বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিদেশী কোচ মানেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকার, এই নীতি অলিখিতভাবে অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। গর্ডন গ্রিনিজ থেকে শুরু করে হাথুরুসিংহে, মাঝখানে নামগুলোই কেবল বদল হয়েছে, কিন্তু ধরন ধারণে খুব বেশি ভূমিকার পরিবর্তন কি লক্ষ্য করা গেছে?
বিদেশী কোচদের এতো ক্ষমতার উৎস কী, এটা নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমেই চলে আসে ক্রিকেট ঐতিহ্যের অভাব। আমাদের ক্রিকেট মেইনস্ট্রিমে আসতে শুরু করেছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর মধ্য দিয়ে। তার আগ পর্যন্ত যে ক্রিকেট, সেগুলো খেলা হিসেবে ক্রিকেটকে একটি প্লাটফরমে দাঁড় করানোর সংগ্রাম বা স্যাক্রিফাইস। অন্যান্য দেশে সাবেক ক্রিকেটার থাকেন যারা, তাদের অনেকেরই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার, যে কারণে তারা কোনো মতামত দিলে সেটা অন্তত গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু আমাদের সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে আমিনুল ইসলামের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি, হাবিবুল বাশারের সাহসি ব্যাটিং আর মোহাম্মদ রফিকের নিয়মিত পারফরম্যান্স বাদে বাকিদের ক্যারিয়ার ইন্টারন্যাশনাল এরিনাতে খুব প্রশংসনীয় কিছু নয়। এদের পূর্বসূরী যারা তাদের রেকর্ড আরও নাজুক, ফলে তাদের স্যাক্রিফাইস এবং স্ট্রাগলের জন্য তারা সম্মানীয়, কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল না হওয়ায় তাদের ব্যাপারে সম্ভবত আস্থা রাখতে পারেন না নীতিনির্ধারকেরা। আর এটারই সুযোগ নেয় বিদেশী কোচেরা, তারা হয়ে উঠেন মহাপরাক্রমশালী।

২য় কারণ, আমাদের দেশে প্রাইভেট টিচার কনসেপ্টের ব্যাপক প্রচলন এবং স্বনির্ভর মানসিকতার অভাব। আমাদের বেশিরভাগ স্টুডেন্ট মনে করে প্রাইভেট টিচার সব সমস্যার সমাধান করে দেবে, নিজে চেষ্টা করার ইচ্ছাটাই তৈরি হয় না। তদ্রুপ আমাদের নীতিনির্ধারকরাও ভাবেন কোচ এলেই সব ঠিকঠাক, ক্রিকেটের বাইরের মানুষেরা ডিসিশন মেকার, ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ডের যারা তারাও চাকুরে (ফলে স্বাধীনভাবে কিছু করার এখতিয়ার তাদের থাকে না, তারা কেবল নির্দেশনা অনুসরণ করেন)। কোচদের প্রতি শতভাগ সমর্পিত মানসিক আচরণের ফায়দা লুটতে কোচরা কখনো কুণ্ঠাবোধ করেনি, করবেও না, কারণ এটাই তাদের বেনিয়াবৃত্তি। দু-চারটে ইংরেজি বলে, ক্রিকেট সংক্রান্ত ভারি ভারি থিওরি শুনিয়ে আর ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ক্লাবে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতার গল্প ভাঙিয়ে তারা নীতিনির্ধারকদের মন জয় করে নেন। কোচ আমাদের খেলোয়াড়দের মেন্টালিটি চেঞ্জ করে দেবেন, অস্ট্রেলিয়ান টাফ এটিচুড গড়ে তুলবেন, বাউন্সি পিচে ব্যাটিং করা শেখাবেন, বোলার বলের গতি বাড়িয়ে দেবেন, আরও কত না জানা আশার বেলুন গ্যাসে ভরপুর হতে থাকে ক্রমাগত।

