লিটন দাসকে বর্ণনা করে সর্বশেষ ৪ বছরে যতগুলো আর্টিকেল লিখেছি, শুধুমাত্র সেগুলো সংকলন করলেই ২৫০ পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে অবলীলায়।
সেদিন রিদওয়ান তালুকদার নামের এক অনুরাগী চাওমিন খেতে খেতে প্রশ্ন করে- উৎপল শুভ্র যেমন আশরাফুলকে নিয়ে মাতামাতি করত, লিটনের ক্ষেত্রে আপনাকে কি আরেকজন শুভ্র বলা যায়?
খুব বোল্ডলি বলেছিলাম- একদমই না।
তাকে যে ব্যাখ্যাটা দিইনি সেদিন, আজ মনে হলো লেখা দরকার। ফরম্যাট যেটাই হোক, লিটন সেঞ্চুরি করলেই উন্মোচন করব বিভিন্ন পাজলের সংকেত।
আমি কোনো মিডিয়া হাউজকর্মী নই। তাই সেলিব্রিটিদের নিয়ে পড়ে থাকা আমার জীবন-জীবিকায় ন্যূনতম গুরুত্ব বহন করে না।
কিন্তু পেশাসূত্রে আমি একজন বায়োপিক এনালিস্ট, তাই মানুষের সমুদ্রে সাঁতার কেটেই পার করি অস্তিত্বের সমগ্র সময়টা।
তারই পরম্পরায় কিছু মানুষের প্রতি আত্মিকভাবে কানেক্টেড বোধ করি। সেখানে যেমন লুবনা, পাপড়ি, ফারহানা ব্রতী, আরমান, অজন্তা হালদার এর মতো অখ্যাত মানুষ রয়েছে, অনুরূপ জেমস, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এসএম সুলতান, পীথাগোরাস এর মতো মানুষও পাবেন। তালিকাটা অনেক লম্বা।
মূলত সুনির্দিষ্ট মানুষের প্রতি সংযোগ বোধ করা আমার জন্মগত মানবধর্ম। এরা প্রত্যেকেই আমার আত্মীয়। যারা আমার বই-টই পড়ে অথবা ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে আড্ডা মারে নিয়মিত তারামাত্রই জানে এইসব নিজস্ব আত্মীয়ের প্রতি আমার কমিটমেন্টের লেভেল কতটা সাংঘাতিক পর্যায়ের প্রবল।
সঞ্চিতার সাথে নানা প্রসঙ্গেই কথা-বার্তা হয় মাঝেমধ্যে। অনলাইনে লেখালিখির কারণে যে ১৮-২০ হাজার মানুষ আমাকে খুঁজে নিয়েছে, সেও তাদের একজন। তবু তার কথা আলাদাভাবে বলার সাথেও যুক্ত আছে লিটন দাস, কারণ উল্লিখিত এই সঞ্চিতা তার সহমানুষ।
সেলিব্রিটি শব্দটার প্রতিই এলার্জিক; তাদের সংস্পর্শও এড়িয়ে চলি, কারণ সেলিব্রিটিদের চারপাশে মৌচাকের মতো এত মানুষ মৌ মৌ করে যে একটা সময়ে অবচেতনভাবেই তারা ধরে নেয় আশপাশের মানুষজন তাদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে উদ্দেশ্য নিয়ে। সঞ্চিতাকে তাই শুরুতেই সহজ ভাষায় বলে দিয়েছি- ‘আপনার হাজবেন্ড সেলিব্রিটি, আপনি নন। আপনার সাথে কথা বলে ইনোসেন্ট মনে হয়েছে, তাই অন্য যে কোনো পছন্দের মানুষকে যেভাবে মূল্যায়ন করি, আপনাকেও স্বতন্ত্র ইনডিভিজুয়াল হিসেবেই দেখি এবং ইনোসেন্স বা সিম্পলিসিটিকে এপ্রিসিয়েট করি। প্রতিটি মানুষের সাথে আমার কানেক্টিভিটির নানা উপলক্ষ বা কার্যকারণ থাকে, আপনার ক্ষেত্রে ঘটনাবশত সেটা লিটন; নাথিং এলস। তাছাড়া লিটন এখন সেলিব্রিটি, ৬-৭ বছর পর খেলা ছাড়লে আর থাকবে না, সেও হয়ে যাবে ভিড়ের মধ্যে থাকা একজন। তখন কি তার মানে আপনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে? পক্ষান্তরে আমরা যারা লিখি বা গবেষণা করি তারা আজীবন একই আইডেন্টিটি বহন করি। লিটনের সাথে বিয়ের পূর্বেও আপনার ২৬ বছরের একটা স্বতন্ত্র জীবন ছিল, ততদিনে মানুষের পারসোনালিটি ম্যাচিউর হয়ে যায়’।
