে থেকে ২৫ বছর বয়সে যখন ছেলেটা বা মেয়েটা কোনো প্রতিষ্ঠানের ৩য় শ্রেণীর কর্মচারীর সাথে কথা বলতে গিয়েও নার্ভাস হয়ে পড়ে, তখন তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, কারণ জীবনভর তাকে অসুন্দর/খারাপ নিয়ে ডিল করতে হবে, অথচ তার আর্লি লাইফে সেরকম প্রতিকূলতা জয়ের কোনো ইতিহাস নেই। ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে’- জাতীয় লাইনগুলো আকাশ থেকে দৈবযোগে চলে আসেনি। প্রাইভেট টিউটর আর কাজের বুয়ার হাতে সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব ছেড়ে দিলে সেই সন্তান কোনো একদিন বাবাকে খালুজান ডেকে বসবে এটাই স্বাভাবিক। এতো ব্যস্ততা, ছুটে চলার আউটকাম কী? পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুজন মানুষ, অথচ তারা একে অপরের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করবে ফেসবুক চ্যাটের মাধ্যমে; এটাই কি সেলফ এনলাইটেনমেন্ট!

ফরমাল স্কুলিংয়ের ২য় গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক হলো, সম্পর্ক তৈরি শেখানো। আমার একটা থিওরি আছে যেটা আমি বিগত ২০ বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছি, থিওরিটা খুবই সিম্পল, একজন মানুষ যদি বিভিন্ন বয়সের মাত্র ১১ জন মানুষের সাথে এমন লেভেলের সম্পর্ক তৈরি করতে পারে যেখানে কোনো যদি-কিন্তু, বিধি-বিধান, লৌকিকতা নেই, সে জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিতেই টিকে থাকবে, এবং সমস্যা টের পাবে না। কিন্তু এটা কেউ কখনো নিজের জীবনে চেষ্টাই করে না, প্রবল আত্মকেন্দ্রিক এক জীবনের মোহে মেহনত চালিয়ে যায় ভুল পথে। ১১ কেন, ৯০% মানুষ সমগ্র জীবনে ৩ জন মানুষের সাথেও তেমন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। ফরমাল স্কুলিংয়ে সেই সুযোগটা আছে।

ডিসটেন্ট লারনিংকে গ্লোবালি যেভাবে প্যাট্রোনাইজ করা হচ্ছে, তাতে আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে ফরমাল স্কুল এমনিতেই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পরিণতির ঘোর বিরোধী। অনলাইনে কনটেন্ট পেয়ে সমৃদ্ধ হওয়া যাবে, অনেক ভালো শেখাও যাবে, কিন্তু হিউম্যান ইন্টারেকশন, ইমোশন সেসব কোথায়। একই বেঞ্চে ৩ জন বসে ৩ রকম চিন্তা করা, ভারচুয়াল রিয়েলিটি কি এটা এফোর্ড করতে পারবে?

ইদানীং প্রি-স্কুলিংও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ৩ বছর বয়স হওয়ার সাথে সাথেই স্কুলের সাথে এডজাস্ট করানোর জন্য ঢুকিয়ে দেয়া, এতে নাকি বাচ্চার ডেভেলপমেন্ট ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে ৮ বছর বয়সে ফরমাল স্কুলিংয়ের পক্ষে, কারণ যথেষ্ট পারিবারিক ইন্টারেকশন ছাড়া একটা বাচ্চাকে কোনো একটা স্ট্রাকচারে ঢুকিয়ে দেয়া মানে ওর মধ্যে স্বকীয়তা তৈরির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা। একটা মিনিমাম লেভেলের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবিলিটি তৈরির জন্যও ৭-৮ বছর বয়স হওয়া উচিত। এখানেই মা-বাবার সার্থকতা। বায়োলজিকাল বাবা কিংবা মা হওয়ার জন্য খুব বেশি চ্যালেঞ্জ ফেইস করতে হয় না, কিন্তু ফিলোসফিকাল প্যারেন্টিং একটি জীবনসাধনা। সেই চর্চায় নিয়োজিত মানুষ কোটিতে কয়জন মিলবে, এই চরম বৈষয়িক এবং ইন্দ্রিয়পূর্তির যুগে!

