উপমহাদেশীয় সিনেমাগুলোতে (বাংলা, হিন্দি, তামিল-তেলেগু, মারাঠি, পাকিস্তানী) নায়কের পেশা সবচাইতে বেশিসংখ্যক ক্ষেত্রে কী হয়? গভীর ভাবনা ছাড়াই বলে দেয়া সম্ভব- ‘পুলিশ’। সিনেমা আমাদের ইন্টারনাল ফ্যান্টাসির বিবর্ধিত প্রকাশ। নায়কের কাছে আমরা এক ইউটোপিয়ান পৃথিবী প্রত্যাশা করি যে সকল অন্যায়, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, নিজে রক্তাক্ত হবে, এবং দুষ্টকে দমন করবে। নায়কের মধ্যে বিরাজ করে এক বিরাট শক্তিমান পুরুষ; নায়িকার সাথে প্রেম-রোমান্স যা-ই করুক, নায়ক তখনই নায়ক হয়ে উঠে যখন সে ভিলেনকে শায়েস্তা করে, জেলে পুরে রাখে। আমাদের অবদমিত এবং নিষ্পেশিত মন ক্রমাগত সুবিচার আশা করে, কিন্তু কোথাও না পেয়ে শেষপর্যন্ত ৩ ঘণ্টার সিনেমার মধ্যে একটা জায়গা খুঁজে পায় যেখানে দুষ্টের দমন হয়। যে সিনেমায় নায়ক পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করে না, সেখানেও শেষ দৃশ্যে পুলিশ এসে অপরাধীকে ধরে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, আমাদের সাবকনশাস মাইন্ডেও শাস্তির এবং শান্তির প্রতীক পুলিশ। মেজরিটি পপুলেশন সাইকোলজি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত ‘ভিকটিম’ ভাবা আমাদের সমণ্বিত মন অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে সুপারম্যানের হস্তক্ষেপ আশা করে; কিন্তু বাস্তবতা রূপালী পর্দার মতো ৩ ঘণ্টার নয়, ৩০০ বছরের মতোই অন্তহীন। ফলে বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে ব্যালান্স করতে হিমশিম খেতে হয়, এবং সেটাই ফ্যান্টাসি হয়ে দাবাং, সিংহাম এর ধুন্ধুমার কাটতি বাড়ায়।

বাস্তবচিত্রে ফেরত আসা যাক। একটা বাচ্চার বাবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, কিংবা অন্য কোনো পেশাজীবী হোক, সেই বাচ্চাকে খুব বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না সচরাচর। কিন্তু পুলিশের ছেলে-মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই বাবার গুণকীর্তন করতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে- ‘আমার বাবা ঘুষ খায় না, নামায কালাম পড়ে, মিথ্যা কথা বলে না’। বাবার চরিত্রে সনদ দেয়ার এই কাজটা কোনো বাচ্চারই ভালো লাগার কথা নয়, তবু বাধ্য হয়েই কাজটা করতে হয়, কারণ আশপাশের অগণিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রতিনিয়ত তাকে বা তাদের অনুসরণ করে, যেজন্য ক্ল্যারিফিকেশনটা না দিলে তাকে মানিয়ে চলতে চরম বেগ পেতে হয়। রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানী ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনলে সেটা খুব বড় ঘটনা হয় না, কিন্তু একজন পুলিশ সদস্যের ছেলে বা মেয়ে যদি এক্সপেনসিভ স্কুলে পড়ে, কমন একটা কথা জোরেশোরে শোনা যায়- ‘ওর বাবা যে টাকা বেতন পায়, এই স্কুলের বেতনই তো দিতে পারার কথা না। এই টাকা কোত্থেকে আসে সবই বুঝি’।

পুলিশ দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত এক ক্রোড়পত্রে দেখলাম, বাংলাদেশে পুলিশের সংখ্যা ১৯৪৭১৩ জন, এটাকে রাউন্ড ফিগারে লিখলে দাঁড়ায় ২ লাখ। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে ২ লাখ পুলিশের চাকরিতে নিয়োজিত। তারাই কি তাহলে যাবতীয় দুর্নীতির মূলে? তাহলে, সর্বস্বীকৃত ঘুষখোর বলতেই পুলিশ পেশাটি চলে আসে কেন? গ্যাপটা কোথায়?