(*** বয়সে ছোটদের ক্ষেত্রে আপনি সম্বোধনটা ন্যাচারাল না আমার ক্ষেত্রে, তবু কারো কারো ক্ষেত্রে কৃত্রিম একটা শিষ্টাচার দেখাই)
দ্রাবিড় খেলা ছেড়েছে কত বছর আগে, জেমসের নতুন কোনো সেনসেশনাল গান নেই ১৫ বছরের বেশি, তবু তাদের প্রতি কৈশোরের সেই সংযোগ একইরকম রয়ে গেছে। পাপডি, লুবনা, আরমান, চমক হাসান দের সাথে দেখা হয় কত কম, কারো সাথে শেষ দেখা হয়েছে ১৫ বছর পূর্বে; তবু কি সংযোগ শিথিল হয়ে গেছে?
হয়নি!
শুরুতে যা বলছিলাম, লিটনকে নিয়ে যা লিখেছি এতদিনে, সেগুলোই বই হতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট বিষয়ক বই লেখার তো কোনো কারণ খুঁজে পাই না। এগুলো ব্লগের লেখা হিসেবেই মানানসই।
যদি কখনো সত্যিই বোধ করি লিটনকে আবিষ্কার করা দরকার, সেই বইয়ের থিম হবে ‘যেখানে ক্রিকেট নেই’, অর্থাৎ An enigmatic individulal/entity beyond cricket; ব্যাটিং এলিগ্যান্সটা সেখানে একটা অনুঘটক মাত্র। তার ব্যক্তিত্ব আগ্রহ জাগালো কিন্তু ব্যাটিং স্টাইল নাঈম শেখ বা তিলকারত্নে দিলশানের মতো, খুবই সম্ভাবনা আছে লিটন আমার কাছে ৫-১০ টার বেশি শব্দ বরাদ্দ পেত না। আবার হাশিম আমলা, মার্ক ওয়াহ, সাঈদ আনোয়ার, রোহিত শর্মা, বাবর আজম, কেভিন পিটারসেন, জয়াবর্ধনে, কে এল রাহুল, ব্রায়ান লারা সহ গত ২৬ বছরের এলিগ্যান্ট সব ব্যাটসম্যানের খেলা দেখেছি প্রচুর; কাউকে নিয়ে তো লিখি না সেভাবে।
তাহলে লিটনের বিশেষত্বটা কী যার কারণে ব্যক্তিত্ব এবং ব্যাটিংয়ের মধ্যে এমন অভূতপূর্ব সংমিশ্রণটা তৈরি হলো৷
লিটনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পর্যবেক্ষণ করলে নির্লিপ্ততা, নির্বিকারত্ব, নৈর্ব্যক্তিকতা, আনপ্রেডিক্টিবিলিটি প্রভৃতি প্রবণতাগুলো খুব দারুণভাবে প্রকট হয়ে উঠে। প্রকাশভঙ্গি হয়ত আলাদা, তবে একই প্রবণতা আপনি পাবেন ব্যান্ড তারকা জেমসের মধ্যে, কিছুটা পাওয়া যাবে সাকিবের মধ্যেও। তবে জেমস এবং সাকিবের ক্ষেত্রে বৈষয়িক বুদ্ধিরও সংযোগ ঘটায় তারা লিমিট ভাঙতে পেরেছে সামাজিক সেটকৃত সাফল্য প্যারামিটারে।
উল্লিখিত ৪ প্রবণতার বাইরে লিটনের এক্সক্লুসিভ কয়েকটা বৈশিষ্ট্য আছে অনুমান করি। তাকে দেখে মনে হবে অমনোযোগী, উদাসীন, ক্যাজুয়াল, কিন্তু আদতে সে সবটাই খেয়াল করে। হয়তবা আপনি ভুলে গেছেন, অতি তুচ্ছ ব্যাপারটিও পরে মনে করিয়ে দিয়ে আপনাকে তাক লাগিয়ে দিবে।
