বই পড়া উচিত নানা কারণেই। যদি পড়ার ধৈর্য না থাকে, প্রতিনিয়ত ভ্রমণ করা যেতে পারে বিকল্প হিসেবে৷ তাতেও নিজের মধ্যে তৈরি হবে দ্বান্দ্বিকতা, নিজেকে পুননির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জাগবে
কিন্তু ৩৫ এর আগে কোনোপ্রকার সেল্ফ হেল্প বই পড়া, আমি বলবো এর চাইতে বই না পড়া অধিক মিনিংফুল!
সেল্ফ হেল্প বইতে সুনির্দিষ্ট লেখকেরই হেল্প হয়, অপরিণত বয়সের পাঠকের জন্য পঙ্গুত্বের লক্ষণ।
কোনো কিছুকে এনালাইসিস, বোঝা বা গভীরভাবে উপলব্ধির সক্ষমতা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে৷
যদি বলেন সবার কেন উপলব্ধির ক্ষমতা থাকতে হবেই, পালটা প্রশ্ন করা যেতেই পারে মস্তকবিহীন মানুষ কেন দেখা গেল না এত বছরেও?
কেন সেল্ফ হেল্প ঘরানার বইতে ৩৫+ ট্যাগিংয়ের প্রস্তাব করছি, সংক্ষেপে বলি৷
বয়স বাড়লে মানুষের মনোযোগ কমতে থাকে, অর্থ উপার্জন এবং সম্পদ আহরণের দায়িত্ব বাড়ে, জীবনবোধে আসে বৃহৎ এবং ব্যাপক পরিবর্তন, তার জন্য সেল্ফ হেল্প বই এলার্ম ঘড়ির কাজ করে৷ ভাবনার স্কুলিং তার হয়ে গেছে, তার দরকার কেবল রেগুলারিটি মেনে চলা। সেজন্য কিছু টোটকার সংকলন যদি পাওয়া যায়, তার সিস্টেম লস কমে।
কিন্তু কলেজ বা ভার্সিটি পড়ুয়া, যার উদ্দীপনা অফুরন্ত, সে কেন সেল্ফ হেল্প বই কিনবে?
একটামাত্র লাইন দিয়ে ২ হাজার লাইন বুঝবার যে মেটাফরিকাল দক্ষতা, তা অর্জনের হৃদয় নিংড়ানো সাধনা সে করবে কীভাবে যদি ফিকশন বা ননফিকশন পড়ার অভ্যস্ততা না থাকে?
বছরে ৫০ না হোক, ১৫টা ফিকশন-ননফিকশনও যদি না পড়া থাকে প্রথম ২৫-৩০ বয়সে সে তো কেরানি বা প্রশাসক হিসেবেও আহামরি পারফরম্যান্স দেখাতে ডাহা ফেইল মারবে৷
অপরিণত বয়সে সেল্ফ হেল্প বই সবটাই চোরাবালি।
বিশ্বজুড়েই সেল্ফ হেল্প বইয়ের স্বতন্ত্র মার্কেট তৈরি হয়ে আছে, যদিও এই মার্কেটের বয়স ১৫০ বছরেরও কম। ফিকশন-ননফিকশনের সাপেক্ষে সময়টা অতি নগণ্য।
তবু বিশ্বজুড়ে উগ্র ডানপন্থীতার ব্যাপক বিস্ফোরণে গণমানুষ আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তাকে ১ নম্বর চাহিদা ধরে আশ্রয় খুঁজছে পানি পড়া আর তাবিজ-কবজের আড়ালে, তারই পরিশীলিত রূপ সেল্ফ-হেল্প নামের আধুনিক মাজার ব্যবস্থা!
The Outlier,
Rich Dad Poor Dad,
Power of Habits,
Think and Grow Rich
Thinking, fast and slow
বহুল পঠিত এসব সেল্ফ হেল্প বই পড়ে জীবন সম্বন্ধে ভ্রান্তি আরো বাড়ে। চিন্তা, কর্ম বা সিদ্ধান্তকে ফরমুলাবদ্ধ মনে হয়৷ জীবনের অনিশ্চয়তা, ভাগ্য, যোগাযোগ, ইচ্ছাশক্তি, ভিশনের তীব্রতাগুলো টের পাওয়া যায় না।
একটা ক্রিটিকাল প্রশ্ন করি।
৫০টি সফলতার কেইস এনালাইসিস করে আরোপিত কিছু প্যাটার্ন পাওয়া যেতেই পারে, সেই প্যাটার্ন অনুসরণ করে কি ৫১ তম সফলতার পুনরোৎপাদন সম্ভব?
