প্রতিটি বই লেখার শেষে আমি সাধারণত ৩-৪টি আড্ডা সেসনের আয়োজন করি। বই বিষয়ে প্রশ্ন থাকে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে আসে। প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠিকঠাক দিতে পারলে বুঝে নিই সিগনাল ক্লিয়ার, বই ছাড়া যেতে পারে। উত্তর দিতে আটকে গেলে বইতে আনি প্রয়োজনীয় সংশোধন।
সিগনেচার সরণ লেখা সমাপ্ত গত ঈদের ছুটিতেই। এরপর থেকেই সম্পাদনা চালিয়ে যাচ্ছি; একে সম্পাদনার পরিবর্তে সিজনিং বললে যথার্থ শব্দচয়ন হয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে আমার শুভাকাংখী মহলেও, বই বিষয়ে ইন্টারভিউ নিতে ইচ্ছুক কারো দেখা মেলা ভার। ইন্টারভিউ নিলেই যদি বই গছিয়ে দিই; অজানা শংকা হয়ত একটা কাজ করেই। কাউকে না পেয়ে অর্বাচীন নাঈম শেখকে হায়ার করেছিলাম হাজার টাকা পারিশ্রমিকের চুক্তিতে।
ভাড়াটে নাঈম শেখের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আলোচনা কেবল সিগনেচার সরণ এ নিবদ্ধ থাকেনি, কথা ছুটেছিল দূরগামী গন্তব্যে।
নাঈম শেখ: সিগনেচার সরণ লেখার সময় থেকেই আপনি এই বইটিকে খুব হাইলি রেট করছেন। বিষয়টা অনেকটা এমন যে পরীক্ষা এখনো শেষ হয় নি, এর আগেই আপনি লেটার গ্রেড দিয়ে দিয়েছেন। এর কারণ কী?
হিমালয়ঃ আমি যখন কোনো একটা বই লিখি, তখন সেটা রেট করার প্যারামিটার হচ্ছে- আমি নিজে সেই লেখার জার্নিটা কতোটুকু উপভোগ করছি। এবং আমার ইমাজিনেশনে আমি যা ফিল করতে চাইছি সেটা পাচ্ছি কি না। সিগনেচার সরণ লেখার ক্ষেত্রে ওই জার্নিটার ভেতর দিয়ে আমার যাওয়া হয়েছে। এবং আমার কাছে মনে হয়েছে যে প্রত্যেকটা জিনিস আমি যেইভাবে চিন্তা করছি, ঠিক ওইভাবেই ঘটছে। বইটা লেখার সময় আমি অনেক বেশি কো-ইনসিডেন্সের মুখোমুখি হয়েছি, ফলে বইটা যে লিখবো এটা বোধহয় অনেকটা নিয়তি নির্ধারিত ব্যাপার ছিলো।
কেবল দুই-একটা বই প্ল্যান করে লেখার বাইরে আমার বেশিরভাগ বই-ই হুট করে লেখা। কিন্তু সিগনেচার সরণ ওরকম হুট করে লেখা বইগুলোর মধ্যেও পড়ছে না। আমার সারা লাইফই কো-ইনসিডেন্সে ভরপুর; কাছাকাছি সময়ে এত বেশি কো-ইনসিডেন্স ঘটছিল, নিশ্চিত হচ্ছিলাম কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ চাচ্ছে বইটা লিখি। এটা আমার জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা। বই লিখতে গেলে এখন আর উচ্ছ্বাস কাজ করে না। এটাও একটা ৯টা-৫টা চাকরির মতোই। কিন্তু এবার প্রথম থেকেই একটা সাজ সাজ রব। আমি সেইসব অদৃশ্য ইক্যুয়েশন বা পাজলগুলো ধরতে পারি। বইটাকে যদি অনেক বেশি রেট করে থাকি সেটা নিয়তিবাদের ফসল, আমি নিজে এখানে নিছক পারটিসিপ্যান্ট। এটি ইথিক্সের বিভিন্ন লেয়ার নিয়ে লেখা একটি ফিকশনাল নন-ফিকশন, কিন্তু ইথিক্স তো আদতে একটি কন্ট্রোভার্সিয়াল ব্যাপার। তাই পাঠকের জায়গা থেকে সিগনেচার সরণ কেমন হবে জানি না। পাঠক বলা ঠিক হবে না, ভোক্তাই বলি।
নাঈম শেখ: ইতোমধ্যে বহুবার দাবি করেছেন আপনি বই লিখেন মেমোরি ক্রিয়েশন এবং সংরক্ষণের জন্য। সিগনেচার সরণ লেখার উদ্দেশ্যও কি সেটিই ছিলো, নাকি এখানে অন্য কোনো ফ্যাক্টর ভূমিকা রেখেছে?