ক্রিমিনাল সাইকোলজি বিষয়ে পড়াশোনাসূত্রে কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করা সহজ। একজন সাধারণ মানুষ আর ক্রিমিনালের ব্রেইনের ফাংশন পুরোপুরি আলাদা। প্রথমবার ক্রাইম করলে প্রচণ্ড অনুশোচনা হয়, পরেরবার কিছুটা কম, ৩য় বার থেকে অভ্যস্ততা গড়ে উঠে। ক্রিমিনাল আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলবে, নির্দ্বিধায় আপনার বুকে গুলি চালিয়ে দেবে, অথচ কোনোরকম অনুশোচনা কাজ করবে না। তার কাছে এটাকেও রুটিনওয়ার্কের মতো মনে হবে। হেরোইনের নেশার মতো ক্রাইমও এক পর্যায়ে নেশা হয়ে উঠে। ক্রাইম করতে না পারলে অস্বস্তি হয়। একজন জাত ক্রিমিনালের সাথে ৩ মাস নিয়মিত ওঠা-বসা করলে তার বেশ কিছু পারসোনালিটি বৈশিষ্ট্য অপরের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে, এবং ক্রিমিনাল মাইন্ডের একটা প্রধান অসুবিধা হলো- সে তার সাথে ইন্টারেকশন হওয়া মানুষকেও শিকার ভাবতে চায়, এবং তাকেও ক্রিমিনাল ভাবে। ক্রিমিনালের মনে পৃথিবীর প্রতি কেবলই ঘৃণা, অভিযোগ বিরাজ করে। কারণ, ক্রিমিনাল জন্মগত নয়, পরিপার্শ্বের বিবিধ ফ্যাক্টরের সমণ্বয়ে একজন ক্রিমিনালের জন্ম হয়, এবং সামাজিক অবক্ষয়কে দীর্ঘায়িত করে।

আপনি আপনার জীবনে কতজন ক্রিমিনালের সাথে ১ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন? খুব সূক্ষ্মভাবে হিসাব করেও সংখ্যাটা ১০ এর বেশি উঠাতে হিমশিম খাবেন। হয়তো, ২-৩ জন ক্রিমিনালের সাথে ১০-২০ মিনিট কথা বলেছে, এটাই অনেকের সারা জীবনের গল্পের টপিক হয়ে থাকে। একজন খুনী, একজন ধর্ষক, একজন ডাকাত, একজন এসিড নিক্ষেপকারী, একজন প্রতারক- কত প্রকার ক্রিমিনাল হতে পারে ধারণা করাই মুশকিল; কারণ ক্রিমিনালের রকমফের করা সত্যিই কঠিন।

এবার একজন পুলিশের জীবনচক্র পর্যালোচনা করা যাক। যদি প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা ডিউটি ধরা হয়, এবং গড়ে ৪০ জন মানুষের সাথে যদি তার ইন্টারেকশন হয়, সেখানে সাধারণ মানুষের সংখ্যা কোনোভাবেই ১০ এর বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ, একজন পুলিশ সদস্যকে প্রতি মুহূর্তে চলাচল করতে হয় সমাজের যাবতীয় ক্রিমিনাল প্রকৃতির মানুষের সাথে। সে একজন খুনীর সাথে সময় কাটায়, ছিনতাইকারীর সাথে সময় কাটায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই চক্র চলতে থাকে। একজন পুলিশ সদস্য সারা বছরে কয়জন নিষ্কলুশ মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পায়? কিংবা, কেউ যখন থানায় যায়, সে কি ভালো কোনো কারণে সেখানে যায়? জীবনের মূল্যবান সময়ের প্রায় সিকিভাগ যে ব্যক্তি ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ক্রিমিনালের পেছনে ব্যয় করে ফেলে, সেই মানুষটি যদি সবকিছুর মধ্যে ‘কিন্তু’ আবিষ্কার করে, প্রত্যেক মানুষকে সন্দেহ করে, তার পক্ষে সেটা করাই তো সঙ্গত। আমরা জীবনে কতজন মানুষ একজন পুলিশকে শুধুমাত্র ধন্যবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে থানায় গিয়েছি, বা ট্রাফিক পুলিশের সাথে কৃতজ্ঞতাসূচক হ্যান্ডশেক করেছি? এই প্রশ্নকে হুমায়ুন আহমেদের নাটকের স্ক্রিপ্ট মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট।

