স্কিল, নাকি টাইম; একজন কর্মী নিয়োগের সময় একটা কোম্পানীর কোনটা ট্রেড করা উচিত? লজিকালি চিন্তা করলে স্কিল বলা উচিত, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা। একজন কর্মী কাজে দক্ষতা দেখাতে না পারলে তাকে ঝাড়ি দেয়া হচ্ছে, অথচ অফিসে ১০ মিনিট পরে ঢুকলে তার স্যালারি কাটা যাচ্ছে, সে সারাদিন কী কাজ করলো সেটা বিবেচনায় না নিয়েই। অর্থাৎ কে বেশিক্ষণ অফিসে সময় দিলো এটাই মাপকাঠি, আউটপুট কী দিল সেটা পরের ইস্যু। আমরা ছোটবেলা থেকেই একটা কমন প্রবণতা দেখেছি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। কেউ ৩০ পৃষ্ঠা লিখেছে মানে সে প্রচুর কাজের কথা লিখেছে, কিন্তু ৫ পৃষ্ঠায় কেউ গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখতে পারে, এই সেন্সটাই আমাদের গড়মানসে অনুপস্থিত। পৃষ্ঠা গুনে নম্বর দেয়ার কালচারের সেই যে শুরু, তার পরম্পরা মেইনটেইন করা হয় কর্মজীবনে এসেও। কারণ অফিস যারা চালান তারাও তো জীবনে কোনো না কোনো সময় ছাত্র ছিলেন, বেশি পৃষ্ঠা মানে বেশি নম্বর এই নীতি তো ভুলবে কীভাবে!

নিয়োগকারীরা বলতে পারেন, ‘আমরা স্কিলই ট্রেড করি, টাইমের ব্যাপারটা ডিসিপ্লিন ঠিক রাখার জন্য। কারণ, কেউ একজন ১০ মিনিট লেট করলো তাকে যদি এলাও করা হয়, সেটা দেখে অন্যরাও লেট করে আসা শুরু করবে, টোটাল সিস্টেম কলাপস করবে। তবে গোপনে একটা কথা বলি চুপেচুপে। আমরা কিন্তু আসলে স্কিলই ট্রেড করি; প্রমাণ চান?আমরা ১ জনকে দিয়ে ৪ জনের কাজ করাই। স্কিল না থাকলে কি এটা সম্ভব’?
এই স্টেটমেন্টের জবাবে আমি বেশ দীর্ঘ সময় নিয়ে বলবো ‘হুমমম’।
নিয়োগকারীর কথা দিয়েই শুরু করি। ডিসিপ্লিন এবং সিস্টেম কলাপস। অফিস কখনো প্রাইমারি স্কুল হওয়া উচিত নয়, বসও হেডস্যার নন। ডিসিপ্লিন একটা ডিপার্টমেন্টাল ইস্যু। ডিপার্টমেন্টগুলো যদি নিজেদের কোয়ার্টারলি টার্গেট ঠিক করে নেয়, সেটা এচিভ করতে পারাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। টার্গেট সেটিংয়ের ক্ষেত্রেও অনেক প্যারামিটার আছে। সেগুলো ফলো করে একটা টার্গেট ঠিক করলে, বস তার থেকে কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু অনুমান নির্ভর টার্গেট নিয়ে ক্ল্যারিকাল জব করিয়ে একটা মানুষের প্রোডাক্টিভিটি কখনোই বাড়ানো সম্ভব নয়। একবার ভাবুন, ৯টার সময় অফিসে ইন করতে হবে। তার মানে ৭:৩০ এর মধ্যে তাকে রওয়ানা হতে হবে জ্যামের ভয়টা মাথায় রেখে, তারপর অফিস শেষ করে বের হতে গড়ে ৭টা-৮টা বেজে যাবে, তারপর বাসায় ফিরতে ফিরতে মিনিমাম সাড়ে নয়টা। বিশ্রাম এবং খাওয়া শেষে ঘুম, পরেরদিন আবার অফিস। সপ্তাহান্তে ১দিন যে ছুটি পাওয়া যায় সেটা বিগত ৬দিনের ধকল সামলিয়েই পার হয়ে যায়। এরকম সিচুয়েশনে একজন কর্মীর প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে কীভাবে? দৈব উপায়ে?