হিমালয়ঃ সিগনেচার সরণ লেখার উদ্দেশ্য যদি বলো – তুমি তো জানো আমার লাইফে পুরুষ এবং নারী মিলিয়ে প্রচুর ক্যারেক্টারের সাথে ওঠা-বসা হয়। ধরো একটা ফিল্ম যখন বানানো হয়, তখন কিন্তু অসংখ্য ক্যারেক্টারের অডিশন নিয়ে এজনকে ফেস হিসেবে বাছাই করা হয়। ফেস হয়ে উঠা একটা পরম্পরা; সবাই ঝরে পড়বে, একজনই পাবে ইয়েস কার্ড। আমিও এরকম একটি ক্যারেক্টার নিয়ে অনেক বছর ধরেই চিন্তা করছিলাম, বিশেষ করে যখন হারমান হেস এর ‘সিদ্ধার্থ’ বা ফ্রেডরিক নীৎশে’র ‘জরাথুস্ত্র বললেন’ পড়লাম, তখন থেকেই আমার মনে হলো আমি একটা ক্যারেক্টার তৈরী করি, যে ক্যারেক্টারটা নিয়ে আসলে কিছু একটা করা যায়, বা যেটিকে মূলত ম্যাগনাম ওপাস বলে- যা একজন রাইটারের সেরা কাজ। তো ওইরকম একটি ক্যারেক্টার তৈরী করার জন্য আমি অসংখ্য ক্যারেক্টার নিয়ে চিন্তা করেছি, অসংখ্য ক্যারেক্টারের সাথে মিশেছি, তাদের সাথে ইমোশনালি ইনভলভ হয়েছি, নিজে ইভলভড হয়েছি- কিন্তু ক্যারেক্টারগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আমার স্পার্কটা আর ধরে রাখতে পারে নাই।
সিগনেচার সরণ লেখার ক্ষেত্রে আমি দৈবযোগে যেই ক্যারেক্টারটি পেয়ে গেলাম তার সাথে আমার যে খুব বেশি ইন্টারেকশান হয়েছে বিষয়টি এমন নয়, কিন্তু ক্যারেক্টারটির প্রতি আমার স্পার্ক তৈরী হয়েছে অনেক বেশি। তাই এখানে মেমোরি রিক্রিয়েশন বা আর্কাইভিং এর চাইতেও নিজেকে পুনরাবিষ্কারের বিষয়টিকে বেশি জোরদার বলা যায়। সেজন্যে অন্যান্য বই লেখার ক্ষেত্রে যে এজেন্ডা, সেটা ‘সিগনেচার সরণ’ লেখার ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রকট ছিলো এমন নয়।
নাঈম শেখ: তাহলে ‘সিগনেচার সরণ’ বইয়ে আপনি নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু একইসাথে আপনি বলছেন এটি একটি ইথিক্সের বই, বইটি অনেকভাবেই মডার্ন ইথিক্সকে এক্সপ্লোর করেছে। এখানে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ইথিক্সের বই বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?
