দ্বিপাক্ষিক সিরিজ কি ক্রিকেটের জন্য আদৌ ভালো, নাকি ত্রিদেশীয় বা চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টগুলোই ক্রিকেট জনপ্রিয়করণে বেশি এফেকটিভ?
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের বিপুল প্রসার (আইপিল, বিগব্যাশ, সিপিএল, এসপিএল, বিপিএল) প্রশ্নটিকে ইনভ্যালিড করে ফেলেছে হয়তোবা, কারণ টুর্নামেন্ট বলতে আমরা এগুলোই বুঝে থাকি, বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটাররা একই দলের হয়ে খেলছেন, এটা দেখতে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, আলাদা করে টুর্নামেন্ট দেখার প্রয়োজনীয়তা হয়তোবা অনুভূত হয় না।
ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে ফুটবলের লীগ ফরম্যাটের একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকতে পারে। মেসি, নেইমার বা রোনালদো যতটা আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা পর্তুগালের, মানুষের কাছে আরও বেশি বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের। ক্লাব ফুটবলের দাপট এতোটাই যে বিশ্বকাপের বাইরে অন্য মেজর টুর্নামেন্টগুলো নিয়ে দর্শকের মাথাব্যথা অনেক কম। ক্রিকেটে একসময় এমনটা ছিলো না, কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজি লীগ সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। ফ্রিল্যান্সার ক্রিকেটার কনসেপ্ট ফ্রিল্যান্সার ফুটবলারের মতোই প্রতিষ্ঠিতপ্রায়।
ক্রিকেটার ফ্রিল্যান্সার হয়ে গেলে কি কোনো সমস্যা আছে? ধরা যাক, ক্রিস গেইল বা সুনীল নারাঈনের কথা, যারা ফ্রাঞ্চাইজি লীগের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলা থেকে বিরত ছিলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো দেশ নয় বলে তাদের খেলোয়াড়রা এরকমটা করতেই পারে। কিন্তু সাকিব আল হাসান বিগব্যাশের কারণে বাংলাদেশের হয়ে কোনো একটি সিরিজ খেললো না; সেটার পরিণতি কী হতে পারে? বোর্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটাররা বোর্ডের ম্যাচগুলোকে প্রায়োরিটি দিতে বাধ্য, লীগগুলোরও অন্যতম শর্ত থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের বোর্ড থেকে এনওসি নিয়ে আসতে হবে, কাজেই এরকম ঘটনার সম্ভাব্যতা কম। কিন্তু সাকিব যদি অবসর নিয়ে নেয়, তখন তো খেলতে বাধা নেই। ভবিষ্যতে এরকমটা হতেই পারে, ভালো খেলোয়াড়রা ফ্রাঞ্চাইজি লীগে খেলার জন্য আগেভাগেই অবসর নিয়ে নিচ্ছে। তখন একটা জমজমাট ক্ল্যাশের সৃষ্টি হবে।
ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটের সূত্রপাত বলতে গেলে ভারতের বিদ্রোহী ক্রিকেট লীগ আইসিএল এর মাধ্যমে। তারও বহু আগে কেরি প্যাকার সিরিজ ফ্রাঞ্চাইজ লীগ শুরু করলেও সেটা সর্ববিস্তারী ভূমিকা নিতে পারেনি। আইসিএল দমনে বিসিসিআই আইপিএল চালু করার পর ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেট ফুল ফ্লেজড আত্মপ্রকাশ করে। ইংল্যান্ডের কাউন্টি লীগ, অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ডে ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেম থাকলেও সেটা ঠিক এখনকার টি২০ লীগগুলোর ফরম্যাটে ছিলো না। ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটের একমাত্র আকর্ষণ বিপুল পরিমাণ টাকা। একজন ক্রিকেটার সারাজীবন খেলে যা উপার্জন করতে পারবে, ২-৩ জন সিজন টি২০ আইপিএল খেলে তার চাইতে বেশি উপার্জন করা খুবই সম্ভব। এই যে অর্থের হাতছানি এটা উপেক্ষা করা ক্রিকেটারদের জন্য কঠিন। ক্রিকেট তো খুবই স্বল্পস্থায়ী ক্যারিয়ার; বয়স ৩০ পেরুলে মানুষের চাকরিজীবন কনসোলিডেটেড হতে শুরু করে, আর ক্রিকেটারদারে বেলায় ৩০ মানে ক্যারিয়ারের মধ্যাহ্ন পার করে ফেলা, আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তো সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া। ফলে, ক্রিকেটারদের