রিয়েলিস্টিক টার্গেট সেটিং নেই, কারণ অধিকাংশ মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজগুলোরই ৩ বা ৪ বছর মেয়াদী কোনো বিজনেস প্ল্যান ঠিক করা থাকে না, বিজনেস চলে মুদি দোকানের মতো অন ডিমান্ড বেসিস এ এবং বড় এন্টারপ্রাইজগুলোর বিজনেস প্ল্যান থাকলেও সেখানে গ্রোথ রেট এতো বেশি ধরা থাকে যে সেটা এচিভ করার জন্য প্রদেয় শ্রমের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রফিট ম্যাক্মিমাইজিং পলিসি পূরণে একজন মানুষ তিলে তিলে যে নিজের আত্মাটাও সেল করে দিচ্ছে ফাউস্টের মতো, সেটা বুঝতে পেরেও করণীয় কিছু থাকে না। অথচ, হওয়া উচিত ছিলো স্কিল সেলিং। তার যথার্থ মূল্যমান কি আদৌ পাওয়া যাচ্ছে? এফোর্টের বিপরীতে ফাইনা্ন্সিয়াল গেইনের তুলনা করলে গ্যাপটা কিন্তু যথেষ্টই বড় হয়ে যায়।

আমি মনে করি, লেট করলে স্যালারি কাটা যাবে, এটার ব্যাখ্যায় কোম্পানীগুলো ডিসিপ্লিনের যে ইস্যুটা সামনে হাজির করে এটা একচুয়াল ফ্যাক্ট নয়। এটার রুট কজ আরও গভীর। সমস্যাটা মাইন্ডসেট এর। চাকরি মানে সাবকনশাসলি বা কনশাসলি কোম্পানীগুলো মনে করে দাসবৃত্তি। একজন কর্মীকে ৩০ হাজার টাকা স্যালারি দেয়া হচ্ছে মানে সে তার ইচ্ছা, রুচি, স্বাধীনতা উক্ত কোম্পানীর কাছে লিখে দিয়েছে, বস যদি বলে ব্রাজিল ক্রিকেট খেলে, তাকে বলতে হবে জি স্যার, ওদের নেইমার অনেক ভালো ব্যাটসম্যান। অর্থাৎ কমপ্লিট আনুগত্য। দাসবৃত্তির এই কারণটা সম্ভবত ঔপনিবেশিক। বাংলা ভূখণ্ডটি খুব অল্প সময়ই স্বাধীন ছিলো, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ম্যাক্সিমাম সময়ই বাইরের শাসক দ্বারা এই অঞ্চল শাসিত হয়েছে, ফলে মানসিক দাসত্ব হয়তোবা জিনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারপর ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন তো আছেই। তার প্রভাবে, স্যুট-টাই হয়ে পড়েছে সাহেবানার নমুনা। অফিসের বস বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্যুট পরবেন, কিন্তু কেরানি বা গার্ড ইচ্ছা থাকলেও তাকে স্যুট পরতে দেয়া হবে না, কারণ তার স্ট্যাটাস তাকে ওই পোশাক পারমিট করে না। ঔপনিবেশিক দাসবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিকরণই আজকের চাকরি ব্যবস্থা। রূঢ় শোনালেও, অনেকেই চাকরি শব্দটাকে চাকর+ই, এই আলোকে ব্যবচ্ছেদ করেন। চাকর থেকে যে শব্দের উদ্ভব, সেটার এন্টারপ্রেটেশনে দাসত্ব থাকবে না তো কী থাকবে। কাউকে ৫০ হাজার হোক আর ৭ হাজার হোক, মাস শেষে বেতন দেয়া হচ্ছে মানেই তার ২৪ ঘণ্টা এবং ৩৬৫ দিন কিনে নেয়া, যদি বলা হয় শুক্রবারেও অফিস করতে হবে, রাত ১টার সময় ডিউটি করতে হবে বা ঈদের সময় ছুটি পাওয়া যাবে না, ইউ হ্যাভ নো চয়েজ বাট টু এডমিট। এরকম যখন মাইন্ডসেট, সেখানে ডিসিপ্লিন বজায় রাখতে লেট করলে স্যালারি কাটা হয়, এই ব্যাখ্যা নিতান্তই শিশুতোষ শোনায়।