হিমালয়ঃ এই বইটির প্রথম পনেরো হাজার শব্দ নিয়ে আমি একটা পিডিএফ ফাইল তৈরী করেছিলাম, এরপর সেই কপিটি কয়েকজন বিটা রিডারকে পাঠাই-ও। আরবান এলিট শ্রেণির প্রতিনিধি সাফির আবদুল্লাহ সেই পিডিএফটি ফিডব্যাক দেয়, “আমার মনে হয় আপনি একজন ভিন্ন মানুষ, এবং আপনার একটা ভিন্ন অভিধান আছে। ফলে ওই অভিধানের শব্দগুলোও আলাদা। দেখা গেলো আপনি পপুলিজম বলতে যা মিন করছেন এবং একাডেমিক অর্থে পপুলিজম বলতে যা বোঝায়, দু’টি পুরোপুরি এক বিষয় নয়।” আমার ক্যারেক্টারগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত পাপড়ি। কাছাকাছি কথা সেও বলেছিল গত ঈদের সময়। দুজনের কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, ইথিক্স বলতে আমি এখানে যা বুঝাতে চাইছি তা একাডেমিক বা সোশ্যাল মাপকাঠিতে ইথিক্স বলতে যা বোঝায়, তার থেকে ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক বাস্তব।
মানে বিষয়টা হচ্ছে, আমি যা ফিল করছি সেটিকে যথাযথ শব্দে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমার যে শব্দচয়ন, তাতে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে আমার যে লেন্স তাতে হয়তো ঘোড়াকে জিরাফ হিসেবে দেখছি, বা বাঘকে দেখছি জেব্রা হিসেবে। কিংবা লেন্সের এই পার্থক্যের কারণে আমি হয়তো বলছি একটা, কিন্তু পাবলিক পারসেপশনে বিষয়টিকে মনে হচ্ছে ভিন্ন। তাই আমি ঠিক শিওর না যে চলতি অর্থে ইথিক্স বলতে যা বোঝায় আমি ঠিক সেটা নিয়েই কাজ করেছি কি না। আমার কাছে যেটি মনে হয়েছে: মানুষের চলমান জীবনধারণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকেই বিভিন্নরকম ইন্টারেকশান এবং ডিসিশান মেকিং প্রসেসের ভেতর দিয়ে যায় এবং এতে অনেকেরই বিভিন্ন স্খলন হয় কিংবা অনেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারে- এইসব কারণে মানুষের সাথে আমি রুবিক’স কিউবের মিল পাই। রুবিক’স কিউব একটা সাধারণ বস্তু তবু এটারই এতো লেয়ার, এটা মিলাতে গিয়েই আমরা হিমশিম খাই, সেখানে এতো বড় মানুষ— তার অভ্যন্তরীণ লেয়ার সংখ্যা রুবিক্স কিউবের চাইতেই বেশি হওয়া কি সঙ্গত নয়?
কিন্তু আমরা ধরো ফিল্মে বা বইতে যে ধরণের ক্যারেক্টারগুলো দেখি, এদের ম্যাক্সিমামেরই এক-দুই লেয়ারের পরে আর কোনো লেয়ার নেই। তুমি যতো ক্যারেক্টার দেখবে, এদের মধ্যে তুমি সর্বোচ্চ দুই-তিনটা লেয়ার খুঁজে পাবে। কিন্তু আমি ইথিক্সের লেয়ার খোঁজার জন্যে একটা ক্যারেক্টারের যে পরিমাণ গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, এটার সাথে তুমি কিউবের লেয়ার মিলানো খেলার মিল খুঁজে পেতে পারো। চেষ্টা করেছি সেই লেয়ার মিলানোর খেলাটিকেই একটি ইথিক্যাল পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখতে। এদিক থেকে ‘সিগনেচার সরণ’ একটি ইথিক্সের বই।
কিন্তু ইথিক্স বলতেই আমরা যেমন বুঝে নেই কোনো বিষয় ভালো কি মন্দ এই বিষয়ক সদুপদেশ। তবে তোমার জ্ঞাতার্থে বলি এটি কোনো নীতিকথার বই না, বা ঈশপের গল্পও না। এমনকি চাইলে তুমি একে রোমান্টিক ফিকশনাল নন-ফিকশনও ধরতে পারো, যদিও সমগ্র বিষয়টিই ইথিক্যাল ডিলেমার সাথে ইথিক্যাল ট্র্যানজিশন বা ট্রান্সফর্মশনের নেগোশিয়েসন। ইথিক্স না বলে আমরা যদি লেয়ার্ড ইথিক্স শব্দটা ব্যবহার করি তাহলে হয়তো বিষয়টা অধিক এপ্রোপ্রিয়েট হবে।
নাঈম শেখ: ‘সিগনেচার সরণ’ বই থেকে একটি লাইন আপনি খুব ঘন ঘন কোট করছেন, সেটি হলো- “একুশ শতকের মানুষের প্রধাণ ষড়রিপু হচ্ছে এনডোর্সমেন্ট।” এই কথাটির মানে কী?