অনেক কিছু ক্যালকুলেট করতে হয়। খেলার বাইরে অন্য স্কিলগুলো তো ডেভেলপ করা হয়নি, লিকুইড ক্যাশ মানে সেটা রানিং কোনো বিজনেস, যেমন রেস্টুরেস্ট, ফ্যাশন হাউজ প্রভৃতিতে ইনভেস্ট করে তারা ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে চায়। যৌবন শেষ মানেই তার লাইমলাইট শেষ, ২টা সিরিজ ফ্লপ মানে উপার্জনে ঝুঁকি চলে আসা- এরকম বহু প্রতিবন্ধকতা জয়ের টেনশনে থাকতে হয়। যারা আজ তার বাউন্ডারি মারাতে হাত তালি দিচ্ছে, সেই প্লেয়ারটিই গুরুতর ইনজুরিতে পড়ে খেলার বাইরে চলে গেলে তার জন্য শুষ্ক সহানুভূতি ছাড়া বরাদ্দ থাকবে না কিছুই। ক্রিকেটার যদি চরম আত্মকেন্দ্রিক হয়, জানবেন সেটা সিস্টেমের কারণেই। স্টারডম যেহেতু সীমিত সময়ের ব্যাপার, এটাকে যতটুকু ক্যাশ ইন করা যায়, সেটাই মঙ্গল তার জন্য।
জাতীয় দলভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিলো ৯২ বিশ্বকাপের পর থেকে, সেই জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন ছিলো ২০০৭ এর আগ পর্যন্ত। কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজ লীগ জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ায় ত্রিদেশীয় বা চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টগুলো সংকুচিত হতে থাকে, বাড়তে থাকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজের আড়ম্বড়তা।
দ্বিপাক্ষিক সিরিজ কেন বোরিং এটার জবাব কিন্তু সিম্পল। দুটো দেশ নিজেদের মধ্যে খেলছে, এটা নিয়ে ওই দুই দেশের মানুষ ছাড়া কারোরই বিশেষ আগ্রহ থাকে না, ওখানে চ্যাম্পিয়ন-রানার আপ জাতীয় কিছু থাকে না, হয় সিরিজ জয়, অথবা পরাজয়। অনেকটাই প্রেডিক্টেবল যে ফলাফল। ব্যক্তিগত রেকর্ডবুক সমৃদ্ধ করা ছাড়া এই সিরিজগুলো থেকে খেলোয়াড়দের প্রাপ্তিও কিছু নেই তেমন। এশেজ সিরিজ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ার অন্যতম কারণ দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং ক্রিকেটের প্রাচীনতম সদস্যদ্বয় অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার দ্বৈরথ। ঐতিহ্যের একটা ইনহারেন্ট শক্তি তো আছেই। এর বাইরে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি, ফ্রাংক ওরেল ট্রফি এই দুটো সিরিজ নিয়েও ঐতিহ্য তৈরির চেষ্টা চলছে, কিন্তু এখনো বহুপথ পেরুনো বাকি।

শারজাহর এর সুবাদে ৯০ এর দশক প্রায় পুরোটাই বহুজাতিক টুর্নামেন্টে ভরপুর ছিলো। সেই টুর্নামেন্টগুলোর সুবাদে ভেনু হিসেবে সবচাইতে বেশি ওয়ানডে ম্যাচ আয়োজনের রেকর্ড গড়েছিল শারজাহ স্টেডিয়াম। অস্ট্রেলিয়ায় একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ হতো, ইংল্যান্ডে হতো ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি। সিঙ্গাপুরে হতো সিঙ্গার কাপ, এশিয়ার চার দেশের মধ্যে পালাক্রমে হতো এশিয়া কাপ (এটা এখনো হচ্ছে), পেপসি কাপও জনপ্রিয় হয়েছিল, একসময় জনপ্রিয় ছিলো বেনসন এন্ড হেজেস কাপ। কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ব্যাপক প্রসার টুর্নামেন্টগুলোর ভবিষ্যৎ আটকে দিয়েছে।

কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজ টুর্নামেন্টের সাথে জাতীয় দলভিত্তিক টুর্নামেন্টের একটা বড় পার্থক্য একসেপ্টেন্স এবং ইমোশনের। বার্সেলোনা হারা আর আর্জেন্টিনা হারা কখনোই একই ফিলিং তৈরি করবে না দর্শকের মনে। স্পোর্টস প্রচণ্ড পলিটিকাল কনসেপ্ট, যার অন্যতম এজেন্ডা ন্যাশনালিজম প্রোমোট করা। ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক স্পোর্টসেও ইজম কাজ করে, সেটা লোকালিজম। একারণেই ম্যানচেষ্টারের সাপোর্টাররা চেলসির সাপোর্টারদের পছন্দ করে না, কেকেআর এর সমর্থক, পাঞ্জাব সুপারকিংসের সমর্থকদের ট্রল করতে চায়। আমাদের ঘরের লীগ বিপিএলেও আঞ্চলিকতাপ্রীতি স্পষ্ট। একজন মানুষ বরিশাল, নাকি রংপুরের সমর্থক হবে এটা খেলোয়াড় দিয়ে নয়, সে কোন্ অঞ্চলে বসবাস করে সেই ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। এই কারণে সিডনীর কোনো একটা দলের ম্যাচের চাইতে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের ম্যাচের গুরুত্ব বেশি। কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজি তো জাতীয় দলের মালিকানা পাওয়ার সুযোগ রাখে না, তারা ক্রিকেটের মধ্যে বিজনেস এবং মার্কেটিং অপরটুনিটি আবিষ্কার করে, এখানে ইনভেস্ট করলে সেটার রিটার্ন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। টি২০ লীগগুলো তাদের ক্রিকেটে এন্ট্রির পথে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে কম্পিটিটিভ ক্রিকেটের, অনেকটা নিয়মরক্ষার প্রয়োজনে দলগুলো একে অপরের সাথে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলছে। বিশ্বকাপের পরে ২য় বৃহত্তম টুর্নামেন্ট হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ত্রিদেশীয় বা চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টগুলো পড়ে গেছে অস্তিত্ব সংকটে।

বিকল্প কী হতে পারে? বাস্তব কারণেই ফ্রাঞ্চাইজি লীগ বন্ধ করার সুযোগ নেই, সবগুলো লীগেই খেলেন এমন খেলোয়াড় সংখ্যাও খুব বেশি নয় (ভারতের ক্রিকেটাররা তো আইপিএল এর বাইরে খেলেই না, ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইল, ব্রাভো, স্যামি, রাসেলরাই ফেরিওয়ালার মতো এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়ায়), তাই লীগের টাইমিং বড় সমস্যা নয়, মাত্র কিছুদিন আগেও জিম্বাবুইয়ে, শ্রীলঙ্কা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট হয়ে গেল। ক্রিকেট বোর্ডগুলো যদি টুর্নামেন্টের ব্যবসায়িক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, এই চিত্র বদলাতে পারে অনায়াসেই, তবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এর রিয়েলিস্টিক কারণ হলো, অস্ট্রেলিয়া বাদে ক্রিকেট খেলুড়ে বাকি দেশগুলোতে ক্রিকেট বোর্ড প্রফেশনাল কম। বোর্ডে ক্রিকেটের বাইরের মানুষের সমাগম বেশি। যে কারণে খেলা-ক্রিকেটের চাইতে প্রোডাক্ট-ক্রিকেটে তাদের ঝোঁক বেশি; সেটাও পজিটিভলি কনভার্ট করা যেতো যদি ক্রিকেট বিজনেস নিয়ে তারা সিরিয়াসলি ভাবতেন। তারা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব (ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা), খেলোয়াড়দের সাথে সংঘাত (ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড), উদ্ভট নিয়ম (সাউথ আফ্রিকা), দারিদ্র্য (জিম্বাবুইয়ে, নিউজিল্যান্ড) আর অরাজকতা (বাংলাদেশ) নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ক্রিকেট কূটনীতি, নেগোশিয়েশন, বা কনভিন্সিংয়ের সদিচ্ছায় যথেষ্ট ঘাটতি আছে বলেই বোধহয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কাছে কোণঠাসা হয়ে আছে।
তাহলে ফ্রাঞ্চাইজিই কি ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ? হতে পারে, নাও পারে, সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তবে আলামতগুলো ইতিবাচক নয়। ফুটবলের মতো ক্রিকেটের বিস্তৃতি যেহেতু ব্যাপক নয়, ফ্রাঞ্চাইজির হাতে চলে গেলে খেলা হিসেবে ক্রিকেট হুমকির মুখে পড়ে যাবে। কারণ, জাতীয় দলের হয়ে খেলার কারণেই ক্রিকেটারদের স্টারডম তৈরি হয়, তাদের দর বাড়ে-কমে, ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে যতই সেঞ্চুরি করুক- ৫ উইকেট পাক, সেটা সাধারণ ক্রিকেটদর্শকের কাছে বিশেষ অর্থবহ হবে না। সাধারণ ক্রিকেট দর্শকই তো বেনিয়াদের বিনিয়োগের মূল টার্গেট পয়েন্ট, তারাই যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর সরে যেতে ১দিনও সময় লাগবে না। তাই ক্রিকেটক্রেজ মাল্টিপ্লাই করতে দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুজাতিক টুর্নামেন্টই হতে পারে কার্যকরী সঞ্জিবনী রসায়ন।