উৎসর্গ উৎসব
বই উৎসর্গ করার রীতি কীভাবে চালু হয়েছিল জানা নেই, তবে একটা জিজ্ঞাসা প্রায়ই বিভ্রান্তিতে ভুগায়- একজন লেখক সর্বস্ব নিংড়ে একটি সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির পরে সেটি অন্য কাউকে অর্ঘ্য হিসেবে কেন অর্পণ করে। ‘উৎসর্গ’ লিখে গুগলে সার্চ দিলাম, উঠে এলো বিভিন্ন গোত্রের বিষয়াদি। তন্মধ্যে দুটো ফ্যাক্ট এই লেখায় সংকলতি করছি। বাকিগুলো আগ্রহীরা খুঁজে নিয়েন।
এক, প্রথম আলোর এক নিবন্ধে উৎসর্গ সম্বন্ধে একটি উদ্ধৃতি পেলাম যার প্রদায়ক গ্রিক রাজনীতিক অ্যারিস্টাইডিস এর- ‘উপাসনালয় উৎসর্গীত হয় দেবতার উদ্দেশে, আর বই উৎসর্গ করতে হয় মহান মানুষকে’। উদ্ধৃতির সমস্যা হলো মানুষ এমন এক বিটকেলে প্রাণী যার পক্ষে সর্বোত মহান বা নীচ হওয়া সম্ভব নয়, মানুষমাত্রই ‘ইন বিটুইন’!
দুই, হুমায়ূন আহমেদের ১০০ টি বইয়ের উৎসর্গপত্র পেলাম। হুমায়ূনের হিউমার লেভেল সম্বন্ধে ধারণা পেতে হলেও উৎসর্গপত্রগুলো মহামূল্যবান।
তারুণ্যে ভাবতাম কখনো বই প্রকাশিত হলে উৎসর্গ ঘরটা নিষ্কন্টক দান করে দিব- ‘প্রতিবার বইটিকে যারা স্পর্শ করবে অথবা দেখাবে পড়ার ঔদার্য, স্থান-কাল-পাত্র যেমনই হোক বইটি তার তরেই উৎসর্গীত হলো’।
কিন্তু
প্রথানুগামী অথবা প্রথাবিরোধী, সৃজনশীল অথবা বাজারি, ব্যতিক্রমী অথবা গতানুগতিক— লেখক যেমনই হোক, উৎসর্গ রীতিকে প্রত্যাখ্যান করে কদাচিৎ; কেন করে না, নিশ্চয়ই এর অন্তর্হিত তাৎপর্য রয়েছে, যদিও তা আবিষ্কারে ব্যর্থ এখনো অবধি।
সম্ভবত সেই অস্পষ্টতা থেকেই উৎসর্গ সংক্রান্ত ভাবনাগুলো স্তিমিত হয়ে পড়ে বই লেখাকালীন।
প্রথম দুটো বই— প্রযত্নে-হন্তা এবং মিলান কুন্ডেরা রচিত আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং এর বঙ্গানুবাদ— এর ক্ষেত্রে উৎসর্গ তাই গতানুগতিকতারই ধারক।
বোধের উন্মেষ ঘটে ৩য় বই বীক্ষণ প্রান্ত রচনাকালে। বোধ করতে থাকি, একটি বই রচনাকালে অসংখ্য মানুষকে মনে পড়ে, আন্তঃক্রিয়া ঘটে কতজনের সঙ্গে, কিন্তু একজন সুনির্দিষ্ট মানুষকে স্মরণ করে বই লিখতে বসলে ভাবনা কেন্দ্রীভূত করা সহজতর হয়৷ আমার ব্যক্তিজীবনে সেই মানুষটির মূল্য মানও নিরূপিত হয়ে যায়। বোধ জাগে অন্তত ওই মানুষটির জন্য হলেও বইটা শেষ করতে হবে, এবং যাকে উৎসর্গ করছি, আমার বাইরে কেউ কি কোনোদিন তাকে বই বা যে কোনো সৃষ্টিকর্ম উৎসর্গ করবে? কারো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটতেও পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার বইটাই তার জীবনের একমাত্র উৎসর্গলিপি৷
এবং
আমার ক্ষেত্রে উৎসর্গই বই লেখার মূল সঞ্জীবনী। যতক্ষণ পর্যন্ত স্থির না করি কে পাচ্ছে উৎসর্গনামা, লেখা হয় না একটি শব্দও; এতোটাই কঠোর বিধিনিষেধ!