যেসব কাজের সাথে সময় ডিরেক্টলি জড়িত, যেমন একাউন্টস ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বসে থাকতে পারে, যেহেতু তার কাছে এই সময়ের মধ্যে টাকা পয়সার লেনদেনের জন্য মানুষ আসবে, বা ফ্যাক্টরি ১ ঘণ্টা বেশি চলা মানে প্রোডাকশন বেশি হওয়া, এইসব কাজের ক্ষেত্রে টাইম নিয়ে কড়াকড়ি করা যেতে পারে। কিন্তু একটা প্রোগ্রাম কোড করতে কোনো প্রোগ্রামারের ৩০ মিনিট, কারো ৩ ঘণ্টা লাগতে পারে, একটা মার্কেটিং প্ল্যান কেউ ৩ ঘণ্টায়, কেউ ৩ দিনে করতে পারে- এরকম কাজের ক্ষেত্রই বেশি এবং এসব ক্ষেত্রে কেউ যদি আগে কাজ শেষ করে ফেলতে পারে সেটা তার স্মার্টনেস, তার স্কিল। সেটাকে এপ্রিশিয়েট না করে সবার জন্য একই নিয়ম বেঁধে দেয়াটা প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায় না, কমিয়ে দেয় বরং। এতে টাইম ফ্রেমের সাথে সম্পৃক্ত কাজের মানুষেরা ডিমোটিভেটেড হতে পারে, কিন্তু যখন সে কাজে ঢুকেছে তখনই সে এটা মেনে নিয়েছে যে তার কাজটা ছকে বাঁধা, সুতরাং তার সাথে আরেকজনেরটা তুলনা করা অনুচিত। এচিভেমেন্ট এন্ড আউটপুট ম্যাটারস।
কিন্তু এই জায়গাতেই বিপত্তি। আমাদের কালচারে কাজ বলতে কায়িক শ্রম, এবং দৃশ্যমান এক্টিভিটি মীন করে। কেউ একজন পলিসি মেকিংয়ে ৩ঘণ্টা মেন্টাল শ্রম দিলো, এটার চাইতে কেউ একজন ৩ ঘন্টা রোদে দাঁড়িয়ে লিফলেট বিতরণ করলো- এটাকে কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে, এবং যে লোকটি ৩ ঘণ্টা চিন্তা করেছে তাকে বলা হবে অলস বসে আছে। কায়িক শ্রমই যদি একমাত্র কাজের মানদণ্ড হতো, তাহলে সবচাইতে বেশি ইনকাম করতো রিকশাওয়ালা আর দিনমজুরেরা। কিন্তু বিশ্বব্যাপীই মানসিক শ্রমের দাম বহুগুণ বেশি। কিন্তু টাইম ফ্রেমওয়ালা কাজের মানুষজন থিংকিং বেইজড মানুষকে অবমূল্যায়ন করতে চায়, এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগে। এই হীনম্মন্যতার শেষ হয় ডার্টি অফিস পলিটিক্সের মধ্য দিয়ে। অফিস পলিটিক্স একটা গ্লোবাল কালচার, তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োগটা অনেক বেশি বিশ্রী।

এবার উল্টো দিক থেকে দেখার চেষ্টা করি সিনারিওটা। আমরা জানি, বেকারত্বের হার আমাদের দেশে অনেক বেশি। অন্যদিকে, কোম্পানীগুলোর হাহাকার যোগ্য ও দক্ষ লোক পাচ্ছে না। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী তাহলে? কোম্পানী বলছে তারা আপ টু দ্য মার্ক কর্মী পাচ্ছে না, আর পাশ করা তরুণ-তরুণী বলছে চাকরি পাচ্ছে না। জটটা আসলে কোথায়?

