ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে বিসিবি সমীপে ১১টি যৌক্তিক প্রস্তাবনা:

প্রিয় বিসিবি,
আমি একজন সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ থেকে ক্রিকেট খেলা দেখি এবং ৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জেতার পর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রায় ৯৫%খেলাই দেখেছি। আমার ধারণা আমি একজন রেশনাল মানুষ, ক্রিকেট নিয়ে ভাবি, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কিছু কাজ করবো। আপনারা একটি বিশাল সংগঠন, কিছুটা রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত, তাই আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি সরাসরি আপনাদের সাথে দেখা করে আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করা। কিন্তু এখনকার পৃথিবী তো অনেক ছোট, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসূত্রে আমার এই লেখাটি অনেক মানুষই পড়বে আশা করছি। সেখানে স্পোর্টস জার্নালিস্টও থাকতে পারেন অনেকে, আমি আশাবাদী তাদের মাধ্যমে হলেও আমার চিন্তাগুলো আপনাদের কাছে পৌঁছাবে। হয়তোবা গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করবেন না, কারণ আমার প্রস্তাবগুলো কোনোটিই মৌলিক নয়, এর প্রায় সবগুলোই বিভিন্ন সময়ে আপনাদের কাছে নানাভাবে গেছে, তবু আমি চেষ্টা করছি শুধু প্রস্তাবে সীমাবদ্ধ না থেকে আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে। বলা তো যায় না, ক্রিকেট নিয়ে লেখালিখি করেন এরকম আরও বেশ কিছু মানুষ যদি ম্যাচ এনালাইসিসের বাইরে এইসব বিষয়েও লিখতে শুরু করেন, সেটার একটা সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট তৈরি হতেও পারে। স্টে পজিটিভ, বি পজিটিভ।
ভূমিকা দীর্ঘ হলো, দুঃখিত। চলুন প্রস্তাবের বেস্ট ইলেভেন জমা দিই:

প্রস্তাবনা ১, জাতীয় দলে খেলোয়াড় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট সেট অব ক্রাইটেরিয়া গঠন করা। আমরা ১৬ বছর হলো টেস্ট খেলা শুরু করেছি, অর্থাৎ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পরিসরে আমাদের বিচরণ এর বয়সও নেহায়েত কম নয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এতোদিনেও দল নির্বাচনে তেমন কোনো প্রফেশনালিজম এবং ক্রিকেট প্রজ্ঞার দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান করা সম্ভব হয়নি। দলে মোটামুটি ৭-৮ জন খেলোয়াড় থাকে অটোমেটিক চয়েজ, বাকি যে ৫-৬টি জায়গা সেগুলো পূরণ করতে গিয়ে প্রত্যেকটা সিরিজেই দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়, কয়েকজন খেলোয়াড়কে নেয়া হয় যাদের নির্বাচনের ক্রিকেটিয় কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সেই ক্রিকেটাররা দর্শক-সমর্থকের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হয়। একটা প্রফেশনাল ক্রিকেট টিমের সাথে এই স্পিরিটটা কোনোভাবেই যায় না। একজন ক্রিকেটারকে জাতীয় দলে ঢুকতে হলে কোন্ লেভেল