প্রতিটি উৎসর্গই রূপ পায় স্বতন্ত্র ইতিহাস কিংবা ইশতেহারে। যেমন বীক্ষণ প্রান্ত বইয়ের উৎসর্গলিপিতে বড়ো আপাকে বিদ্রুপ করে এক জায়গায় লিখেছিলাম তার রান্নাকৃত ডিমের কোর্মা আদতে ডিমের পায়েস হয়ে যায়; এই গল্পটা অন্তত ৩০ জন পাঠকের ফিডব্যাকে স্থান পেয়েছে। ৪র্থ বই বেনিফিট অব ডাউট এ আরিফাকে নিয়ে যা লিখেছিলাম বইয়ের কনটেন্ট দুর্বল হওয়ায় নিজেও হয়ত মনে রাখিনি কী লিখেছি।
নামহীন বইয়ের যেমন নাম নেই, লেখকের নাম অনুপস্থিত, বিনা সম্পাদনায় প্রকাশ করেছি, অনুরূপ উৎসর্গ বলতেও আলাদাভাবে স্পেস রাখা হয়নি। ভার্সিটি জীবনে একপাক্ষিক প্রণয়বায়ু বয়ে গিয়েছিল, যার রেশ হয়নি শেষ। ৫ম বইটি আদতে সেই রেশকে স্থায়ীভাবে ট্রিবিউট জানানো তথা অব্যাহতি প্রদানের অভিলাষ। বইয়ের সর্বশেষ চ্যাপ্টারের অন্তিম পৃষ্ঠায় ৪ লাইনের ননসেন্স রাইমের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশিত
জিরো ডিগ্রিতে বরফ গলে না
বৃষ্টি প্রচুর, রিকশা চলে না
বই চাইলে মন দিলে না
মুভি দেখছি, নাম ম্যালেনা
হিউম্যানল্যাব এবং মৌনতা ক্লাব এর উৎসর্গ অনেক বেশি আবরণমিশ্রিত হওয়ায় এর মর্মোদ্ধার করাটা দুষ্কর বটে। সে তুলনায় ঘোরবন্দী গোল্ডফিশ এবং রঙপ্যাথি এর উৎসর্গকে স্বতন্ত্র অনুগল্প বলে চালিয়ে দেয়া যাবে অবলীলায়। চিন্তা এক্সপ্রেস আর ব্যাসার্ধগ্রাফির উৎসর্গে আড়াল কম উপকরণ বেশি; তবু তার মধ্যেও স্মৃতির খাম গুঁজে দেয়া হয় ঠিকই।
কাকে উৎসর্গ করব, নির্বাচনের অধিকার নিজের কাছে থাকলে রুমেল এবং আম্মু এতদিনে তালিকায় ঢুকে পড়ত, বন্ধু আরমানও। কিন্তু বই নিয়ে ভাবাকালীনও জানা থাকে না কে হতে যাচ্ছে সেই আরাধ্য মানুষটি যাকে আশ্রয় করে লিখতে পারি নতুন একটি বই!
