মহিষ প্রাণীটির জন্য ইদানীং প্রায়ই মায়া জাগে, গরুর আড়ালেই কাটিয়ে দেয় সমগ্র জীবন; মূল্যায়ন জুটে না। ঢাকার বাজারে মাংসের চাহিদা পূরণ করেও পরিচিতি জুটে গরু হিসেবে। কোনো প্রজ্ঞাবান মহিষ কি অপেক্ষায় থাকে একদিন গরুকে ছাপিয়ে উচ্চারিত হবে তার/তাদের নাম? ভাবনার এক পর্যায়ে আবিষ্কার করি মানুষ আর মহিষ শুনতে প্রায় কাছাকাছি!

গত সপ্তাহে একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম। শূন্য থেকে বিলিওনিয়ার হওয়ার গল্পগুলোকে ধোঁকাবাজি আখ্যা দেয়াই ছিল আর্টিকেলের মূল বক্তব্য। পড়ার পর থেকেই ভিন্ন এক ভাবনা বা প্রপঞ্চ জিজ্ঞাসায় ব্যস্ততা এবং অবসর, ব্যয়িত হচ্ছিল দুটোই।

যারা সৃজনশীলতার চর্চা করে যেমন লেখালিখি-ছবি আঁকা-ফিল্ম নির্মাণ-মিউজিক কম্পোজ প্রভৃতি এবং অর্থনৈতিক সাফল্য থেকে বঞ্চিত তাদের জীবনযাপনকে কোন ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়?

অর্থ-খ্যাতি-ক্ষমতা-প্রশংসা জুটে না কোনোটিই, বরং টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম, পারিবারিক এবং সামাজিক নিগ্রহ—ইত্যকার প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা সৃজনশীলতার চর্চা চালিয়ে যায় কোন্ আশা বা  স্বপ্নের প্রলোভনে? একটা ভীষণ বায়বীয় বাবল তাদের ভরসা যোগায় হয়ত- সমকালীন মানুষেরা তাদের চিন্তা ধরতে পারছে না, ভবিষ্যতে তাদের কর্ম অবশ্যই সমাদৃত হবে। থরে বিথরে সৃজনশীল মানুষ এক অবর্ণনীয় কষ্টদায়ক জীবন অতিবাহিত করে টুপ করে মারা যায় একদিন। যদি জানতে চাওয়া হয় জীবন থেকে তার/তাদের প্রাপ্তিটা কী, সন্তোষজনক উত্তর কি দিতে পারবে? নাহ।

ডিফেন্স মেকানিজমের অংশস্বরূপ কেউ কেউ বলবে- ‘প্রাপ্তিযোগের আশায় তো কিছু করিনি, কাজটা করে আনন্দ পেয়েছি কিনা সেটাই মূখ্য, কিংবা কাজটা যদি ৫ জন মানুষের ওপরেও ইমপ্যাক্ট রাখে সেটাই যথেষ্ট’।

আনন্দ শব্দটা যে প্রতিরক্ষামূলক বা ব্যর্থতা আড়াল করবার আবরণ, এটা কি দুর্বোধ্য থাকে আদৌ? সে যখন নিজের সৃষ্টিকর্ম বাজারে তুলছে তার কি প্রত্যাশা বা লক্ষ্য থাকে না যতটা সম্ভব বেশিসংখ্যক মানুষ সেটি সাবস্ক্রাইব বা কনজিউম করুক? বেশি না হোক, ন্যূনতম সংখ্যার কনজ্যুমার অবশ্যই চাহিদায় থাকে তার। সেই সংখ্যাটা যদি মাত্র ১০-২০ বা ৪০ হয় এবং তার ৫০% ই কোনোসূত্রে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত, তখন কি তার মনোজগতে রক্তক্ষরণ ঘটে না? সমকালীন মানুষের কাছে তার কনটেন্টের যদি চাহিদা না থাকে দায়টা ভোক্তার, নাকি কনটেন্টের?