হিমালয়ঃ মানুষের যে ষড়রিপু- কাম, ক্রোধ, মোহ, মাৎসর্য এবং আরো যে দু’টি রিপু আছে, আমার কাছে মনে হয়েছে এগুলো দিয়ে একুশ শতকের মানুষের ট্র্যাপকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এজন্যে এই রিপুগুলোর রিব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। আমরা যেহেতু অনেক বেশি ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট একটি সোসাইটিতে এখন বাস করছি, সামনে যেটি আরো প্রবল হবে, সেহেতু মানুষের জীবনের প্রধাণ লক্ষ্যও এখন পালটে গেছে। মানুষ এখন এচিভমেন্ট এবং এক্সপোজারকে জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। যেজন্যে মানুষের যতো রকমের এক্টিভিটি এবং এফোর্ট আছে, সেসব কিছুতে এখন ইথিক্যাল-আনইথিক্যাল দ্বন্দ্ব বা জিনিসটা সে ডিজার্ভ করে নাকি করে না এসব কিছু আর বিবেচনায় আসছে না, বরং মানুষের ভাবনা এখন আটক আছে ‘সে পেলে আমি কেন নয়’ ভাবনায়।
এনডোর্সমেন্ট বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? এনডোর্সমেন্ট বলতে আমরা বুঝি কোনো কিছুর এম্ব্যাসেডর হওয়া। আমাদের সময়ে এসে আমরা কী দেখছি এখন? আমাদের কাজগুলোকে আমরা যতোটা না own করি তার চাইতে অনেক বেশি অন্যেরা সেটাকে জানছে কি না বা সেটাকে এপ্রিশিয়েট করছে কি না এই ব্যাপারগুলো মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি কতোটা ভালো আছি এর থেকে এখন অনেক বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট হচ্ছে আমি ভালো আছি এটা অন্যেরা জানতে পারলো কি না। এই সবকিছু মিলিয়ে যেই ইক্যুয়েশন, সেটিকেই আমি এনডোর্সমেন্ট বলার চেষ্টা করেছি। ব্যাপারটি এত লিনিয়ার না, আরো লেয়ার আছে। এজন্যই সারাফান সাহুরাকে আমাদের স্টাডি করতে হবে।
নাঈম শেখ: ইন্টারেস্টিং ফাইন্ডিংস। তো, সেদিন আপনি বলছিলেন বইটি লিখে শেষ করার পর যখন আপনি সম্পাদনার কাজ শুরু করেন, তখন বইয়ের কাঠামোতে পুরোপুরি বদল ঘটে। এখানে আমার যেটি জানার, তা হলো- সম্পাদনার আগে এবং পরে, ‘সিগনেচার সরণ’ বইটিতে ঠিক কী কী পরিবর্তন এসেছে?