মেলামেশার ক্ষেত্রে সে সিলেক্টিভ, অর্থাৎ কথা বলে কমফোর্ট বোধ করাটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়ত অনেক স্বপ্ন নিয়ে গেছেন তার সাথে সময় কাটাবেন, কিন্তু আনমনে একঝলক তাকিয়েই যদি সে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় আপনি যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং নন, ভদ্রতাবশত সে হয়ত আপনার সাথে কথা চালিয়ে যাবে, কিন্তু নিজেই একটা সময় উপলব্ধি করবেন আলাপটা কোনো গন্তব্যে আগাচ্ছে না।
তবে সাকিব বা জেমসের সাথে লিটনের মূল পার্থক্যটা এমপ্যাথিতে।
সাকিব বা জেমস যা মনে আসে বলে দিবে, আপনি আঘাত পেলেন কিনা প্রাধান্য দিবে না, কিছুটা ড্যাম কেয়ার এটিচুড; লিটনের ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রধান বিবেচ্য তার কথায় আপনি যেন আহত বোধ না করেন। তার স্বল্পভাষী হওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। সে হয়তবা বিহেভিয়েরাল কনফিউশনে ভুগে। কোন কথাটা বলা উচিত, ওই লোকটা আমাকে কীভাবে পোরট্রে করছে। যে কারণে সে এক নিজস্ব ঘেরাটপে নিমজ্জিত থাকে সর্বক্ষণ।
এই নিমজ্জনটা ন্যাচারাল, এবং এর একটা নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। যেহেতু সে অন্যের অনুভূতির প্রতি এমপ্যাথিপ্রবণ, অন্যদের থেকেও একইরকম আচরণ প্রত্যাশা করে। সেখানে অন্যথা ঘটলে ভেঙ্গে পড়ে। তার মানে এটা নয় সে সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, কিন্তু সাকিব বা জেমস যেমন এরোগেন্টলি সমালোচনাকারীদের বৃদ্ধাঙ্গলি দেখাতে পারে, তাদের যথেষ্ট যোগ্য মনে করে না, লিটন প্রকৃতিগতভাবেই ততটা এরোগেন্স দেখাতে পারে না, বরং আপনমনে ভাবে লোকটা এভাবে না বললেও পারত, আমি কি এই আচরণ ডিজার্ভ করি। তারপর হয়ত নিজের জগতে ফিরে যায়।
এরকম বৈশিষ্ট্যের মানুষকে আপনি স্পিরিচুয়াল এবং ফিলোসফিকাল পয়েন্ট দিয়ে আকৃষ্ট করতে পারবেন, তারা যে কোনো কাজের পারপাজ এবং মিনিং খুঁজে। আপনি তাকে অনেক পরামর্শ দিবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সেটাই করবে যা তার কাছে মিনিংফুল মনে হবে, এমনকি সেটা যদি চূড়ান্ত ভুলও হয়। তাতে তাকে আপনার ঘাড়ত্যাড়া, একগুয়ে অনেক কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু বিবেকের প্রতি সে কমিটমেন্টবদ্ধ। কমিট করলে সেটা পূরণ করবেই। যে কারণে দেখবেন ব্যক্তিগত গ্লোরির চাইতে টিমে তার যা প্লেয়িং রোল দেয়া হয় সেটা পূরণেই ফোকাসড থাকে। কখনো সফল কখনোব ব্যর্থ। কিন্তু কমিটমেন্ট ভঙ্গ করবে না। কমিটমেন্টের এই ব্যাপারটা সেই ২০১৯বিশ্বকাপে উপলব্ধি করতে পারি বলেই তখন থেকে ক্রমাগত লিখে যাচ্ছি সাদা বলের ক্রিকেটে তার প্লেয়িং রোল পালটে