পুলিশ সদস্যরা কঠোরভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের ইমোশনাল বিহেভিয়ারকে বেসামরিক মানুষের সাথে মেলাতে চাওয়া সুচিন্তার লক্ষণ হবে না। তারা মানুষকে জেরা কীভাবে করতে হয়, মানুষের ভেতর থেকে কথা বের করতে হয় সবই জানে; কিন্তু দিনশেষে তারা তো অবশ্যই সামাজিক মানুষ। তাদের মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান আছে, যেমনটা থাকে অন্য সবার। ডাক্তার বা দোকানদার যেমন একটা পেশা, পুলিশও তা-ই। শুধুমাত্র প্রশিক্ষণের ঢাল দিয়ে তাদের কগনিটিভ বিহেভিয়ারকে আলোচনার বাইরে ঠেলে দেয়া উচিত হবে না। পুলিশের দিন-রাত কাটে যেহেতু ক্রিমিনাল পরিবেষ্টিত হয়ে, তার প্রভাব কিছুটা হলেও যদি তাদের ব্যক্তিত্বে পড়ে, একে দূষণীয় বলার যৌক্তিকতা পাই না।

পুলিশের আরেকটা বৈশিষ্ট্য, তারা অস্ত্র বহন করে এবং যে কোনো মানুষকে সন্দেহজনক মনে হলে তল্লাশি চালাতে পারে। দুটোই খুব ভাইটাল। আমাদের বেসামরিক মানুষদের বড় অংশই জীবনে কখনো পিস্তল দেখেনি সামনাসামনি, হাতে নেয়া তো বহুদূর। তল্লাশী করে সন্দেহজনক লাগলে জেলে নিয়ে যাওয়ারও এখতিয়ার আছে। ফলে পুলিশের সাথে কথা বলতে গেলে বেসামরিক মানুষদের স্বরতন্ত্রী স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাঁপে, হার্টবিট বেড়ে যায়।

‘আর্মস’ এর ইমপ্যাক্ট বিষয়ে পড়াশোনা করলে দেখা যাবে, যে কোনো অস্ত্র মানুষের বিহেভিয়ার শতভাগ বদলে দেয়। সেই গুহাবাসী মানুষেরা যখন নিরস্ত্র ছিলো তখন সর্বদা পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হতো, কখন কোন্ হিংস্র জন্তু এসে খেয়ে ফেলে এই ভয়ে। তারপর তারা যখন অস্ত্র বানানো ও চালানো শিখলো, তাদের লাইফস্টাইল পুরো উল্টে গেলো। শিকার হবার চাইতে উল্টো পশু শিকার করার দিকে তাদের নজর পড়লো বেশি করে। বাড়িতে চোর এলে, আপনি যদি তাকে ধরতে যান সাথে করে বড় একটা লাঠি নিয়ে যান, খালি হাতে যাওয়ার সাহস পান না। পথে ছিনতাইকারী ধরলে আপনার জিনিস লুট হচ্ছে এই ভাবনা যতটা তাড়িত করে, তার চাইতে তার হাতে থাকা অস্ত্র আপনাকে বেশি সন্ত্রস্ত্র করে। আপনার সঙ্গে একটা অস্ত্র থাকা মানে আপনি সম্রাট আলেকজান্ডার, সবাই আপনার অধীনে। একটা ট্রিগার চাপলেই আপনার সামনের মানুষটি এফোড়-ওফোড় হয়ে যাবে। এরকম এক অস্ত্র যদি সাথে নিয়ে ঘোরেন, দম্ভ আর ডমিনেন্সের কন্টিনিউয়াস কনফ্লিক্ট আপনাকে নিবিষ্ট রাখবে। যে কারণে, পুলিশ সদস্যদের আচরণ যদি রুক্ষ এবং দাম্ভিকতাপূর্ণ হয়, ক্ষমতা আর আর্মস এর ইমপ্যাক্টটা বোঝার চেষ্টা করুন; ব্যবহারের রুটটা ধরতে সহজ হবে।

