ক্রমবিবর্তনের ধারায় ক্রিকেট বাণিজ্য এখন অনেকটাই পিএল নিয়ন্ত্রিত। আইপিএল, সিপিএল, এসপিএল, বিগব্যাশ (এপিএল), এবং এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন বিপিএল। বিজ্ঞমহল পিএল এর প্রাদুর্ভাবকে ক্রিকেটের জন্য যতোই ক্ষতিকর মনে করুক, আমি খেলাটির বিশ্বায়নের সম্ভাবনা প্রশ্নে, পিএল ডোমিনেশনের পক্ষে। একঘেয়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ দেখার চাইতে বহুজাতিক সংমিশ্রণের পিএল টুর্নামেন্টগুলোর পটেনশিয়ালিটি বেশি অনেকাংশে। নিরপেক্ষ দেশের ক্রিকেট দর্শকের জন্য দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো অর্থবহ কিছু নয়। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই মাসব্যাপী ভারত সফরটিকে টানা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়া বা জিম্বাবুয়ের কোনো ক্রিকেট দর্শক এই সিরিজের জন্য অপেক্ষা করে নেই। কিন্তু আইপিএল বা এসপিএল এ নিজ দেশের খেলোয়াড়ের দলের খেলা থাকলে তার খবরাখবর রাখতে তারা উদগ্রীব হয়ে থাকে। ফুটবল লীগগুলোর দিকে খেয়াল করলে এই প্রবণতাটি আরও ভালোভাবে বুঝা যায়। স্প্যানিশ বা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের ম্যাচগুলো দর্শকরা যতোটা আগ্রহ সহকারে দেখে, স্পেন বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচের উত্তেজনা সমপরিমাণের নয়। ক্রিকেট দর্শকের জন্য দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বিশেষ আকর্ষণ বহন করে না।
ক্রিকেট খেলা কি তাহলে ঘরোয়া লীগের মতো হয়ে যাবে? ত্রিদেশীয় বা চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্ট একসময় প্রায় নিয়মিত ঘটনা ছিলো। ভেনু হিসেবে শারজাহ অপাঙক্তেয় হওয়া, এবং এফটিপি ঘোষণার পর থেকেই টুর্নামেন্ট বলতে আমরা এখন শুধু আইসিসি পরিচালিত টুর্নামেন্টগুলো দেখি। বিকল্প হিসেবে আইসিসি তাই বছরে অন্তত দুটো মিনি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারে। সেটা আইসিসির পক্ষে সম্ভব না হলে বোর্ডগুলোর উচিত দ্বিপাক্ষীয় সিরিজের পরিবর্তে উক্ত সময়ে ফ্রি থাকা এক বা একাধিক দলকে নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে হবে শুধু টেস্ট ম্যাচ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটই যেহেতু পাবলিক ক্রেজ, এবং ক্রিকেট বাণিজ্যের সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তাই এই ফরম্যাটের ক্রিকেটকে সবচাইতে ভালোভাবে ইউটিলাইজ করার পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলোর অবশ্যই থাকা উচিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নে এবং ক্রিকেটার পেশাটিকে নিরাপদ করার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিপিএল এর উপযোগিতা বিপুল। তবে মাত্র ৬টি ফ্রাঞ্চাইজি দেয়াটা একটা কৌশলগত ভুল। অন্তত ১০টি ফ্রাঞ্চাইজি নিয়ে এই বিশাল পরিসরের টুর্নামেন্ট আয়োজিত হওয়া উচিত। তাতে হয়তোবা টাকার ঝনঝনানি কিছুটা হ্রাস পাবে, কিন্তু আরও ৬০ জন ক্রিকেটারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। বিসিবির উচিত বছরে ২ বার বিপিএল আয়োজন করা, একবার এপ্রিলে, অন্যটা অক্টোবর মাসে। তবে দুই বিপিএল এর গঠনতন্ত্র এক হবে না। এপ্রিল মাসের বিপিএল হবে অনুর্ধ্ব ১৯, সেখানে কোনো বিদেশী খেলোয়াড় খেলতে পারবে না, সর্বোচ্চ ৩ জন প্রিমিয়ার খেলা খেলোয়াড় একেকটি দলে খেলতে পারবে। এটাও হবে ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক। অনুর্ধ্ব ১৯ এর প্রাইজমানি মূল বিপিএল এর চাইতে কম হবে, কিন্তু ১৯ বছরের একটা ছেলে যদি এতো বড় একটা আসরে