দিতে হবে, পাওয়ার প্লে ইউটিলাইজেশনের দায়িত্ব দেয়া হোক অন্য কাউকে, সে নামুক ৩-৪ এ, দলের এবং নিজের এচিভমেন্ট বেড়ে যাবে। কিন্তু সাকিব আর মুশফিক ওই দুটি পজিশন এমনভাবে আকড়ে ধরে আছে, ৫ এর আগে সুযোগই হয় না। তার ক্যালিবারের একজন ব্যাটসম্যান ৩ টা উইকেট পড়ার পরে নামলে ন্যাচারাল খেলাটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে তামিম নেগেটিভ এপ্রোচে ব্যাটিং করবেই, ফলে পাওয়ার প্লে কাজে লাগানোর কনফ্লিক্টিং প্লেয়িং রোল থেকে আর মুক্তি মিলছে না।
আজ ক্রিকইনফোতে মোহাম্মদ ইসাম এর একটা আর্টিকেল পড়লাম। টেস্টে ভালো করতে প্রয়োজনে টি২০ ছেড়ে দিতে পরামর্শ দিয়েছে। অত্যন্ত কনজারভেটিভ এবং নেগেটিভ চিন্তা। কোহলি, বাবর আজম, কেইন উইলিয়ামসন, হাসিম আমলা ৩ ফরম্যাটেই খেলে গেছে, তাতে কি অন্য ফরম্যাটে প্রভাব পড়েছে? আপনার টি২০ দলের ওপেনার নাঈম শেখ, মিডল অর্ডার সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ— সেই একাদশ থেকে আপনি লিটনকে ড্রপ করে দিচ্ছেন? অথচ টি২০ তে ৪ নম্বরে নামিয়ে দিলে সে রানরেট ঠিক রেখেও অসাধারণ স্ট্রাইক রোটেশন জারি রাখতে পারবে বর্তমান বাংলাদেশের যে কোনো ব্যাটসম্যানের তুলনায়। এইসব কনজারভেটিভ চিন্তাধারার লেখক আর সমর্থকরাই ব্যতিক্রমী মননের মানুষদের বিকাশের প্রধান অন্তরায়, অথচ এরাই ভোকাল সর্বত্র!
লিটন কথা কম বলে, কিন্তু তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিতে হয়। যথাযথ প্রশ্ন করতে পারলে তার কাছ থেকে অত্যন্ত ইনসাইটফুল মন্তব্য পাবেন, যেখানে পাবেন না ফরমালিনের আস্তরণ। এখনো মনে পড়ে ২০২০ এর জিম্বাবুয়ে সিরিজের প্রথম ওয়ানডের প্রেস কনফারেন্স। ১২৬ করে রিটায়ার্ড হার্ট হয়েছিল, প্রশ্ন ছিল ডাবল সেঞ্চুরি মিস করায় খারাপ লেগেছে কিনা। সে বলেছিল, ভাই আমি ৫০ রানই করতে পারি না, ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন কীভাবে দেখব। সেই সিরিজেই আরেকটা ইন্টারভিউতে বলেছিল- ক্রিকেট হতাশার খেলা, আপনি এক ম্যাচে সেঞ্চুরি করবেন, পরেরটায় জিরো। লিটনের এই কথাটার পরে গুগলে ঘাঁটাঘাটি করে কিছু আর্টিকেল পেয়েছিলাম এথলেটদের মনোজগত বিষয়ক। একটা রিসার্চ আর্টিকেল পড়ি, অন্য যে কোনো এথলেটদের চাইতে ক্রিকেটাররা হতাশ বেশি হয়, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তাও বেশি আসে। কারণ এত ট্রাঞ্জিশন আর ট্রান্সফরমেশন সবাই নিতে পারে না। অথচ এতটা বুদ্ধিদীপ্ত এক মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে প্রচুর স্ট্যাটাস প্রসব করতে দেখেছি লোকজনকে, তাকে আখ্যায়িত করেছে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে! কতটা প্যাথেটিক আমাদের চিন্তাশীল মানুষজন!