পর্যন্ত খেলতে হবে, কতদিন ধরে পারফরম্যান্স করতে হবে, তার ক্রিকেটিং মেরিট কী কী ফ্যাক্টর দিয়ে যাচাই করা হবে, বিকল্প বা পাইপলাইন দলগুলোর অধীনে কতগুলো ম্যাচ খেলতে হবে, সর্বত্র তার পারফরম্যান্সের রেকর্ডের ভিত্তিতে ডাটা মাইনিং এর মাধ্যমে তার স্কিল ট্রেইট সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা হবে কিনা, এরকম লজিক এবং ইন্টেলিজেন্স চালু করলে একজন খেলোয়াড় যেমন জানবে সে কোন্ লেভেলে আছে, অনুরূপভাবে সাংবাদিক, সমর্থকরাও জানতে পারবে এই খেলোয়াড় কেন জাতীয় দলে এবং সে যদি পারফরম নাও করে অন্তত এটা বলার সুযোগ থাকবে না তাকে অমুক কোটায়, তমুক কোটায় সুযোগ দেয়া হয়েছে। আপনারা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, দর্শকের কাছে আপনাদের সরাসরি জবাবদিহিতার হয়তো কিছু নেই, কিন্তু এটাও তো সত্য, ক্রিকেট ক্রেজ আছে বলেই বিসিবি এতো বিত্তশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পেরেছে। দাবা, খো খো বা টেবিল টেনিস ফেডারেশনের দিকে তাকান,তারাও আপনাদের মতোই প্রতিষ্ঠান, কিন্তু ক্রেজ নেই বলেই তারা দীনহীন। ভোক্তাকে যতবেশি খুশি রাখতে পারবেন, বিজনেস তত প্রোফিটেবল হবে, এটা তো খুব সিম্পল ক্যালকুলেশন। তাছাড়া, এইসব সিস্টেম এবং ক্রাইটেরিয়া নিয়ে কাজ করতে গেলে পিপল এনগেজমেন্ট বাড়বে, ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে, সেগুলোর জন্য স্পন্সর নিলে ৭০ টাকা খরচ হলে ৯০ টাকা স্পন্সর পাবেন, মাঝের ২০ টাকা তো ইজিলি আপনারাই পাচ্ছেন। ফলে, এটা কিন্তু ভোক্তা এবং আপনাদের, উভয়পক্ষের জন্যই বেনিফিট। ক্রাইটেরিয়া নিয়ে আমার কিছু ভাবনা আছে, আমাকে কোনো পারিশ্রমিক দিতে হবে না, জাস্ট কাজের সুযোগ দিলেই আমি মডেলটা আপনাদের সামনে পেশ করতে পারি।
প্রস্তাব২, বিকল্প দলগুলোকে একটিভ করা। শুধুমাত্র জাতীয় দলকে গুরুত্ব দিয়ে আপনারা ক্রিকেট খেলাটাতে মেরুকরণ করছেন এবং জাতীয় দলে কোয়ালিটি সম্পন্ন খেলোয়াড় সাপ্লাইয়ের পাইপলাইনকেও আটকে দিচ্ছেন। আজ থেকে ৭-৮ বছর পরে এটার ভয়ানক পরিণতি ভোগ করতে হবে জেনে রাখুন। ‘এ’ দল বলতে আমাদের কোনো দল নেই, সেখানে জাতীয় দলের অধিনায়ক আর ২-১ জন তারকা খেলোয়াড় বাদে প্রায় সবাই খেলেন; ফলে সেটাও আসলে ডামি জাতীয় দল। বিসিবি ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াড, হাই পারফরম্যান্স ইউনিট মিলে ১০০ জন মানসম্পন্ন খেলোয়াড় আপনারা কি তৈরি করতে পেরেছেন যাদের দিয়ে অন্তত ৩ টি রিজার্ভ বেঞ্চ বানানো সম্ভব জাতীয় দলের কাছাকাছি মানের? আপনারা এক কাজ করতে পারেন। আয়ার‌ল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, আফগানিস্তান, ওমান, স্কটল্যান্ড এই দলগুলো উঠে আসছে। ওরা ম্যাচ খেলার জন্য মুখিয়ে থাকে। ওদের সাথে ট্যুর বিনিময় চুক্তি করতে পারেন, সেখানে ‘এ দল’ বা ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াড খেললো। এতে খেলোয়াড় উঠে আসা সহজ হবে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের উপর প্রেসার বাড়বে; ১ জনের ঘাড়ে যখন ১০জন নিঃশ্বাস ফেলবে একটামাত্র জায়গার জন্য তখন অটোমেটিকালি জায়গাটা ধরে রাখার জন্য মরিয়া ভাব বাড়বে, সেটা তাদের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলবেই। তখন আর কেউ দিনের শেষ বলে বোল্ড আউট হবে না, মিস ফিল্ডিং করবে না। আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন, বিকল্প দলগুলোতে স্পন্সর পাওয়া যায় না। আপনারা ৩-৪টা দল নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারেন, সেগুলো টিভিতে প্রচারের ব্যবস্থা করলে মানুষ অবশ্যই দেখবে। মার্কেটিং টিমকে আরও ডায়নামিক করুন; তাতে আপনাদের ব্যক্তিগত আয় বাড়বে, প্রতিষ্ঠান এগুবে, ক্রিকেটও উন্নত হবে। নিজেদের বেনিফিটই দেখুন, সেটা একটু ইন্টেলিজেন্টলি দেখলে তো বরং সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হয়।

প্রস্তাব৩, ক্রিকেট কূটনীতি জোরদার করুন। বাংলাদেশ ৮ বছর চেষ্টা করার পরে একটা স্টেবল ইউনিট হতে পেরেছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। এই দলটা আরও প্রায় ৪-৫ বছর একসাথে খেলবে। এরপর কিন্তু একটা বড় শূন্যতা তৈরি হবে, সে ব্যাপারে সতর্ক হোন। এবং এই ৪ বছরকে কীভাবে বেস্ট ইউটিলাইজ করা যায় সেটা নিয়ে ভাবুন। জিম্বাবুইয়ে বা আফগানিস্তানের সাথে কম খেলে সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলার স্কোপ বাড়ানোর চেষ্টা করুন। সেটা সম্ভব না হলে শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা পাকিস্তানও চলে। কিন্তু খেলুন, যত বেশি পারুন এই ৪ বছরে খেলে খেলে নিজেদের প্রোফাইল ভারি করুন। একবার ভাবুন, মুশফিকুর রহিম ১০ বছরে মাত্র ৫০টা টেস্ট খেলেছে, ওয়ানডের সংখ্যাও ২০০ এর কম। আগে পারফরম্যান্স ছিলো না, বড় দলগুলো খেলতে চাইতো না; এখন সীমিত ওভারে বাংলাদেশের যা পারফরম্যান্স তাতে আগামী বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আমরা এমনকি চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারি। এদেশের মানুষের ক্রিকেট উন্মাদনা আছে, ভারতের পরে ক্রিকেটের সবচাইতে বড় বাজার হওয়ার সম্ভাবনা আছে আমাদের; আইসিসিকে সেটা ডাটা দিয়ে প্রমাণ করে দেখান। তথাকথিত বড় দলগুলো এখন আমাদের ঔদ্ধত্য নিতে পারছে না, এখনই তো বেস্ট চান্স তাদের এই ক্ষোভটাকে খেলার আগ্রহে কনভার্ট করার। এফটিপির বাধ্যকতা নেই যেহেতু, বোর্ডগুলো নিজেরাই তো মিউচুয়ালি খেলার আয়োজন করে। তাছাড়া, ক্রিকেটে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আছে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে কূটনীতির আশ্রয় নিন। কিন্তু খেলা না বাড়ানোর উপায় নেই, এবং সেটা বাড়ানোর জন্য মাঠের ক্রিকেটে যতটুকু সম্ভব তার চাইতে বেশিই করে দেখিয়েছে ক্রিকেটাররা; বল কিন্তু এবার আপনাদের কোর্টে।

