লজিকাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে বিরোধীতা অথবা প্রমোট করার দীক্ষাটা অধিকাংশ মানুষেরই দুর্বল থাকে বিধায় তাদের মতামতগুলো নৈতিক ভিত্তি হারায়।
আপনি কোনো ব্যক্তি বা মতাদর্শকে অপছন্দ করেন, সর্বক্ষণ তার ক্রিটিক করেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি বা আদর্শও প্রশংসনীয় কাজ করে। আপনাকে সেগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে, একমাত্র সেক্ষেত্রে আপনার বক্তব্যের অরিজিনালিটি বা নৈতিকতাকে ডিফেন্ড করতে পারবেন, ভয় কাজ করবে না।
অনুরূপ আপনি যাকে পছন্দ করেন বা যে আদর্শের বাস্তবায়ন দেখতে চান সেখানেও অনিয়ম ঘটে, ভুল-ভ্রান্তি থাকে। আপনার চোখে সেগুলো পড়লে সোচ্চার কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে।
কিন্তু দুর্বল লজিকাল ফ্রেমওয়ার্কের কারণে আমরা দুটো কাজ নিয়মিতই করি
– অপছন্দের কেউ পছন্দনীয় কাজ করতে পারে কোনোক্রমেই মানি না। সে অন্যায্য সুবিধা পেয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে বা কাজটা আহামরি কিছু নয় প্রমাণের চেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের আশ্বস্ত করি তার ব্যাপারে আমার চিরায়ত অবস্থান যথেষ্ট যৌক্তিক।
– পছন্দের কেউ খারাপ করলে তাকে ইনোসেন্স অবস্থানে রেখে বোঝাই তাকে মিসগাইড করা হয়েছে, সে পরিস্থিতির শিকার, সে দুষ্ট রাজনীতির বলি। তার ভুলটা মেনে নেয়া মানে নিজের চয়েজকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, সে ইনোসেন্ট থাকলে নিজেকে বিচক্ষণ মনে হয়।
এই হাইপোথিসিসের কেইস হিসেবে আমরা ক্রিকেটার তামিম-রিয়াদ এবং উত্তর প্রজন্মের ক্রিকেটারদের নিতে পারি।
তামিম এবং রিয়াদের বিরোধীতার মূল কারণ ২ টি-
১. তারা নেগেটিভ এপ্রোচে ব্যাটিং করে। দুনিয়ার সকল পিচে সবরকম কন্ডিশনে এক্টাই মুড তাদের, যার কারণে দলীয় রান সবসময় একটা লেভেলে ঘোরাফেরা করে, গ্রোথ হয় না বা পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে না। সুতরাং ভাগ্য পরিবর্তনে তাদের সাদা বলের ক্রিকেট থেকে অব্যাহতি দিতে হবে, যদিও সবসময় এটাও বলি টেস্টে তামিম মানের একজন ওপেনার প্রয়োজন, যতদিন পারে খেলুক।
২. ফিল্ডিং এবং রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে দুজনে স্লো৷ এতে প্রতি ম্যাচেই ফিল্ডিং-রানিং মিলে দল প্রায় ১০-১২ রান কম তুলে। বাংলাদেশের মতো সীমিত রিসোর্সের টিমে এই ১০-১২ রানই বিশাল পার্থক্য গড়ে দেয়।
তার মানে কিন্তু এটা নয় তামিম খারাপ প্লেয়ার। সেরা সময়ে সে অবশ্যই বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন ছিল, সুতরাং তার কিছুটা হলেও এবিলিটি আছে। বয়স বাড়লে রিএকশন টাইম কমে যায়, যাকে আমরা বলি রিফ্লেক্স। আগে কোনো একটা বলের লেন্থ পিক করতে হয়ত ১জন ব্যাটসম্যানের ১ মাইক্রো সেকেন্ড সময় লাগত, বয়সের কারণে সেটা হয়ে ২ বা ২.৫ মাইক্রো সেকেন্ড। রিএকশন টাইমের এই সামান্য পরিবর্তনের কারণেই প্রভাব পড়ে সামগ্রিক বডি ল্যাঙ্গুয়েজে।
তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্লেয়ারদের ক্যালকুলেট করতে হয় কোন ফরম্যাটে তার কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ বেশি, কোন্টাই সবচাইতে কম৷ শুধু টেস্ট খেলা একজন ক্রিকেটারের জন্য প্রফিটেবল নয়। ইংল্যান্ড বা ভারতের মতো বছরে ১২-১৩টা টেস্ট খেললে হয়তবা ভাবা যেত, বাংলাদেশ খেলে সর্বোচ্চ ৭-৮ টা; এনডোর্সমেন্টের বাজারে চাহিদাই তো তৈরি হবে না। অন্যদিকে টি২০ থেকে অবসর নিলে ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগগুলোতে কেউ দলে নিতে চাইবে না, বা নিলেও দাম পাওয়া যাবে না চাহিদামতো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় টেস্ট থেকে অনায়াসে অবসর নেয়া যায়, বাকি ২ ফরম্যাট ছেড়ে দেয়াটা দুরূহ সিদ্ধান্ত, বিশেষত যেসব ক্রিকেটারের পেছনে বিভিন্ন কোম্পানির কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ থাকে।