উল্লিখিত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আরেকটি ক্লাসিকাল কারচুপি বা শেয়ালের সান্ত্বনাবাক্য শুনে থাকি আমরা- ‘এককালে অমুক, তমুক দুর্দান্ত জনপ্রিয় ছিল, তাদের নামে মার্কেট চলতো, আজ কোথায় তারা? কিংবা অমুকে এখন সস্তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, ২০ বছর পরে মানুষ তাকে কী হিসেবে মনে রাখবে’।

—- মনে রাখা কথাটাতে এতখানি জোরারোপ করছেন আপনি কি নিশ্চিত ২০-৩০ বছর পরে মানুষ আপনাকে মনে রাখবেই? সেই মানুষগুলো আসলে কারা। আজ ২৩ বয়সী তরুণের জীবনের যা প্রায়োরিটি ২০ বছর পরে তার প্রায়োরিটি যাবে সম্পূর্ণ বদলে, কী দায় পড়েছে আপনাকে তার মনে রাখার!  সমকালে যাকে কেউ মূল্যায়ন করলো না, ৪০ বা ৫০ বছর পরে আচমকা কোন্ ঘটনা ঘটবে যার বদৌলতে সে হয়ে উঠবে কাল্ট ফিগার?

এরকম জিজ্ঞাসায় জিহ্বার ডগায় এসে পড়ে কবি জীবনানন্দ দাস, সাহিত্যিক ফ্রানজ কাফকা কিংবা চিত্রকর ভ্যান গঘ! জীবনানন্দের কবিতা নাকি সমকালে সমালোচিত হয়েছে; কাফকার আয়ুষ্কাল মাত্র ৪২ বছর, এর মধ্যেই সে বন্ধুকে অনুরোধ করেছিল সকল পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলতে। বিলিওনিয়ার হওয়ার গল্পগুলোতে যেমন জোচ্চুরি থাকে, আমি অনেকটাই নিশ্চিত জীবনানন্দ বা কাফকার প্রতিষ্ঠার গল্পেও রয়েছে পর্যাপ্ত যদি-কিন্তু, যেগুলো রোমান্টিসাইজ করার বাহানায় উহ্য রাখা হয়। তবু যদি ধরেও নিই যা বলা হয় পুরোটাই ফ্যাক্ট, সমকালে সৃজনশীল মানুষ থাকে হাজারে-বিজারে যাদের কনটেন্ট মার্কেটে চলছে না বা ফিট করছে না, প্রত্যেকেই যদি জীবনানন্দ বা কাফকা থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজে, কতটা ভয়ংকর হবে ব্যাপারটা, ভাবা যায়! ঢাকা শহরের দীর্ঘ জ্যামের ন্যায় আমরা দেখব কাফকা-জীবনানন্দ জ্যাম! ১৯৪০-৬০ সময়সীমায় শুধু বঙ্গদেশেই যত সৃজনশীল ব্যক্তি ছিলেন, মাত্র ৬০ বছর পরে ২০২১ এ তাদের কে কে বিপুল সমাদৃত হচ্ছে; তাহলে ২০১০ এ যেসমস্ত সৃজনশীল ব্যক্তি অর্থ-খ্যাতি-ক্ষমতা-প্রশংসাশূন্য জীবন পার করেছে ২০৪০-৫০ এ তাদের ক্ষেত্রে অন্যথা ঘটবে কোন দৈববলে?

মূল বিভেদসূচক নিয়ামক পপুলিজম। যারা পপুলিস্ট চিন্তাধারাকে কম প্রশ্রয় দেয় তাদের প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম, কিন্তু যারা দেয় তাদের বৃহত্তর অংশ কি প্রতিষ্ঠা পায়? অবশ্যই না। প্রতিষ্ঠা জুটে সেই গুটিকয় মানুষেরই। তার মানে পপুলিজমের সাথে সংগতিপূর্ণ কর্ম করলেই প্রতিষ্ঠা আসে না তা প্রমাণিত ইতোমধ্যে। অবধারিত জিজ্ঞাসা তাই, পপুলিজমকে যে অতি সীমিত সংখ্যক মানুষ ক্যাপিটালাইজ করতে পারলো তাদের বিশেষত্বটা কী এবং পপুলিজমের বিরোধী আপাত জনবিচ্ছিন্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের দৃষ্টিতে তারা কি আদৌ কোয়ালিটি সম্পন্ন তথা সৃজনশীল? দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলতে পারি পপুলিজম দ্বারা প্রতিষ্ঠা পাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তারা বাজারি, লঘু, সস্তা, স্থূলরুচি প্রভৃতি ঋণাত্মক বিশেষণ প্রয়োগ করে থাকে। নেপথ্যে থাকে ঈর্ষাজনিত হীনম্মন্যতা অথবা আপাত অযোগ্য ব্যক্তির মূল্যায়ন পাওয়াজনিত বিক্ষুব্ধতা।

