মিডিয়া প্রেজেন্সকে আমি বলি প্লেসমেন্ট ক্রিকেট, যেটা মাঠের ক্রিকেটের চাইতেও অনেক বেশি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াতে বাংলাদেশের প্লেসমেন্ট ক্রিকেট বরাবরই কঠিন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে, আসন্ন ৫ বছরে এই প্রতিকূলতার ডাইমেনশন আরও বাড়বে, সেটা ট্যাকল করার মতো স্মার্টনেস ও স্কিল আমাদের মিডিয়ার আছে কিনা এটাই ভাবনার বিষয়। আসলে আমাদের ক্রিকেট তো অনেকটাই ফাউন্ডেশন ছাড়া ১৬ তলা বিল্ডিং তৈরির মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই মাঠের মতো প্লেসমেন্ট ক্রিকেটও নিজেদের গড়ে তুলবার পর্যাপ্ত সময় পায়নি। তবু যুদ্ধে যেহেতু নামতেই হয়েছে, দেয়ার ইজ নো চয়েজ বাট টু ফাইট।
নিন্দুক, বিদ্বেষী এবং পজিটিভ- ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট ইন্টারন্যাশনাল এরিনায় এই তিনটি গোষ্ঠীর দেখা পেয়েছে। নিন্দুক এবং বিদ্বেষী দুটোই নেগেটিভ গ্রুপ, তবু আমি বলবো নিন্দুকের চাইতে বিদ্বেষীরা বেশি ক্ষতিকর। নিন্দুক হচ্ছে তারা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে নেগেটিভ কমেন্ট করে, ক্রিকেট কাঠামোর সমালোচনা করে। কিন্তু বিদ্বেষী হলো যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অবমাননাকর দৃষ্টিতে দেখে, বাংলাদেশ যা-ই করুক সেটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, এবং পলিটিক্স করতে চায়। নিন্দুকরা প্লেসমেন্ট ক্রিকেটের জন্য ততটা হুমকিস্বরূপ নয়, ক্ষেত্রবিশেষে উপকারীই, কিন্তু বিদ্বেষীরা খুবই ভয়ানক, এবং এদের মোকাবিলা করার ইন্টেলেকচুয়াল চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।

১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট আমলে নেয়ার মতো কিছু ছিলো না ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায়। প্রথম আমলে নেয়া হয় ৯৯ সালের বিশ্বকাপে হট ফেবারিট পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। একটি গ্রুপ সাক্ষী-সাবুদ দিয়ে এটা প্রায় প্রমাণ করে ফেলে ম্যাচটা পাতানো ছিলো। নিজ যোগ্যতায় বাংলাদেশ একটা বড় দলকে হারাতে পারে এটা যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার, অথচ ৯৬ বিশ্বকাপে নবাগত কেনিয়া যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৯৩ রানে অলআউট করে দিলো বা ৮৭ এর বিশ্বকাপে জিম্বাবুইয়ে ওই আসরের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিলো তখনও কথা উঠেনি, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উঠেছে, কারণ প্রতিপক্ষ দলটা পাকিস্তান, ম্যাচ ফিক্সিং যাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। সেই জয়ের পর প্রায় ৫ বছর বাংলাদেশ কোনো ম্যাচ জেতেনি, টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে এবং নিয়মিত ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে। ফলে অল্পতেই অস্থির হয়ে যাওয়া নিন্দুকের সংখ্যা বেড়েছে, এবং কৌলিন্য খর্ব হচ্ছে এরকম একটা হাপিত্যেশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিদ্বেষীর, যে দলে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সৌরভ গাঙ্গুলী (যদিও ২০০০ সালের প্রথম টেস্টের সময় থেকেই সে বাংলাদেশ বিদ্বেষী। বাংলাদেশের সাথে জয়ের পর কলকাতার এক ইন্টারভিউয়ে সে বলেছিল বাংলাদেশের সাথে জয় নিয়ে উচ্ছ্বাসের কিছু নেই, এটা অস্ট্রেলিয়া হলে কথা ছিলো। কিন্তু এই কথা নিয়ে তখন হৈচৈ হয়নি, কারণ তখন ফেসবুক ছিলো না)