পুলিশকে বলা হয়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো বিয়ে বাড়ি বা ঈদের জামাতেও যদি পুলিশের ডিউটি পড়ে, সেখানে নিছক খাওয়া-দাওয়া বা নামায আদায় তার উদ্দেশ্য থাকে না; অন্যদের ওপর যাতে হামলা না হয় সেটা প্রোটেক্ট করার জন্যই তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সামাজিক কিংবা ধর্মীয়, উপলক্ষ্য যেটাই হোক, পুলিশের ভূমিকা অভিন্ন। প্রতিটি মানুষকে সে সন্দেহ করে, প্রত্যেকের মধ্যে লুকিয়ে আছে গুপ্ত ঘাতক- এরকম এক মাইন্ডসেট তার মধ্যে কাজ করে। তার লাইফস্টাইল এবং থট প্রসেস নিয়ে ভেবেছেন কখনো? মানুষকে অবিশ্বাস করার চাইতে যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি পৃথিবীতে কয়টা আছে? সেই নিষ্ঠুরতম অনুভূতি দিয়েই তার জীবন কেটে যায়। যে বন্ধুটি একসময় চরম হাসিখুশি ছিলো, আড্ডা মাতিয়ে রাখতো, পুলিশে যোগ দেয়ার পর সেই ছেলেটিরই স্বভাব-চরিত্র পুরোপুরি বদলে গেল; ভেবে আফসোস হয় না, অবাক লাগে না? ‘পাওয়ার অব হ্যাবিট’ নামে একটা বই পাওয়া যায়, সেখানে একটা ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ লিখেছেন লেখক। টানা ৩ সপ্তাহ কোনোকিছু প্র্যাকটিস করলে সেটা অভ্যাস বা স্বভাবের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পুলিশের লাইফস্টাইল তো ৩০০ সপ্তাহের বেশি; এবার স্বভাবের ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
বাংলাদেশ পুলিশের সাইট ঘাঁটতে গিয়ে একটা পরিসংখ্যান পেলাম। ২০১৩-২০১৫ এই ৩ বছরে ডিউটিতে থাকাকালে ৩৩৬ জন পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। ৩৩৬ জন পুলিশ মানে ৩৩৬টি আলাদা পরিবার। ব্যাংকে দায়িত্ব পালনের সময় ব্যাংকার মারা গেছেন, কিংবা রোগী দেখার সময় ডাক্তার মারা গেছেন, ক্লাস নেয়ার সময় শিক্ষকের মৃত্যু- এরকম সংবাদ ৫ বছরে ৫টাও বোধহয় আসেনি। পেশাগত কমিটমেন্টের এই চরম নিদর্শন সত্যিই কি ভেবে দেখেছি আমরা?