যারা স্কুলে দিতে অনাগ্রহী, তারা বাচ্চাকে প্রথম ২০ বছরে বিল্ড আপ করার কোনো প্রসেস নিয়ে আদৌ কি কিছু ভেবেছেন? তারা তো জানেনই টেনেটুনে পাশ করা বা ২-১ সাবজেক্টে ফেল করা কোনো ব্যাপারই নয়, বরং ভালো; তাতে স্ট্রাগলিং টেন্ডেন্সি তৈরি হবে। তারা বাচ্চাকে উৎসাহিত করতে পারেন বন্ধুবাৎসল্যের দিকে, জীবনদর্শন শেখানোর ব্যাপারে। কিন্তু বাচ্চা আপনার মতো বয়স্ক মানুষের সান্নিধ্য বেশিক্ষণ পছন্দ করবে না, সমবয়সীদের সাথে তাকে মেশার সুযোগ দিতে হবে, তাহলেই কেবল বুঝতে পারবে,ওর কোথায় আগ্রহ-উৎসাহ আছে। স্কুলিংয়ের ইতিহাস মোটেই এরকম ইনস্টিটিউশনালাইজড ছিলো না, গুরুমুখী বিদ্যার গল্প এখনো বইয়ের পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। স্কুলিংকে স্কেলেবল করতে গিয়েই একে স্ট্রাকচারবন্দী করা হলো, বহু লোকের জীবিকারই মাধ্যম হয়ে গেলো এটি, অথচ তারা কখনো ভাবেওনি কতগুলো সম্ভাবনাময় মাথাকে তারা নারচার করছে; তাদের ভাবনায় বেতন, সংসার, খাতা দেখা, ক্লাস নেয়া, এইসব মোটাদাগের এলিমেন্ট। সমগ্র শিক্ষাজীবন শেষ করে ফেলার পরও তাই শ্রদ্ধা বা মনে রাখার মতো শিক্ষক খুঁজতে হয় বেশির ভাগ মানুষকে, অথচ শিক্ষকের ইমপ্যাক্টই হওয়া উচিত ছিলো তীব্রতম।

মনে রাখতে হবে, ফরমাল স্কুলিংও একটি প্রশাসন, সেখানেও আছে বিবিধ প্রটোকল আর দায়-দায়িত্ব। এই গণমুখী সিস্টেমে গণিত, ইংরেজি আছে, কিন্তু মেন্টাল হেলথ ডেভেলপমেন্টের জন্য স্পেস রাখা হয়নি, যদিও যেরকম দিন আসছে, তাতে এটা সিলেবাসে ঢুকে পড়া নিশ্চিত। ৭ হাজার টাকায় যেমন মাস চালানো যায়, ৭০ হাজারেও তা-ই; শুধু খরচের খাতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ এডজাস্টেড হয়, নাথিং এলস। জীবিকার জন্য জীবন বানাতে গিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর জীবনে আসলে জীবন ধারণাটিই এক্সিস্ট করে না। মোহের কাছে এখানেই জীবন নির্মমভাবে পরাজিত হয়। আমরা মানিব্যাগের আকার বাড়িয়ে কেবল কমোডিটির সংখ্যা বাড়িয়েছি, বিক্রি করেছি, বিক্রিত হয়েছি, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে প্রাপ্তির ভাড়ার খাঁ খাঁ করছে গ্রীষ্মের দাবদাহে। এরই মধ্যে ভিন্নধারার মননশীল মানুষেরা যদি সত্যিই ফরমাল স্কুলিং থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত পরিপুষ্টির মতো আত্মমুখী এপ্রোচ গ্রহণ করেন, পৃথিবীর বসবাসযোগ্যতা গরুর বিচুলির অভাব পূরণ করা ছাড়া ভিন্ন কোনো ভূমিকা খুঁজে পাবে না।

দৃষ্টির সীমা প্রসারিত হোক।