বাংলাদেশ বিদ্বেষীতার মূল ফ্যাক্টরটা আসলে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া। ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্সে কেনিয়া তখন বাংলাদেশের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিলো, কিন্তু ক্রিকেট অবকাঠামো, দর্শক সমর্থন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এসবে কেনিয়ার কোনো ফিউচারই ছিলো না যার প্রমাণ পাই যখন দেখি ৪৫ বছর বয়সে মরিস ওদুম্বে, টমাস ওডোয়ারা এখনো কেনিয়া দলের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশে ক্রিকেট খেলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সবসময়ই ছিলো, টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পেছনেও বোর্ডের চাইতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতা বেশি প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের তখনকার যে ক্রিকেট স্ট্যান্ডার্ড তাতে ২০০০ সালে কোনোভাবেই টেস্ট স্ট্যাটাস ডিজার্ভ করি না আমরা, কিন্তু আমাদের কান্ট্রি কালচার হলো আমরা ঠেকে শিখি, আমরা প্রো-একটিভ কম। সুতরাং টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছি বলেই যতটুকু যা সম্ভব ক্রিকেটে উন্নতি হয়েছে, এটা না হলে এখনো আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের মতো স্ট্রাগল করতে হতো, এবং নিশ্চিতভাবেই জনপ্রিয়তায় ফুটবলের অনেক পেছনে থাকতে হতো। কৌশলগত কারণে অনেক সময় ৫ বছরের নাবালক শিশুকেও বিয়ে করাতে হয় এরকম দৃষ্টান্ত আছে, কাজেই ইনফ্র্যাস্টাকচারাল যতই লিমিটেশন থাকুক, টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিলাম বলেই ক্রিকেটটা বেঁচে গেছে। ক্রিকেট রাজনীতিতে এশিয়দের অবস্থান আরেকটু সংহত করতে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা সমর্থন দিলেও অন্য দেশ বিশেষ করে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে টেস্টে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ছিলো টেস্টের জাতচ্যুতির মতো ব্যাপার। তাই তাদের ক্রিকেট বিশ্লেষকরা এটাকে কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। তাছাড়া, মার্ক ওয়াহকে বোলিং করা যেখানে হাসিবুল হোসেন শান্তদের জন্য স্বপ্নের ব্যাপার, শচীনদের সাথে ১ মিনিট কথা বলা যখন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, সেই তারা ইন্টারন্যাশনাল তারকাদের সমগোত্রীয় হয়ে যাবে এটা হয়তোবা মানতে পারেনি অনেকেই। এখান থেকেই বিদ্বেষের শুরু।
বিদ্বেষীর তালিকা করলে প্রথমেই রাখবো জিওফ্রে বয়কটের নাম। তার বিদ্বেষটা ব্লু ব্লাডজনিত অহংবোধ। আমার দাদীও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চাইতে ভালো খেলে, এরকম নির্লজ্জ কমেন্ট সম্ভবত সে-ই প্রথম করেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে। সেঞ্চুরি করেও স্লো খেলার জন্য একাদশ থেকে পরের ম্যাচ বাদ পড়েছিল বয়কট সে চিবিয়ে চিবিয়ে অদ্ভুত একসেন্ট এ এরকম অভদ্র কমেন্ট করাটা তাকে ভালোই মানায়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলো তখনও বয়কট বাংলাদেশের সাফল্যের চাইতে ইংল্যান্ডের ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখেছিল, যেন ইংল্যান্ড হারতেই পারে না বা ওয়ানডে কোনো খেলাই নয়, এরকম একটা ভাব।