হিমালয়ঃ প্রথমে আমি বইটিতে কোনো যোগসূত্র রাখার চেষ্টা করি নি, স্বতন্ত্র কতোগুলো আর্টিকেলের সমষ্টি হিসেবে শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিটা রিডারদের ফিডব্যাক পেয়ে আমার মনে হলো বইটিতে ক্যারেক্টারের চেয়ে ন্যারেটরের কীর্তন বেশি হয়ে যাচ্ছে। এটি অনেক বড় একটি গঠনগত ত্রুটি ছিলো। কিন্তু এখন আমি যেটা করেছি, ন্যারেটরকে অনেক বেশি সাপ্রেসড করে ক্যারেক্টারগুলোকে ডমিনেন্ট হিসেবে রূপ দিয়েছি।
দ্বিতীয় যে পরিবর্তন সেটি হচ্ছে, বইটির মধ্যে প্রথমে কোনো ক্রনোলজিক্যাল সিক্যুয়েন্স ছিলো না। কিন্তু পরবর্তীতে বইটিকে আমি ছয়টি চ্যাপ্টারে ভাগ করি। যেমন ধরো ইথিক্সের বিষয়ে আমার যে প্রস্তাবিত মডেল, এই প্রস্তাবিত মডেলে ছয়টি বিষয় রেখেছি। এর একটি হলো দ্বৈবচয়ন, মানে দ্বৈবচয়ন কাঠামো।
ধরো, তুমি ময়মনসিংহে জন্ম না নিয়ে যদি মানিকগঞ্জে জন্ম নিতে, বা তোমার জন্ম এখনকার ফ্যামিলিতে না হয়ে যদি ঢাকার একটি ফ্যামিলিতে হতো, তাহলে তোমার এখনকার যে চিন্তা-ভাবনা তা হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো। বা ধরো, ‘মানুষ’ শব্দটা বললে সুনির্দিষ্ট কোনো ইমেজ আমাদের চোখে আসে না, আমি দেখলাম যে মানুষ শব্দটা শোনার পর মিনিমাম পনেরো বা ষোলটা প্যারামিটার, যেমন- বয়স, ওজন, উচ্চতা, লিঙ্গ, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি স্থাপন করার পর নির্দিষ্ট মানুষটিকে আইডেন্টিফাই করা যায়। তো এতোকিছুর পারমুটেশন কম্বিনেশন করে যখন একজন মানুষকে নিয়ে কথা বলবে তার বেশিরভাগই তো রেন্ডম সিলেকশন। তাই না? এখন যে বিষয়টি র্যান্ডম সিলেকশন, সেই বিষয়ে তোমার তেমন কোনো ব্যর্থতা নেই বা ক্রেডিটও নেই। সম্পূর্ণটাই একটা র্যান্ডম ঘটনা। এই দ্বৈবচয়নের জায়গা থেকেই আমি বিভিন্ন বিষয়কে দেখার চেষ্টা করেছি।
এরপরের যে চ্যাপ্টার সেটির নাম হলো পুণঃনির্মান। পুণঃনির্মান শব্দটির মাধ্যমে জানতে চাইছি পুননির্মান আদৌ ফিজিবল কি না বা এর আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে কি না । এই চ্যাপ্টারের ছয়টা সাব-চ্যাপ্টার আছে।
পরের চ্যাপ্টারটির নাম বিনির্মান। বিনির্মান বলতে কী বুঝি? ধরো, টেবিল বললে আমাদের মাথায় আসে গোলাকৃতি বা চতুর্ভুজ। অর্থাৎ মানুষ খুব সহজেই একটা আকৃতির প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু চতুর্ভুজ কোনো কিছু মানেই কি টেবিল? বা ধরো টেবিলকে আমি যদি এখন অন্য কোনো একটা শেপে বানাই তাহলে কি সেটা টেবিল থাকবে নাকি অন্য একটা কিছুতে পরিণত হবে? মানুষের এই বিশ্বাস বা আচার আচরণে যে পরিবর্তন আনা যায়, যেটাকে বলে ডিকনস্ট্রাক্ট, আমি এখানে সেটি নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি।
এরপরে একটা চ্যাপ্টার আছে যেটার নাম ব্যবধান বা পার্থক্য। ধরো তোমার সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে বা কমিউনিকশনে যে গ্যাপ, বা আরেকজনের সাথে যে গ্যাপ, সেই গ্যাপটা আমাদের ইথিক্যাল পয়েন্টে কীভাবে প্রভাব ফেলে তা আমি এখানে দেখাতে চেয়েছি।
এরপরের চ্যাপ্টার অর্থাৎ ফিফথ চ্যাপ্টারের মূল বক্তব্য হচ্ছে তোমার যেটা অপ্রিয়, যে জিনিসটাকে তুমি একসেপ্ট করতে পারো না সেটা তোমার ইথিক্যাল ডিলেমায় কী ধরণের ক্রাইসিস তৈরী করে।