প্রাকৃতিক নিয়ম হলো, আপনাকে স্রোতে গা ভাসাতে হবে, স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে চাইলে যত দক্ষ সাঁতারু আর বলশালীই হোন ক্লান্তিতে ডুবে যাওয়াই নিয়তি। প্রাকৃতিক নিয়মকে উপেক্ষা করে যারা তবু স্রোতের বিপরীতেই যেতে চায় তারা কি অমোঘ নিয়তি সম্বন্ধে অবগত নয়? অবশ্যই অবগত, তবু বিপুল বিক্রম বা ঔদ্ধত্যে তারা আদতে নিয়তিকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে, এবং প্রত্যাশায় থাকে দিন বদলের। অর্থাৎ স্বীকৃতির প্রতি প্রকট একটা মোহ সক্রিয় থাকেই, প্রসেস অজানা থাকার দরুণ সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে জমা হয় সিস্টেম, বৈষয়িকতা আর সামাজিক মানুষের প্রতি।

পপুলিজমের জীবনচাহিদায় অ্যাবস্ট্রাক্ট কনটেন্টের অবস্থান আদতে কোথায়? দৈবচয়নের মাধ্যমে ১০০ জন ব্যক্তিকে নমুনা হিসেবে নিলাম, ধরা যাক তারা পপুলিস্ট কাঠামোর প্রতিনিধি, গড় আয়ুসীমা  ৭৩ বছর। প্রত্যেকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে যদি বাজারের ফর্দের আদলে তৈরি করা হয় জীবনে চাওয়ার ফর্দ, কোন উপকরণগুলো ব্যক্তিভেদেও অভিন্ন থাকবে? ফর্দে চোখ বুলিয়ে নিন-

১.বাসস্থান: সাধ্যের মধ্যে সবচাইতে বিলাসী একটি বাসা থাকবে; যদি ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয় সেটাও উন্নতমানের হলে ভালো।

২.পোশাক: দামী অথবা আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করতে হবে; পোশাকের মধ্য দিয়েই ব্যক্তিত্ব প্রতিফলিত হয় অনেকে বলেন

৩.সঞ্চয়: যে কোনো দুর্ঘটনা, অনুষ্ঠান বা চিকিৎসার জন্য এককালীন অনেক টাকার প্রয়োজন হতে পারে। বিপদের সময় সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসবে না, ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, সুতরাং ব্যাক আপ হিসেবে কিছু সঞ্চয় করা যেতে পারে।

৪.প্রতিযোগিতা: আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং পরিচিত মহলে অন্যদের তুলনায় অর্থ-ক্ষমতা এবং সামাজিক সমাদরে এগিয়ে থাকতে হবে, নইলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যেই কেটে যাবে জীবন।

৫. ঠাঁট-বাট: ফুটানি করার সুযোগ বা শো-অফ এর মাধ্যমে নিজেকে কেউকেটা প্রমাণ করতে না পারলে বেঁচে থাকাই মূল্যহীন।

৬. নির্ঝঞ্ঝা: অভাব-অনিদ্রা-অনাহার-অসম্মান প্রভৃতি যে কোনো অপ্রাপ্তিজনিত দুর্গতিমুক্ত এক শামুকের খোলসবন্দীতা। দুবেলা দুমুঠো ভাত, মোটা কাপড়—বাংলা সিনেমার চিরন্তন সংলাপের মধ্যেই নিহিত সামষ্টিক চাওয়া।

৭. বড়ো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তথা স্ট্যাটাস: মানুষের ভাবনা অনেকটা গাড়ির মতো কেবলই একমুখী এগিয়ে যাওয়া, ব্যাক গিয়ারে যাওয়াটা পছন্দ করে না, এবং প্রতিনিয়ত সমুখে যাওয়াকে তারা বড়ো হওয়া বুঝে। বয়সে বড়ো নয় অর্জনে বড়ো হওয়া যা তাকে স্বস্তি এবং আনন্দ দেয়।