৩য় কারণ, ক্রিকেট মানেই জাতীয় দল বোঝা এবং কিছুটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স। আমাদের দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের স্ট্যান্ডার্ডের চাইতে নেদারল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ডের স্ট্যান্ডার্ড এগিয়েই থাকবে আমার ধারণা। ক্রিকেট যে নিছকই একটা স্পোর্টস নয়, এটা একটা সম্ভাবনাময় বিজনেস সেক্টর, এটা বুঝতে পারেন প্রশাসকেরা, টাকা-পয়সার এদিক-সেদিক নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু প্রোপার প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে বিজনেস গ্রো করাতে পারলে টাকার ভাগও যে বাড়বে এই সিম্পল ইকুয়েশনটুকু বোঝার বুদ্ধি নেই, নাকি সদিচ্ছার অভাব এটাই বোঝা যায় না। বিপিএল দিয়ে যারা ক্রিকেট বোঝেন, তাদের কাছ থেকে খুব বেশি বুদ্ধিমত্তা আশা করা উচিত হবে কিনা এটাও একটা প্রশ্ন। বিপিএল ক্রিকেটের গ্ল্যামার বাড়াতে আর্টিলারির ভূমিকা নিতে পারে, প্রিমিয়ার লীগ দেশের প্রধান লীগ হতে পারে, কিন্তু এরপরে কী? সেগুলো নিয়ে চিন্তা করবে কে? জাতীয় দলের ক্রেজ কাজে লাগানোর জন্য হলেও তো জেলা পর্যায়ের ক্রিকেট এবং জাতীয় লীগ জাতীয় টুর্নামেন্টগুলোতে আরও মনোযোগ কোথায়। সেটা না করে শুধু নিউজিল্যান্ড সফর, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে মেতে থাকলে হবে! যেহেতু জাতীয় দল মানেই বাংলাদেশের ক্রিকেট, এটা নিয়েই মেজরিটি পপুলেশন ফ্যাসিনেটেড থাকে (এমনটাই হওয়ার কথা। আমরা যারা স্রেফ ক্রিকেট দর্শক, অন্যান্য কাজের ফাঁকে সময় করে খেলার খবর রাখি, তারা ঘরোয়া ক্রিকেটের খুঁটিনাটি নিয়ে আগ্রহী হওয়ার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক কারণ পাবে না আসলে), কিন্তু ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন যারা তারা যদি সাধারণ সমর্থকের মতো আচরণ করেন, সেটা বিরাট ভাবনার বিষয়, এবং সেই ফাঁকেই কোচেরা হয়ে উঠেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল।
ক্রিকেটে কোচ সংস্কৃতি চালু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম যখন প্রতাপ দেখাচ্ছিল, কোচ কনসেপ্ট তখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। ৮০ এর দশক পুরোটাই ক্রিকেট কোচ ছিলো একটি ঐচ্ছিক পোস্ট। কোচ কনসেপ্ট জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ৯০ এর দশকে এবং ২০০০ সালের পর থেকে কোচ হয়ে পড়েন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্রিকেটে প্রফেশনালিজম বেড়েছে, টাফনেস এসেছে, ব্যাটিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ, ট্রেনার- অনেক ধরনের পোস্টের উদ্ভব ঘটেছে। সেক্টর এক্সপান্ড করলে সেটার যথাযথ মেইনটিনেন্সের জন্য ম্যানেজেরিয়াল কাজে লোকের সংখ্যাও বাড়বে, কিন্তু কোচনির্ভরতা কতটুকু যৌক্তিক? স্টিভ ওয়াহ বা পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া টিম যখন ইনভিনসিবল হয়ে উঠেছিল, সেখানে কি কোচের কোনো পরোক্ষ প্রভাব ছিলো?

একটা ক্রিকেটার যখন জাতীয় দলে আসে, ধরে নেয়া যায় তার স্কিল দেশের অন্যান্য ক্রিকেটারদের চাইতে বহুখানি এগিয়ে। সেই ক্রিকেটারের ব্যাটিং স্ট্যান্স, বা হুক-পুল কীভাবে খেলতে হয়, শর্টপিচ বল কীভাবে সামলাতে হয়, বা কীভাবে আরও বেশি ইনসুইং, ইয়র্কার দেয়া যায়, বা বল টার্ন করানো যায়- এসব শেখানোর সুযোগ কতটুকু? কোচের কাজটা আসলে অনেকটাই ম্যানেজারিয়াল এবং কিছু ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক। কিন্তু মাঠে যেহেতু দল চালায় ক্যাপ্টেন, সবকিছুর দায়িত্বও তার, ক্রিকেট তাই অনেকটাই ক্যাপ্টেন্স গেম। ফিল্মে ডিরেক্টরই যেমন শেষ কথা, ক্রিকেটে ক্যাপ্টেনেরও রোলও তা-ই হওয়া উচিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ক্যা্প্টেন একটা পোস্ট, যার দায়িত্ব টস করা এবং পুরস্কার বিতরণীতে কথা বলা। স্ট্র্যাটেজিক বিষয়-আশয় প্রায় সবই ড্রেসিং রুম থেকে নির্ধারিত হয়, একাদশের বাইরের খেলোয়াড়রা ড্রিংকস আনার বাহানায় ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যায়। আনিসুর রহমান, জাভেদ ওমররা এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন; জুনায়েদ সিদ্দিক, জিয়াউর রহমানরা করেছেন, এখন নাসির, ইমরুলরা করছেন, কিন্তু কোচের ক্ষমতার জায়গাটি বদল হয়নি।