আর শেষ যে চ্যাপ্টার, সেটিতে গ্যালিলিও’র যে পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, অর্থাৎ বাতাসের বাধা না থাকলে ভারী বস্তু আর হালকা বস্তু একই সময়ে নিচে পড়বে, এই সূত্রটিকে আমি মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ মানুষের বাঁধাগুলোকে যদি উপেক্ষা করা যায়, যেটি মূলতঃ সামাজিকতার বাঁধা, সেক্ষেত্রে মানুষের ইথিক্সটা আসলে কোন জায়গায় থাকবে।
নাঈম শেখ: ‘সিগনেচার সরণ’ বইটিতে একটি ক্যারেক্টার আছে, ক্যারেক্টারটির নাম শিপঠ, যেটি কী না একটি মহিষ। এরকম ফিকশনাল নন-ফিকশন বইয়ে এই মহিষের ক্যারেক্টারটি কোত্থেকে আসলো?
হিমালয়ঃ মহিষের প্রতি আমার দীর্ঘদিনের একটা ভালোবাসা কাজ করে। আমার কিছু পছন্দের প্রাণী আছে। যেমন আমার সবথেকে পছন্দের প্রাণী হলো দাঁড় কাক, আমার অনেক বইতে তুমি দাঁড় কাক পাবে। পিঁপড়াও পাবে। ঘোড়া-জেব্রাও অনেক জায়গায় পাবে। তারপর ধরো জিরাফ, এই বইতে জিরাফের উল্লেখ কিন্তু অনেকবার এসেছে। যেমন প্রোটাগনিস্ট যে সারাফান সাহুরা, সে মানুষকে পছন্দ করে না। মানুষের সাথে গল্প করার চাইতে সে চিড়িয়াখানায় গিয়ে জিরাফের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে। আমি প্রায়ই দেখি যে সারাফান সাহুরা বসে আছে আর তাকে চারপাশে ঘিরে আছে জিরাফ, তারপর ধরো সে বাসায় বসে আছে আর তার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে অগণিত জিরাফ, আস্তে আস্তে হাজার হাজার জিরাফ এসে তাকে আটকে ফেলেছে যে কারণে সে বাসা থেকে বের হতে পারছে না।
বেসিক্যালি প্রাণীগুলোর মেটাফরিক্যাল ইন্টারপ্রেটেশন আছে, কিন্তু সেগুলো আমি বলতে চাই না। তাহলে সেটা সংজ্ঞায়ন হয়ে যাবে, ভিন্নার্থের সুযোগ হয়ে পড়বে সংকুচিত।
নাঈম শেখ: এই বইয়ের অন্য চরিত্রগুলোর বিষয়েও যদি পাঠককে কিছু ধারণা দিয়ে রাখেন।
হিমালয়ঃ এটি যেহেতু একটি ফিকশনাল নন-ফিকশন সেহেতু ক্যারেক্টারগুলো এখানে এসেছে কোনো একটা থিওরিকে এস্ট্যাবলিশড করার প্রয়োজনে, ক্যারেক্টারগুলো ঠিক ক্যারেক্টারের প্রয়োজন থেকে আসে নাই। এজন্যে নানা ধরণের ক্যারেক্টারই এই বইয়ে আছে। তবে আমি একটা হাইপোথিসিস প্রস্তাব করেছি। তুমি চাইলে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারো।
ধরো একটা মানুষকে যদি আমি রুবিক’স কিউব ধরি, তাহলে তার লেয়ার ধরতে হলে আমাকে ছয়জন মানুষ বাছাই করতে হবে, যে ছয়জন মানুষ তার সম্বন্ধে জানে- অল্প হোক বা বেশি হোক কিন্তু জানে । সেই ছয়জন মানুষ আবার একে অপরের অপরিচিত।
আমি যদি ওই ছয়জন মানুষকে নিয়ে অ্যানালাইসিস করি, তাহলে যেই পার্টিকুলার মানুষটির কথা বললাম তার সম্পর্কে আমি যদি খুব একটা না-ও জানি বা তার সাথে আমার ইন্টারেকশান যদি না-ও হয়, তাও আমি ওই মানুষটির লেয়ার মিলিয়ে ফেলতে পারবো। সারাফান সাহুরার ক্যারেক্টারের লেয়ার মেলাতে এই থিসিসট সহায়তা করেছে।
নাঈম শেখ: আপনার অন্যান্য বইতে মানুষের আগ্রহ যেরকম থাকে, আগের বইটিতেই যেমন প্রি-অর্ডারের সংখ্যা প্রায় একশো ছুঁইছুঁই ছিলো, সেই তুলনায় এই বইটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম কেনো?
