উকুন বা কৃমি কী করে?
কোনো একটি দেহে আশ্রয় নেয়, তারপর সেই দেহ থেকে খাবার শুষে নিয়ে টিকে থাকে, এক পর্যায়ে দেহ ভেঙ্গে পড়তে থাকে, সবল হয় উকুন, কৃমি।
আমি কোনোদিন বায়োলজি পড়িনি, প্যারাসাইটের আলোচনাকে বুঝি অফিস কালচার দিয়ে। অফিস প্রধান যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তার ড্রাইভার এবং পিয়ন সেখানকার সবচাইতে ক্ষমতাধর মানুষ। ড্রাইভার আর পিয়ন তদবির বা সুপারিশের ক্ষেত্রে মিডলম্যান হিসেবে কাজ করে। এক পর্যায়ে তারা বসের ইমেজ বিক্রি করতে থাকে।
ধরা যাক আপনার একটা ফাইল আটকে আছে। বসের ড্রাইভার বা পিয়নকে ধরবেন, সে আপনাকে শোনাবে স্যার এমনিতে ১০ লাখের নিচে কাজ করে না, তবে আমি বললে ৫ লাখে রাজি হতে পারে। বসকে বলবে- ‘স্যার লোকটা আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। বহু কষ্টে দেড় লাখ যোগাড় করেছে। আপনি যদি একটু কনসিডার করতেন’।
— সাড়ে ৩ লাখ যাবে তার পকেটে।
খোলা মনে চিন্তা করুন- একজন পিয়ন বা ড্রাইভারের সামাজিক স্ট্যাটাস কতটুকু; কিন্তু প্রধান কর্তাব্যক্তির কৃপায় নামে-বেনামে গড়ে তুলেছে অর্থসম্পদের পাহাড়!
লেখালিখির জন্য ক্রিকেট তেমন সিগনিফিক্যান্ট কোনো বিষয় নয়। ফিল্ম বা মিউজিকের মতো এটাও পারফর্মিং আর্টস বা এন্টারটেইনমেন্ট। আমাকে ভীষণ উদ্দীপ্ত করে ক্রিকেট ক্যারেক্টার এবং ক্রিকেট রাজনীতি।
সমাজের যে কোনো সেক্টরের ক্যারেক্টার বা রাজনীতি নিয়ে লিখলেও টেম্পলেট বা ফ্রেমওয়ার্ক একই। ক্রিকেট তাই সময় ও সমাজ সংক্রান্ত আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরির মৃগয়াক্ষেত্র।
সময়মতো প্যারাসাইট নিধনের উদ্যোগ না নিলে পরিণাম ভয়াবহ।
কৃমি বা উকুনের অপকারিতা বিষয়ে গুগলে সহস্র আর্টিকেল পাওয়া যায়, সেই চর্বিত চর্বনে না গিয়ে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে যদি প্যারাসাইট তত্ত্ব বুঝতে চাই, সমকালীন বাংলাদেশে স্যাম্পল হিসেবে খালেদ মাহমুদ সুজনের সমকক্ষ পাওয়া যাবে কতজন!
সুজনকে আমরা প্রথম পাই ক্রিকেটার হিসেবে। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি বিজয়ী টিমের সদস্য ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেট তখনো এমেচার। অর্থ, খ্যাতি, সম্মান, ক্রেজ কিছুই নেই।
সেই এমেচার টিমেও তারকা বলতে আকরাম, বুলবুল, নান্নু, রফিক, এনামুল হক মনি, আতহার আলি, সাইফুল। প্রমিজিং হাসিবুল শান্ত, পাইলট, দুর্জয়। মিডিয়ায় সুজনকে পরিচিত করা হত ‘ফাইটার’ হিসেবে৷ এটার পেছনে ক্রিকেটিং স্কিল নয়, বারবার বাদ পড়ে ফিরে আসতো— এটাকে তৎকালীন সাংবাদিকেরা ‘লড়াকু স্পিরিট’ হিসেবে দেখতেন।
সুজন ছিল এমন একজন ক্রিকেটার যে ব্যাটিং-বোলিং কোনোটাই পারে না ঠিকমতো। ফিল্ডিংয়ের কথা বলছি না, কারণ সেই সময়ে দলে ভালো মানের ফিল্ডার ছিল ২-১ জন।
২০০৩ এ পাকিস্তান সফরে কোনো এক অস্ট্রেলিয়ান সাবেক অধিনায়ক এসেছিলেন কমেন্ট্রি করতে, প্রথম আলোতে তার এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।বাংলাদেশ সম্বন্ধে মূল্যায়নে বলেছিলেন- ‘দলে তরুণ প্রতিভা আছে কয়েকজন, তবে মাহমুদকে সরিয়ে দাও। এই দলের অধিনায়ক হওয়ার যোগ্যতা নেই তার’
আশরাফুলের ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যুতে প্রথম আলোতে লাল কালিতে লিড নিউজ হয়েছিল- ‘শুধু আশরাফুল একা নন’; সেখানে পাইলট, রফিক আর সুজনেরও সম্পৃক্ততা ছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল তারাই বাংলাদেশের শততম ওয়ানডের আগে আশরাফুলকে ভারতীয় বুকির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রিপোর্টটা যদি মিথ্যা হত সুজন বা পাইলট মানহানির মামলা করত নির্ঘাৎ, তারা চুপ থাকলো কেন?