তাহলে কি বিদেশী কোচের প্রয়োজন নেই? লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে আমাদের সাবেক ক্রিকেটারদের প্রোফাইল সেরকম সমৃদ্ধ নয়। মিডিওকার ক্রিকেটাররাই সাধারণত ভালো কোচ হয়, কারণ তারা প্লেয়ারের স্ট্রাগলটা বোঝে। সেরকম এক্সক্লুসিভ পাবলিক ফিগারও নেই আমাদের ক্রিকেটে। কিন্তু আমিনুল ইসলাম বুলবুল তো কোচিংয়ে আছেন দীর্ঘদিন, ইন্টারন্যাশনাল এরিনাতেও কাজ করার এক্সপেরিয়েন্স আছে তার। তাকে কেন ওভারলুক করা হচ্ছে বুঝতে পারি না। সমস্যাটা সম্ভবত, গেয়ো যোগী ভিখ পায় না গোত্রীয়। এমনিতেই আমরা রাইজিং দল, সেখানে যদি একজন দেশী কোচ নিয়োগ দেয়া হয় সেটা তো প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে উঠবে নীতিনির্ধারকদের জন্য। তাছাড়া, এদেশে পোস্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শও একটা বড়[ ফ্যাক্টর, গ্রুপিং ফ্যাক্টর- এই সবকিছু মিলিয়ে দেশের চাইতে বিদেশই নিরাপদ অপশন।

অনেক বছর আগে রিচার্ড ম্যাকিন্স নামের বয়সভিত্তিক দলের এক কোচ মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো কোচ নেই। সেটা নিয়ে স্থানীয় কোচরা প্রতিবাদমুখর হলেও বিসিবির তরফ থেকে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল কিনা জানা নেই। ছোট ছিলাম, ভালোমতো মনে নেই, তবে এখন বুঝতে পারি ম্যাকিন্সের সেই ঔদ্ধত্যের উৎস আসলে কোথায়। কারণ, ম্যাকিন্সরা কখনো আমাদের বেতনভুক কর্মচারী হয়নি, বরং অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে আমাদের মতো আন্ডারডেভেলপড একটা দেশের ক্রিকেট টিমের দায়িত্ব নিয়ে তারা আমাদের ধন্য করেন যেন। একটা অফিসের এমপ্লোয়ি যদি ডিরেক্টরের চাইতে পাওয়ারফুল হয়ে উঠে, সেটা একটা ইস্যু বটে।

আমাদের অধিকাংশ কোচদের সাথেই এন্ডিংটা খুব মধুর হয়নি। মেয়াদ শেষ করতে পেরেছেন খুব অল্প কয়েকজনই, অধিকাংশই চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই ভুল বোঝাবুঝিতে চলে গেছেন, কিংবা অন্য কোথাও বেটার অফার পেয়ে চলে গেছেন। এটাও সেই কোড অব কনডাক্ট আর কর্মপরিধি সম্পর্কে স্পষ্ট গাইডলাইন না থাকার কারণে হয়েছে। একসময় বাদাম বিক্রি করা একজন মানুষ যদি হঠাৎ করে একদিন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়, তার আচরণজনিত যেসব সীমাবদ্ধতা কাজ করে ক্রিকেট বোর্ডের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে।