হিমালয়ঃ এটার কারণ হতে পারে দু’টি। যেহেতু আমি বলেছি ‘সিগনেচার সরণ’ একটি ইথিক্সের বই তখন হয়তো মানুষ ধারণা করেছে যে এই বইটিতে অনেক বেশি নীতি কথা থাকবে। ইথিক্স একটি কন্ট্রোভার্সিয়াল বিষয়। ফলে মানুষ মনে করতে পারে যে এতো নীতি কথা শোনার আমার দরকার নেই, আমি নিজেই এইসব অনেক ভালো বুঝি। টপিকটা ইন্টারেস্টিং না।
আর, আমার অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন বইয়ের বিষয়ে অনেক কিছু বলি এই বইয়ের বেলায় তেমন হয়নি। আমি হয়তো কিছু কিছু লেখা লিখেছি বইটির বিষয়ে কিন্তু তাতেও কোনো কিছুই খোলাসা হয় নি, ফলে মানুষের মধ্যেও কোনো পারসেপশন তৈরী হয়নি বইটির সম্পর্কে। এটিও একটি কারণ হতে পারে।
ধরো অনেকেই বলবে ইথিক্সকে কে ডিফাইন করবে? আমি যেটাকে ইথিক্স বলছি আরেকজনের কাছে সেটা ইথিক্স না-ও মনে হতে পারে। মডার্নিটির এটাই হচ্ছে সমস্যা, সবাই এখন মিষ্টি বিতরণ কর্মসূচিতে ব্যস্ত। আমার যদি রিয়েল লাইফে আরো কিছু এনগেজমেন্ট থাকতো তাহলে হয়তো চিত্রটা অন্যরকম হত।
আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে যে বন্যা, সীতাকুন্ড দুর্ঘটনা, রাশিয়ার যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি সবকিছু মিলিয়ে সময়টাও অত্যন্ত খারাপ। আমি আমার বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখেছি যে চালের দাম বেড়ে গেছে, ডালের দাম বেড়ে গেছে, এই সময়ে মানুষ বিদ্যুৎ বিলের টাকাই দিতে পারছে না সে বই কীভাবে কিনবে। বই তো মানুষের কোনো জীবন-মরণ সমস্যা না। এরকম সময়ে যেই ব্যক্তি বই লিখতে পারে তাকে আসলে ননসেন্স হিসেবে একঘরে করা উচিৎ।
নাঈম শেখ: আপনার প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পীই আলাদা আলাদা, ‘সিগনেচার সরণ’ এর প্রচ্ছদ কার করা?
হিমালয়ঃ এই বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী ইথিক্যালি আমি নিজে (হাসি), আর যদি টেকনিক্যালি বলো তাহলে এই বইয়ের কোনো একক প্রচ্ছদশিল্পী নেই। তবে পুরো প্রচ্ছদের একজন CEO আছে। কারণ আমার কোনো বইয়ের প্রচ্ছদের বেলাতেই কনসেপ্ট এ ইনপুট দিই না, কিন্তু এই বইয়ের প্রচ্ছদের কনসেপ্ট আমি নিজে ঠিক করেছি। একজন মাস্ক পরিহিত নারী, দাঁড়িয়ে আছে সাদা দেয়ালের সামনে। সমগ্র দেয়ালটাই ঢাকা পড়েছে একটা পোস্টারে, যেখানে চা পানরত এক নারী, পাশে লেখা S for Solitude!