সুজন সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার যাকে খেলা চলাকালে দর্শক জুতা প্রদর্শন করেছিল৷ সাউথ বিপক্ষে ছিল ম্যাচটা।
সুজনের সমগ্র ক্যারিয়ারে একমাত্র সিগনেচার হয়ে আছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়া। তবে পরবর্তীতে সেই ম্যাচটা নিয়ে গুগলে পড়াশোনা করে, উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নির্মোহ মূল্যায়ন হলো- ম্যাচটা জেতায় বাংলাদেশের কৃতিত্বের চাইতে পাকিস্তানীদের জিততে না চাওয়ার প্রতিজ্ঞাটাই বড়, ফিক্সিং আর পাকিস্তান দল একে অপরের হরিহর আত্মা বন্ধু!
বর্তমান সময়ের মোহাম্মদ মিঠুন যে ক্যালিবারের প্লেয়ার, সুজন তার খেলোয়াড়ি জীবনে ছিল এর চাইতেও নিম্নমানের একজন। তার অধিনায়কত্ব পাওয়াটাও ছিল একটা মেকশিফট সমাধান। ২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডা আর কেনিয়ার কাছে হেরে আসার পরে তৎকালীন অধিনায়ক পাইলটের অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে সুজনকে ঠেকনা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এমন কোনো পারফরম্যান্স তার ছিল না যেজন্য এটা তার প্রাপ্য বলা যেতে পারে। বরং সুজনকে যখন অধিনায়ক করা হয় তখন ইন্টারভিউতে সে বলেছিল ব্যাটিংটাতে জোর দিতে চায় যাতে উপরে ব্যাট করতে পারে।
সুজন যে ক্যালিবারের এবং যে সময়ের প্লেয়ার তাতে অবসর নেয়ার পরে তার অপশন ছিল দুটো- ব্যবসা বাণিজ্য অথবা কোচিং; মুশফিকুর রহমান বাবু নামে একজন খেলোয়াড় ছিল, প্লেয়িং রোল সুজনের মতোই– ভাংতি ক্রিকেটার। মুশফিকুর নেই কোনো আলোচনায়। কিংবা খেলোয়াড়ি জীবন থেকে কোচিংয়ে এসেও তেমন আলোচনায় নেই মেহরাব অপি, সাইফুল।
সুজন এক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। কারণ সুজন বেছে নিয়েছে বাঙালির আদি-অকৃত্রিম পেশা : দালালি!