কোচদের এই আধিপত্যের সর্বশেষ সংযোজন হাথুরুসিংহে। তার শাসনামলে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে ভালো করতে শুরু করেছে, টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে, কিন্তু কোচ হিসেবে তার কার্যক্রম অতীতের যে কোনো বিদেশী কোচের চাইতে অনেক বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। হাথুরুসিংহে বা জেমি সিডন্সরা অতিথি পাখির মতো আমাদের ক্রিকেটে বিচরণ করতে এসেছেন, সিজন শেষে ফিরে যাবেন, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট রয়ে যাবে, সমর্থকেরা জাতীয় দলের সাফল্যের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন। অথচ, এটা অলক্ষ্যেই রয়ে যাবে, এইসব অতিথি পাখির নিরন্তর এক্সপেরিমেন্টের বলি হয়ে দেশের ক্রিকেট একটি বৃত্তাকার বলয়েই ঘুরপাক খেতে থাকবে, এগুনোর পথ সামান্যই।
একটা জনশ্রুতি আছে, ইংল্যান্ডের সাথে জয়ী হওয়া টেস্টে টি-ব্রেকের পর ক্যাপ্টেন্সি করেছে তামীম ইকবাল, কারণ মুশফিকের ডিফেন্সিভ ফিল্ড সেটিংয়ে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এই বিব্রতকর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মুশফিককে ক্ল্যারিফাই করতে হয়েছে পর্যন্ত যে তামিম নয়, সে-ই টি-ব্রেকের পর ক্যাপ্টেন্সি করেছে। সেই টেস্টে আচমকা ইংল্যান্ডের ব্যাটিং কলাপস করায় ব্যাপারটাকে সবাই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে, কিন্তু আমি পারিনি। ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি মুশফিকের ঘোর বিরোধী, তার মধ্যে ইনোভেশনের অভাব দেখে বিরক্ত হই, কিন্তু একটা ম্যাচ চলাকালে কোচ সহঅধিনায়ককে ক্যাপ্টেন্সি করতে বলবে, এতোটা পাওয়ার প্র্যাকটিসের সুযোগ কোচ পেল কোথায়? নাকি, একটা ম্যাচ জিতেছে বলেই সবকিছু ভুলে যেতে হবে? টি২০ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সাথেকার ম্যাচটি মনে আছে? সাকলাইন সজীব এক ওভারে ১৭ রান দিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছিলো আমাদের, অথচ ওই ওভারটি করার প্ল্যান ছিলো মাশরাফির, কোচের নির্দেশে সেটি বদলে যায়। গত বিশ্বকাপেই নিউজিল্যান্ডের সাথের সেই ম্যাচটি হারার পর হাথুরুসিংহে কী বলেছিলেন মনে আছে? ‘আমরা জিততে পারলাম না শুধুমাত্র তাইজুল যাচ্ছেতাই বোলিং করার কারণে’। দল সাফল্য পাচ্ছে বলে এইসব ব্যাপারকে উপেক্ষা করা সহজ, এমনটাও বলা যেতে পারে, আমাদের মতো দেশে কোচ সর্বেসর্বা না হলে প্লেয়াররা গ্রুপিং করবে, বা কোচের যে ক্রিকেট মেধা, আমাদের ক্রিকেটারদের সেটার সিঁকিভাগও নেই। এইসব বলে আমরা যে নিজেদের প্লেয়ারদের আরও ছোট করি সেটা কি বুঝতে পারি?
হাথুরুসিংহের সমালোচনা করা আমার টার্গেট নয়। আমি সমালোচক দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সিস্টেমের। ২০১৬ সালের পুরোটা যে টি২০ খেলে কেটে গেল এর দায় কি কোচকে দেয়া যায় না একটুও? জিম্বাবুইয়ের সাথে জানুয়ারিতে শুধু টি২০ খেলা হলো, অথচ শিডিউল অনুসারে তাদের সাথে টেস্ট খেলারও কথা ছিলো। একজন কোচ কেন ডিসিশন মেকিংকে ইনফ্লুয়েন্স করবেন? এতোটাই কি মেরুদণ্ডহীন আমাদের ক্রিকেট প্রশাসন?