খেলার সুযোগ পায় সেটা তার মোরাল বুস্ট আপ এর জন্য দারুণ কার্যকরী হবে। প্রশ্ন হলো, অনুর্ধ্ব ১৯ আসর কি লাভজনক হবে? বিসিবি এখন যে অবস্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছে, তাদের মার্কেটিং স্কিল খাটিয়ে এই আসরের জন্য ফ্রাঞ্চাইজি এবং টেলিভিশন সম্প্রচার সুবিধা ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপারই নয়। এতে করে মেরুর সৃষ্টি হবে না। বর্তমান সিস্টেমে, এক শ্রেণির ক্রিকেটাররা ধনী থেকে ধনীতর হচ্ছে, আর তরুণ ক্রিকেটাররা উপযুক্ত প্ল্যাটফরমের অভাবে স্ট্রাগলিং পিরিয়ড ক্রমেই দীর্ঘায়িত করছে। বিপিএল অনুর্ধ্ব ১৯ আসরের মধ্য দিয়ে ক্রিকেটার পেশাটিকে আরেকটু পোক্ত করা সহজ হবে।
খেলোয়াড়দের নিলাম একটি বাজে প্রক্রিয়া। প্লেয়ার বাই চয়েজ সে তুলনায় অনেক সিস্টেমেটিক। যদিও ৩৫ লাখ টাকাকে ইলেকট্রনিক আর প্রিন্টিং মিডিয়া কোনো টাকাই মনে করছে না, তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের মতো অনুন্নত রাষ্ট্রে ৯-১০ টি ম্যাচ খেলে ৩৫ লাখ টাকা পাওয়া মানে একজন খেলোয়াড়ের সারাজীবনের উপার্জন হয়ে যাওয়া। একজন সাধারণ চাকরিজীবীর সাথে তুলনা করুন। ৩০ বছর চাকরি করেও সে কিন্তু ৩৫ লাখ টাকা পেনশন পায় না। সুতরাং ব্যালেন্স থাকাটা জরুরী। বরং বিগত বিপিএল গুলোতে খেলোয়াড়দের টাকা-পয়সা দেয়া নিয়ে যেসব টালবাহানা হয়েছে, সেসব যাতে না হয় বিসিবির উচিত সেদিকটাতে নজর দেয়া।
নিলামের চাইতে প্লেয়ার বাই চয়েজ কেন ভালো সেটা ব্যাখ্যা করি। নিলাম অনেকটা দাসপ্রথা এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতার মতো। দেখা যায় একজন ক্রিকেটারকে কিনতে তিন-চারটি দল পাল্লা দিচ্ছে। তার ভিত্তিমূল্য হয়তো ছিলো ৫ লাখ টাকা, প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে করতে সেটা গিয়ে দাঁড়ালো ১৫ লক্ষতে। এতে করে যা হয়, খেলোয়াড় মূল্য নিরূপণে কোনো স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করা যায় না। কিন্তু বিসিবি থেকে একজন ক্রিকেটারকে যখন গ্রেডিং করা হয়, এবং গ্রেডের বিপরীতে তার একটি পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়, তাকে যে দলই কিনুক পারিশ্রমিকে বৈষম্য আসে না। কেউ যদি এক্সট্রা পারফরম করে সেজন্য তো ম্যান অব দ্য ম্যাচ, ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার সুযোগ থাকেই। তাই খেলোয়াড়দের মধ্যে মেরু সৃষ্টির পায়তারা করা মিডিয়াকে বুঝতে হবে, টাকা গাছে ধরে না, সেটা কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়। বিদেশী ক্রিকেটারের মূল্য স্থানীয় ক্রিকেটারের চাইতে বেশি কেন। আপনাকে বুঝতে হবে, তারা সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে খেলে। কাজেই তাদের পারিশ্রমিক অন্যান্য দেশের লীগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে তারা খেলতে আসবে কেন। বিপিএল এর ফ্রাঞ্চাইজি আইপিএল বা বিগ ব্যাশ এর ফ্রাঞ্চাইজির সমপরিমাণ না হোক, কাছাকাছি মানের পারিশ্রমিক দিতে গেলেও সেটা অনেক টাকা হয়ে যাবে। এই সাধারণ ব্যাপারটা না বুঝলে বিদেশীদের জন্য বিপিএল বন্ধ করে দিলেই হয়। তা যদি না করে, তাহলে কম্পিটিটিভ প্রাইস এর ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবেই। আবেগ দিয়ে বাণিজ্য হয় না, গান বা বই লেখা যায়। ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত একটি পটেনশিয়াল প্রোডাক্টই, এখানকার পরিস্থিতি আবেগ দিয়ে বিচার করলে বাণিজ্য করা কঠিন হয়ে পড়বে, এবং ক্রিকেটার পেশাটি গভীর সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়বে।