৮. আইডল: ধর্মীয়-রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট, এন্টারটেইনার, ব্যবসায়ী সহ সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের এক বা একাধিক সফল ব্যক্তিত্বের অনুসারী হওয়া ব্যতীত ভাসমান মনে হয় নিজেকে, মাথার বর্গা তাদের কাছে দেয়ার মাধ্যমে আরেকটু স্থিতিশীলতা বোধ সক্রিয় হয়।

৯.অভিযোগ/হতাশা/আহাজারি: কোথাও কিছু হচ্ছে না, একটু সুযোগ পেলে অনেক বড়ো কিছু হতে পারতাম, অমুকে বেঈমানী করাতেই জীবনে এত দুর্গতি আমার।

১০. শৌখিনতা: বিলাস দ্রব্য কেনা, ভ্রমণ, শিল্পানুরাগ, ব্যতিক্রম আর বৈচিত্র্যের প্রতি ঝোঁক।

দীর্ঘ জীবনের চাওয়ার ফর্দ থেকে এটা স্পষ্ট সৃজনশীলতা পপুলিজমের প্রতিভুদের চাহিদায় শৌখিনতার স্তরে অবস্থান করে, যা অন্যান্য চাহিদার সাপেক্ষে একেবারেই অপশনাল। ফর্দে দেয়া ফরমায়েশ পূরণে তাকে কেনাকাটা করতে হয় (আক্ষরিক অথবা মেটাফরিকালি) এবং তার মাধ্যম হিসেবে পরিণত বয়সে বাছাই করে একটি পেশা। স্থায়ী পেশা নির্বাচনের পূর্বে নিজেকে মানসিকভাবে সেভাবেই প্রস্তুত করে। এই ফর্দতে আপনার কনটেন্ট তখনই চলবে যখন সেটি শৌখিনতার বদলে অন্য কোনো উপকরণ স্তরে উন্নীত হয় তথা তাদের জীবনে ভ্যালু যুক্ত করতে পারে। কিন্তু প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই কনটেন্টগুলো শৌখিনতাতেই আটকে পড়ে।

একটি সমাজে শৌখিন মানুষের সংখ্যা কখন বাড়ে? ভূ-রাজনীতিতে অবস্থান, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বচ্ছতা এবং নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্রীয় পলিসি—এই ৩টি সূচকের অন্তত ২টিতে যদি সন্তোষজনক নম্বর পায়। শৌখিন মানুষের ঘাটতি মানে রুচিশীল ভোক্তারও অনুপস্থিতি।

জীবনানন্দ বা কাফকা বিভ্রমে ভোগা কনটেন্ট ক্রিয়েটররা এসব ফ্যাক্ট সম্পর্কে অবগত কিনা অনুসন্ধানসাপেক্ষ বিষয়। বিভ্রমের একমাত্র উৎস নিশ্চয়ই সমকালে অমূল্যায়িত হওয়া নয়, একাধিক উৎস থাকা অনিবার্য সম্ভাবনা, এবং একই বিষয়ে অন্যান্য কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সাথে পার্থক্য বা কিংবা পুরোপুরি আলাদা হওয়াটাও একটি অনুঘটক হতে পারে। ব্যতিক্রমী মানেই উৎকৃষ্ট, সেই নিশ্চয়তা কোথা থেকে পেলেন জানতে চাইলে নীরবতাই যথোচিত জবাব।

তবু বিভ্রমের আবেশে সমগ্র আয়ুষ্কাল ব্যয়িত হয় যে জীবনছকে তাকে নিশ্চিন্তে মিডিওকর ট্যাগ তো দেয়াই যেতে পারে। এই মানুষগুলো যদি ৬০ বা ৭০ বছর বাঁচে, খুব জানতে ইচ্ছে হয় জীবন সায়াহ্নে নিজের অস্তিত্বকে মূল্যায়ন করতে বললে তখনো কি মরণোত্তর স্বীকৃতির মিথেই আস্থা রাখেন, নাকি অনুভব করেন যদি আরেকটা সুযোগ পেতাম নিজেকে শুধরে নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দটা অন্যকিছুর মধ্যে খুঁজে নিতাম!