পেন্সিলের সাথে শার্পনারের সম্পর্করূপক বোঝার বয়স হওয়ার বহু আগে থেকেই আমার একটা স্বপ্ন ছিল। বালি বালি করে গড়েছি সেই স্বপ্ন, যতটা যত্ন আর মমতায় একজন ভাস্কর নির্মাণ করে জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাস্কর্য। ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ের মতোই আটপৌরে, অপি করিমের হাসির চাইতেও সাদামাটা সে স্বপ্ন। আমি চেয়েছিলাম এশিয়া-আফ্রিকার সেরা গল্পকার হাসান মাহবুব এর সাথে একই মলাটে বই প্রকাশ করতে। একবার যদি স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায় আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। ৫ মাস ঠাকুরগাঁওয়ে ৪ মাস নীলফামারীতে কাটাবো, বাকি ৩ মাস লিখব বই, তার রয়্যালটি দিয়ে পরের ২ বছর শুধু চিঠি লিখব ৭৯ জন মানুষকে।
সেই স্বপ্ন আমার ঠাকুরগাঁওগামী বাসের নিচে পিষ্ট হয় যখন কিংবদন্তী মাহবুব আমায় জানিয়ে দেয় তার সাথে বই করার একটাই শর্ত- ইমরুল কায়েসকে জাতীয় ক্রিকেট দলে ফেরানোর দাবিতে মানববন্ধনে সশরীরে অংশ নিতে হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিবের চাইতেও তার অবদান বেশি প্রমাণ করে লিখতে হবে ক্রিটিকাল এনালাইসিস।
হাসান মাহবুবের সাথে আমার গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, হতে দিল না তেলুগু ফিল্মের ন্যারেশন প্যাটার্ন।
শুনেছি এক দরজা বন্ধ হয় অন্য অনেকগুলো দরজা খুলবে বলে। ইমরুল কায়েস প্রশ্নে আমরা একই মলাটবন্দী হতে অসমর্থ হলেও জসিম ইস্যুতে তৈরি হলো নৈকট্য। বলিষ্ঠ হাসান মাহবুবের হেয়ারস্টাইল, চলন-বলন প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা সিনেমার মহাকমেডিয়ান জসিমকে৷ আমার সম্বন্ধে কেউ যদি মাত্র ৩টা তথ্য জানে সেখানে ১টা তথ্যের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী- ‘জসিম আমাকে যতটা এনার্জাইজড করে তার সাপেক্ষে তুলনীয় নয় কেউই। কেবলমাত্র জসিমের সিনেমা নিয়ে ব্যাপক মাতামাতির দরুণ পরীক্ষায় ফেলও করেছি।
হাসান মাহবুবের মধ্যে জসীমের পুনরুত্থান পেয়ে নিজেকে বোঝাই, হে সাইকোপ্যাথ হিমালয় তোমার নির্বান্ধব, দুর্গন্ধময় জীবনে হাসান মাহবুব স্বয়ং জামরুল গাছ, তার অবহেলা করো না। মহাকমেডিয়ান জসিম আমাদের মধ্যে দূরত্বের প্রাচীর ভেঙ্গে দেয়, আমরা পরস্পরকে ‘কাকা’ সম্বোধন করতে শুরু করি। জীবনে যত মানুষের সাথে আমার সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে ৯৭% ক্ষেত্রেই মূল কারণ ছিল হিউমার সেন্সের ভিন্নতা। আমার ডার্ক হিউমারে তাদের অনুভূতি আহত হয়, তারা অসম্মানিত বোধ করে, এবং আমার সাথে মেলামেশায় আনকমফোর্টেবল বোধ করে। কাকার ক্ষেত্রে সেই সমস্যাটা হয় খুবই কম। তার ইমোশনের বেলুন প্রায়ই ফুটো হয়, কিন্তু তাতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ফিগারে পরিবর্তন আসে না।
আমরা উভয়ই ইন্টারপাশ ইঞ্জিনিয়ার। আমার সিজিপিএ যেখানে ২.৩৮, কাকা আমার চাইতেও সরেস; ২.৩৬! বিশ্রি হাতের লেখার জন্য যতজনকে চিঠি লিখেছি প্রায় প্রত্যেকেই কটূ কথা শুনিয়েছে। কাকার হস্তাক্ষর আমার চাইতেও কুদর্শন, এটা মেনে না নিয়ে উপায় দেখি না।
আমাদের জন্মদিন খুবই সিম্বলিক দুটো তারিখ- ১৫ আগস্ট এবং ৭ নভেম্বর। কাকার সাথে আমার সম্পর্ক রসায়ন ব্যাখ্যায় জন্মতারিখই বোধহয় সব কথা বলে দেয়।
তবে নিয়তির ভাবনা ছিল আরো কমেডি, হিউমার আর উইটপূর্ণ। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একের পর এক ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে হিউম্যান ক্যারেক্টার ম্যাপিং বিষয়ে একটা বই লিখলাম মডার্ন ইথিক্স মডেল প্রস্তাব করে। বইটা আদতে বৃশ্চিক রাশির একজন ইনডিপেনডেন্ট নারীর বায়োফিকশন। ‘সিগনেচার সরণ’ নামের প্রকাশিতব্য এই বইয়ের যে নায়িকা তার সাথে ২ দিন কথা হয়েছিল আমার। ২ দিনেই সে আমায় সিজোফ্রেনিক সাব্যস্ত করেছে, তাই যোগাযোগও বন্ধ।
গল্পের উইটি অংশ হলো- সেই ক্যারেক্টারের জন্মদিনও ৭ নভেম্বর!
