টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত ভরাডুবি ঘটেছে। সমর্থকরা ক্ষুব্ধ, এবং স্তম্ভিত। মার্ক ওয়াহ এর মতো কিংবদন্তী বাংলাদেশের ব্যাটিংকে থার্ড ক্লাসেরও অধম বলছে (সম্পূর্ণ একমত), এবং নানা স্টেকহোল্ডার একে অপরকে দোষারোপে মত্ত। বাংলাদেশ এবং বিসিবির প্রশাসনিক কাঠামোতে অনবদ্য সাদৃশ্য। দেশের যে কোনো ইস্যুতে যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে লোকেরা, অনুরূপ বিসিবির সকল বিষয়ের প্রতিনিধি নাজমুল হাসান পাপন। নিশ্চিত কাল-পরশু নাগাদ তার বক্তব্য চলে আসবে। সেখানে পপুলিস্ট এবং বিতর্ক উস্কে দেয়া ধরনের প্রশ্নের ছড়াছড়ি থাকবে, সেগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হবে, কিন্তু যে প্রশ্নগুলো আসলেই সেন্স মেইক করে, রয়ে যাবে উপেক্ষিত। কারণ ওসব প্রশ্নে ভিউ পাওয়া যায় না।
ধরে নিচ্ছি নাজমুল হাসান পাপনের সাথে দেখা হয়ে গেল একদিন, অন ক্যামেরা তার একটা ইন্টারভিউ নিচ্ছি। সেসময় যেসব প্রশ্ন করা উচিত গণ্য করছি তার তালিকা প্রস্তুত করলে কেমন হয়?
চেষ্টা করা যাক-
প্রশ্ন১- বাংলাদেশ বছরের পর বছর মিরপুরে খেলে, এবং এখানকার উইকেট রীতিমত বিভীষিকা। অনেকেই বলেন মিরপুরে মাটির যা বৈশিষ্ট্য সেখানে চাইলেও খুব স্পোর্টিং উইকেট তৈরি করা সম্ভব না। আগামী বছর বিশ্বকাপ বসছে অস্ট্রেলিয়ায়, সেখানে ড্রপ-ইন পিচের প্রচলন শুরু হয়েছে অনেকদিন হলো। যেহেতু মিরপুরে স্পোর্টিং পিচ সম্ভবই নয়, এতদিনেও ড্রপ ইন পিচ তৈরির চিন্তা আপনারা করছেন না কেন? ড্রপ ইন পিচ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ অতি অবশ্যই অত্যন্ত ব্যয়বহুল, কিন্তু ৯০০ কোটি টাকা যাদের এফডিআর করা তাদের মুখে কি ব্যয়বহুলতার গল্প মানায়?
প্রশ্ন২- বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দলে, হোক সেটা ক্রিকেট অথবা ফুটবল, কোচরা অত্যন্ত চাপে থাকে, এবং দলের পারফরম্যান্সের সাথে তাদের চাকরি ঝুলতে থাকে। এবং বিশ্বকাপ থাকে তাদের সর্বোচ্চ এসাইনমেন্ট, সেখানকার সাফল্য-ব্যর্থতার সরাসরি প্রতিফলন ঘটে তাদের চুক্তিতে। রাসেল ডমিঙ্গো ২ বছর ধরে কাজ করছে, গত বছরের ৭ মাস যদি বাদও দিই, তবু দেড় বছরে তার অধীনে দল কোনো সিগনিফিক্যান্ট পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি, এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩য় সারির দলের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হারের পরে তার চাকরি নিয়ে প্রশ্ন শোনা যাচ্ছিল। পরের সময়ে উল্লেখযোগ্য ঠিক কী ঘটলো যার কারণে বিশ্বকাপের আগেই তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলো, এবং এমন একটা ধারা রাখা হলো যার ভিত্তিতে আগামী ১ বছর তাকে বরখাস্ত করা যাবে না? নাকি ঘরের মাঠে আন্ডারপ্রিপার্ড পিচে ২য় সারির অস্ট্রেলিয়া আর ৩য় সারির নিউজিল্যান্ডকে টি২০ হারানোতে সাধারণ দর্শকদের মতো আপনারাও ভেবেছিলেন এটা বিরাট অর্জন, যার প্রভাব দেখা যাবে বিশ্বকাপে?