পাসপোর্ট অফিস, হাসপাতাল, সচিবালয়, সরকারি অফিস— সর্বত্র বিরাজমান দালালতন্ত্রের যে সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক, তারই পরিবর্তিত চেহারা ক্রিকেটে এনেছে সুজন। ক্রিকেটার হিসেবে নাথিং একজন মানুষ পুতুলের মতো করে নাচাচ্ছে একটা দেশের সমগ্র ক্রিকেট ইকোসিস্টেমকে, তার এই উত্থান এবং ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে একটি এক্সাইটিং ঘটনা।
এদেশের অজস্র লোভী, সিস্টেমবাজ মানুষের জন্য সুজন এক অত্যাশ্চর্য ইনস্পাইরেশন। তাকে দেখে শিখতে পারে স্রেফ লেগে থাকার ধৈর্য, অন্তরে কাঁপুনি দেয়া কথা জানা আর ক্ষমতাবানের পদলেহনের জন্য ডিগনিটি স্যাক্রিফাইস করতে পারলে এই দেশে ধনী আর প্রভাবশালী হতে বাড়তি যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। যেজন্য প্রথম বিশ্বকাপের অধিনায়ক এবং অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুলকেও সুজন অবলীলায় শোনাতে পারে- ‘আমি বোর্ডে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেছি, উনি করেননি’। একজন ড্রাইভার বা পিয়নের বেতন এর চাইতেও অনেক কম, কিন্তু সম্পদের পরিমাণ কয়েক শো কোটি— এটাই সোস্যাল ডায়নামিক্স। সুজন সেটা জানে বলেই বিভিন্ন ইন্টারভিউতে বলে- ‘ঢাকা শহরে আমার একটা ফ্ল্যাটও নেই’, যদিও অস্ট্রেলিয়া বা কানাডাতে আছে কিনা সে কথা কখনো জিজ্ঞেস করেনি কেউ।
দালালির জন্য সুজনের প্রয়োজন ছিল মক্কেল। একসময় বয়সভিত্তিক দল, জাতীয় দল ছিল বিকেএসপি আর চট্টগ্রাম ডমিন্যান্ট। দুর্জয়, রোকন, রাজ্জাক, সাকিব, মুশফিক, রকিবুল, সৌম্য, লিটন, বিজয়, আফিফ সহ আরো অনেকেই বিকেএসপি প্রোডাক্ট। সর্বশেষ কয়েক বছরে যারা বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলেছে এবং জাতীয় দলগুলোতে খেলছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা যেতে পারে। তারা কোন একাডেমির, ফার্স্ট ডিভিশন বা সেকেন্ড ডিভিশন লীগে কোন দলের হয়ে খেলেছে; বিস্মিত হবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব ক্লাব বা একাডেমির সাথে সুজনের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এমনকি জাতীয় দলের যেসব ক্রিকেটারের সিলেকশন প্রশ্নবিদ্ধ প্রত্যেকেই সুজনের আশীর্বাদপুষ্ট। নাজমুল শান্ত আর নাঈম শেখ কোন ক্লাবে খেলে, কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে একটু খোঁজ নিলেই ব্যাপারটাকে আর নিছক কাকতালীয় মনে হবে না।
বিপিএল এ প্রায়ই আনকোড়া ক্রিকেটার দেখা যায়। মোহর শেখ নামের ফাস্ট বোলারকে মনে পড়ে, কিংবা সুনীল নারাইনের একশনে বোলিং করা আলিস ইসলাম? বিপিএল এ এদের সুযোগ দিয়েছে সুজন। কিংবা প্রায়ই শোনা যায় তরুণ কোনো ক্রিকেটার দল পাচ্ছে না, তাকে দল পাইয়ে দিল সুজন।
প্রশ্নটা যদি উল্টোভাবে করি, সুজন যদি দল পাইয়ে দেয়া বা ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করতে পারে, দল না পাওয়া বা ম্যাচ খেলতে না দেয়ার ক্ষমতাও কি তার থাকতে পারে? একজন তরুণ ক্রিকেটারকে সুজন যা বলবে সেটাই যদি শিরোধার্য হয়, এখান থেকেই জন্ম নেয় মাফিয়া। সাকিব তার কোচ সালাহউদ্দিন কিংবা নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে অনেক বেশি সম্মান করে, যে কোনো ক্রিকেটিয় সমস্যায় তাদের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন ক্রিকেটারের মুখেও শুনলাম না তার টেকনিকাল ইস্যু ছিল, সুজন স্যারের তত্ত্বাবধায়নে সেটার সমাধান হয়েছে। সবাই ধন্যবাদ দেয় তাকে ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করে দেয়ায়। একজন কোচ যদি খেলোয়াড়ি দক্ষতা বৃদ্ধিতে কোনোরকম কন্ট্রিবিউশন রাখতে না পারে, বরং খেলার ব্যবস্থা করিয়ে দেয়াই হয় মূল কৃতিত্ব— সে কোচ নাকি এজেন্ট?
ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগগুলো খেলার ক্ষেত্রে প্রতিটি দামী-অদামী প্লেয়ারের এজেন্ট থাকে। প্রতিটি সফল ডিলিংয়ের জন্য এজেন্ট সাধারণত ১৫% ফি নিয়ে থাকে মোট এমাউন্টের। সুজনের কাজের মডেলটার সাথে এজেন্টের পার্থক্য কোথায় কেউ কি বুঝিয়ে বলতে পারবেন আমায়?
ফার্স্ট ডিভিশন-সেকেন্ড ডিভিশন-থার্ড ডিভিশন শুরুর বহু আগে থেকেই ঠিক করা থাকে কারা উঠবে, কারা নামবে, কাদের টিম সেফ। যে টিমগুলো উঠছে সেইসব টিমের গভর্নিং বডির ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তদন্ত করা হোক, সেখানেও সুজনকে পাওয়া যাবে।
প্রিমিয়ার লীগ একসময় জমজমাট হত। আবাহনীর অন্যায্য সুবিধা এবং দখলদারিত্বের সূচনা হয়েছে যখন থেকে, একটু কষ্ট করে টাইমলাইনটা দেখুন, আবাহনীর কোচ কে ছিল তখন।
প্রেসিডেন্ট পাপন মিডিয়াতে প্রচুর কথা বলে অভিযোগ শোনা যায়। আপনি স্যাম্পল হিসেবে ২০২০-২০২২ এই ৩ বছরের টাইমলাইন নিতে পারেন। আপনি অবাক হতে বাধ্য যখন দেখবেন ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়ায় বিসিবির যে প্রতিনিধিটি সবচেয়ে বেশিবার উপস্থিত তার নামও সুজন।
মাশরাফি দল থেকে বাদ পড়ার পরে বোর্ড ডিরেক্টরদের তুলোধুনো করে নিয়মিত, এর মধ্যেও সুজন-বন্দনায় খামতি নেই। সাকিবের পাবলিক ইমেজ এরোগেন্ট, ড্যাম কেয়ার, তবু সে সুজনের এত প্রশংসা করে কেন?
অর্থাৎ
সুজন হচ্ছে সেই পিয়ন বা দারোয়ান যার ভয়ে অফিসের জিএম রাও তটস্থ থাকে।
ভালো ক্রিকেটার ভালো কোচ সবসময় নাও হতে পারে। তাই নিম্ন প্রোফাইলের প্লেয়ার হওয়া সত্ত্বেও কোচ হিসেবে সুজনের উচ্চমানের হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা নেই। প্রশ্ন হলো, কোচিংয়ের দীক্ষাটা সে নিলো কোথা থেকে। কোনো লেভেল পর্যন্ত সে কোচিং করেছে, কোথা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, সেইসব কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় তার পারফরম্যান্স কেমন ছিল?
নিশ্চিতভাবেই আহামরি কিছু নয়। নইলে তার মতো প্রচারণাপ্রিয় মানুষ অন্তত ১১০০ বার শুনিয়ে দিত আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে কোচিং শিখে এসেছি, আমি ৫০ জন কোচের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম, আমার ইংল্যান্ড কাউন্টি দলে কোচিংয়ের অফার ছিল।
সুতরাং গাজিপুরের কোচ রুহুল কিংবা মাগুরার জনাব গোর্কী যে ধরনের কোচ, সুজন তার চাইতে একটুও আলাদা কিছু নয়।
সাধারণ বা নিম্নমানের কোচ হয়েও সুজন শুরুর দিকে এত বেশি এক্সপোজার কীভাবে পেল এই গল্পটা বোঝার ক্ষেত্রে মফস্বলীয় প্রেমের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নেয়া যায়।