প্রস্তাব৪, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট এবং প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট নিয়ে একটু ভিন্নভাবে ভাবুন। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে উন্নতি করতে হবে এটা নিয়ে তো লেখালিখি কম হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়া হয় না, এবং খেলোয়াড়দের ফ্যাসিলিটিসও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এখন যে ফরম্যাটে জাতীয় লীগ হচ্ছে সেখানে পিকনিক আমেজ বেশি। জাতীয় দলের এবং পাইপলাইনের খেলোয়াড়দের জাতীয় লীগে ন্যূনতম একটা সংখ্যার ম্যাচ খেলার বাধকতা দেয়া উচিত এবং সেখানকার রেকর্ড সিরিয়াসলি বিবেচনায় নেয়া উচিত। দেশের বিভিন্ন জেলায় জাতীয় লীগ না করে ঢাকা এবং আশপাশের ভেন্যুগুলোতে জাতীয় লীগ করলে সেটার গ্ল্যামার বাড়বে। কিন্তু সবচাইতে গুরুত্ব দেয়া হয় প্রিমিয়ার ডিভিশন লীগকে এবং এখানে ১ সিজন ভালো খেলা বা বিপিএলে ১টা আসরে ভালো খেলা মানেই সে জাতীয় দলের জন্য এলিজিবল হয়ে উঠে। বিপিএল বরং ৫-৬টা ভেন্যুতে হওয়া উচিত ঢাকার বাইরে, যেহেতু এটার গ্ল্যামার আছে স্থান কোনো সমস্যা হবে না। ব্রডকাস্টিং জটিলতা একটা ইস্যু, কিন্তু তাদের কনভিন্স করা খুব টাফ হবে না, কারণ ঢাকার বাইরে এক্সপ্লোর করলে তাদের চ্যানেলের জন্যই ভালো। প্রিমিয়ার লীগকেও অন্তত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট/খুলনা এই তিন জেলাতে নিয়ে যাওয়া উচিত। ঢাকার ক্লাবগুলো সঙ্গতকারণেই রাজি হবে না, কিন্তু ক্লাবের কাছে জিম্মি হয়ে থাকলে আপনারা বিজনেস এ আগাবেন কীভাবে। তাছাড়া, প্রভাবশালী ক্লাবগুলোর মালিক তো বেশিরভাগই আপনারা ইন্টারনাল মানুষজন। প্রফিট ক্যালকুলেট করে দেখেন, ঢাকার বাইরে প্রিমিয়ার লীগ হলে স্পন্সর এমাউন্ট বেশি পাবেন। হিসাব সহজ তো। প্রিমিয়ারের দলসংখ্যাও দুটো বাড়িয়ে দিন; তাতে অন্তত ৫০জন খেলোয়াড়ের আরেকটু ভালো জায়গায় খেলার স্কোপ তৈরি হলো, আরও কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটারের কোচ হওয়ার পথ সুগম হলো; এমপ্লোয়মেন্ট চেইন তো এভাবেই কাজ করে।

প্রস্তাব৫, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটকে আরেকটু লাইফলাইন দিন। বিশেষত ২য় আর ৩য় বিভাগ ক্রিকেটের অবস্থা খুবই নাজুক। কোয়ালিফাইং রাউন্ড খেলার জন্য এন্ট্রি ফি ৫ লাখ টাকা করার সিদ্ধান্তটা ক্রিকেটের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এটা সম্ভব হলে প্রত্যাহার করুন। দ্বিতীয় ও ৩য় বিভাগ ক্রিকেট খেলে যারা তারা বছর ধরে অনেক পরিশ্রম করে, কিন্তু বেশিরভাগই ওই লেভেলের উপরে আর উঠতে পারে না। কারণ, আম্পায়ারিং আর পেশীশক্তির কারণে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্লাবের খেলোয়াড়রাই এডভান্টেজ পেয়ে থাকে, এটা আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি। পেশী থাকলে শক্তিও থাকবে, এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মেনে নিয়েই একটা নির্দোষ প্রস্তাব দিই। একজন ব্যাটসম্যানের স্ট্যান্স আর ২-৪টা শট দেখলেই তার ট্যালেন্ট বুঝা যায়, একজন বোলারের ২ ওভার বোলিং দেখলেই তার কোয়ালিটি