আরেকজন বিদ্বেষী রমিজ রাজা। প্রতিটি টেস্ট বা ওয়ানডেতে কমেন্ট্রি বক্সে বাংলাদেশকে তুলোধনা করতে তার জুড়ি নেই। তামীম ইকবালকে উর্দুতে প্রশ্ন করতে চেয়ে অশিষ্টাচারের চরম বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বিদ্বেষের পালে আরেকটু হাওয়া লাগিয়েছে। রমিজ রাজার মতোই আরেকজন নোংরা মানসিকতার বিদ্বেষী নভোজাত সিং সিধু। খেলোয়াড় হিসেবে কখনোই আহামরি ছিলো না, ক্রিকেট প্রজ্ঞারও ছিটেফোঁটা নেই, বরং রিয়েলিটি শো তে ভাঁড়ের মতো বিচারক হওয়া পর্যন্তই তার প্রতিভা, তবু মার্কেটে কমেন্টেটর হিসেবে তার ডিমান্ড আছে, কারণ সে উগ্র জাতীয়তাবোধকে লালন করে, কোটি মানুষের মনের কথাগুলো মুখে এন্টারপ্রেট করে। বাংলাদেশকে তেলাপোকা বলার মতো ধৃষ্টতা এবং অভব্যতা দুটোই সে অবলীলায় দেখাতে পারে।
শ্রীলংকার একজন কমেন্টেটর ছিল রঞ্জিত ফার্নান্দো। বাংলাদেশের প্লেয়াররা খেলতে পারে এটাই তার বিশ্বাস হয় না। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াতে খুব বেশি পরিচিত না হওয়াতে বিদ্বেষী হিসেবে তার biনাম সেভাবে আসে না, কিন্তু সুযোগ পেলেই কথা শোনাতে ছাড়েনি কখনো।
রবি শাস্ত্রী লোকটার পারসোনালিটি টাইপটাই তেলবাজ। সম্ভবত উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চাহিদা যোগান দিতেই বাংলাদেশ বিদ্বেষী মন্তব্য করতে সে পিছপা হয়নি কখনো। সর্বশেষ এশিয়া কাপ টি২০ এর ফাইনালে বালখিল্য এক মন্তব্য করে নিজের জাত নতুন করে চিনিয়েছে সে।

সৌরভ গাঙ্গুলীকে এই ঘরানার একটু বাইরে রাখতে হবে মিডিয়া প্রেজেন্টেশনের কারণে। কলকাতার হওয়ায় বাংলাদেশী মিডিয়াগুলো সবসময়ই তার বাঙালি পরিচয় নিয়ে মাতামাতি করতে চেয়েছে, ২০০০ সালে অভিষেক টেস্টে দুর্জয়ের সাথে টস করতে গেছে, সেটা নিয়েও মহাকাব্য লেখার ইন্তেজাম করেছে (২জন বাঙালি অধিনায়ক টস করার মাধ্যমে ইতিহাসের সাক্ষ্মী হয়ে রইলেন), তার দুঃসময়ে বাঙালিত্ব প্রশ্নে তাকে সাপোর্ট দিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে ভিলেন বানিয়েছে, রাহুল দ্রাবিড়কে ক্রিমিনাল হিসেবে উপস্থাপন করেছে, বোর্ডের রাজনীতি আবিষ্কার করেছে, কিন্তু ব্যক্তি সৌরভ গাঙ্গুলী কখনোই বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলো না, ক্রিকেটার গাঙ্গুলী তো নয়ই। বরং ২০০৪ এ তার অধিনায়কত্বকালেই প্রথম বাংলাদেশের বিপক্ষে হারের স্বাদ নিতে হয়েছে ভারতকে, ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়ে সেই যে মহা কেলেঙ্কারী হয়ে গেল ভারতীয় ক্রিকেটে সেখানে সেও তো একজন কুশীলব। কাজেই বাংলাদেশের প্রতি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার তো কোনো কারণই নেই। তবু গাঙ্গুলীর নিকনেম হয়ে গেছে ‘দাদা’; কলকাতার মানুষ তাকে দাদা, জ্যাঠা যা ইচ্ছা বলতে পারে, কিন্তু তার প্রভাবে বাংলাদেশী মিডিয়াও তাকে ‘দাদা’ বলতে উদ্বুদ্ধ করে কেন, এই রাজনীতিটা