তামিম সারা ক্যারিয়ারে কখনোই ফিটনেস সচেতন ছিল না, যেটা তার কনভারসন রেট দেখেই বুঝা যায়। একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের ওয়ানডেতে ৫০ ফিফটির বিপরীতে সেঞ্চুরি ১৪টা, টেস্টে সেঞ্চুরি ৯টা, কিন্তু ফিফটি অনেক বেশি। অর্থাৎ ব্যাটিং করতে করতে ক্লান্তিজনিত কারণেই সে আউট হয়ে গেছে বেশিরভাগ সময়।
এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামিম এমন এক চরিত্র যার ভক্তের চাইতে সমালোচক বেশি। এটা বিজ্ঞাপন জগতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ হতে সহায়তা করেছে।
তামিমের সমালোচিত হওয়ার ক্ষেত্রে ৪টা সম্ভাব্য ফ্যাক্টর কাজ করে থাকতে পারে-
প্রথমত, তার নেগেটিভ ব্যাটিং ইনটেন্ট। একদম নিজের হিটিং জোনে বল না পেলে সে মারার কোনো চেষ্টাই করে না সাদা বলের ক্রিকেটে, তার পার্টনারকে সবসময় মারার দায়িত্ব নিতে হয়। অন্যদিকে তার স্ট্রাইক রোটেশন এবিলিটিও বেশ খারাপ, বাউন্ডারির বাইরে শুধু ডট, যে কারণে তার খেলাটা প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত প্রাইডের প্রতীক হয়ে উঠে।
দ্বিতীয়ত, আকরাম খানের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক। এদেশের মানুষ সর্বক্ষেত্রে নেপোটিজম খুঁজে, কেউ নিজ যোগ্যতায় কাজ করেছে বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ এদেশের সিংহভাগ মানুষই অযোগ্যতার খনি। সেখানে আকরাম খান বোর্ডে প্রভাবশালী অনেকদিন থেকেই, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে অনেকেই। যদিও বাংলাদেশের কালচার অনুযায়ী আত্মীয়রাই সর্বনাশের মূল কারণ হওয়ার কথা, সেক্ষেত্রে এমন হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট আকরামের সাথে তামিমের পরিবারের সম্পর্ক শীতল, বিশেষত তার বাবা যেহেতু অল্প বয়সে বিগত হয়েছেন।
তৃতীয়ত, সাকিবের সাথে সম্পর্কের অবনতি সংক্রান্ত গুঞ্জন। দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়াসূত্রে মানুষ জেনেছে তামিম-সাকিব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার অনেকদিন ধরেই এটা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে সাকিবের সাথে তামিমের বিরোধ। সাকিব যেরকম কাল্ট ফিগার, তাতে তার প্রতিপক্ষ মানে ভক্তদেরও প্রতিপক্ষ এমন একটা একরৈখিক সমীকরণ তো থাকেই। অবশ্য তামিমও এর সুবিধাভোগী। সাকিবের আওয়ামি ঘনিষ্ঠতার কারণে বিএনপিপন্থী বিরাট অংশ তাকে যারা অপছন্দ করে তাদের একটা অংশ তামিমকে সমর্থন দেয়।
চতুর্থত, অতি মাত্রায় সেলফ-গ্লোরিফিকেশন আর মিডিয়া এক্সপ্লোয়টেশন। সুনির্দিষ্ট কিছু টিভি চ্যানেল এবং প্রিন্ট মিডিয়া হাউজ যেভাবে তাকে ঘিরে প্রতিনিয়ত বন্দনা চালায়, রুচিশীল শ্রেণির পক্ষে এটা প্রশ্রয় দেয়া কঠিন, এবং অনুমান করতে ইচ্ছা জাগে এরা তামিমের মার্কেটিং এজেন্সি। কারণ কেউ যখন আনডিউ প্রিভিলেজ পায় তার মধ্যে কিছুটা হলেও জড়তা বোধ কাজ করে, মানুষও তার প্রতি ক্ষুব্ধ থাকে। তামিমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো। আমি এই করেছি, সেই করেছি, সিনিয়র ক্রিকেটারকে সম্মান করতে হবে প্রভৃতি আস্ফালনের মধ্যে ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগানো মানুষদের আচরণের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়।
এই সমস্ত ফ্যাক্টরের কারণে তামিম সবসময়ই আলোচনায়। কিন্তু সে যখন মাঠে নামে তখন সব ফ্যাক্টর ড্রেসিংরুমে রেখে এসে একজন ক্রিকেটার, এবং বাংলাদেশের মানদণ্ডে একজন দক্ষ ব্যাটসম্যান। তার সিক্স হিটিং এবিলিটি যথেষ্ট ভালো। সে যদি কোনোদিন এগ্রেসিভ খেলে টি২০ তে ফিফটি বা সেঞ্চুরি করে এটা কি প্রশংসাযোগ্য নয়?
