আকর্ষণীয় সিভি লেখার কৌশল সংক্রান্ত বই, ব্লগ আর্টিকেল প্রভৃতি উপকরণের বিপুল চাহিদা দেখে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায়, সিভি অত্যন্ত পাওয়ারফুল; অন্তত একজন মানুষের প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। অনেক এমপ্লোয়ার বলে থাকেন, যে ব্যক্তি তার সিভি ঠিকমতো লেখে না, অসংখ্য বানান ভুল থাকে, সেই মানুষ চরম ইনসিনসিয়ার; সিভি দেখেই মানুষ চেনা যায়!

চাকরি যেহেতু পেতেই হবে, নইলে টিকে থাকা দুষ্কর হবে, সুতরাং সিভি রাইটিং ওয়ার্কশপ, কোচিং প্রভৃতিতে অংশ নেয়া, বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল এবং লোকাল বড় ব্র্যান্ডের এইচআর কর্মকর্তার পরামর্শ শোনা প্রভৃতি কার্যাবলী- অতিমাত্রায় ক্যারিয়ারসচেতন তরুণ-তরুণীদের জন্য আইডিয়াল টাইম এন্ড মানি ইনভেস্টমেন্ট হয়ে উঠেছে। এমনকি কিছু কিছু ভার্সিটিতেও বোধহয় সিভির কভার লেটার কীভাবে লিখতে হয়, সিভি খুললেই প্রথমে কী কী জিনিস রাখতে হবে- এসব ব্যাপারে ক্লাশ করানো হয়। You Have to sell yourself and the CV is your very first impression- এই লাইনটি কত শতবার উচ্চারিত হয়েছে এবং হয়েই যাচ্ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

আমাদের চাকরি বাজারে, ক্যারিয়ার-ভাবনায় সিভি তাই প্রবলভাবে এস্টাব্লিশড একটি নর্মস এবং ট্রাডিশন।এটা অনুসরণ করে অধিকাংশই আর্থিক, সামাজিক এবং মানসিকভাবে সুখী জীবনযাপন করছে, সুতরাং এস্টাব্লিশড এবং প্রুভেন এলিমেন্টের বিরুদ্ধাচারণ করা একধরনের এলিট মানসিকতা মনে হতে পারে; তবু নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং ভাবনার জায়গাটা শেয়ার বোধহয় করা যেতেই পারে।

রিক্রুটমেন্ট প্রসেস এবং সিস্টেম বিষয়ে অনেক বছর ধরেই ক্রমাগত এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছি; এখনো বুঝতে পারিনি স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম আসলে কেমন হওয়া উচিত। তবে বিভিন্ন চিন্তা-চেতনার পারমুটেশন-কম্বিনেশন থেকে একটা উপসংহারে উপনীত হতে পেরেছি, সেটা হলো, ত্রুটিপূর্ণ রিক্রটমেন্টের পেছনে প্রধানতম ফ্যাক্টর ‘সিভি’ নামক কাঁঠালের আমসত্বটিকে সিলেকশন ফিল্টার প্রসেসের টপ পজিশনে স্থান দেয়া।

সিভি কেন জরুরী?
এটা এমপ্লোয়ার এবং এমপ্লোয়ির মধ্যবর্তী সেতু হিসেবে কাজ করে, এক নিমিষে একজন কর্মীর যোগ্যতা-দক্ষতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়। একটা জব সার্কুলারে ২-৩ হাজার মানুষ আবেদন করেছে, তার মধ্য থেকে বাছাই করতে হলে সিভিকে তো গুরুত্ব দিতেই হবে; এতোজনকে ধরে ধরে ইন্টারভিউ করা তো স্মার্ট প্রসেস নয়। তার চাইতে, সিভির ক্ষেত্রে যদি সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত আরোপ করে রাখা হয়, যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিস, ট্রেনিং প্রভৃতি, সেগুলো থেকে শর্টলিস্ট করা সহজ হবে; তার প্রেক্ষিতে ইন্টারভিউ।সিভি কত কার্যকরী, তাই না? ধরলাম ২ হাজার নয়, সংখ্যাটা ৫০০; তবু সিভি সর্টিং তো করতেই হবে, সেখানে প্যারামিটার সেট করতে হবে। সিভি ছাড়া উপায় কী! কিংবা যদি আরেকটু এডভান্সড লেভেলের চিন্তা থেকে পারসোনালিটি টাইপ এনালাইসিস করতে চাওয়া হয়, সেখানেও তো সিভি লাগবেই। এতো ইফেকটিভ একটা জাজমেন্ট টুলকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা কোন্ ধরনের আঁতলামী বা ঔদ্ধত্য!