স্কুলে পড়াকালে দেখতাম এলাকায় সুন্দরী হিসেবে খ্যাত মেয়েরা যাদের সাথে প্রেম করে বেশিরভাগই বেহায়া, গাজাখোর, লোফার হিসেবে স্বীকৃত। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এই অসাধ্য? বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়— রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে, চড়-লাথি হজম করে, সর্বাবস্থায় পিছনে পড়ে থেকে এবং অনবরত প্রশংসা কীর্তনের মাধ্যমে তবেই পেয়েছিল অনুকম্পামিশ্রিত প্রেম।
ক্রমাগত নিজের প্রশংসা শুনলে আর অপরিসীম আনুগত্য দেখলে খুবই বিরলসংখ্যক মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
সুজন সেই সুযোগটিই নিয়েছে। সে কথা বলতে জানে। এক্ষেত্রে তার মাথা একদম পরিষ্কার। খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই তাকে পরিচিতরা ‘চাচা’ ডাকে। করোনাকালীন তামিম ইকবালের লাইভ প্রোগ্রামে সে বলেছিল অল্প বয়সে বিয়ে করার কারণে তখন থেকেই তার উপার্জনের প্রেসার ছিল অনেক বেশি, দেশের আনাচে-কানাচে খ্যাপ খেলে বেড়াত, সবার আগে বিয়ে করায় সমবয়সীরাও চাচা ডাকতো দুষ্টুমি করে।
ঘটনাটার রেফারেন্স দিলাম অন্য একটা ক্রিকেটিয় রেফারেন্সিংয়ের সাথে কোরিলেশন মিলাতে। ২০১৯ ক্রিকেটার বিদ্রোহ নাটকের শেষ পর্বে প্রেসিডেন্ট পাপনের সাথে ক্রিকেটারদের মিটিংয়ের খবর ফলাও করে প্রচার হয়েছিল সংবাদপত্রে। কালের কন্ঠের একটা শিরোনাম এখনো মনে পড়ে- ‘মাহমুদকে পাপনের ধমক!’ সুজন যখন পাপনকে খুশি ক্রিকেটারদের বিষোদগার করছিল, সবার সামনে পাপন তাকে বলে- ‘তুমি কোনো কথা বলবা না, একদম চুপ থাকো। শুধু ভুলভাল বুঝ দাও’
ডিগনিটি সম্পন্ন কোনো মানুষ এরপরেও সেখানে কাজ করে!
একবার কোন একটা পদ ছেড়েছিল সুজন। ইন্টারভিউতে বলে- ‘খেলোয়াড়ি জীবনে সবসময় ক্যাপ্টেনের কথামতো চলেছি। পাপন ভাই আমার ক্যাপ্টেন, উনি বলেছেন, সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি’
এরকম গদগদ আলাপ শুনলে পাপনের খুশি না হয়ে উপায় থাকে!
যে কারণে জাতীয় দলের নেটওয়ার্কে সুজনকে আমরা পাই সহকারী কোচ হিসেবে, আপৎকালীন হেড কোচ হিসেবে কয়েকটি সিরিজও কভার করেছে। পাপন তোষণের সর্বশেষ নজির রূপে সে দায়িত্ব পেয়েছে টিম ডিরেক্টরের। দলে কোচিং স্টাফ, ক্যাপ্টেন থাকা সত্ত্বেও টিম ডিরেক্টর পজিশনের রোলটা কী আজ পর্যন্ত বোধগম্য হলো না। কোচরা কি তার কাছে জবাবদিহি করে, নাকি দলের ভেতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসব খবর পাপনকে সরবরাহের জন্য সে স্পাই হিসেবে কাজ করে?
স্পাইংয়ের জন্য দলের খেলোয়াড়রাই তো যথেষ্ট, সুজনকে কেন দরকার! তবু যদি পাপনের নির্দিষ্ট স্পাই ই লাগে, অন্য কাউকে নিয়োগ দিক, সুজন কেন?