পুলিশের ঘুষ খাওয়া আর হয়রানির বহু গল্প আমরা শুনি, খবরের কাগজে পড়ি। যারা ভুক্তভোগী, তাদের ব্যথার কোনো প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়। যে কোনো পেশাতেই ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটে, তবু পুলিশের কথা বেশি করে আসে, কারণ একজন ঘুষখোর কর্মকর্তা আপনাকে থানা হাজতে আটকে রাখতে পারবে না, যেটা পুলিশ পারবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, যতটা ক্ষমতার কথা ভাবা হচ্ছে পুলিশের ক্ষমতার স্কোপ আদতে তার চাইতে অনেক কম। ধরা যাক, একজন নিরপরাধ মানুষকে আসামী করে থানায় নিয়ে আসা হলো, ছাড়াতে হলে ২ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে। কিন্তু ৫ মিনিটের মধ্যে যদি একজন এমপি বা ওয়ার্ড কমিশনার ফোন করে, আসামী ছাড়া পায় না এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি দেখানো সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধরে আনা হলো, মন্ত্রী বা এমপির ফোন; লক আপে ঢোকানোর আগেই সে খালাস।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? পুলিশ তাদের জন্যই ভয়ংকর যাদের শক্ত কোনো রেফারেন্স নেই। সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে; পুলিশ আজ্ঞাবাহী মাত্র। আগের দিনে রাজারা প্রাণদণ্ড দিতো, একজনকেও কি রাজা নিজ হাতে হত্যা করেছে? সেটা এক্সিকিউট করতো জল্লাদ বা ঘাতকরা। ইতিহাস কিন্তু জল্লাদকে মনে রাখেনি, হুকুমদাতা রাজাকেই মূল্যায়ন করেছে সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে। মিছিলে টিয়ার শেল মারতে হবে, লাঠিচার্জ করতে হবে, এটা কি পুলিশ খুব খুশি মনে করে? কিংবা, সিদ্ধান্তটা কি পুলিশের নিজের? সৈন্যের দায়িত্ব অর্ডার ফলো করা, তার নিজস্ব চিন্তার কোনো ভ্যালু নেই, স্কোপও নেই। অর্ডার হয়েছে টিয়ার শেল মারতে হবে, চেইন অব কমান্ড অনুসারে অবশ্যই মারবে, অন্যথায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সাসপেনশন। অথচ, মিডিয়াগুলোতে পুলিশের মারমুখী ভূমিকাগুলোই ফোকাস করা হয়; এটা ছাড়া করার আছে কী তা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা দেখা গেলো না। আমাদের গণজীবনে পুলিশ তাই এক ফ্রাঙ্কেইনস্টাইন হয়ে আছে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে পুলিশ বরাবরই ক্ষমতাশালীদের আজ্ঞাবাহীর ভূমিকা পালন করেছে; তাদের নিজস্ব কোনো চয়েজ কখনোই ছিলো না। আমার ছোট ভাই একটা চমৎকার উদাহরণ দেয়; তাজমহল বানিয়েছে ২২ হাজার শ্রমিক, সেই কথা কারো মনে নেই; শাহজাহান টাকা দিয়েছে, আদেশ দিয়েছে; সুতরাং শাহজাহানই তাজমহলের কীর্তিমান। খুবই ভ্যালিড পয়েন্ট। সমাজের সর্বস্তরেই এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়; কেবল পুলিশের বেলায়ই সকল লাঠিচার্জ, টিয়ালশেলের দায়ভার তাদের নিজস্ব হয়ে যায়।

ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে পারে, যে রাস্তায় রিকশা চলা নিষেধ পুলিশকে ৫টাকা দিলে সেখানেও রিকশা চলে, হকার পুলিশকে টাকা দিলে সেও ব্যবসা করতে পারে। পুলিশের ঘুষ খাওয়ার উদাহরণ আরও অজস্র। ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিক যতটা ক্ষমতাশালী, পুলিশ সেই গাড়ি আটকে রাখতে পারবে কতক্ষণ? হয় ঘুষ নাও, অথবা গাড়ি ছাড়ো। অপশন যেখানে দুটো, অন্য কিছু করার কি আছে। যে রাস্তায় রিকশা চলা নিষেধ, সেখানে রিকশা চালানোর দরকার কী? এই প্রশ্ন মাথায় আসে কম, পুলিশের ৫টাকা নেয়াটা বেশি করে চিন্তায় আসে।

বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরই দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই দুর্নীতিযুক্ত। বইমেলার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়; কতজন লম্বা লাইনে ঢুকেন? এরকম সূক্ষ্ম লেভেলে আমাদের দুর্নীতি বোধ ঢুকে পড়েছে। আমাদের এথিক্স সেন্স কাজ করে না। ৫ টাকা বাস ভাড়া বাঁচানোর জন্য স্টুডেন্ট ভাড়া দেয়া নিয়ে গোলমাল বাঁধাই, এবং চাকরি পাওয়ার জন্য নির্বিচারে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে দিই। দুর্নীতির এক লম্বা শিকল লকলক করে বাড়তে থাকে, যার আসলে সুনির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ আর পুলিশের অনুপাত হওয়া উচিত ৪০০:১; আমাদের দেশে এই অনুপাত ৮২২:১। এই চিত্র থেকেই বোঝা যায়, পুলিশের অপ্রতুলতা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যার ঘনত্বের সাথে অপরাধের সরাসরি সম্পর্ক আবিষ্কৃত। এর মধ্যে সারভাইভিং ফ্যাক্টর জড়িত। যেখানে ৫ জন মানুষ থাকার কথা, সেখানে যদি ৫০ জন থাকে, আনুপাতিক হারে খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান হবে না, কর্মসংস্থান হবে না; টিকে থাকার এক অবর্ণনীয় প্রতিযোগিতায় সেখানকার মানুষ লিপ্ত হবে, এবং একে অপরকে প্রতিপক্ষ গণ্য করবে। যে কোনো ক্রাইমের সূচনাবিন্দু অভাব এবং লালসা। ঘনবসতিতে এই দুটো ফ্যাক্টর চিরাচরিত। সুতরাং এখানে ক্রাইমের ডাইমেনশন এবং ফ্রিকোয়েন্সি দুটোই ব্যাপক হবে। এর সঙ্গে যোগ করুন ভৌগলিক ও জলবায়ুক্রান্ত কারণে প্রাপ্ত আমাদের আরামপ্রিয়তা আর শ্রমবিমুখ মানসিকতা। আমরা কেবল শর্টকাটে মহান হতে চাই, ভোগবিলাস করতে চাই, কিন্তু সেই অনুপাতে যথেষ্ট শ্রম দিতে আমাদের আগ্রহ নেই। একারণে আমাদের দেশে শেয়ার বিজনেসে ধস নামে, এমএলএম বিজনেস করে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়, হায় হায় কোম্পানীর প্রাদুর্ভাব ঘটে, পীর ব্যবসার সাফল্য চরমে পৌঁছে যায়। প্যাটার্নটা খেয়াল করলেই আমাদের গড় চরিত্র ধরতে পারা যায়। আমাদের এখানকার ক্রাইমের সবচাইতে বড় অংশ ধোঁকাবাজি আর প্রতারণা। ঘনবসতির সাথে এটা গভীরভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।

পুলিশ ক্ষমতার একটা সাব-লেয়ারে অবস্থান করে। সাধারণ মানুষের দৌড় যেহেতু মন্ত্রী, এমপি বা ধনী ব্যবসায়ী পর্যন্ত পৌঁছায় না, সে মধ্যস্বত্বভোগী পুলিশকেই বিরাট হাঙর গণ্য করে তাকে দেখে তটস্থ থাকে। অথচ, এইসকল অনাচারে পুলিশের ভূমিকা দাবার সামান্য এক ঘুঁটির চাইতে একটুও বেশি নয়।

মিডিয়াতে পুলিশের এরকম বিকট নেগেটিভ উপস্থিতির কারণ কী? সাধারণ মানুষ পুলিশকে ভয় পায় এবং পুলিশি হয়রানির নানা গল্প শুনে আতঙ্কে থাকে। সোলাকিয়া ঈদের জামাতে জঙ্গিদের সাথে যুদ্ধে পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে, এই ঘটনা মিডিয়াগুলোতে কতো বড় আকারে এসেছে, বিপরীতে পুলিশের ওসি ব্যাংকের কর্মকর্তাকে নির্যাতন করেছে, এটা নিয়ে কী পরিমাণ লেখালিখি হয়েছে? স্রেফ এই দুটো সংবাদ নিয়ে মেথডোলজিকাল এনালাইসিস করলেই বোঝা যাবে, পুলিশের এই খারাপ ভাবমূর্তির উৎস কোথায়! অথচ, এপ্রিশিয়েশন পেলে হয়তোবা আরও ১০-১৫ জন পুলিশ ভালো কাজে উৎসাহিত হতো। বরং পুলিশ মানেই তো খারাপ, ভালো কাজ করে কী হবে- এরকম হতাশাবোধ যদি পুলিশ সদস্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই বেশি সম্ভাব্য পরিণতি মনে হয়। রাস্তা পার হতে প্রতিদিন কতজন মানুষকে পুলিশ সহায়তা করে, এ নিয়ে কোনো লেখা কোথাও কি ছাপা হয়েছে? ২ লাখ পুলিশের মধ্যে ২০ হাজার পুলিশ যদি অমানবিক পর্যায়ের আচরণ করে থাকে, তাতে কি বাকি ৯০% এর এচিভমেন্ট খর্ব হয়ে যাবে? বাংলাদেশের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেক্টর কোনগুলো এ নিয়ে টিআইবি বা অন্যান্য বিদেশী সংস্থাগুলোর রিপোর্ট ঘাঁটাঘাঁটি করুন, সেখানে পুলিশের আগেও অনেকগুলো সেক্টর আছে, কিন্তু মজার বিষয় হলো, সেগুলো নিয়ে আমরা উচ্চকণ্ঠ নই; সব দোষ ঘুরেফিরে ওই পুলিশের; আদর করে আমরা যাদের নাম দিয়েছি ‘ঠোলা’!

