ক্রিকেট ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা পরিভাষা ঝিঁঝিঁ পোকা।
অবিশ্বাস্য এবং মিথ্যা হলো, ক্রিকেটের বাংলা যে ঝিঁঝিঁপোকা এটা কোনো ডিকশনারি দেখে শিখিনি, আমাকে শিখিয়েছিল ময়মনসিংহের মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদ! বলের সাথে তার ব্যাটের সুইট টাইমিংয়ে যে আওয়াজটা হয় আমার কবি মন তার সাথে মিল পেয়ে যায় ঝিঁঝি পোকার ডাকের।
রচিত হয় ২ লাইনের কাব্য-
‘খেলছে দেখ ব্যাট হাতে ওই রিয়াদ নামের খোকা
দুলছে মাঠে, ক্রিকেট তো নয়, রাতের ঝিঁঝিঁ পোকা’
সময়টা একুশ শতকের ঊষালগ্ন, মাত্র দেখা মিলছে গোঁফরেখার, গালে জানান দিচ্ছে দাঁড়ির ঝাপসা উপস্থিতি, ভেঙ্গে যাচ্ছে গলার স্বর— বড়রা বলছে বয়ঃসন্ধিক্ষণ, সেসময়ে নিজের সাপেক্ষে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মনে হতো দাদার বয়সী। তবে তারা আমায় স্নেহ করত, গল্প শোনাতো। বেশি না, মাত্র ২২ বছর আগের কথা।
এরকমই এক দাদার নাম শিবলি ভাই। ছিলেন ক্রিকেটার, এসএসসি দিয়েছেন সেবছরই। তার মুখেই শুনি- ময়মনসিংহে খেলতে গিয়ে এক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। দুর্দান্ত ক্রিকেটার, পড়াশোনায় তার এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল, খেলার ব্যস্ততায় পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে, এবছর তাদের সাথেই এসএসসি পাশ করলো। মাত্র ১৮ বয়সেই পরিচিতরা তাকে ডাকে ময়মনসিংহের জাভেদ মিয়াদাদ। রিয়াদ আর মিয়াদাদ শুনতে কাছাকাছি। এই ছেলে বড় হয়ে জাতীয় দলে চান্স পেলে বাংলাদেশের ভাগ্যই বদলে যাবে।
তখন থেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি কবে আসবে সেই সুদিন, বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে উদিত হবে রিয়াদ নামের তারা, ময়মনসিংহের মিয়াদাদ নয় সে হবে ‘রিয়াদ মেইড ইন বাংলাদেশ’।
কেটে গেল সাত সাতটা বছর।টি-২০ বিশ্বকাপ, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শ্রীলংকার বিপক্ষে সাঙ্গাকারাকে বোল্ড করার মাধ্যমে সে জানিয়ে দেয় সৌদি আরবের রাজধানী নয় রিয়াদ মানে ব্রান্ড অব বাংলাদেশ, তার মতো কেউ ছিল না, হবেও না কোনোদিন।
আমারও সমস্ত সংশয় কেটে নিশ্চিত হই অতি আমদানি নির্ভর বাংলাদেশে এক প্যাকেট লবণও যেখানে আমদানি করতে হয় সেই দেশে একটা রফতানিযোগ্য প্লেয়ার পাওয়া গেল যাকে জিম্বাবুয়ে বা কেনিয়া মানের ক্রিকেট পরাশক্তিগুলো অবজ্ঞা করলেও কুয়েত, আর্জেন্টিনা, জাপান, জার্মানি, ব্রাজিল কিংবা রাশিয়াসহ আইসিসিভুক্ত শতাধিক সদস্য দেশের যে কোনোটিই লুফে নিবে।
বিশ্বের বুকে এ এক অনবদ্য-অশ্রুতপূর্ব অর্জন। নতুন করে লিখি ২ লাইনের পদ্য
ভারতে আছে কিশোর কুমার, হলিউডে জ্যাক স্প্যারো
রিয়াদ তুমি প্রসারিত হও, আমরা ভীষণ ন্যারো
২২ বছর আগের সেই বয়ঃসন্ধিক্ষণের কিশোর আজ দামড়া হয়েছে, তার ২ কন্যাও কয়েক বছর পর মাধ্যমিক দিবে, শিবলি ভাই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড, চল্লিশের প্রভাবে পাক ধরেছে চুলে, কিন্তু তার চাইতেও ১ বছরের সিনিয়র সেই ময়মনসিংহের মিয়াদাদ এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাঠ! সে প্রমাণ করেছে বয়স কেবলই সংখ্যা নয়, বয়স কাউকে ক্ষমাও করে না।
তবু সে ক্ষমার পরোয়া করছে না।
মাশরাফি মুর্তজা যদি ৯ বার হাটু অপারেশন করিয়েও বিশ্বকাপ মাতাতে পারে সে দিব্যি সুস্থ্য মানুষ কেন স্রেফ বয়সের কুদৃষ্টির কাছে হার মানবে; সে কি মাশরাফির চাইতে কম ভালোবাসে দেশকে! মাশরাফির সাথে যদি থাকে ই-অরেঞ্জ তার সাথে কি নেই আকাশ ডিটিএস? সর্বোপরি ৭০ বয়সে রজনীকান্ত যদি নায়ক হতে পারে, সে যদি থেমে যায় চল্লিশেই, পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে?