আলোচনা বিস্তারিত হওয়ার আগে একটা সুস্পষ্ট ক্ল্যারিফিকেশন দেয়া জরুরী বোধ করছি।ব্লগ আর্টিকেল, বা ওয়ার্কশপগুলোতে যে ফরম্যাট বা যেসব ডু এবং ডোন্ট এর ব্যাপারে বলা হয়, মূলত সেই ফ্রেমওয়ার্কের সিভিকেই মূলত প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাওয়া হচ্ছে। ধরা যাক, কেউ একজন এক পৃষ্ঠায় একটা বিল্ডিংয়ের স্কেচ এঁকে সেখানে নিজের বৈশিষ্ট্যগুলো আসবাবপত্রের আকারে বসিয়ে দিলো, এটাও কিন্তু কোনো একটা ফরম্যাটের সিভি। আবার ৭ পৃষ্ঠায় নিজের আত্মজীবনী লিখে পাঠিয়ে দিলো। এটাকেও সিভি বলা যেতে পারে। বরং কর্মশালা হওয়া উচিত কীভাবে এমপ্লোয়ারের সাথে ফার্স্ট ইন্টারেকশন হবে, ইমপ্রেশন তৈরি করবে, সেই সংক্রান্ত। সিভি বলতে যদি ফার্স্ট ইন্টারেকশন টুল বোঝাতে চাওয়া হয়, সেই এপ্রোচের সাথে প্র্যাকিটিকাল লাইফের ইমপ্লিমেন্টেশনে বহু পার্থক্য আছে। এখানে সিভি হয়ে গেছে কয়েকটা বাঁধাধরা ফরম্যাটের অন্ধ অনুসরণ। এই ফিল্টারিং প্রসেস দিয়ে এক্সিলেন্ট কর্মী পাওয়া আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনায়। অবশ্য,এমপ্লোয়াররা এক্সিলেন্ট কর্মীর আদৌ প্রয়োজনীয়তা বোধ করে কিনা, সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। ধরা যাক, আপনি বললেন তুমি কী কী অর্গানাইজিং কাজ করেছো, কী কী ট্রেনিং নিয়েছো সেসব আগে লিখো, কভার লেটারটা লুক্রেটিভ আর ফ্যান্সি ওয়ার্ডে ভরপুর করে দাও যাতে তোমার সম্পর্কে ব্যতিক্রমী ইমপ্রেশন তৈরি হয়, এবং ১০০ জন মানুষ হুবুহু সেটাই করে আবেদন করলো; তখন সেটাও তো একটা গৎবাঁধা ফরম্যাটে পরিণত হয়ে যাবে।

পক্ষান্তরে, ইনস্ট্রাকশনটা যদি এমন হয়, ১০০ জন আবেদন করলে সেখানে নিজেকে এমনভাবে প্রেজেন্ট করতে হবে যাতে ৯৯ জনের সাথে নিজের পার্থক্যটা বোঝানো যায়, এবং তুমি অন্যের চাইতে কেন ও কীভাবে ব্যতিক্রমী হবে সেটা নিয়ে ভাবো, তখন বিবিধ আইডিয়া চলে আসবে। এভাবেই মানুষের মধ্য থেকে ক্রিয়েটিভিটি বের করতে হয়। আপনি যদি বলেন, সবার মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি থাকে না, এটা শতভাগ ভুল কথা। ক্রিয়েটিভিটি একটা কমন বৈশিষ্ট্য মানুষের, কারোটা প্রকট, কারো প্রচ্ছন্ন। একটু ঘষামাজা করলেই সেটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের অতিমা্ত্রায় পরনির্ভরশীলতা আর মাথা খাটানোতে প্রবল অনীহা আমাদের নিজেদের এক্সপ্লোর করা থেকে বিরত রাখে, আরেকজনের সিভিতে কেবল নাম আর বাবা-মার নামগুলো বদলিয়ে সিভি বানিয়ে ফেলতে প্রলুব্ধ করে। একটা কাজের পারপাস কী, এবং তার প্রেক্ষিতে কোন্ টার্গেট এচিভ করতে চাই সেই উত্তরটা বেশিরভাগেরই জানা নেই। পারপাস এবং টার্গেট জানা না থাকার দরুণ, আমরা কলুর বলদের মতো খেটে যাই, কিন্তু স্যাটিসফ্যাকশন আসে না, প্রত্যাশিত রেজাল্ট্ও আসে না। এমনকি যারা রিক্রুট করেন তারাও জানে না যেসব প্যারামিটার সেট করা হচ্ছে, স্পেশালি সেগুলোই কেন, অন্য কিছু কী সমস্যা ছিলো!