কিংবা একটা ঘটনাকে প্রাথমিক পর্যায়েই কি অনুমান করা যায় সেটা সফলতার উদাহরণ হবে কিনা?
যদি আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলি, লেভেল অনুসারে সফলতা বা প্রোডাক্টিভিটিকে যদি শ্রেণিকরণ করি ঈষৎ-মধ্যম- বৃহৎ, এরকম ১ হাজার সফল ব্যক্তির স্যাম্পল নিলে তাদের মধ্যে কতজন সেল্ফ হেল্প বই পড়েছিল কাজের পূর্বে?
আপনি সকালে হাঁটছেন অথবা গাড়িতে বসে আছেন, এয়ারফোন কানে গুজে অডিওবুক হিসেবে সেল্ফ হেল্প বই শুনতেই পারেন। পড়বেন কেন?
মানুষ মূল্যবান হয় উপলব্ধিতে, প্রশ্নে, অন্তর্দৃষ্টিতে৷ মুখস্থবিদ্যায় নয়।
ফিকশন যত ফালতুই লাগুক, সেখানে লেখকের আইডিয়া এবং ফিলোসফি থাকে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবনা পাওয়া যায়।
ননফিকশন যতই রাবিশ লিখুক, লেখক নিদেনপক্ষে আর্গুমেন্ট এবং হাইপোথিসিস নিয়ে ডিল করেন।
ফলে ফিকশন বা ননফিকশন পড়ার মধ্য দিয়ে অবচেতনেই আপনার মধ্যে দ্বান্দ্বিকতা তৈরি হয়, আপনি প্রশ্ন করতে শিখেন।
প্রাথমিক পর্যায় পেরুলে আপনি হবেন আরো সিলেক্টিভ।
কোনো সুনির্দিষ্ট লেখককে আপনার পছন্দ হতেই পারে। তবে তার লেখা ৩টা বই পড়া শেষে যদি তার আইডিয়া বা আর্গুমেন্টকে প্রশ্ন করতে না পারেন বা কেবল মুগ্ধতার উদ্দেশ্যেই পড়ে যান, উপলব্ধি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে।
সুতরাং এই ধাপে আপনি আরো বেশি সংখ্যক লেখককে অন্তর্ভুক্ত করুন।
সেল্ফ হেল্প আপনাকে শোনাবে প্রচুর ব্যর্থতা আর হতাশার গল্প, সবকিছুর শেষ পরিণতি সাফল্য৷ কিন্তু মানুষের জীবন একরৈখিকতায় চলে না। সাফল্য না পেলেই জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। আবার সাফল্যের প্রক্রিয়ায় যেসব সমঝোতা বা এক্সপ্লোয়টেশনের ডার্কনেস থাকে, সেল্ফ হেল্প বইতে সেসব স্ট্র্যাটেজিকাল আলাপগুলোও খুঁজে পাবেন না।
ফিকশন বা ননফিকশনে আগ্রহ পান না, সুনির্দিষ্ট টেকনিকাল বই পড়ুন। গণিত-অর্থনীতি-পদার্থবিজ্ঞান-প্রোগ্রামিং-ভাষা শিক্ষা সহ বহু বিষয়ের বই রয়েছে। একই বিষয়ে ৩০টা বই পড়ে ফেললে টেকনিকাল বইগুলোকেও আর কাঠখোট্টা মনে হবে না, তার মধ্যেও সৌন্দর্য খুঁজে পাবেন। তবে সেগুলো অবশ্যই গণিতের মার্কো পোলো বা ঘরে বসে ইংরেজি শিখুন ধরনের লেকচার শিট নয়।
বাংলাদেশের পঠন প্রক্রিয়া একটা জায়গায় এসে ফাঁদে আটকায়। আমরা ঐতিহাসিকভাবেই ফিকশনে আইডিয়া বা সামাজিক-রাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণের বদলে আচ্ছন্ন হই ভাষাভঙ্গিমায়, চটুল কাহিনীশৈলিতে। ফিকশনগুলো হয়ে উঠে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট।
ননফিকশনে আর্গুমেন্টের চাইতে রেফারেন্সনির্ভর এমফিল গবেষণাপত্র।
আমাদের ফিকশন এবং ননফিকশন চর্বিতচর্বণ।
তবু বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেতেই পারে।
সেল্ফ হেল্প এর প্রতি জিরো টলারেন্স।।
পৃথিবী এখন উন্মুক্ত। মাল্টিকারেন্সি কার্ডও চলে এসেছে। ফিকশন বা ননফিকশনের যত বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ হয়েছে, গুগল থেকে চাইলেই সেগুলো কিনে পড়া সম্ভব। তাতে অন্য ভাষা শেখার প্রতিকূলতাও দূর হয়ে যায়।