অনুর্ধ্ব১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অবশ্যই বড় অর্জন। এর কৃতিত্ব যদি সুজনের হয় জাতীয় দলের পাইপলাইনে কোয়ালিটিহীন ক্রিকেটারের মহামারীর দায় তবে কার? আর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাও ফ্লুক হয়ে যায় যখন পরের আসরেই দলের ভরাডুবি ঘটে। সাসটেইনেবল গ্রোথ তখনই বলা হয় যদি আউটকামে ভারসাম্য থাকে৷ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পরের আসরে সুপার ফোরেই উঠতে পারবে না, নির্বিচারে হারবে— এটা তো প্রসেস হলো না।
কিন্তু দালালি সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সুজনকে জাতীয় দলের নেটওয়ার্কে থাকতে হবেই।
নাজমুল শান্ত যদি জানে সুজন তাকে যে কোনো উছিলায় জাতীয় দলে খেলানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে সুজনকে কেন সমঝে চলবে। অনুরূপ শান্ত যদি বুঝে ফেলে দলে থাকার জন্য তেমন হাতি-ঘোড়া মারার দরকার নেই, সুজন স্যার আছেন, তার মধ্যে জিদটাই তৈরি হবে না, দেয়ালেও ঠেকবে না পিঠ। ফলে একজন দালাল সুজনের কারণে ধ্বংস হবে ১০০ টা নাজমুল শান্ত বা নাঈম শেখ!
সোস্যাল মিডিয়া সুজনকে প্রমোটের ক্ষেত্রে আরেকটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। দেড় যুগ আগে খেলা ছাড়া ক্রিকেটারকে ট্রল করা হয় তার খেলোয়াড়ি স্কিল দিয়ে (গতি দানব); নেগেটিভ ব্রান্ডিংয়ের কারণে প্রায় সারা বছর সে আলোচনায় থাকে। বাংলাদেশের যে কোনো ক্রিকেটারের চাইতে তার ফেসভ্যালু বেশি। নেগেটিভ মার্কেটিংকে উপজীব্য করে মিডিয়াও তাকে দেয় স্পটলাইট।
অথচ সে খেলোয়াড় হিসেবে কেমন সেই প্রশ্ন এখন আর কোনো ইস্যুই নয়৷ সে একজন প্রুভেন পরজীবী। তাকে ট্রল করার জন্য কৃমি আর উকুনের মধ্যে কোনটা অধিক মানানসই, কথা হতে পারত সেটা নিয়ে। আমরা যদি বলতাম সুজন আরো ২০ টা পদ দখল করুক ক্রিকেট বোর্ডে, কিন্তু কোনো ক্লাবে তাকে কোচিং করতে দেয়া হবে না, জাতীয় দলের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো পদে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, সুজন প্রকৃত অস্তিত্ব সংকটে পড়ত।
সাকিবদের প্রজন্ম তবু সুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো, কিছুদিনের মধ্যেই যখন লিটন-আফিফরা লিডিং রোলে চলে আসবে তারা সুজন দিন বললে দিন রাত বললে রাত বলতে বাধ্য হয়ে পড়বে। সুনির্দিষ্ট খেলোয়াড় বদলিয়ে বা তাদের মকিং করে আসলেই কি রেজাল্ট আনা সম্ভব যদি না দালাল মাফিয়া উকুন/কৃমি সুজনকে সিস্টেম থেকে নিশ্চিহ্ন করা হয়?
দুর্নীতি মানুষের কমন ধর্ম। ভারতীয় ক্রিকেটেও আঞ্চলিক কনফ্লিক্ট চরমে। শ্রীলংকা-পাকিস্তান বোর্ড দুর্নীতির মহাসমুদ্র। সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড কোটার যন্ত্রণায় দগ্ধীভূত। তবু তারা বেটার রেজাল্ট করে কারণ তাদের রিসোর্স পুলে আছে কোয়ালিটি ক্রিকেটার।
সাধারণ দর্শকের জায়গা থেকে বিসিবির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির সাথে আমার বা আমাদের লেনাদেনা নেই। আমরা খেলা দেখে বিনোদন চাই, কম্পিটিটিভ ম্যাচ চাই, সেটা পাই না কোয়ালিটি ক্রিকেটারের অভাবে। তাই কোয়ালিটির পথে প্রধান বাধা অপসারণই আমাদের একমাত্র দাবি হওয়া উচিত। তাই অমুক তমুকের জন্য কী-বোর্ড না কাঁপিয়ে ক্রিকেটপ্রেমিদের একটাই শ্লোগান হওয়া উচিত-
‘কৃমি মুক্ত ক্রিকেট চাই’
একটা দাবিতে অনড় থাকলেই ২০২৪ বিশ্বকাপে বেটার বাংলাদেশ দেখার সম্ভাবনা শতভাগ বৃদ্ধি পাবে।
মাথার উকুন আর পেটের কৃমি নিধনের এখনই উপযুক্ত সময়!