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বাস করে অপরাধপ্রবণ মন। ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অপরাধের সংখ্যা আরও বেশি। পুলিশও সেই দোষে দোষী; পুরো সিস্টেমই যেখানে জরাগ্রস্ত, আলাদা করে একটি সুনির্দিষ্ট পেশাজীবী গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তোলাটা হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ। যে লোকের দুর্নীতি করার সুযোগই তেমন নেই, তার সততা খুব বেশি প্রশংসিত হওয়া উচিত নয়, প্রকারান্তরে অসৎ হওয়ার সবরকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে সৎ জীবনযাপন করে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে এপ্রিশিয়েট করি। একারণে সৎ কেরানি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না, কিন্তু একজন সৎ পুলিশ অথবা সৎ কাস্টমস অফিসার মানে বিশাল ব্যাপার।

বারট্রান্ড রাসেলের ‘ক্ষমতা’ বইটি পড়লে জানা যায়, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে কেমন হিংস্র আর ডেসপারেট করে তোলে। সেই ক্ষমতার উত্তাপ সহ্য করাটা কি দুর্বিষহ ব্যক্তির জন্য। ব্যক্তি বনাম ক্ষমতার সাইকোলজিকাল ওয়ারে ব্যক্তিসত্তা বরাবরই ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয়। সাধারণের মানসজগতে পুলিশ মহাক্ষমতাধর, বিশেষত পাসপোর্ট, সরকারি চাকরি সবখানে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগে। একজন পুলিশকে প্রতিনিয়ত তার ব্যক্তিসত্তা আর ক্ষমতা লিপ্সার মধ্যে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই লড়াইয়ে ব্যক্তিসত্তাকে সাপোর্ট করার মতো এলিমেন্ট আমরা দিতে পারি না, উপরন্তু চোর-ছ্যাঁচড় আর ক্রিমিনালদের সাহচর্য তাকে আরও ক্ষমতাফ্রিক করে তোলে।ক্ষমতার ছায়া ক্রমশই দীর্ঘায়ত হতে থাকে।

সিনেমার শেষ দৃশ্যে পুলিশ আসে আসামী ধরতে আর আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না সংলাপ বলতে। এই দৃশ্যটা খুবই সিম্বলিক। পুলিশের আসলেই কিছুই করার থাকে না ক্ষমতাবানদের লড়াইয়ে; আমরা জীবনভর দৃশ্যটা দেখি, কিন্তু তাদের অসহায়ত্বটা ধরতে পারি না। ঈদের সময় পরিবারের সাথে ঈদ করতে ছুটে যাই, পুলিশেরও একটা পরিবার আছে; তার ছুটি কোথায়. আনন্দ কোথায়? সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ যাত্রী আর ১ পুলিশ সদস্য নিহত। পুলিশদের নিয়ে এটাই বোধহয় নির্মমতম রসিকতা। কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী নয়, সে শুধুই পুলিশ!

পুলিশ বাহিনী নিজেদের ওয়েবসাইট চালু করেছে, ফেসবুক পেজ খুলেছে; তবু আমি মনে করি পুলিশ বাহিনীর ব্রান্ডিংয়ে আরও মনোনিবেশ করা উচিত। বিশেষ করে, বেসামরিক মানুষের সাথে পুলিশের দুরত্ব কীভাবে কমানো যায়, এই ইস্যুতে সিরিয়াসলি কাজ করা উচিত। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’, সিনেমায় বহুবার শোনা এই সংলাপকে বাস্তবায়ন করতে বেসামরিক আর পুলিশের মধ্যবর্তী মনস্তাত্ত্বিক দেয়ালটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে বোধহয়। দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজন নেই, তবে দেয়ালের উচ্চতা কিছুটা কমানো যেতেই পারে, যাতে অন্যপ্রান্ত থেকে দেখা যায় এপ্রান্তে কী ঘটছে।

‘ভেবে দেখেছো কি তারারা কত আলোকবর্ষ দূরে, তারও দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে’…………..ধন্যবাদ, পুলিশ বাহিনী।