সম্পর্কে বুঝা যায়। তাই দ্বিতীয় ও ৩য় বিভাগের ম্যাচগুলো দেখার জন্য প্রাক্তন ক্রিকেটারদের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। ফলে একজন খেলোয়াড় যে দলের হয়েই খেলে সে যেন অন্তত একটু খেয়ালে থাকে। এখানকার বাছাই করা খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা বিপিএল টাইপ টুর্নামেন্ট করুন। বাংলাদেশে ক্রিকেটের চাইতে বড় কোনো ব্র্যান্ড নেই, কাজেই নাটাই আপনাদের হাতে। কোম্পানীগুলো ব্রান্ডিংয়ের জন্য টাকা নিয়ে বসে আছে, আপনারা জাস্ট তাদের বেনিফিটটা বুঝাতে পারলে এই খেলোয়াড়দের নিয়ে স্বল্প খরচে বিপিএল করাটা টাফ কিছু হবে না। তখনো দেখা যাবে প্রভাবশালী ক্লাব বা লবিংয়ের মাধ্যমেই বেশি খেলোয়াড় ঢুকবে, কিন্তু অন্তত ২০% রিয়েল ট্যালেন্ট যদি উঠে আসা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটাই বড় এচিভমেন্ট। আপনারা একটু চিন্তা করলেই এই সুযোগটা ইউটিলাইজ করতে পারেন।

প্রস্তাব৬, পেসার হান্টের পাশাপাশি উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান এবং স্পিনার হান্ট কার্যক্রমটাও শুরু করতে পারেন। বাংলাদেশে যে কোনো কিছু পপুলারাইজ করতে একটা হাইপ লাগে। পেসার হান্ট অলরেডি সেই হাইপটা তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু লক্ষ্য করেছেন কি, আমাদের স্পিনারের ভাণ্ডার শূন্য হয়ে আসছে। এটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে পারেন। আরেকটা সমস্যা হলো উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানের। এখনকার ক্রিকেটে শুধুমাত্র উইকেট কিপিংয়ের জন্য স্পেস এফোর্ড করা ডিফিকাল্ট, কিন্তু লিটন দাসের মতো প্লেয়ার তো থাকতেই পারে যিনি উইকেট কিপার হিসেবে ভালো, ব্যাটসম্যান হিসেবেও। লিটন দাস ওয়ানডেতে ভালো করতে পারেনি এখনো, কিন্তু টেস্টে যতটুকু সুযোগ পেয়েছে কিছুটা হলেও প্রতিভা দেখিয়েছে। এখনকার ক্রিকেটে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এমন, যে মূলত ব্যাটসম্যান, কিন্তু গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে ভয় পায় না। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে উইকেট কিপারের এই রোল গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য উইকেট কিপিংকে জনপ্রিয় করতে হবে, তার জন্য লাগবে হাইপ। তাহলেই হয়তোবা ৮-১০ বছর পরে প্রোপার উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান পাওয়া সহজ হবে।

প্রস্তাব৭, নিজেদের স্পোর্টস ওয়েবসাইট এবং স্পোর্টস ব্লগ চালু করুন। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রিকেট দর্শক বাংলাদেশ বাদে অন্য দলের খেলা খুব একটা ফলো করে না, ফলে বাংলাদেশ খেললেই জিততে হবে এরকম একটা ডেসপারেট মনোভাব কাজ করে; দুই দল খেললে একটা দলকে যে হারতেই হবে এটা মানতে পারার মতো স্পোর্টিং দর্শক আমাদের এদিকটায় তুলনামূলক কম। শুধু মাঠের ক্রিকেটে উন্নতি করলেই চলবে না, স্মার্ট দশর্কও সাথে সাথে গ্রো করিয়ে নিতে হবে। এজন্য