৩০ বছর আগে কোনো বাংলাদেশি তরুণ বা তরুণী চাইলেও এই সুযোগটা নিতে পারতো না।
বাংলাদেশের মার্কেটেও অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেল্ফ হেল্প বইয়ের। লুৎফর রহমান নামের এক ব্যক্তি উচ্চজীবন, মহাজীবন সহ আরো বাহারি বিশেষণযুক্ত জীবনের বই লিখেছিলেন, মাধ্যমিক স্কুলে পাঠ্যও ছিল কোনো একটা লেখা। তার বইগুলো আমাদের কৈশোর-তারুণ্যে আছর করতে পারেনি। তার ঘরানার পশ্চিমা লেখক ডেল কার্নেগি আমাদের আগের প্রজন্মের ছোট্ট একটা অংশকে সাময়িক মুগ্ধ করেছিল বটে, রেশ রাখতে পেরেছে মনে হয়নি।
আমাদের কৈশোরে শিবখেরা রচিত ‘তুমিও জিতবে’ বইয়ের বাজার কাটতি ধুন্ধুমার। ইন্টারে পড়াকালীন একই বই উপহার পাই দুজন পৃথক ব্যক্তির থেকে৷ ১০ পৃষ্ঠা পড়ে উপলব্ধি জন্মে কনফুসিয়াস বা রাহুল সাংকৃত্যায়ন পড়ে যতটুকু জেতার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম, শিবখেরা আমায় বানিয়ে দিল ভেড়া!
কোচিং সেন্টারের মালিক কি নিজে কোচিংয়ে পড়েছিল?
মূল সর্বনাশ হয়েছে ফেসবুকের হাতে শাসনক্ষমতা চলে যাওয়ার পরে। সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা হয়ে উঠলেন দিকপাল, বইমেলাকে টার্গেট বানিয়ে লিখতে শুরু করলো বই, যার প্রায় সবই সেল্ফ হেল্প ঘরানার।
এসব বইয়ের ক্রেতা তারাই যারা তার লাইফস্টাইল সাবস্ক্রাইব করে। সে বই লেখার পরিবর্তে মগ বা বালতি তৈরি করলেও সংগ্রহে রাখতো।
কিন্তু আইরনি হলো বাণিজ্য মেলায় কোনো সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার স্টল পান না। বালতি বা মগের পরিবর্তে তাদের বই তৈরি করতে হয়।
সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের ইনফ্লুয়েন্সের উৎস গণমানুষের ভালনারেবিলিটি তথা ভঙ্গুরতা। সে কোনো কালচারাল এফিলিয়েশনে নেই, একাগ্রচিত্তে সুনির্দিষ্ট স্কিল রপ্ত করার সাধনাতে নেই, তার এন্টারটেইনমেন্ট ধারণা ফ্যাশন, হ্যাং আউট এর বাইরে প্রবেশ্যতা পায়নি, সে কিছু পারসিভ বা এবজর্ব করছে না, অথচ নিজেকে ঘিরে অন্তহীন উচ্চাশা।
প্রলোভন তার শিরায় শিরায়। তখনই সে গলাকাটা পাসপোর্টে জার্মানি যাওয়ার ধান্ধায় আত্মা-শরীর-সম্পর্ক বেচে, কিন্তু জানেও না ইমিগ্রেশনে আটক হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র!
যে কারণে অধিকাংশ মানুষের কোনোরকম উপলব্ধি বা জিজ্ঞাসাই তৈরি হয় না, তারা জানে কেবল ঘৃণা করতে, অপদস্থ করতে, এবং অভিযোগের গুয়েতেমালা কারাগার নির্মাণ করতে।
বরং ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রকাশ করুক নিজেদের বায়োগ্রাফি, কিংবা ইন্টারভিউয়ের বই, তাতে অনুসারীরা তার ব্যক্তিসত্তাকে জানার বোঝার সুযোগ পাবে।
বইমেলা শেষে আমার উপলব্ধি তাই এক লাইনে- ‘কর্মস্পৃহা না পেলে নেটফ্লিক্সে সিরিয়াল দেখা যায়, অন্য অনেকভাবে সময় কাটানো যেতে পারে। বই পড়তেই হবে কেউ দিব্যি দেয়নি। তবে দিব্যি রক্ষায় সেল্ফ হেল্প এর চক্করে পড়লে গল্পটা ওখানেই শেষ’।