টি২০ বিশ্বকাপের পূর্বে প্রথম আলো একটা মিনি ইন্টারভিউ করেছিল, ব্যাটিং কোচ এশওয়েল প্রিন্সের রেফারেন্স দিয়ে বলেছিল তিনি মনে করেন আপনি সব ফরম্যাটেই ওয়ার্ল্ড ক্লাস ব্যাটসম্যান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। লিটন খুব স্পষ্টভাষায় বলে- পারফরম্যান্স দেখাতে না পারলে এসব মনে করা দিয়ে কিছু হবে না। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে কয়েকটা ইনিংস ছাড়া আমার ক্যারিয়ারে অর্জন তো তেমন নাই।— এরকম অকপট আত্মসমালোচনা কেউ আলাদাভাবে খেয়াল করেছিল কিনা মনে নেই, তবে আমাকে কৌতূহলী করেছিল। ২০১৬ এর পুরোটা, আর ২০১৭ এর অর্ধেকের বেশি সময় সে ছিল দলের বাইরে। ইউটিউবে সেই সময়ের একটা ছোট ইন্টারভিউ পাওয়া যায়, যেখানে সে বলছে- ‘ব্যাটটা উচু করে ধরতে সবারই ইচ্ছা করে। এর আগে যেখানেই খেলেছি রান করেছি, খারাপ সময়ের সাথে পরিচিত ছিলাম না’।— অর্থাৎ তার চিন্তার শিফটিংগুলো অনেক আগে থেকেই হচ্ছিল, সিকুয়েন্সিংটা হয়তবা ছিল অলক্ষ্যে।
আমাদের এই জনপদে নতুন কিছু কনসেপ্ট এসেছে মার্কেটে। যেমন অধিনায়ককে প্রচুর টকেটিভ হতে হবে, মাঠের মধ্যে চিল্লাপাল্লা করতে হবে, মাঠের বাইরে থরে বিথরে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াতে হবে, বোর্ডের সিস্টেমবাজির অংশ হতে হবে, কিছু ইয়ার-বকশি সাংবাদিক পুষতে হবে, যারা খাটি খাদেমের মতো তাকে প্রমোট করবে। তবেই তাকে আমরা ক্যাপ্টেন ম্যাটেরিয়াল বলবো। কিন্তু ক্যাপ্টেনের মূল বৈশিষ্ট্য যে এথিকাল কারেক্টনেস, ফোকাসড থাকা এবং চিন্তাশীলতা সেটা এই অর্ধশিক্ষিত-কুশিক্ষিত মানুষের দেশে কে কাকে বুঝাবে! কোয়ালিটিহীনতার যে মহামারি সর্বত্র, এখানে আমরা লিটনদের ট্রলের টার্গেট হিসেবেই অধিক উপযোগি হিসেবে উপস্থাপন করব।
আমি একদম নিশ্চিত, ক্রিকেটের ট্যাকটিকাল এবং স্ট্র্যাটেজিকাল বিষয়ে লিটনের চিন্তাধারা যে কোনো বাঙালি ক্রিকেটারের চাইতে অনেক তীক্ষ্ম, কিন্তু অন্য দলের খেলা দেখা বা ক্রিকেট সংক্রান্ত পড়াশোনার প্রবণতা খুবই কম হওয়ায় সেগুলো হয়তবা অর্গানাইজড নয়, কিংবা বলা যায় মেথডলজিকাল নয়। এটাই জ্ঞান আর প্রজ্ঞার পার্থক্য। জ্ঞান তৈরি হয় তত্ত্ব-তথ্য থেকে, সেগুলো একটা নির্দিষ্ট ছাঁচের। প্রজ্ঞা আসে উপলব্ধি-ইন্টারেকশন-ইমাজিনেশন-ইমপ্রোভাইজেশন প্রভৃতি প্রবণতা থেকে।
যে কারণে লিটনকে ভুল এন্টারপ্রেট করা, নেগেটিভলি পোরট্রে করা মানুষের সংখ্যা অগণিত। একটা জংলি পাড়ায় যদি একজন কবিকে বছরের পর বছর বসবাস করতে হয় এবং সেখানেই মানিয়ে চলতে হয় সেখানে যদি সে টিকেও যায় সেটা তার জন্য নির্বাসন দন্ডই হবে। তাই পাপন, সুজন, দুর্নীতির আখড়া ক্রিকেট পাড়া, ইন্টারনাল টিম পলিটিক্স এর টক্সিক পরিবেশটা লিটনের মতো সংবেদনশীল মননের মানুষের জন্য জংলি পাড়ার মতোই। এখানে যেহেতু সে অভিযোজিত হতে পেরেছে, তার মেন্টাল স্ট্রেন্থ নিয়ে বাজারে প্রচলিত সমস্ত থিওরিই শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যাবে।