যখনই কারো সাথে আড্ডা বা আলাপ হয় মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপ করতে থাকি, ইনি কি হওয়ার যোগ্য বইয়ের ক্যারেক্টার অথবা উৎসর্গপত্র রচিত হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, যাদের ঘিরে মনে হয়েছে বইয়ের ক্যারেক্টার হওয়া উচিত, নিদেনপক্ষে উৎসর্গীত হতে পারে বই, ৯০% ক্ষেত্রেই তাদের নিয়ে কাজ করা হয়নি, বরং তারাই স্থান পায় যাদের সাথে আন্তঃক্রিয়া অতি সামান্য। কারো সাথে মানসিকতার ফ্রিকুয়েন্সি মিলে গেলে সঙ্গোপনে তার তরে একটি প্রতিশ্রুতি বা কমিটমেন্ট তৈরি করে নিই, মূলত প্রতিশ্রুতিরক্ষার খেলা হিসেবেই পরিচালিত হয় কর্মযজ্ঞ।
মৃত্যুর পূর্বে লিখতে চাই ৩৭টি বই। প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী আলাদা, উৎসর্গ প্রাপকও; যদি লক্ষ্য পূরণ হয় লেখালিখিসূত্রে ৭৪ জনকে কানেক্ট করা হবে; আমার পছন্দ ৭৯ জন; ওই ৫টি শূন্যস্থান ফিল্মের স্ক্রিপ্ট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে অধিকতর আনন্দিত হব।
গত পরশু এক অনুরাগীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তার প্রশ্ন ছিল- আপনি যে বিভিন্ন বাস্তব নারীকে বইয়ের ক্যারেক্টার বানান তারা মাইন্ড করে না বা প্রাইভেসি লংঘনের অভিযোগ তুলে না? উত্তরে বলি- ‘পৃথিবীতে পাপড়ি বা লুবনা নামে ১ লক্ষ মানুষ আছে, আমি কি সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিচ্ছি চরিত্র তৈরি হচ্ছে কার কল্পনায়। তোমার কি ধারণা কেবলমাত্র ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত মানুষেরাই বই পড়ে আমার? বরং অপরিচিতরাই পাঠক তালিকা সমৃদ্ধ করে। মাইন্ডের প্রসঙ্গে যদি বলি- তাকে ঘিরে কেউ কখনো বই লিখবে এটা প্রায় প্রত্যেক মানুষই পছন্দ করে। তাই যাদের ক্যারেক্টার বানানো হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুশিই হয়, যারা মাইন্ড তারা আমাকে জীবনের তরে ডিলিট করে দেয়; শিফট-ডিলিট জিনিসটা খারাপ না তো। স্পেসের পরিমাণ নির্দিষ্ট, ডিলিট না করলে স্পেস ফুরিয়ে যাবে, এভাবেও ভাবতে পারো; শেষ পর্যন্ত আমার যাবতীয় আচরণযজ্ঞ লেখার কনটেন্টের প্রয়োজনেই। বই বিক্রি না হলেও চূড়ান্ত মূল্যায়নে তুমি আমাকে লেখক হিসেবেই রায় দিতে বাধ্য’।
প্রায় ১৫-২০ জন মানুষ নির্বাচন করে রেখেছি যাদের একটা বই উৎসর্গ করা উচিত। যখন লিখতে বসবো, দেখা যাবে তাদের ডাক আর আসছে না, ঢুকে পড়ছে লিস্টবহির্ভূত মানুষেরা। এই যে একটা বড়ো সংখ্যক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েও ইয়েস কার্ডটি পাবে না এটাই বোধহয় লেখক হিসেবে অতৃপ্তি বা অপূর্ণতা বোধ, সর্বক্ষণ ভাববো এদের জন্য হলেও আরো বই লেখা উচিত, কিন্তু ক্ষণিকের অতিথিশালায় অপরিমিত সময়ের বন্টন জুটবে না কপালে।
এবং
এই সময়জনিত দুষ্প্রাপ্যতাই উৎসর্গলিপিগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার ইন্ধন দিয়ে চলে। ইন্ধন তো ঋণাত্মক ভাব প্রকাশক, উৎসর্গের সঙ্গে এর সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব? প্যারাডক্স না থাকলে কিসের লেখালিখি, এর চাইতে মুশফিকুর রহিমের উইকেট কিপিং নিয়ে মন্তব্য করা অনেকখানি নিরাপদ!