প্রশ্ন৩- দেশের কোটি কোটি মানুষ আপনাদের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কনজিউম করে বলেই মাঠের ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছাড়াই আপনারা ৯০০ কোটি টাকার রেভিনিউ অর্জন করেছেন, এবং ক্রিকেট দুনিয়াতে আপনারাই একমাত্র বিজনেস কোম্পানি যারা দিনের পর দিন নিম্নমানের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস দেয়া সত্ত্বেও লয়্যাল কাস্টমার গ্রুপের ঘাটতি হয়নি কখনো। দর্শকই সকল ক্ষমতার উৎস, এতে নিশ্চয়ই দ্বিমত করবেন না। প্লেয়ার বা কোচিং স্টাফ আপনাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য, কিন্তু আপনারা কার কাছে answereable; আপনার কি মনে হয় না প্রতিষ্ঠান হিসেবে দর্শকদের প্রতি আপনারা ন্যূনতম কমিটমেন্টও দেখাচ্ছেন না? এই স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে?
প্রশ্ন৪- বিসিবির চুক্তিভুক্ত একজন ক্রিকেটার এবং ওয়ানডে ফরম্যাটের অধিনায়ক বিশ্বকাপ চলাকালে টেলিভিশনে শো করছে, এবং টিম ম্যানেজমেন্ট, সহখেলোয়াড় সহ নানা সেনসিটিভ বিষয়ে মতামত দিচ্ছে। এটা কি কোনোভাবে কোড অব কনডাক্টের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়? এ ব্যাপারে আপনাদের নৈতিক অবস্থান কী?
প্রশ্ন৫- আমরা প্রতিনিয়ত শুনি আগামী কয়েক বছর জাতীয় দলের প্রচুর খেলা৷ বায়োবাবল, অফ ফর্ম, ইনজুরি মিলিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিকল্প খেলোয়াড়ের প্রয়োজন পড়ার কথা। কিন্তু সেই খেলোয়াড়ের যোগান আসবে যেসব জায়গা থেকে, যেমন ‘এ’ দল, এইচপি তাদের আগামী ১ বছরে কয়টা সিরিজ আছে, এবং ২০২১ এ তারা কয়টাই বা কম্পিটিটিভ ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছে? এই যে বিকল্প দলগুলো প্রায় অকেজো এবং বিকল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে আপনি এর দায় কীভাবে এড়াবেন, এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণের সক্ষমতা আপনার আদৌ কি আছে?
প্রশ্ন৬- সর্বশেষ ৭ বছরে কোনো ফরম্যাটেই এমন কোনো ক্রিকেটার আমরা পাইনি যাকে ধারাবাহিক পারফরমার বলা যায়, এবং নতুন যারা আসছে তাদের পারফরম্যান্সও বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো। তার মানে কি ধরে নিতে হবে আপনারা মানসম্পন্ন ক্রিকেটার তৈরিতে পুরো ব্যর্থ? এর সাথে সম্পূরক প্রশ্ন হলো, আমাদের যে কোনো ক্রিকেটার, পুরনো থেকে নতুন, দলে ঢোকার সময় যে স্কিলসেট নিয়ে আসে ১০-১৫ বছর খেলার পরও স্কিলে আর পরিবর্তন আসে না। একই প্যাটার্নে আউট হয়, একই চ্যানেলেই বোলিং করে। এই যে স্কিল আর বাড়ে না, আপনারা প্লেয়ারের গ্রোথে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সেগুলো কেন কাজ করছে না সে সংক্রান্ত কোনো পর্যবেক্ষণ বা ফাইন্ডিংস আছে কিনা?
প্রশ্ন৭- মিনহাজুল আবেদিন নান্নু এবং হাবিবুল বাশার সুমন বহুদিন যাবৎ নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু এতদিন পরও প্লেয়ার নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ক্রিকেটারের বলয়ে আটকে আছেন, এবং আমাদের ভাবতে প্রলুব্ধ করছেন ওই কয়েকজনের বাইরে আমাদের রিজার্ভ বেঞ্চে ক্রিকেটার নেই। প্লেয়ারদের পারফরম্যান্সের যেমন মূল্যায়ন হয়, নির্বাচকদের পারফরম্যান্স কি সন্তোষজনক? লাগাতার ব্যর্থতা সত্ত্বেও তারা সপদে বহাল থাকবার হেতু কী?