এই কনসেপ্টটা আমি মহুয়াকে বুঝিয়ে দিলাম। মহুয়ার মা আমার চাচাতো বোন। বয়স অল্প হলেও অ্যারোগেন্স আর উউট সেন্স দুর্দান্ত; ত্রিশালে পড়ে।
তো ওকে বললাম যে তুই এই কাজটা উঠায়ে দে। ও এক ফ্রেন্ডকে বললো, ওই ফ্রেন্ড অনেকদিন ঘুরানোর পরে পরীক্ষায় ফেল-টেল করে কী অবস্থা, পরে গায়েব। এরপরে চারুকলার একজনকে হায়ার করলো নগদ অর্থ দিয়ে, কিন্তু সেই কাজ এতোই বাজে হলো যে ও বললো মামা ড্রয়িংটা দেখার পরে যে আমি কেরোসিন খেয়ে মরে যাইনি এটা ভেবেই খারাপ লাগছে।
এরপর আরো একজন আসলো, কিন্তু দেখা গেলো যে সে যেসকল ক্যারেক্টার এঁকেছে সব বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে, এদিকে আমার ক্যারেক্টারের বয়স ৪০+। তো আমি যা চাচ্ছি তা তো হচ্ছে না।
মহুয়াকে বলেছি তোর হাতে সারা বাংলাদেশের রিসোর্স ছিল, ছিল না বাজেটের সীমাবদ্ধতা, তবু এক্সপ্লোরিং মানসিকতার অভাবে ঝুলে আছিস জামরুল গাছের মগডালে। তোকে শাবানার ফ্যাক্টরিতে নিষ্প্রাণ সেলাই মেশিনের চরিত্রে কাস্ট করা উচিত ছিল। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, দেখা যাক CEO ভাগ্নী শেষ পর্যন্ত কোন আউটপুট উপহার দেয়।
নাঈম শেখ: গ্যাপশেডিং প্রকাশ পাওয়া উপলক্ষে বুয়েটে যেই চা উৎসব হওয়ার কথা ছিলো সেটি তো ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিলো নানান ব্যস্ততা এবং জটিলতায়। ‘সিগনেচার সরণ’ এর প্রকাশনা উৎসব নিয়ে আপনার চিন্তা-ভাবনা কী?
হিমালয়ঃ হ্যা, ‘সিগনেচার সরণ’ নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা আছে। তবে এটা নিজে করতে চাই না, আমি চাই আমার কয়েকজন অনুরাগী মিলে একটা প্ল্যান বানাক। সেই প্ল্যানের সাথে আমি না হয় কিছু সংযুক্ত করলাম। খরচ নাহয় আমিই দিলাম, কিন্তু নিজেই প্ল্যান করাটা কেমন যেন নিজের বিয়েতে নিজেই খাজিন্দারি করা, গেট ধরার মতো লাগছে।
নাঈম শেখ: সারাফান সাহুরা কি দাওয়াত পাবেন অনুষ্ঠানে?
হিমালয়: তুমি যদি বরিশাল তালুকদার চর থেকে শিপঠ নামের মহিষ আর আমেরিকা থেকে সঞ্চিতা দে কে নিয়ে আসতে পারো অনুষ্ঠানে, তখন নাহয় করো প্রশ্নটা। তুমি বা তোমরা মাত্র এক লেয়ারে চিন্তা কর বেশিরভাগ সময়; লেয়ারসংখ্যা বাড়াও হে অর্বাচীন নাঈম শেখ। দেখ টি২০ দল থেকে কিন্তু অলরেডি তোমার মিতা বাদ পড়ে গেছে।