প্রতিটি ক্রিকেটারের প্রাইম টাইম থাকে। এরপর ডিক্লাইন করতে থাকে। লিটনের ক্যারিয়ারের সেই প্রাইম সময়টা ২০২৭ পর্যন্ত, এরপর শুরু হবে ডিক্লাইন। সাকিবদের মেয়াদোত্তীর্ণ প্রজন্মের বয়স যেমন বাড়ছে, লিটনেরও তো থেমে নেই বয়স। তাদের চক্করে পড়ে কখনো কিপিং, কখনোবা ওপেনিংয়ে খেলে লিটনের থেকে বেস্ট আউটপুট আসার সম্ভাবনা আমরা কমিয়ে দিচ্ছি। তাই এই মুহূর্তে ২ টা প্রায়োরিটি
১. টেস্টের কিপিং থেকে অব্যাহতি দেয়া। এখানে সোহানকে নেয়া হোক, সে ৩০ করে দিলেই চলবে। অথবা অন্য কেউ। লিটন খেলবে ৪ নম্বরে। তাতে বাংলাদেশের টেস্ট ড্র করা অথবা জয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। মমিনুল ৫ এ বা ৬ এ চলে যাক।
২. ওয়ানডেতে ওপেন থেকে সরিয়ে ৩ বা ৪ এ খেলানো, তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে দলের ব্যাটিং; টি২০ তে ৪ এ সেটল করা। ইনিংসটাকে সে-ই টেনে নিবে।
এই দুই প্রায়োরিটি পূরণ হলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান র্যাংকিংয়ে ৫ এর মধ্যে ঢুকবে। তাতে লাভটা বাংলাদেশেরই। আকরাম, বুলবুল তাদের সময়ের সাপেক্ষে দেশসেরা ব্যাটসম্যান ছিল, তামিম-মুশফিকরাও নিজেদের সেরা সময়ে দেশসেরা ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু লিটনই প্রথম ব্যাটসম্যান যার সামর্থ্য আছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বসেরাদেরই একজন হওয়ার। সাকিবের পরে আরেকজন গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের প্লেয়ার হওয়ার।
আমাদের জংলি সিস্টেম সেই সুযোগ সম্ভবত দিবে না; আমরা লিটনকে ক্রমাগত পাওয়ার প্লে ব্যাশার হিসেবে পুশ করব, সে হাই রিস্ক শট খেলে আউট হবে, তারপর সব জায়গায় প্রচার করে বেড়াবো ‘এত্ত পরতিভার দরকার নাই, আর রাজ্জাক- সুমনের মতো লোকজন নির্বাচক হয়ে বাছাই করবে নাঈম শেখ, মোহাম্মদ মিঠুনদের। তাতে সমর্থক হিসেবে আপনিই বঞ্চিত হবেন, লিটনের খুব বেশি মন খারাপ হবে না গ্যারান্টেড। কারণ শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটটা সে নিছক আনন্দের জন্যই খেলে, এবং টাকা-পয়সা যতটুকু যা উপার্জন করেছে তাতে আফসোস কাজ করবে এমনও মনে হয় না। এবং টিভিতে খেলা দেখানো, ক্যামেরা এসব সে অনেক মিস করবে তাও না। সে নিজের নিয়মে ভালো থাকতে জানে, জীবনকে উপভোগের ব্যক্তিগত কিছু সূত্রও জানা আছে। লিটন যখন ফিল্ডিং করে, বডি মুভমেন্ট স্টাডি করলে নিজেই বুঝে যাবেন। না বুঝলে আমার লেখাটা রেফারেন্স হিসেবে রাখতে পারেন।
এজন্যই বললাম, লিটনের প্রতি সংযোগের ক্ষেত্রে ক্রিকেটিয় কারণের চাইতে ব্যক্তিত্বের গঠন অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। আপনার কোনো দায় পড়েনি ব্যাটসম্যানের বাইরে অন্য কোনো কনটেক্সট থেকে তাকে বিনির্মাণের। আপনি বরং ২ আউন্স ট্রল করুন, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ায় যদি অনিয়ন্ত্রিত কৌতূহল কাজ করে, লিটন দাস আপনার ওয়াচলিস্টে থাকবেই। সে এক বিরল স্যাম্পল, আই ক্যান চ্যালেঞ্জ