অবশ্যই।
এবং সেঞ্চুরি করে পুনরায় যদি নেগেটিভ ব্যাটিং করে নিন্দিত হবে না?
অবশ্যই।
এই অতি প্লেইন এবং সিম্পল ব্যাপারটা নিয়েই চরম লেভেলের লজিকাল ফ্যালাসি লক্ষ্য করছি গতকাল থেকে। তামিম সিলেট টিমের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছে। অসাধারণ ব্যাটিং নিঃসন্দেহে।
কিন্তু দলের ভেতর আমরা যারা সংস্কার চাই তাদের অনেককেই দেখলাম কৃতিত্বকে লঘু করতে চাইছে। আবার তামিমের পাড়ভক্তরা ইনবক্সে এসে গালিগালাজ করছে, তামিম নাকি আমার মুখে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছে। দেখলাম দু পক্ষই উগ্রপন্থী, সংস্কারপন্থীদের যুক্তি হলো
– রাতের বেলা শিশির পড়েছে। মানহীন সব স্পিনার; আলাউদ্দিন বাবু, মুখতার আলি টাইপ বোলার। এটা তামিমকে নায়কোচিত প্রমাণ করতে সাজানো নাটক
– তামিম প্রথম ওভারেই স্লিপে ক্যাচ তুলে দিয়েছিল, মিঠুন ক্যাচ না ছাড়লে এসব কিছুই ঘটতো না
– সিলেটের দুর্বল বোলিংয়ে তামিম সেঞ্চুরি করে টি২০ তে ফেরার রাস্তা করে রাখলো। এরপর আবারো আগের মতো ডট খেলতে থাকবে।
৩টিকেই সোজা বাংলায় কুযুক্তি বলা যায়। সিলেট দলটাই এমন। তাসকিনের বাইরে সিলেটে পেসার কে আছে? একমাত্র ছিল আল আমিন, সেও ইনজুরিতে পড়েছে ছিটকে। রাতের ম্যাচ তাদের আরো ৪ টা বাকি, বোলিং এটাকও একই থাকবে, সেখানেও কি এরকম এগ্রেসিভ ব্যাটিং করবে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা। ৪ ম্যাচের অন্তত ২ টাতে কেউ করে দেখাক, তখন নাহয় শিশির আর দুর্বল বোলিংয়ের তত্ত্ব চেক করা যাবে।
– এবারের বিপিএল প্রায় প্রতি ম্যাচেই ক্যাচ ড্রপ হচ্ছে। ক্যাচ মিসকে পূর্ণাঙ্গরূপে কাজে লাগিয়েছে কয়জন? তামিম নিজেও কি বিভিন্ন সময়ে লাইফ পায়নি, কয়বার সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে?
– তামিম যদি পরের ম্যাচে নেগেটিভ ব্যাটিং করে পুনরায় নিন্দা করব। যে কোনো ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করুক বা ৪১, পরের ইনিংসে শূন্য থেকেই শুরু হবে। এবং সেই ইনিংসে করা নেগেটিভ ব্যাটিং আগের সেঞ্চুরি দিয়ে জাস্টিফাইড হয়ে যায় না। ক্রিকেট এতটাই নিষ্ঠুর প্রকৃতির খেলা। সব বাস্তবতা মেনেও তামিমের গতকালকের সেঞ্চুরি যদি প্রাপ্য প্রশংসা থেকে বঞ্চিত হয় সেটা হবে উগ্র মৌলবাদীতা।
তামিমের সিক্স হিটিং ক্ষমতা ভালো, পাওয়ার প্লে তে সে যদি এগ্রেসিভ ইনটেন্টে খেলতে গিয়ে এক নাগাড়ে ১০-১২ ম্যাচে সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হয় তবু সেটা সমর্থনযোগ্য, কিন্তু নেগেটিভ ব্যাটিং করে ৩৫ বলে ৪০ বা ৪৬ বলে ৫২ ধরনের যেসব ইনিংস খেলে এগুলো দলের উপর বিষাক্ত ইমপ্যাক্ট তৈরি করে, বা ওয়ানডেতে নেগেটিভ ব্যাটিং করে ২৪০-৪৫ টার্গেটের যে খেলা এটাও একইরকম বিষাক্ত। যখনই ঝুঁকি নিয়ে খেলবে ব্যাটিং এভারেজ স্যাক্রিফাইস হয়ে যাবে, কনসিসটেন্সি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তামিম যদি আত্মতুষ্টি এবং সেলফ-অবসেসন নিয়ন্ত্রণ করে বুঝতে পারে এসব ব্যাটিং গড় ম্যাচ জিতাবে না, বরং হারের মূল কারণগুলোর অন্যতম, একমাত্র তাহলেই কিছুটা আশাবাদী হওয়া যায়। কিন্তু মানুষের বেসিক ক্যারেক্টার বদলায় না, বদলাবে না তামিমও।
তাই তামিমের নেগেটিভ ব্যাটিংও সিন্দাবাদের ভূত হয়ে বাংলাদেশ দলের ঘাড়ে চেপে থাকবে অন্তত ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত। থাকলে থাকুক, আপাতত গতকালকের সেঞ্চুরিটার প্রশংসা করি।