আপনারা ক্রিকইনফো টাইপ একটা সাইট যদি চালু করতে পারতেন যেখানে লাইভ স্কোর আপডেটের প্রয়োজন নেই, কিন্তু ক্রিকেট রিলেটেড নানারকম এনালাইটিক পোস্ট থাকবে, এরকম একটা প্লাটফরম সুস্থ ক্রিকেট কালচার এবং কমিউনিটি বিল্ড আপ এ কাজে আসবে। একবার ভাবুন, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে বিভিন্ন টাইপ পোস্ট লেখা হচ্ছে, আপনাদের তেমন কিছু্‌ই করতে হবে না, মাসের সেরা কয়েকটা লেখাকে পুরস্কৃত বা সম্মানিত করবেন এবং তিনমাসের সেরা ১০টি পোস্ট দাতাকে বাংলাদেশের খেলা দেখার ফ্রি টিকেট দিবেন। এমনিতেই প্রচুর লেখা চলে আসবে। বিশ্বাস করুন, ক্রিকেট গ্রুপগুলো আমি ফলো করি, সেখানে অনেক এনালাইটিক লেখা আসে রেগুলার, ফালতু লেখাও আসে। কিন্তু এরকম বিসিবি স্বীকৃত একটা প্লাটফরম থাকলে সেখানে ভালো লেখার পরিমাণ প্রচুর হবে, এবং আপনারা সেখান থেকে অনেক এনালাইসিস ডিসিশন মেকিংয়েও কাজে লাগাতে পারবেন। বাংলাদেশে বোদ্ধা বলতে এক সময় আমরা সাহিত্য, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীতে সমৃদ্ধ মানুষই বুঝতাম, কিন্তু ২০১০ এর পরে ক্রিকেট বোদ্ধার সংখ্যাও বাড়ছে এবং এটা বাড়তেই থাকবে। এই ইন্টেলেকচুয়াল এনার্জিকে আপনারা আপনাদের বিজনেসে কাজে লাগাতে পারবেন, এমনকি সাইট থেকেও প্রচুর আর্ন করতে পারবেন। কাজেই, সাইট চালু করলে সেটা আপনাদের জন্যই সবদিক থেকে ভালো।

প্রস্তাব৮, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে দেড়ঘণ্টার একটা ডকুফিকশন তৈরি করুন, ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতে বই লেখার উদ্যোগ নিন, এবং মাশরাফি, সাকিব, আকরাম খান, রকিবুল হাসানদের কার্টুন ও কমিক্সের চরিত্র হিসেবে শিশুদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিন। ক্রিকেট ঐতিহ্যের জন্য ডকুমেন্টারি লাগবে, ইন্টেলেকচুয়াল এনরিচমেন্ট এর জন্য লাগবে বই। এই ডকুমেন্টারি কোটি কোটি মানুষ দেখবে, বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ডকুমেন্টারি হবে এটি। বইটা কীরকম চলবে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, তবে ই-বুক করলে এবং ইংরেজি ভারসনটা বেশ ভালোই চলার কথা। ১৬ বছর হয়ে গেল টেস্ট খেলছি, অথচ দেখুন এই সিম্পল জিনিসগুলো নেই। কিন্তু এগুলোর আর্কাইভিং ভ্যালু হিউজ, যত সময় যাবে ভ্যালু তত বাড়বে। কমিক্স এবং গেমস এ ক্রিকেটারদের ঢুকিয়ে দিতে হবে, কারণ তখন মিডল ক্লাসের মধ্যেও ক্রিকেট একটা পেশা হিসেবে জায়গা করে নেবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডারের সাথে সাথে ক্রিকেটার পরিচয়টাও মানুষ গর্ব করে দেবে। এরকম আইডিয়া কোনোটাই কিন্তু নন-প্রফিটেবল নয়, প্রত্যেকটা থেকেই বিপুল পরিমাণ রেভিনিউ জেনারেট করার সুযোগ আছে। অর্থাৎ আপনারা বিজনেস এরিয়া এক্সপান্ড করছেন, শুধু খেলা নয়, অন্য বিকল্প সোর্স থেকেও বিজনেস হচ্ছে।আপনারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। এতো বিশাল অপরটুনিটি আপনাদের, আপনারা কেন এর সদ্ব্যবহার করছেন না?