খুব অস্পষ্ট, আবার স্পষ্টও। ভারতীয় ক্রিকেটে গাঙ্গুলীর অবদান থাকতে পারে; ধোনি, শেওয়াগ, যুবরাজ, হরভজন এর মতো তরুণদের প্রোমোট করতে তার ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার কন্ট্রিবিউশন কী? আইপিএল এ কেকেআর ইস্যুতে শাহরুখ খানের সাথে তার ঝামেলা হলে সেটা নিয়ে আমাদের এখানে মানুষ তার পক্ষে দাঁড়ায়, কারণ সে বাংলা ভাষায় কথা বলে। এই যে বাংলা, বাঙালি- এসব নিয়ে গাঙ্গুলীর নিজের কোনো পাবলিক স্টেটমেন্ট কোথাও পাওয়া গেছে কখনো? আর যদি দিয়েও থাকে তার সাথে ক্রিকেটকে মেলানোর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু! জাস্ট নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার বর্তমানের জনপ্রিয় কমেন্টেটর ড্যানি মরিসনের সাথে তার অবস্থানটা তুলনা করা যাক। হাস্যরসের মধ্য দিয়ে মরিসন সর্বদা বাংলাদেশকে পজিটিভলি ইনস্পায়ার করে, এমনকি নিউজিল্যান্ড যখন বাংলাদেশের কাছে হোয়াইটওয়াশ হয় তখনো সে বাংলাদেশের জয়েই উচ্ছ্বসিত হয় (এ নিয়ে নিউজিল্যান্ডবাসীরা আক্রমণাত্মক হয় না, তার প্রতি বিষোদগার করে না; এইটুকু স্পোর্টিং ম্যাচিউরিটি এবং মেন্টালিটি তাদের আছে। বাংলাদেশী দর্শকরা অবশ্য এরকম ক্ষেত্রে রাজাকার, বেঈমান এসব আখ্যা দিয়ে ফেলতো। উগ্র জাতীয়তাবাদী দর্শক হিসেবে আমরাও দিনদিন ভারতীয়দের ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামছি যেন)। পক্ষান্তরে, গাঙ্গুলী কী করেছে বাংলাদেশের ফেভারে? ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জেতার পরও উল্টো ব্যঙ্গ করেছে ‘যে পিচে খেলা হয়েছে সেটা টেস্ট উপযোগি না, ভারতের বিপক্ষে খেললে বাংলাদেশ ওই পিচে ১০০ রানও করতে পারতো না।‘ এই মন্তব্য যে করতে পারে, তার কাছ থেকে ক্রিকেট প্রজ্ঞা সত্যিই কি আশা করা যায়? পেস বলে দুর্বলতা, লেগ সাইডে দুর্বলতা, রানিং বিটুইন দ্য উইকেট-ফিল্ডিং সবই জঘন্য, টস করা নিয়ে স্টিভ ওয়াহর সাথে নাটক (যার প্রেক্ষিতে ওয়াহ তাকে স্কুলবয় বলেছিল), শেন ওয়ার্নের সেই সরসিক মন্তব্য- ‘গাঙ্গুলী তো পাড়ার ক্রিকেটার’, লর্ডসের সেই জার্সি ওড়ানো উচ্ছ্বাস, এইসবকিছুই আমরা ভুলে গিয়েছি, সৌরভ গাঙ্গুলী মানে এখন জি-বাংলা চ্যানেলের দাদাগিরি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক।
নিন্দুকদের কথা বলি। প্রথমেই মনে পড়ে অস্ট্রেলিয়ান প্রয়াত ডেভিড হুকসকে। মাত্র দেড়দিনে টেস্ট শেষ করে দেয়ার অভাবনীয় তত্ত্ব বাতলে দেয়া ভদ্রলোককে সমুচিত জবাব দিয়ে বাংলাদেশ সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ দিন পর্যন্ত টেস্টে টিকে ছিলো। এরপর মনে পড়ে শোয়েব আখতারকে। পেশোয়ার টেস্টে পেস বোলিং দিয়ে বাংলাদেশকে উড়িয়ে দেয়ার হুংকার দেয়া বোলারটিকে কোনো উইকেট না দিয়ে নিজের জবাবটি গিলে নিতে বাধ্য করেছিলো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ইউনিস খান বলেছিল, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নিয়ে আফগানিস্তানকে দেয়া উচিত। ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াইশ, ১টা টেস্ট ড্র করে তাকেও ১টা সমুচিত জবাব দেয়া গেছে।