প্রশ্ন৮- শ্রীলংকা এবারের বিশ্বকাপে অত্যন্ত অনভিজ্ঞ এক দল খেলিয়েছে। কুশল পেরেরা বাদে কারোরই ক্যারিয়ারের বয়স বেশি নয়। অথচ এই অনভিজ্ঞ দল প্রতিটি ম্যাচেই স্পিরিটেড ক্রিকেট খেলেছে। পক্ষান্তরে এই দলের সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ ৭টি বিশ্বকাপ খেলেও দলের চিত্র বদলাতে পারেনি, এবং তারা যে টি২০ তে প্রুভেন ফেইলার এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবু পরের বিশ্বকাপে এদের উপরই আস্থা রাখবেন, নাকি প্রুভেন ফেইলারদের বাদ দিয়ে অনভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের নিয়ে ঝুঁকি নিবেন? এবং যে কোনো ইন্টারভিউতে আপনি এদের বিকল্প নেই বা অমুক খেলছে না বলে দল খারাপ করছে যেভাবে বলেন, তাতে কি এটা বলা যায় আপনি এসব ক্রিকেটারের তারকা ইমেজকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেন?
প্রশ্ন৯- আপনি প্রায়ই ৯০০ কোটি টাকা এফডি আর এর রেফারেন্স দেন। আফগানিস্তান আমাদের চাইতে অনেক পরে শুরু করেছে, তারা নিজেদের দেশে খেলতে পর্যন্ত পারে না, অর্থকড়িও আমাদের তুলনায় কিচ্ছু না। যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকে। তবু টি২০ তে তারা আমাদের গোনায়ই ধরে না, ঘরের মাঠেও তাদের বিপক্ষে টেস্টে হারতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে উল্লিখিত ৯০০ কোটি টাকার এফডিআর আপনাদের গুটিকয় ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থ পূরণ করা ব্যতীত ক্রিকেটের কোন কাজে লেগেছে?
প্রশ্ন১০- বিসিবিতে একজন পেইড সিইও আছেন, মিডিয়া ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া আছে, তবু আপনি অতি তুচ্ছ ইস্যুতেও ঘন ঘন মিডিয়ায় চলে আসেন, এবং যা বলেন তাতে টি আরপি বাড়ানো ব্যতীত ক্রিকেটের কোনো পারপাস পূরণ হয় না। আপনার এই ফ্রিকুয়েন্ট মিডিয়া এক্সপোজারের কারণ কী, এবং আমরা কি ধরে নেব আপনার ক্রিকেটকেন্দ্রিক ব্যাপক ও বৃহৎ কোনো পরিকল্পনা নেই বলেই এসব খুচরা কাজে সময় খরচ করে আলোচনায় থাকতে চান? এবং রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য দেয়ার সময় যেরকম চ্যালা-চামুণ্ডা পরিবৃত হয়ে থাকেন, বিসিবির স্পোকস পারসন হিসেবে আপনিও কথা বলাকালীন নানান লোক-লস্কর মৌমাছির ন্যায় ঘিরে রাখে, আপনাকে বিভিন্ন সূত্রের আইল ধরিয়ে দেয়। যদিও আপনি একজন রাজনীতিকই, তবু বিসিবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার এধরনের কালচারকে প্রমোট করা স্বাস্থ্যকর বলা যায় কিনা?
প্রশ্ন১১- বাংলাদেশ টেস্টে পারে না, টি২০ তে টেস্টের চাইতেও বাযে খেলে, ওয়ানডেতে ঘরের মাঠে যা একটু ফাইট দেয় বাইরের মাঠে হযবরল দশা। অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে ওয়ানডের পরিমাণ মারাত্মক হারে হ্রাস পেয়েছে, এবং টি২০ আরো বৃদ্ধি পাবে; বিশ্বকাপ আর সুপারলীগ ব্যতীত ওয়ানডে হয়ত দেখাই যাবে না সেভাবে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে গতবার তলানীতে ছিল, এবারের ফিক্সচার যেরকম তাতে তলানীতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বাস্তব। সেক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে ক্রিকেট ক্রেজ বাঁচিয়ে রাখতে জিম্বাবুয়ের সাথে নিয়মিত বিরতিতে সিরিজ খেলার বাইরে আপনার কোনো কংক্রিট প্ল্যান আছে কিনা এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই অবিরাম অধোগতি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কি আপনাকে লজ্জিত করে?
সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।