ওয়ার্কশপগুলোতে সাধারণত বলা হয় সোশ্যাল ওয়ার্ক, কালচারাল এক্টিভিটি, অর্গানাইজিং স্কিল বোঝা যায় প্রভৃতি লিখতে। যেকারণে, ভলান্টারালি সোশ্যাল ওয়ার্ক করার হার আগের চাইতে বৃদ্ধি পেয়েছে; একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সেকেন্ড ইয়ারের চাইতে থার্ড বা ফোর্থ ইয়ারে ভলান্টিয়ার কার্যক্রমের পরিমাণ বেশি, লিডারশিপ প্রোগ্রামগুলোতে এটেন্ড করা হচ্ছে বেশি। পুরো ইনটেনশনটাই যে সিভিকেন্দ্রিক, আরেকটু বেশি সংখ্যক মানুষকে নিয়ে ঘাঁটলেই ফ্যাক্টটা ধরা সহজ হবে।

কোনো একটা পোস্টে যখন লোক রিক্রুট করা হয়, সেই কাজটা ভালোভাবে করার জন্য উক্ত কর্মীর কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, সেগুলো বোঝার জন্য কী কী কৌশল অবলম্বন করা হবে, এবং নিয়োগ দেয়ার পর সেই কর্মীর গ্রুমিং এবং গ্রোথ পাথওয়ে কী হবে- এরকম একটা প্রশ্নের ফ্লোচার্ট যদি নিয়োগকর্তাদের দেয়া হয়, সেটা যথার্থভাবে পূরণ করতে পারবেন এই সংখ্যাটা অস্বাভাবিক কম হবে। কারণ, কোন্ বৈশিষ্ট্যটা দরকার এটা ভাবারই প্রয়োজন বোধ করা হয় না, এবং ধরে নেয়া হয় সিস্টেম ফলো করলেই গ্রো হয়ে যাবে। ফলে, হিউম্যান ক্যালিবার বিনষ্ট করা বা তাকে আটকে দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা অতুলনীয়।
কর্মী কোম্পানীর এসেট না হয়ে তাকে গণ্য করা হচ্ছে প্রফিটমেকিং রোবট হিসেবে। অথচ, কর্মী যদি এসেট হতো প্রফিটের পরিমাণ বেড়ে যেতো বহুগুণ। ইনস্ট্যান্ট আর ইমিডিয়েট গেইনের মোহে পড়ে বুঝতেই পারি না ছোট্ট ট্যাংরা মাছের পেছনে লুকিয়ে আছে কত বড় হাঙর। বাঘ শিকার করতে টোপ হিসেবে যে ঘোড়া ব্যবহার করতে হয়, এই সিম্পল থিওরি আমরা কেবল বইয়ে পড়ি, কিন্তু বাস্তবজীবনে সেই সাহসই দেখাতে পারি না। এই মুহূর্তে আমার প্রাপ্তি কী সেটাই আসল, এক সপ্তাহ পরে কী হবে সেটা ভাবতে গেলে ৬ দিন তো আগে টিকতে হবে; এই মাইন্ডসেট থাকার দরুণ সমগ্র জীবন আমাদের নুন আর পান্তা ফুরানোর গল্প শুনেই পার করে দিতে হয়।

ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট বলতে কোনো কিছু আছে, এটা এমপ্লোয়ারদের বোঝার ভুল, নাকি ইচ্ছার অভাব- এই সমীকরণ মেলে না। যে ছেলেটার প্রতিভা আছে কোম্পানীর সিইও হওয়ার, সে হয়তো এসিসটেন্ট ম্যানেজারের উপরে আর উঠতেই পারলো না, কারণ তার ট্যালেন্টকে মূল্যায়ন করা হয় না। কোম্পানী বছর শেষে ১ কোটি টাকা প্রফিট করেছে, এটাই যথেষ্ট, ওই ছেলেকে প্রোমোট করলে যে ১০ কোটি প্রফিট হতে পারতো, সেই বোধ জাগেই না। ‘এই বেশ ভালো আছি’- এরকম আত্মপ্রবঞ্চক সন্তুষ্টি থেকে আমরা কখনো চিন্তাই করতে পারি না আমাদের ক্ষমতার লিমিট আসলে কতটা বিস্তৃত ছিলো। প্রফিট মেকিংকে দোষ দিচ্ছি না, কিন্তু প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করতে হলে যে ম্যাক্সিমাম রিস্ক এবং কনসেন্ট্রেশন দরকার, সেটুকু ভাবাও অনেক সময় বিলাসিতা মনে হয়। চিন্তা করার সময় নেই, মূল্যায়ন করার সময় নেই; এতো সময় যে আসলে যায় কোথায়, এটাই একটা ব্যাপক অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। প্রফিট চাই, প্রফিট, কিন্তু কীভাবে তা জানি না; বড়ই আজব বিজনেসম্যান সাইকোলজি।

সিভিতে সাধারণত কী কী দেখা হয়, এটার সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়া অসম্ভব। সিভির আদিখ্যেতা মূলত এন্ট্রি আর মিড লেভেল রিক্রুটিমেন্টেই বেশি, টপ লেভেল রিক্রুটমেন্টে কম-বেশি সব প্রতিষ্ঠানই অনেকরকম যাচাই-বাছাই করে থাকে; সিভির বাড়াবাড়িটা এন্ট্রি লেভেলেই বেশি চোখে পড়ে। ফ্রেশারদের ক্ষেত্রে এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড, ২-৩ বছরের অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে কোথায় কাজ করেছে, জব রেসপনসিবিলিটি কী ছিলো, এইসব। এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড দেখার ক্ষেত্রে চিন্তা করা হয়, ভালো জায়গায় যেহেতু পড়াশোনা করেছে তাহলে মেধাবী ছাত্র ছিলো কোনো একসময়, যদিও আমি মনে করি এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রধান এডভান্টেজ হলো বড় ইনস্টিটিউটে পড়ার কারণে বেশিসংখ্যক মানুষের সাথে ইন্টারেক্ট করার সুযোগ হয়, এবং কিছুটা মেধাবী হলে তাদের পারসোনালিটিতে বৈচিত্র একটু বেশি থাকার সম্ভাবনা বাড়ে, এই যা। সেক্ষেত্রে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকেও খুব ভালোমতো এই যুক্তিতে এডভান্টেজ দেয়া যায়, যেহেতু সেখানেও অনেক স্টুডেন্ট থাকে। কিন্তু ক্লাশে এটেন্ড করার বাধ্যকতা তুলনামূলক কম থাকায় এবং এভারেজ মেধার ডেনসিটি তুলনামূলক কম হওয়ায়, হয়তোবা একটু কম প্রায়োরিটি পেতে পারে। তবু ইনস্টিটিউট আসলে একটি মিথ। নিজের যোগ্যতা আর দক্ষতা সম্পূর্ণই ব্যক্তির অন্তর্গত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল; ইনস্টিটিউট তাকে মানুষ বানায় না।

কিন্তু প্রি-সেট কিছু ভ্রান্ত এজাম্পশনের ভিত্তিতে যুগ-যুগান্তর ধরে সিভিতে এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন, ব্যাকগ্রাউন্ড সংক্রান্ত সংস্কার কাজ করে চলেছে, যার কোনো ভিত্তিই নেই। আপনি একটি সার্কুলার দিলেন, আপনার ২ জন সাপ্লাই চেইন অফিসার লাগবে, সার্কুলারে একটা রিয়েল লাইফ এসাইনমেন্ট দিয়ে ১৫ দিন অপেক্ষা করুন সেটা সমাধান পাওয়ার। দেখবেন সেটাই কত চমৎকার সিভি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা বড্ড বেশি থিওরিটিকাল; আমরা কোনোকিছুর গভীরে ঢুকি না, কাউকে বোচার চেষ্টা করি না, একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিলো, ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্টলি কথা বলতে পারলো, কিংবা শ্যালো থিংকিং থেকে কিছু ফ্যান্সি আইডিয়া বলে দিলো, ব্যস আমরা খুশি হয়ে যাই। কেউ যদি তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে ২ দিন সময় চায় গভীর আর থট প্রভোকিং কোনো মতামত দিতে, সেটাকে দেখা হয় স্লো-প্রসেস হিসেবে। Insight এর অভাব এতোটাই চরম! সুতরাং সিভিতেই সব আছে, ওটাই যা বলার বলে দেবে!

বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সময় মানুষ সাধারণত কী করে? সবচাইতে ভালো পোশাকটা পরে যায়, সাধ্যমতো সাজগোজ করে, এবং ইদানীংকালের ফ্যাশনসচেতনতার কারণে বিয়ে বা পার্টিতে মানুষের চেহারা তো পুরোই বদলে যায়। অর্থাৎ এই ইভেন্টগুলোতে যা দেখছেন তার বেশিরভাগটাই আরোপিত এবং বাড়াবাড়ি। সেখানে একজন মানুষকে দেখে যদি তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে চলে আসেন, সেটা ভুল হবার বাস্তব সম্ভাবনা যথেষ্ট, কারণ ওই আরোপিততার মধ্যে একচুয়াল মানুষটি কিন্তু নেই। মানুষটি বাসায় লুঙ্গি নাকি ট্রাউজার পরে, মাসের ২৯ দিন কীভাবে জীবনযাপন করে তার মধ্যেই আছে প্রকৃত ব্যক্তিসত্তা। সবই যদি বোঝেন, তাহলে সিভির ব্যাপারটাও তো তেমন। সিভি তো সেই বিয়েবাড়ির সাজ বা আচারআচরণের মতোই।

একজন কর্মী অবশ্যই একজন প্রোডাক্টিভ মানুষ।সেটা বিচারের জন্য তাকে বুঝতে হবে, আড্ডা দিতে হবে,ঠাট্টা-মশকরা করতে হবে; তবেই না সে বেরিয়ে আসবে গহীন থেকে। সময় নেই? ব্যস্ততা বলতে কিছু নেই, পুরোটাই প্রায়োরিটির বিষয়। আপনি এতোই ব্যস্ত থাকেন যে আমার সাথে কথা বলার মতো ৫ মিনিট সময়ও নেই, কিন্তু যদি বলা হয় আমার সাথে কথা বললে ৭৩ লাখ টাকার একটা ডিল পেয়ে যেতে পারেন; আপনি সবকিছু ফেলে সারাদিন আমার অপেক্ষায় বসে থাকবেন; কিসের ব্যস্ততা! আমরা প্রায়োরিটিই বুঝতে পারি না;আগামী ৭ দিন আপনার টপ থ্রি প্রায়োরিটি কী, জিজ্ঞেস করলে গুছিয়ে উত্তর দিতে পারবেন, সেই সংখ্যা বেশি হবে না। যেহেতু একজন মানুষকে ভালোমতো বুঝলে আপনার বেনিফিট কী সেই ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা নেই, খুব অবলীলায় সময় নেই বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। ‘প্রায়োরিটি’সেট করা জীবনের সবচাইতে বড় বেনিফিট।এটা বুঝতে না পারার দরুণ, আমাদের সিনেমার পোস্টারগুলো এতো লুক্রেটিভ আর সেলেবল করে বানানো হয়, অথচ তার সিকিভাগ সময়ও দেয়া হয় না সিনেমার ভেতরের কনটেন্ট ডেভেলপমেন্টে; কারণ পোস্টার আর ট্রেইলার দেখেই দর্শক সিদ্ধান্ত নিবে এটা দেখবে, নাকি দেখবে না। পোস্টারটাও তো সিনেমার সিভি হিসেবেই কাজ করে।
তাহলে কি সিভি বানাবো না? অবশ্যই বানাবেন। তবে সিভিকে আগে ডিফাইন করুন।সিভি যদি হয় নিজের আর্কাইভ, একটি লাইভ স্টুডিও বা সিনেমা সেধরনের কিছু একটা অবশ্যই দরকার আছে, সেটা যদি নিজের থট প্রসেস আর পারসোনালিটি শো-কেসিং এর প্লাটফরম হয় তারও দরকার আছে, কিন্তু অবশ্যই ইউনিক কিছু। একটা মগের মধ্যে নিজের সম্পর্কে ৩টি লাইন লিখে কোম্পানীতে কুরিয়ার করুন, সেটাকেও সিভি বলা যায়। কিন্তু ২-৩ পৃষ্ঠার মধ্যে কিছু মুখস্থ ফরম্যাট এদিক সেদিক করে সাজানো হলো, এটা ইফিশিয়েন্সি আর ক্রিয়েটিভিটির বিরাট লস। আমরা লাভ-লোকসানের ক্যালকুলেশনে পেরেশান হই, কিন্তু ইফিশিয়েন্সি লসের কারণে প্রতিঘণ্টায় কতটা পিছিয়ে পড়ি সেই ক্যালকুলেশনের প্রয়োজনীয়তা আদৌ কি কোথাও বোধ করা হয়? ইউরেনাস বা নেপচুন গ্রহে হতে পারে, বা ফিনল্যান্ড-হাঙ্গেরি জাতীয় দেশে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে? একটাই উত্তর আসবে- আসল কাজের খবর নাই, ফাও কাজে সময় উজাড় করে দিচ্ছে, ফাউল লোক কোথাকার!

এবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। ২০১১ থেকে এখন পর্যন্ত ৭০০-৮০০ জন মানুষের জব ইন্টারভিউ নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমি এইচআর এ কাজ করি এমন নয় ব্যাপারটা, আমার আসলে কোনো পেশাই নেই। ২৩ বছর বয়স থেকে স্ট্র্যাটেজিক কনসালটেন্সিই আমার কাজ, তার পরম্পরায় রিক্রুটমেন্টে কাজ করা হয়েছে, যেহেতু ১২ বছর বয়স থেকেই মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া আমার প্রচণ্ড ভালোবাসার একটা কাজ। এই ৭০০-৮০০ মানুষের একজনেরও সিভি দেখিনি, বাকি জীবনেও কখনো দেখবো না; কিন্তু তাদের ইভালুয়েট করার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছি। অনেকগুলো সফল হয়েছে, ব্যর্থও হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু মানুষের স্কিল বুঝতে চাওয়া, ইনটেন্ট বুঝতে চাওয়া, তার ভেতরের মানুষটার একটা পোরট্রেইট আঁকতে চাওয়া- আমি মনে করি সিভিনির্ভরতার মধ্যে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের খোলা আকাশের নিচে জব ইন্টারভিউ নেয়ার ঘটনাও আছে অসংখ্য। সিভির মধ্যে মানুষ সচেতনভাবে নিজেকে গ্লোরিফাই করে, কিন্তু সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে হঠাৎ করে যদি একজনকে বলা হয় ডাবওয়ালার বায়োগ্রাফি বানাতে, সেখানে গ্লোরিফাই করার স্কোপ কই! অবচেতনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আসল মানুষটি; একটু স্রেফ জাগিয়ে নিতে হয়। একজন মানুষ স্যুট পরা কারো সাথে হ্যান্ডশেক করলো এর মধ্যে তার টাইপ নেই, কিন্তু একজন চাওয়ালার সাথে কীভাবে কথা বলে সেখানেই তার মূল টাইপ। এসি রুমের স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে বসে টিমওয়ার্ক এসাইনমেন্ট দিয়ে ইগো স্যাটিসফাই করা যায় হয়তোবা, ইনোভেশনের আনন্দ পাওয়া পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ানের মতোই অনিশ্চিত!

শত বছরের অধিক যে সিভি এপ্রিশিয়েশন ঐতিহ্য বা প্রবণতা, আমার একটি লেখায় তার গ্রহণযোগ্যতায় বিন্দুমাত্র প্রভাবও পড়বে না। বা ১৩ জন পছন্দ করলো, ২৯ জন সমালোচনা করলো, তাতেও অবস্থান নড়চড় কিছুই হবে না। কিন্তু ৩ জন এমপ্লোয়ারও যদি এটা পড়ে সিদ্ধান্ত নেন সিভির বিকল্প হিসেবে মানুষ মূল্যায়নের আরও ইফেকটিভ এবং ইনোভেটিভ কৌশল চেষ্টা করবেন, সেটাই হয়তোবা এই লেখার ছোট্ট একটা টার্গেট পূরণে কার্যকরী হবে। কারণ, ওই ৩ জন মানুষই ৩০০ জন মানুষকে নিয়োগ দেবেন, সেই ৩০০ জন মানুষও যদি সিভির সার্কাস থেকে বেরিয়ে অন্য কিছু চিন্তা করতে চায়……………
থাক, কল্পনার ঘুড়ি বাকাট্টা যাওয়ার আগেই নাটাই গুটিয়ে নিই। তাদের সময় নেই জানি, মানি কিনা জানি না, তবু মাত্র ৩ জন এমপ্লোয়ারের প্রত্যাশায়…