জটটা আমাদের বিল্ড আপ প্রসেস এবং সোশ্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে। আমাদের গড় কালচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরুদ্যম, শর্টকাট খোঁজে এবং আরামপ্রিয়। শর্টকাট খোঁজার কারণেই আমাদের এদিকে ডেসটিনি এতো বড় কোম্পানী হয়ে উঠে, বাজি বা বেটিং পেশা হয়ে উঠে, জায়গা-জমি বিক্রি করে মানুষ শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করতে চায়। অর্থাৎ শর্টকাটে বেশি আর্ন করার যত উপায় আছে সবকিছু এখানে অব্যর্থ। (ডেসটিনি বা যুবকের সাথে শেয়ার বাজারকে মেলানো উচিত হবে না, আমি মেলাচ্ছিও না। পৃথিবীর বহুদেশেই শেয়ার বিজনেস চলে। কিন্তু আমি বলছি ধরনের কথা। শেয়ার বাজারে যখন ধস নেমেছিল, তখন দেখা যায় ডেইরি ফার্ম বিক্রি করে, বাড়ি বিক্রি করে শেয়ারে ইনভেস্ট করেছিলো বুঝে না বুঝে। এই যে ডেসপারেট মনোভাব এটাকেই অভিযুক্ত করেছি)।
আরামপ্রিয়তার সাথে আরেকটা বড় দোষ অধৈর্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধৈর্য ধরে লেগে থাকার মানসিকতা কম। একটা কিছু শুরু করলাম মানে ৩-৪ মাসের মধ্যে সেখান থেকে রেজাল্ট চাই; ধৈর্য ধরার কোনো বালাই নেই। একারণে আমাদের রিমার্কেবল এচিভমেন্টের সংখ্যাও খুব বেশি হয় না।

আরেকটা গ্রুপ আছে যারা অনেক কিছু চিন্তা করে, কিন্তু আনুপাতিক হারে চেষ্টা করে না। এরা নিজেদের পরিচয় দেয় স্বপ্নবাজ হিসেবে, এবং একটা কথা খুব ফলাও করে ছড়িয়ে দেয়, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুবই কনফিউজিং একটা লাইন। এবং ভাষা হিসেবে বাংলা অনেক আবেগী এবং বাহুল্যপূর্ণ, ইংরেজিতে সেই আবেগটা নেই, বাহুল্য তুলনামূলক কম। এটার কারণ, আমাদের এদিকের মানুষ কথা বেশি বলতে পছন্দ করে, ইংরেজি ভাষাভাষীরা তুলনামূলক আনসোশ্যাল, ফলে তাদের ল্যাঙ্গুয়েজও কাঠখোট্টা টাইপের। কিন্তু এন্টারপ্রেশনে গিয়ে বাংলা আর ইংরেজির মধ্যে মূল পার্থক্যটা তৈরি হয়। যেমন, স্বপ্ন এই শব্দটার ইংরেজি আসলে কী; dream, নাকি vision? অর্থ এবং সংজ্ঞাগত দিক থেকে ভিশন কিন্তু ড্রিমের চাইতে অনেক গভীর, এবং ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। ড্রিম হলো আমি কী চাই সেই চিন্তা, আর ভিশন হলো আমি যা চাই সেটাকে একদম ডিটেইলে ভিজুয়ালাইজ করতে জানা এবং বিগার পিকচারটা পুরোপুরি মাথায় থাকা। উদাহরণ দিই, আমি রাজশাহী যাব এটা হলো ড্রিম, আর আমি রাজশাহীতে কোন বাসে চড়ে যাচ্ছি, কোন সিটে বসেছি, আমার সাথে আর কে কে আছে, পথে কী কী মজা করেছি এই টোটাল জার্নিটা হচ্ছে ভিশন। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বাংলাদেশে ড্রিমারের অভাব নেই, প্রতি ৩ জনে ১ জন ড্রিমার, কিন্তু ভিশনারীর খুবই অভাব। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, এই স্বপ্নের ইংরেজি ড্রিম নয়, ভিশন। কিন্তু আমরা এটা ভুল এন্টারপ্রেট করে ফ্যান্টাসি আর ডে-ড্রিমিংয়ে সময় এবং এফোর্ট লস করি।

নিরুদ্যমতার কারণে কিছু একটা সিরিয়াসলি করা এবং সেটার কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট এ কন্টিনিউয়াসলি চেষ্টা করা, এই প্রবণতাই খুব বিরল। উপরন্তু ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার কারণে, এখন যে কোনো ইভেন্ট খোলা, সেখানে গোয়িং দিয়ে না যাওয়া, সেলফি তুলে আপলোড করা, লাইক, কমেন্টের জন্য হাপিত্যেশ করা, এরকম খুবই ন্যারো একটা স্কেলে জীবন আটকে ফেলছে তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ। আপনি বলতে পারেন, আমি ২ বছরে ২০ টা জব ইন্টারভিউ দিয়েছি, একটাতেও হয়নি।
প্রথম কথা,আপনি ছাত্রজীবনে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এ কী কী কাজ করেছেন এবং কোন্ লেভেল পর্যন্ত করেছেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, অন্য দশজন যেভাবে সিভি লেখে তার চাইতে আপনার সিভি কি আদৌ আলাদা?