মোরাল ডিলেমা মাকড়সার ন্যায় ক্রমাগত বিস্তার করতে থাকে জাল।
দর্শক তাকে মাঠে চায়, তাকে খেলতে দেখেই সাংবাদিকতায় আসা সেদিনের ছোকরা রিয়াসাদ আজিম তাকে দলে না দেখলে অভিমানে অনশনে বসে, আরেক স্নেহভাজন সামি ক্রিকেট বিশ্লেষণের মধ্যেও জানাতে ভুলে না মাহমুদুল্লাহ এর বিকল্প নেই, তার পুত্র স্বপ্ন দেখে একদিন বাবা-ছেলে একসাথে জাতীয় দলে খেলে বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতাবে ভূটানের বিপক্ষে।
এত শত ইমোশনকে সে কীভাবে উপেক্ষা করবে। বিবেকের তাড়নায় সে খেলতেই থাকে, শরীর যতই বিশ্রাম চাক, এসব নেগেটিভ এনার্জিকে সে প্রশ্রয় দিবে না।
মাথা বলছে বিদায় হও, হৃদয় বলছে থেকে যাও!!!
অসহনীয় এই মোরাল ডিলেমায় আমি ব্যথিত হই।
বাংলাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার কে এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেছে সেই ২০১১ বিশ্বকাপেই যখন তারই দিক নির্দেশনায় পেসার শফিউল সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হারতে থাকা ম্যাচে ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। একজন জেনুইন ব্যাটসম্যান তার সমস্ত স্কিলসেট টেইল এন্ডারের শরীরে ট্রান্সফার করে দিল, এরকম ২য় দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে কে দেখাতে পেরেছে? এশিয়া কাপের ফাইনালেও সে ট্রান্সফার করতে চেয়েছিল বোলার রাজ্জাকের মধ্যে, কিন্তু নীচ মনের পাকি বোলার আইয়াজ চিমা তাকে ধাক্কা দেয়ায় ক্যান্সেল হয় ট্রান্সফার, ম্যাচটা বাংলাদেশ হেরে বসে স্রেফ চিমার চক্রান্তে।
তবে চিমার অপরাধের দায় মাহমুদুল্লাহকে দেয়ার মতো অমানবিক হতে পারিনি৷
তাই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার তালিকায় প্রথম ৫টা পজিশনে রিয়াদকে বসিয়ে, ৬ নম্বর পজিশনটা তাকে সম্মান জানিয়ে ফাঁকা রেখে ৭ নম্বর থেকে খোঁজা শুরু করি অন্যদের। কখনো সেখানে সাকিব-টাকিব আসে, তবে সিংহপুরুষ রিয়াদের প্রতাপের সামনে ইদুর হয়ে পলায়ন করে গর্তে।
আমি আবারো রচনা করি পদ্য
ধন্য রিয়াদ, তোমার পরে জন্মেছিলাম আমি
তোমার সাথে পড়তো স্কুলে, আমার ছোট মামী
আমার মনে হয় না ক্রিকেট ইতিহাসেই মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদের মতো ভার্সেটাইল ক্রিকেটার খুব বেশি ছিল। একটা সময় ক্রিকেট রোমান্টিকদের খুব পছন্দের টপিক ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাইক হাসি, ভারতের মাহেন্দ্র সিং ধোনি আর বাংলাদেশের মাহমুদুল্লাহ— কে সেরা ফিনিশার। স্রেফ বাংলাদেশী হওয়ার কারণে এবং আইসিসিকে হাত করে ধোনি বিশ্বকাপ জিতে নেয়ায় রিয়াদ তার প্রাপ্য মূল্যায়ন পায়নি। তবে প্রকৃতি ঠিকই তার দায় চুকিয়েছে। এজন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ৭ বছর। ধোনির মতো পাতানো ম্যাচ খেলে হিরো হওয়া নয়, বিশ্বকাপের পরে ২য় মর্যাদাপূর্ণ আসর নিদহাস ট্রফিতে ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রিয়াদ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী।
রিয়াদের ব্যাটিং-বোলিংয়ের কোটি কোটি অনুরাগী, সে তুলনায় তার ফিল্ডিং ছিল প্রাদপ্রদীপের আড়ালে। আমি তার ফিল্ডিংয়েরই গুণমুগ্ধ প্রথম থেকে। রবীন্দ্র জাদেজার মতো এভারেজ ফিল্ডারকে নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই, অথচ জাদেজা যে স্কুলে ফিল্ডিং শিখেছে সে স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে রিয়াদ ১০ বছর চাকরি করেছে এখনকার প্রজন্মের দর্শকদের মা-বাবার আকদ বা এনগেজমেন্টের আগেই, প্রজন্ম কি তা ফিল করতে পেরেছে কোনোদিন?