কাকা এত বছর কমেডি কিং জসিমের প্রতিমূর্তি ছিল, জন্মের জন্য তার ৭ নভেম্বরই বেছে নিতে হলো!
হে কাকা, আপনি কি পারতেন না এফিডেভিট করে জন্মদিন পালটে শুধু জসিমকেই ধারণ করতে! কেন এ নিষ্ঠুরতা আর হৃদয়হীনতা!
বহুদিন যাবৎ আমি একটা বিশেষ ধর্ম অনুসরণ করি, যার নাম ‘কানেক্টিভিটি’। এই ধর্মের প্রধান রিচুয়াল কারণে-অকারণে পরিচিত-অপরিচিত মানুষকে উপহার দেয়া। আমাদের কালচারে উপহার দিতে জন্মদিন, বিবাহ, খতনা অথবা কোনো কিছু অর্জনের উপলক্ষ থাকতে হয়। এছাড়া ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের দিয়ে স্বার্থ হাসিলেও তাদের দেয়া হয়ে থাকে বিবিধ উপঢৌকন, যেগুলো আদতে ঘুষ। কিন্তু তেমন কোনো কারণ নেই, দিতে ইচ্ছে করছে তাই দিলাম মানসিকতায় উপহার দেয়ার চল খুবই বিরল। উপহার দিতে অর্থ খরচ হয়। পশ্চিমের প্রচণ্ড ইনডিভিজুয়ালিস্ট কালচারকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরায় কারো পেছনে অর্থ খরচের চিন্তাটাই লাগে এবসার্ড। তাছাড়া থাকে দারিদ্রের অজুহাত। আমি নিজেও প্রতিনিয়ত পারিবারিক জেরার মুখে পড়ি উপহার দেয়া নিয়ে। তবু দারিদ্র দমাতে পারে না। উপহার তৈরি করে স্পার্ক।
শুভাকাংখী, অনুরাগীদের থেকেও সময়ে-অসময়ে পাই প্রচুর উপহার। তারা হয়তবা উপহারটাকে রিলিজিয়াসলি না দেখে হৃদ্যতার পয়েন্ট থেকে দেখে, তবু ভালোবাসা তো মিশ্রিত থাকেই সেখানে।
দূরতম কল্পনাতেও যা ছিল না, সেটাই এবার ঘটিয়েছে হাসান মাহবুব কাকা। আমার জন্মদিনে পাঠিয়েছে বই উপহার। আমার শেভ না করা গোঁফ করে উঠলো কুটকুট। আমি জানি কাকার ঘরে উনুন জ্বলতেই হিমশিম খায়, কারণ গ্যাস থাকে না প্রায়ই। অর্থের অভাবে চাল কিনতে না পেরে কাকা দোকান থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি আর বার্গার কিনে খায়। সেই কাকা আমার জন্মদিন মনে রেখেছে! আবার হাজার টাকার বইও পাঠিয়েছে, যেগুলোর সবই বিখ্যাত লেখক বা আর্টিস্টের ইন্টারভিউ সংক্রান্ত।
জসিম কি পাঠাতো উপহার? সম্ভবত না।।
বইয়ের ক্যারেক্টার যদি আমায় না ভাবতো সিজোফ্রেনিক সে কি উপহার দিত? সম্ভাবনা ছিল হয়তবা।
কাকা তবে কার চাহিদা পূরণ করে দিল!
নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও জেলা দুটো আমার অবসেসন। মিশর বা ডেনমার্কের চাইতেও এই জেলা দুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা বেশি। বলা যায় ডিভাইন ডেস্টিনেশন। কাকা সে ব্যাপারে অবগত বলেই বোধহয় ৩ লাইনের চিঠিতে ৩ লক্ষ লাইনের বক্তব্য দিয়েছে।
হে নিকৃষ্ট হাসান মাহবুব কাকা, ইমরুল কায়েসের জন্য যে লোক মানববন্ধন করে সেই একই মানুষ লিখে ‘নীলফামারী বহু দূরে’, কেইসটাতে ঘাপলা পান না?
আপনার জন্য সিগনেচার সরণ এর মূল্য নির্ধারণ করলাম মাত্র ৭৯ টাকা, যদিও বইয়ের দাম ৭০০ টাকার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
৭৯ জন মানুষ খুঁজছি ৭৯ টা কমিটমেন্ট দিতে। সব লোক আপনি গায়েব করে দিতেছেন মানববন্ধনের ধান্ধায়৷
কাজটা কি জুইতের হইলো কাকা। পলি-শানু-ময়ূরীর কাটপিস দেইখা তবে শিখলেনটা কী!