তৃতীয় প্রশ্ন, ১ম আর ২০ তম ইন্টারভিউ এপ্রোচে কোনোরকম চেঞ্জ কি এনেছিলেন ? নাকি প্রত্যেকবার একইরকম গেট আপ, সেট আপ এ হাজির হয়েছেন?
চূড়ান্ত প্রশ্ন, অন্য যারা আপনার সাথে ইন্টারভিউ দিয়েছিল তাদের চাইতে আপনি কোন্ পয়েন্টে ডিফারেন্ট? সবার মতো আপনিও অনলাইনে সিভি ড্রপ করেছেন, সিভিতে সবার মতোই একই স্টাইলে ক্যারিয়ার অবজেকটিভ, এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন লিখেছেন, আপনার স্পেশালিটি কোথায়? আপনি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে কয়টা আর্টিকেল পড়েছেন, কমিউনিকেশন স্কিল নিয়ে কতটুকু পড়েছেন, বা মানুষকে কীভাবে ইমপ্রেস বা অবাক করা যায় এটা নিয়ে কতটুকু জেনেছেন? ইন্টারনেট কি শুধু ফেসবুকিং আর এডাল্ট সাইট ভিজিটের জন্য ভাই? গুগলে নেই এমন কিছু কি থাকা সম্ভব? সেই গুগলে কতটুকু ঘাঁটাঘাটি করেছেন? কোনোটাই যদি না করে থাকেন, আপনার স্কিল বাড়বে কীভাবে, আপনি নিজেকে অন্যদের থেকে ডিফারেন্টশিয়েট করবেন কীভাবে?
পক্ষান্তরে, চাকরি পাওয়ার পর আরেক সমস্যা। মন শুধু উড়ু্‌উড়ু করে। অন্য কোথায় বেটার অফার আছে, এই ধান্ধায় ইন্টারভিউ দেয়ার খাসলত আপনার যায় না। অন্য কোম্পানী থেকে ২ হাজার টাকা বেশি অফার পেলেই আপনি জয়েন করার ৭ মাসের মাথায় জব সুইচ করার চেষ্টা করেন, কোম্পানী যদি বন্ড সই করিয়ে ফেলে সেক্ষেত্রে হয়তোবা পেরে উঠেন না, কিন্তু বুদ্ধি করে ফ্যামিলি প্রবলেম দেখিয়ে ঠিকই উড়াল দেন। ১ বছর পর আরেক জায়গায়, অর্থাৎ আপনি কোথাও থিতু হননি, আপনি কেবল যাযাবরের মতো এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছেন, আপনার স্কিল যতটুকু বাড়া দরকার ছিলো, বাড়েনি, মধ্য বয়সে গিয়ে একটা লেভেলে গিয়ে আটকে পড়েছেন।
আবার কেউ কেউ আছেন যারা চাকরি পেয়ে খুবই খুশি। স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে উদাসীন থেকে সে শুধু আরোপিত কাজটুকু করে গেছে, মাস শেষে বেতন নিয়েছে। কিন্তু কোনো অফিসেই এমন কোনো কাজ থাকা সম্ভব নয় যা ৩ বছর পর শেখার আর কিছু বাকি থাকে। সেই ৩ বছর পার করে ফেলার পর আপনিও কোম্পানীকে কিছু দিতে পারবেন না, কোম্পানীও দেখবে আপনার জায়গায় কম বেতনে কাউকে নিলে আউটপুট সেইম আসবে। কিন্তু নিজের ভ্যালু যদি বাড়াতেন, স্কিল ডেভেলপ করতেন, আরও ৫-১০ বছর অবলীলায় নিজের মূল্য বাড়াতে থাকতে পারতেন, অন্য জায়গা থেকে অফার এলেও সেটা ৫-১০ হাজার লেভেলে নয়, প্রায় ডাবল স্যালারির কাছাকাছি, যে সুইচিংটা হতো আপনার ক্যারিয়ারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট।