এক্সপেরিমেন্ট করা অবশ্যই ভালো, কিন্তু একটা রাইজিং টিমের জন্য অতিরিক্ত এক্সপেরিমেন্ট বিলাসীতার লক্ষণ, এবং এটার মাশুল বেশ চড়াদামে দিতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। হাথুরুসিংহের প্লেয়ার সিলেকশন প্রসেস অনেকটাই পাড়ার টিমে চান্স পাওয়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা দেশের জাতীয় দলে ঢোকা যদি এতোটাই সহজসাধ্য হয়ে পড়ে, সেটা অন্য অজস্র ক্রিকেটারের মধ্যে ভুল মেসেজ ছড়িয়ে দেয়, সবাই তখন স্কিল ডেভেলপের জন্য পরিশ্রম করার পরিবর্তে যে কোনোভাবে কোচের নজরে পড়ার চেষ্টা করবে। ফলে কোচ তোষণনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ক্রিকেট একাডেমির প্র্যাকটিস ম্যাচগুলোতে কোচরা যেমন বাইরে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, ইচ্ছা হলেই একজন ব্যাটসম্যানকে উঠিয়ে এনে নতুন ব্যাটসম্যানকে ক্রিজে পাঠাতে পারেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটেও তার ছায়া পড়লে কোটি কোটি মানুষ সেই ক্রিকেট থেকে কী আউটপুট আশা করবে?
মাশরাফি, মুস্তাফিজ এরা এক্সট্রা অর্ডিনারি ছিলো, যে কারণে প্রসেস ফলো না করেই তাদের জাতীয় দলে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু এই ধারা যদি চলতেই থাকে সেটা কি খুব ভালো প্র্যাকটিস হবে? এতো এক্সট্রা অর্ডিনারী ক্রিকেটারে যদি দেশ ভরে যায় তাদের বিসিবি ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডে সুযোগ দেয়া হোক, সেখানে তাদের পারফরম্যান্স মনিটর করা হোক, তাই বলে সরাসরি জাতীয় দলে! জুবায়ের হোসেন লিখনকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শেষ করার আগেই তানভীর হায়দার নামের আরেকজন লেগস্পিনারকে নিউজিল্যান্ড সফরের দলে নেয়া হলো। এর ক্রিকেটিয় ব্যাখ্যা কী? এবং এই তানভীর যদি নিউজিল্যান্ড সফর শেষেই বাদ পড়ে যায়, তার পরিণতি কী হবে? সে তো জানলোই না কেন এসেছিলো, আবার কেনই বা চলে গেল। জুবায়ের কি জানে এই প্রশ্নের উত্তর? জাতীয় দল কি খেলোয়াড়দের গিনিপিগ বানানোর জায়গা? এতোটা বিলাসীতা দেখানোর পর্যায়ে আমরা কবে পৌঁছালাম? আমি একটা ক্রিকেট টিম চালাই, যেটা সারাদেশ ঘুরে ঘুরে ক্রিকেট ম্যাচ খেলে এবং ভালো ক্রিকেটারদের প্রোফাইল তৈরি করে। এই টিমে আলি আকবর নামে একজন লেগস্পিনার আছে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এই ছেলেটি ভ্যারিয়েশন এবং কোয়ালিটিতে জুবায়ের বা তানভীরের চাইতে অনেকখানি এগিয়ে। এজন্য হাথুরুসিংহে কি আলি আকবরকে জাতীয় দলে সুযোগ দেবেন, বা সেটা আদৌ উচিত হবে? কিন্তু টেকনিকালি সেটাই ঘটছে। পার্থক্য হলো, তানভীরের বোলিং হাথুরুসিংহে নেটে দেখেছেন, আলি আকবরকে দেখেননি। সিনেমার মতো ২-১দিন নেট বোলিং দেখেই যদি এরকম প্লেয়ার নেয়া হয়, এবং ২-১টা সিরিজ শেষেই বিদায় করে দেয়া হয়, এই খেলোয়াড়গুলোকে সমর্থকদের চক্ষুশূল বানানো ছাড়া কোন্ উপকারটা হচ্ছে?

নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ১টি ওয়ানডের বেশি জিতলে সেটা বোনাস হয়ে যাবে। লড়াকু হারের দিন শেষ, এগ্রেসিভ খেলার কারণে বাজেভাবেও হারতে পারে কোনো ম্যাচ, টেস্ট আর টি২০ তেও সুবিধা করার কথা নয়। এবং বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা খেলোয়াড় আর নির্বাচকদের গালিগালাজে মত্ত হয়ে যাবেন। মৌসুমী সমর্থক যারা খেলা দেখতেই বসে জয় দেখার জন্য, তারা এমনটা করতেই পারে। পত্রিকাগুলোতেও লেখা হবে খেলার পোস্টমর্টেম, কেউ কেউ লিখবে হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ এর বাণী, স্ট্যাটিসটিক্স দিয়ে অনেকে বুঝাতে চাইবেন যে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে কোনো দলই সুবিধা করতে পারেনি, বাংলাদেশ তো কোন্ ছার; ফলে কোচের সর্বেসর্বা সত্তাটি আড়ালেই রয়ে যাবে। বড়জোড় তানভীর হায়দারকে নেয়া, নাসিরকে না রাখা, মুমিনুলকে ওয়ানডেতে না খেলানো- এসব নিয়ে আক্ষেপ আর অভিযোগের তীর আসতে পারে, কিন্তু বিদেশী কোচ মানেই তার আধিপত্য মানার দিন থেকে বেরিয়ে আসারও যে সময় ঘনিয়ে এসেছে, এই প্রসঙ্গটি আলোচনাতেই উঠে আসবে না। আমার হিসাবটা খুব সহজ। কোচকে তার কর্মপরিধির ব্যাপারে সজাগ করা হোক, তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক, এবং এক্সপেরিমেন্টের একটি লিমিট ঠিক করে দেয়া হোক। কোচের রোল কী? সে কি খেলোয়াড়দের বস, নাকি ম্যানেজার? লজিকালি চিন্তা করলে, ম্যানেজার হওয়া উচিত, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বস। দীর্ঘ ৩০ বছর বসগিরি তো দেখলাম, এবার বসকেও তার সীমানা দেখিয়ে দেয়া উচিত বোধহয়।