প্রস্তাব৯, খেলোয়াড়দের নৈতিক শিক্ষা এবং সাইকোলজিকাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করুন। চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জীবনকে নজরদারিতে আনুন। তাদের পেছনে আপনাদের ইনভেস্টমেন্ট আছে। খেলার বাইরের সময়টা তারা যাতে খেলার মনোযোগ ব্যহত হয় এমন সব কার্যক্রমে বেশিমাত্রায় ইনভলভ হয়ে না পড়ে সেলক্ষ্যে কড়া নীতিমালা প্রণয়ন করুন। আমাদের খেলোয়াড়দের নার্ভ খুবই দুর্বল, যে কারণে ক্রুশাল মোমেন্টে ম্যাচের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। ক্রিকেট খেলা পুরোটাই সাইকোলজিকাল। আপনারা এরকম কোর্স চালু করলে প্রচুর মানুষ সেখানে এনরোলড হবে। এটাও আপনাদের আরেকটা বিজনেস উইন্ডো হতে পারে।

প্রস্তাব ১০, দেশের সবগুলো জেলাকে নিয়ে যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ হয় সেটাকে আরও জমকালো করুন। ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেমে দিতে পারেন, এতে প্রত্যেক জেলার প্রতিনিধি হবে, একটা জোশ বাড়বে। এটার জন্য বড় স্পন্সর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন। স্কুল ক্রিকেট ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে, এটাকে কম্পিটিটিভ করতে পারেন, না করলেও খুব সমস্যা নেই, কারণ আমাদের দেশে এডুকেশনাল সিস্টেমে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটের মতো চরম প্রফেশনাল খেলায় স্কিল ডেভেলপ করার জন্য যে পরিমাণ সময়ের দরকার হবে সেটা এফোর্ড করা কার্যত অসম্ভব। এর মধ্য থেকে ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার পাওয়া আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় কঠিন। তাই ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপটাতে ফেস্টিভ লুক নিয়ে আসুন। কর্পোরেট লীগ ক্রিকেট বল এ চালু করুন। টেপ টেনিস এ ক্রিকেট খেলে তো আর লাভ হবে না। কর্পোরেট লীগ হলে কোম্পানীগুলো ভালো ক্রিকেটারদের খেলোয়াড় কোটায় চাকরি দেবে, ফলে খেলার বাইরেও তাদের উপার্জন থাকলো।

প্রস্তাব১১, অধিনায়কত্ব ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি দেখুন। একটা ক্রিকেট টিমের এক্টিভিটি অনেকখানিই অধিনায়কনির্ভর। এখনকার ক্রিকেট এগ্রেসিভ এবং প্রো-একটিভ অধিনায়কদের প্রোমোট করে। ২০০০ সালের পরে ক্রিকেটে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ওয়ানডেতে ঠিক থাকলেও আমি মনে করি টেস্টে পজিটিভ অধিনায়কের বিশাল অভাব বোধ করছি আমরা। মুশফিকুর রহিমের অধিনায়কত্ব ৯০এর দশকের ইংল্যান্ড টিমের চাইতেও প্রেডিক্টেবল এবং ডিফেন্সিভ। ওয়ানডেতে কাজ চললেও টেস্টে তার উইকেটকিপিংও গ্রহণযোগ্য নয়। তাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতে পারেন। অনেক বছর পর আমরা একটি বিদেশ ট্যুরে যাচ্ছি, এসময় অধিনায়ক পরিবর্তন করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু ২০১৭ তে প্রথম হোম সিরিজেই নতুন অধিনায়ক মনোনয়ন দিলে দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হয়। এক্ষেত্রে অপশন হতে পারেন সাকিব আল হাসান অথবা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। সাকিব দলের সবচাইতে বড় তারকা, এতো বড় তারকাকে অধিনায়ক না করে তার নিজস্ব যে ইমেজ আছে সেটা ক্যারি করতে দেয়াই বেটার। শচীন টেন্ডুলকার যে ইমেজ নিয়ে খেলে গেছেন, অধিনায়ক যে-ই হোক, তার রোল কিছু বদলায়নি। আমাদের ক্রিকেটে সাকিব তেমন একজন চরিত্র। এদিক থেকে মাহমুদুল্লাহ বেটার। মাঝেমধ্যেই তিনি উল্টা পাল্টা শট খেলে আউট হন, কিন্তু এটা তো আমাদের ব্যাটসম্যানদের জাতীয় সমস্যা; এজন্য আলাদাভাবে তাকে দোষারোপ করে কী হবে। ভাবতে পারেন।

আমার প্রস্তাবনা শেষ। সম্ভবত এটাও একটা উচ্চভিলাষী স্ট্যাটাস হয়েই থেকে যাবে। তবু জানিয়ে রাখলাম, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সরাসরি কন্ট্রিবিউট করার যে কোনো সুযোগ পেলে আমি নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বলে দেব। ইংল্যান্ডের মতো দলকে ৩ দিনে টেস্টে হারানোয় আপনাদের এফোর্টকে সম্মান জানাই; ক্রিকেটাররা তো খেলে মাঠে, আসল খেলোয়াড় তো আপনারাই। আজ সাকিব, তামীম খেলছে, ৫ বছর পর অন্য কেউ খেলবে, কিন্তু বিসিবি ঠিকই বিসিবি হয়েই থাকবে। কংগ্রাচুলেশন।