আমি তাই বেকারত্ব নয়, স্কিল ডেভেলপমেন্টে অনীহা আর মাথা খাটানোর কম প্রবণতা এটাকেই বড় সমস্যা হিসেবে দেখি। হাল আমলে বিসিএস ক্রেজ তৈরি হয়েছে। একজন স্টুডেন্ট সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই বিসিএস এর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এরকম দৃষ্টান্ত এখন অজস্র। আমি এই এপ্রোচকে নেগেটিভলি দেখছি না, কিন্তু একটা ডাটাও দিয়ে রাখি, ৩৭ তম বিসিএস প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছে মোট পরীক্ষার্থীর মাত্র ৩%; প্রোবাবিলিটি অনুসারে ৯৭% এর মধ্যেই মেজরিটি মানুষ পড়বে যতই চেষ্টা করুক। যত দিন যাবে, এই ক্রেজের দরুণ উত্তীর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা এরকমই থাকবে, প্রশ্নও কঠিন হবে। জব সল্যুশন, কোচিং এসব দিয়ে বিসিএস এ টেকার দিন আরও কঠিন হয়ে পড়বে; পেপার পত্রিকা, বই পড়ুন, নেটে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ুন, তাতে জানার পরিধি বাড়বে, সেই সাথে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এ মন দিন। শুধুমাত্র বিসিএস এর ভরসায় থেকে স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে উদাসীনতা বজায় রেখে নিজের ক্ষতি করা ছাড়া আর বিশেষ লাভ হবে না।

সামগ্রীক সিনারিও হলো, দক্ষ জনশক্তির অভাব আছে এটা যেমন সত্য, কোম্পানীগুলোর রক্তচোষা প্রফিট ম্যাক্সিমাইজিং নীতি এটাও মিথ্যা নয়। ব্যালেন্সিং পয়েন্ট হলো, প্রফিট লিমিট সেট করা, এবং অফিসকে এমপ্লোয়ি ফ্রেন্ডলি করার চেষ্টা করা। তাতে প্রফিট এবং প্রোডাক্টিভিটি দুটোই বাড়বে। হাফ-মোটিভেটেড এবং ডিমোটিভেটেড ওয়ার্কফোর্সকে প্রেসারাইজ করে, খিস্তি খেউর করে হয়তোবা সাময়িক বিজনেস চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে, কিন্তু এলাস্টিক লিমিট পার হয়ে গেলে একদিন কিন্তু সিস্টেম রানা প্লাজার মতো বিধ্বস্ত হবে। সেটা সামাল দেয়া সহজ হবে না। হ্যাঁ, আপনার ইনভেস্টমেন্ট প্রচুর, এমপ্লোয়ির ওয়ার্ক আওয়ার আছে, আপনার ৭দিনই বিজনেস, আপনার ব্যাংক লোন আছে, বোর্ড অব ডিরেক্টরস এর প্রেসার আছে, কিন্তু আপনি এসব চ্যালেঞ্জ নিতে পারবেন বলেই তো বিজনেস এ নেমেছেন, নইলে আপনিও কোনো একটা চাকরিতে ঢুকে পড়তেন। তা যেহেতু করেননি, এইসব এক্সকিউজ দিয়ে নিজের অপনীতিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করবেন না, তাহলে যুক্তির চালে নিজেই কিস্তিমাত হয়ে যাবেন।

ফ্যান্টাসি নয়, স্বপ্ন নয়, এমনকি আপাত চার্মিং অথচ ভীষণ বোরিং মোটিভেশনাল মন্ত্রও নয়, যতটুকু স্কিল আছে সেটাকেই শার্পনার দিয়ে শার্প করুন, সময় চলে যাচ্ছে…