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা নিন্দুক আমি বলবো সুনীল গাভাস্কার আর বীরেন্দর শেওয়াগ। সুনীল গাভাস্কারের মন্তব্যগুলো ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণে খুবই প্রাসঙ্গিক, সেগুলো শুনতে যতই খারাপ লাগুক। তাকে আমি নিন্দুক না বলে সমালোচক বলতে চাই। ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে বলার জন্য ভারতীয় বোর্ড থেকে টাকা পেলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তার ক্রিকেট এনালাইসিসের সাথে একমত। আকাশচোপড়া নামের এক অখ্যাত ক্রিকেটার মাঝখানে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিল, কিন্তু সেগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয়ার কিছু নেই।
শেওয়াগ টেস্টের আগে বলেছিলো ‘বাংলাদেশের বোলিং খুবই অর্ডিনারি, ওদের ২০ উইকেট নেয়ার এবিলিটি নেই’। প্রায় ৮ বছর পূর্বে বললেও আমি মনে করি শেওয়াগের কথা এখনো বাস্তবতা। আমরা ভাগ্যচক্রে ইংল্যান্ডকে অলআউট করেছি, কিন্তু বোলিং কোয়ালিটির কথা চিন্তা করলে টেস্টে থ্রেট তৈরির মতো বোলার আমরা এখনো প্রোডিউস করতে পারেনি। মিরাজ উইকেট পেয়েছে সত্যি, কিন্তু তার বোলিংয়ে আমি এমন কিছু দেখিনি যার প্রেক্ষিতে তাকে চ্যাম্পিয়ন বোলার বলা যেতে পারে মুস্তাফিজের মতো। তাকে আমার মাহমুদুল্লাহ আর সোহাগ গাজীর মাঝামাঝি একজন বোলার মনে হয়েছে। (মাহমুদুল্লাহ অভিষেক টেস্টে ৫উইকেট পেয়েছিল, সোহাগ গাজীরও ৬ উইকেট নেয়ার কীর্তি আছে)। তাই ১-২ টেস্টের পারফরম্যান্স নিয়ে তুষ্টিতে ভোগার কিছু নেই যে আমরা বেশিরভাগ টেস্টে ২০ উইকেট নেয়ার এবিলিটি অর্জন করে ফেলেছি। টেস্টে আমাদের পেসার কই? উইকেটের সাহায্য না পেলেও স্পিন করাতে পারে এমন স্পিনার কই; তাহলে উইকেটটা নেবে কে; তাইজুল ইসলাম? সিজনাল সমর্থক যারা বাংলাদেশের বাইরে কোনো দলের খেলা দেখে না, তারা ১-২টা ম্যাচের ফলাফল নিয়ে মাতামাতি করতে পারে, কিন্তু যারা ক্রিকেটের বিশাল ক্যানভাস নিয়ে আবিষ্ট থাকে,তারা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারবেন শেওয়াগ কতটা নির্মম এক সত্য বলেছিল। নিজের শুনতে খারাপ লাগলেই তার কল্লা ফেলে দিতে হবে এরকম জঙ্গী মনোভাব যেসব মানুষের, তাদের সাথে আর যা-ই হোক কোনো গঠনমূলক আলোচনা চলে না। এইসমস্ত সমর্থক প্লেসমেন্ট ক্রিকেটের জন্য ক্ষতিকর। এরাই তাসকিনের হাতে ধোনির কাটামুন্ডের ছবি ভাইরাল করে, এবং সাইবার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়, অথচ জানেও না তাসকিনের বোলিংয়ের বিশেষত্ব কী, ধোনির ক্যাপ্টেন্সির গুরুত্ব কী; এরা শুধু জানে বিপক্ষ দল মানে শত্রুশিবির। এই যুদ্ধংদেহী মানুষের সুবুদ্ধির জন্য দোয়া করা ছাড়া উপায়ন্তর নেই কোনো।

সবাই নিন্দুক বা বিদ্বেষী নয়, পজিটিভ মেন্টালিটিরও আছে অনেকে। প্রথমেই বলবো নাসের হুসেইনের কথা। খেলোয়াড় হিসেবে খুব বেশি স্টাইলিশ না হলেও কমেন্টেটর হিসেবে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় এই সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে সবসময় পজিটিভ কথা বলে সে। আরেকজন কমেন্টেটর এলান উইলকিনস। বাংলাদেশ যখন নিয়মিত ইনিংস ব্যবধানে হারতো, তখনও কোনো ব্যাটসম্যান বা বোলারের পারফরম্যান্স চোখে পড়লে সেগুলো নিয়ে আলাদাভাবে বলতো। ডেভিড লয়েডের কথাও বলা যায়। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর সেই ম্যাচে আতহার আলিকে কমেন্ট্রি বক্সে বাতাস করার দৃশ্য এখনো মনে পড়ে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রকৃত অনুরাগী কেউ থাকলে তিনি প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পেছনেও তার ক্রিকেট কূটনীতির বিশাল প্রভাব রয়েছে। আরও ২জন ভারতীয়র কথা বলতে হবে। একজন ক্রিকেটার ভিভিএস লহ্মণ, অন্যজন কমেন্টেটর হারশা ভোগলে। বিশেষত হারশা ভোগলে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ারও আগে থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন, এবং একটা পজিটিভ মাইন্ডসেট নিয়ে চলেন।
শুধু ব্যক্তি নয়, বিদ্বেষীর তালিকায় ইংলিশ এবং অস্ট্রেলিয়া মিডিয়াকেও রাখতে হবে। বাংলাদেশ যখন প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া সফরে গেল, তখন তাদের জন্য কেয়ার্নস আর ডারউইনের মতো অখ্যাত মাঠের ব্যবস্থা করা হয়, ভালো কোনো গ্রাউন্ডে তাদের খেলতে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। ২০০৬ এ ইংল্যান্ড সফরে যায় যখন বাংলাদেশ এবং টেস্টে বাজেভাবে হারে, তখন ইংলিশ মিডিয়াতে নিউজ আসে বাংলাদেশকে লর্ডসের আশপাশেই ঢুকতে দেয়া উচিত হয়নি, এরা ক্রিকেটের জন্য অভিশাপ। সেই ইংল্যান্ডকে বাংলাদেশ দুটো বিশ্বকাপে হারিয়েছে, টেস্টে ৩ দিনে হারিয়ে দিয়েছে; এশেজ হারলেও বোধহয় এতোটা অপমানিত বোধ করতো না তারা। কাজেই সাবধান বাংলাদেশ, সামনে খুব কঠিন সময় অপেক্ষা করে আছে। ইন্টেলেকচুয়াল কমিউনিটি তৈরি তো?

লোকাল মিডিয়ার প্রসঙ্গে আসি। মানুষ যতই হাসাহাসি করুক, আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু মনে করি চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফতকে। ৯৭ এর আইসিসি ট্রফিতে ভদ্রলোক যেভাবে রেডিও ধারাভাষ্য দিয়েছে সেই স্মৃতি আজও অমলিন। সিধুর ব্যাপারেও প্রকাশ্য স্টেটেমেন্ট বোধহয় একমাত্র সে-ই দিয়েছে; ‘সিধু কোন্ লেভেল পর্যন্ত ক্রিকেট খেলেছে, সে মডার্ন ক্রিকেট সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখে?’- এরকম কথা সে নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছে। আবেগের আতিশয্য ছিলো অবশ্যই, কিন্তু ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’- এরকম কথাও তো ভুলতে পারি না। কাছাকাছি কথা প্রযোজ্য আতহার আলি এবং শামীম আশরাফ চৌধুরীর ব্যাপারেও। বাংলাদেশ যখন ম্যাচের পর ম্যাচ জঘন্যভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে, তখন প্রেসবক্সে টিপ্পনীগুলো তাদেরই হজম করতে হয়েছে।
জার্নালিস্টদের কথা বললে বলবো আরিফুর রহমান বাবুর প্রসঙ্গ। এই লোকটি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে গভীর প্যাশনের সাথে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন, প্রথম আলোতে কাজ না করার কারণেই বোধহয় লাইম লাইটে কম এসেছেন।