তাই যে মাঠে রিয়াদ ফিল্ডিং করে সেই মাঠে ফিল্ডাররা যাচ্ছেতাই ক্যাচ মিস করে, এই দৃশ্যে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে হতে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় আমার।
রিয়াদের নাহয় দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ দায়বোধ, যে কারণে শরীরের আকুতির বিরুদ্ধে গিয়ে খেলে যাচ্ছে, কিন্তু একজন রিয়াদ ভক্ত হিসেবে আমার কিসের দায়, প্রতিটা ক্যাচ মিস যে মহাত্মা রিয়াদের প্রতি অসম্মান— এই ক্ষতে প্রলেপ কে দিবে! তখনই ক্ষোভ জমে। রিয়াদ যদি দলের ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব নেয়, ৯০ দশকের সাউথ আফ্রিকা ফিল্ডিংয়ে যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছিল, রিয়াদের জাদুরকাঠির স্পর্শে মাত্র ৩ মাসেই বাংলাদেশ সেটা ছাড়িয়ে যেতে পারবে। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রিয়াদ নিজেও ইচ্ছাকৃত ২-১টা ক্যাচ ছেড়ে আকারে-ইঙ্গিতে কি বুঝিয়ে দিচ্ছে না দলের ঘাটতিটা কোথায়?
সালমান খান এখনো ভার্জিন এটা বিশ্বাস করার চাইতেও কি অধিক কষ্টকর নয় রিয়াদের মানের ফিল্ডার ক্যাচ মিস করছে?
তবু বোঝে না বিসিবি, চ্যানেল একাত্তর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে প্রেসিডেন্ট পাপন। সম্ভবত সে চিন্তা করে- আমার ৯০০ কোটির এফডিআর রিয়াদ চলে গেলে ২ মাসে ৯ হাজারে নেমে যাবে!
উপায়ন্তর না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠি। রিয়াদের নামের পূর্বে মেয়াদোত্তীর্ণ, ভুচরা প্রভৃতি বিশেষণ যুক্ত করে স্ট্যাটাস লিখতে থাকি। মন থেকে কিছু চাইলে, প্রেম সত্যি হলে নাকি তা পূরণ হয়— রিয়াজের সিনেমায় প্রচুর দেখেছি। হয়তবা পাপনও ভক্ত নায়ক রিয়াজের। রিয়াদ আর রিয়াজ— কী দারুণ অন্তমিল নামে! তার মানে হবে পাগলা, হবে, তুই চালিয়ে যা, তুই পারবি— কোত্থেকে যেন পেয়ে যাই গায়েবি মোটিভেশন।
তাই পরাক্রমশালী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম প্লেয়ারটিকে বিসিবি বিশ্রাম দেয় প্রথমবারের মতো। আমার চোখ দিয়ে গলগল করে ঝরে আনন্দ অশ্রু। খুশিতে ঘোষণা দিই অফিসের ৩০ জনকে মহিষের গোশত আর কোকাকোলাযোগে লাঞ্চ করাবো। কিন্তু রাতের ঢাকায় মহিষের পাল নেমে এলেও ভোরে তারা গরু নামে জবাই হয়। যে কারণে মহিষের মাংস যোগাড় যত্নে দেরি হয়ে গেল। আমার অন্তর ফেঁটে চৌচির, কিন্তু তাকে মসৃণ করতে কেউ লাগিয়ে দিল না ভ্যাসলিন!
কর্তব্যে অবহেলায় রুষ্ট হয়েই কিনা প্রকৃতি পুনরায় রিয়াদকে ঠেলে দিল কাঠফাঁটা রোদের মাঠে। এখন সময় যার যুবক ছেলের হাত ধরে নেটে নিয়ে যাওয়ার, পিছন থেকে ছেলের হেড পজিশন-ব্যালেন্স-ব্যাকলিফট দেখার, রোদের উত্তাপ সহ্য না করতে পেরে ছাতার নিচে মাথা গলিয়ে দেয়ার, তাকে নিজেদের প্রয়োজনে এখনো খেলিয়ে যে অন্যায়টা করা হচ্ছে এই সিনিয়র সিটিজেনের প্রতি একজন নিঃশর্ত ভক্ত হিসেবে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হারাম।।
তাই আজ যখন মহাসমারোহে অফিসের অন্যান্যরা মহিষের গোশত খেয়ে প্রার্থনা করছিল মাহমুদুল্লাহকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হোক, মহিষের মাংসটা গলা দিয়ে নামতে চাইছিল না, গলার অতি সংবেদনশীল অংশে আটকে পড়েছিল।
তখনই পুনরায় সংকল্প নিয়েছি যেদিন নির্দয়-কষাই প্রকৃতির বিসিবি সকলপ্রকার চুদুরবুদুর বন্ধ করে আমার আইডল, কিংবদন্তী- মহামতি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে সত্যিকারের মুক্তি দিবে সেই মুক্তির আনন্দ সেলিব্রেট করবো বনানী স্টার রেস্টুরেন্টে ৫ জন সুহৃদকে চিতল মাছ খাওয়ানোর মাধ্যমে।
কবে আসবে সেই শুভদিন?
জানুক পাপন-সুজন- ডেভিড হাসি
রিয়াদ তোমায় ভালোবাসি