ক্রিকেটারদের স্টার বানানোর গল্প নিয়ে কাজ করেছেন উৎপল শুভ্র। মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি এদের নিয়ে ক্রেজ তৈরির পেছনে এই মানুষটার অবদান যেমন, আশরাফুলের পতনের ক্ষেত্রেও তাকে দায়ী করা যায়। তবু স্টার ক্রেজ তৈরির যে উদ্যোগ তার মাধ্যমে শুরু হয়েছে এই অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। স্ট্রেইটকাট কথা বলা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ক্রিকেট রাজনীতি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে মোস্তফা মামুনের অবদানকেও স্বীকার করতে হবে, তবে কালের কণ্ঠ পত্রিকার আদর্শ বাস্তবায়নে অনেক সময়ই বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। ক্রিকেটারদের নিয়ে মিথ তৈরি, বইয়ের ক্যারেক্টার বানানো এসব কাজের জন্য দেবব্রত মুখার্জীকেও আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে হবে। মাশরাফিকে নিয়ে লেখা বইটি তিনি যেভাবে মার্কেটিং করেছেন এবং ক্রেজ তৈরি করেছেন, এই স্কিলের প্রশংসা না করে উপায় নেই। আরও কয়েকজন এরকম উদ্যোগ নিতে থাকলে ক্রিকেট লিটারেচার টার্মটা আমাদের কালচারে এস্টাব্লিশ হয়ে যাবে। রণজিত বিশ্বাস নামে একজন ক্রিকেটের সাথে হিউমার মিলিয়ে এক ধরনের সাহিত্য লিখতেন এককালে। সেটাও সময়ের বিচারে অনেক আধুনিক ছিলো। সাম্প্রতিককালে আরিফুল ইসলাম রনী ক্রিকেট জার্নালিজমকে ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলে নিয়ে গেছেন; তিনি স্রেফ রিপোর্ট লিখেন না, তার লেখনীতে ইনসাইট পাওয়া যায়। একই কথা প্রযোজ্য মোহাম্মদ ইসামের বেলায়ও। ক্রিকইনফোতে নিয়মিত বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ইংরেজি ভাষায় যেসব আর্টিকেল লিখে চলেছেন এই মানুষটি, তাতে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট আলোচনার টপিক হতে পারছে।
তবে কোয়ালিটি প্রশ্নে বাংলাদেশের ক্রিকেট জার্নালিজম এখনো অনেকটাই পিছিয়ে আছে। মূলত এখানে যারা ক্রিকেট নিয়ে লেখে তারাই ফুটবল, ভলিবল, হকি নিয়ে রিপোর্ট করে। অর্থাৎ স্পোর্টস জার্নালিজমে সেক্টরভিত্তিক প্রফেশনাল ডিভাইডেশন এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি। ক্রিকেটের ক্রেজ থাকার কারণে স্পোর্টস ডেস্কের মানুষটিই ক্রিকেট নিয়ে তুলনামূলক বেশি লিখছে, এটুকুই যা পার্থক্য।

কিন্তু এখন ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিকেট বিপ্লবের সময় সমাগত। বাংলাদেশ মাঠের ক্রিকেটে উঠে আসছে, এটাকে বিদ্বেষীরা ভালো চোখে দেখবে না, আজ সৌরভ গাঙ্গুলী বলছে, পরশুদিন শহীদ আফ্রিদি বলবে, পরের মাসে বলবে জেমস এন্ডারসন বা বেন স্টোকস। কিংবা বিষেণ সিং বেদী বা আরবিন্দ ডি সিলভার মতো প্রাক্তন ক্রিকেটার। তাদের ইন্টেলেকচুয়ালি হ্যান্ডল করতে হবে। অহেতুক ট্রল বানিয়ে, নিজেদের আঙিনায় গালিগালাজ করে এই বিদ্বেষের সমাধান হবে না, এর জন্য ক্রিকইনফোতে লিখতে হবে বা লোকাল কমিউনিটিতে ইংরেজি ভাষার কোনো স্পোর্টস সাইট চালু করতে হবে। আমি ইতিপূর্বে বিসিবির উদ্দেশে এরকম একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অন্যগুলো যেমনই হোক, অন্তত এই ব্লগসাইট চালুর ব্যাপারে বিসিবির অবশ্যই হ্যাঁ সূচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। নইলে সমীকরণ কিন্তু ক্রমেই জটিল হয়ে উঠবে। আগামী ৫ বছরে শুধু মাঠের ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না, প্লেসমেন্ট ক্রিকেটেও একইরকম আন্তরিক থাকতে হবে। এটা আমি বুঝছি, আর আপনারা এতো বড় সংগঠন চালিয়ে বুঝতে পারছেন না?
Wake up BCB, it’s time to rekindle cricket-intellect