এগারো সংখ্যার তাৎপর্যটাই এই, শুনলেই অনুমান করা যায় ক্রিকেট বা ফুটবল সংক্রান্ত কোনো আলোচনা। বার্সা-রিয়াল নিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে উন্মাদনা থাকলেও দেশী ফুটবল জৌলুস হারিয়েছে অন্তত ২ দশক আগে। যেকারণে লেখকের নাম যদি উৎপল শুভ্র আর বইয়ের নাম এগারো হয়, প্রায় অবধারিতভাবেই সেটা ক্রিকেটের আসরই হবে। স্পোর্টস জার্নালিজম শব্দটা যতটা ব্যাপকতা ধারণ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা অনেকখানিই ক্রিকেট-জার্নালিজম, অল্পবিস্তর অন্যান্য খেলা।

এগারো বইটা আসলে কী নিয়ে?
১৯৮৬-২০০৭ এই সময়সীমায় বাংলাদেশের হয়ে যতজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিচরণ করেছেন, তাদের মধ্য থেকে ১১ জনকে বাছাই করেছেন সাংবাদিক উৎপল শুভ্র। এই ২২ বছরের মধ্যে অন্তত ৪টি পৃথক ব্যাচের ক্রিকেটার সময়ের নিয়মে আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। তবে সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন ধ্রুবকের মতো।

একজন খেলোয়াড় ২টি পৃথিবীতে বসবাস করে। সীমানাঘেরা মাঠের মধ্যে প্রবেশ করে সে এক পৃথিবী পায় যা সমগ্র পৃথিবীর তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র, অন্যটা সৌরজগেতর পৃথিবী নামক গ্রহ যেখানে সকল মানুষের বসবাস। ক্ষুদ্র পৃথিবীর কার্যকলাপ দিয়েই বৃহত্তর পৃথিবীর মানুষেরা তাদের চেনে-জানে এবং মূল্যায়ন করে। কিন্তু একজন খেলোয়াড় কতটা সময় সীমানাঘেরা পৃথিবীতে থাকে, বৃহত্তর পৃথিবীতেই তো তার সময় কাটে, যেখানে সে যে কোনো মানুষ। টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা স্টেডিয়ামে বসে আমরা খেলোয়াড়দের ব্যক্তিসত্তার যে ঝলকটুকু দেখি, পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিসত্তাটি আসলে কেমন এবং কেন, মূলত সেই সিনেমাটোগ্রাফিটুকুই সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রায়ণের প্রয়াস এগারো নামের নন-ফিকশন বইটি।

তবে চাইলে একে উৎপল শুভ্রর পরিমার্জিত ডায়েরিও বলা যেতে পারে। এগারো জন ক্রিকেটারের সাথে ঘটে যাওয়া তার এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন, এবং কিছু জায়গায় কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

১১জন নির্বাচনের ভিত্তিটা খুবই সরল। তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠতার ক্রমানুসারে যে ১১ জন শীর্ষে আছেন তারাই স্থান পেয়েছেন এই বইতে। শুরুতেই উল্লেখ করেছি তাতে ৪টি পৃথক ব্যাচের খেলোয়াড় রয়েছে। ব্যাচ১ (নান্নু, আকরাম, বুলবুল), ব্যাচ২(পাইলট, রফিক, সুমন), ব্যাচ৩ (আশরাফুল, মাশরাফি), ব্যাচ৪(মুশফিক, সাকিব, তামিম)। টিকিট কেটে তিনি যদি মাত্র একজন বাংলাদেশীর খেলা দেখতে চান সে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ. তবু এগারোতে স্থান হয়নি ঘনিষ্ঠতায় পিছিয়ে থাকাহেতুতেই (লেখকের সরল স্বীকারোক্তি)।

৮৬ সালে নান্নুর অভিষেক দিয়ে যে ঘনিষ্ঠতাচক্রের শুরু ২০০৭ এ অভিষিক্ত তামিম ইকবালের মধ্য দিয়ে তার ১১ এর কোটা পূর্ণ হয়েছে।এরপরও আরো বেশ কয়েকটা ব্যাচের খেলোয়াড় দলে এসেছে। যেমন এনামুল বিজয়-নাসির-সাব্বির-সৌম্য-লিটন, এবং মিরাজ-মুস্তাফিজ। এই ব্যাচের কেউ স্থান না পাওয়ার কারণটা যদি ক্রিকেটীয় হয় (খুবই অধারাবাহিক, এখনো দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে, ক্যারিয়ারে বলার মতো কিছুই করতে পারেনি, কিংবা দর্শকপ্রিয়তায় পিছিয়ে) সেই ব্যাখ্যা খুবই গ্রহণযোগ্য, কিন্তু লেখক নিজেই যেহেতু বলেছেন ঘনিষ্ঠতাই মূল সূচক, সেক্ষেত্রে পরের ব্যাচের খেলোয়াড়দের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে না উঠার কারণ কী হতে পারে?
তারা কেউ উৎপল শুভ্রর মনে রেখাপাত করতে পারেনি, আশরাফুলের ঘটনার পর নতুন কারো ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সতর্ক হয়ে পড়েছেন, নাকি ত্রিশ বছর সাংবাদিকতা করবার পর হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন বয়স হয়ে গেছে?
যদিও ২০০৭ পরবর্তী ব্যাচের কারো ঘনিষ্ঠতা ক্রমে স্থান না পাওয়াতে বইয়ের কনটেন্ট মেরিটের শ্রীহানি ঘটেনি একচুল পরিমাণেও, তবু উৎপল শুভ্রকে যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাক্ষ্মী তরু হিসেবে দেখতে চাই, সেই জায়গার ভিত্তি একটু নড়বড়ে হয়ে যায়। এখন চলছে ২০১৯, অর্থাৎ একযুগ পেরিয়ে গেছে; এই সময়ের মধ্যে দলে আসা সৌম্য সরকারের ক্যারিয়ার ৫ বছর হয়ে এলো, নাসির বা এনামুল হক বিজয়ের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে আরো আগে, তাদের বয়স ৭ পেরিয়ে গেছে; সাকিব বা তামিমের রূপান্তর কিংবা ধারাবাহিকতা যেমন বড়ো গল্প, অনুরূপভাবে বিজয়-সৌম্যের অধারাবাহিকতা কিংবা নাসির-সাব্বিরের উশৃঙ্খলতা এগুলোও গল্প হওয়ার যোগ্যতা রাখে, কিংবা লিটন বা মোসাদ্দেককে নিয়ে যতো আশা করে মানুষ,ক্রিকেটের মঞ্চে তার ছিঁটেফোটাও কেন দেখা গেলো না এসবও তো আলোচনার দাবি রাখে।

তবে কি তিনি সেইফ-সাইডে থাকতে চেয়েছেন, নাকি এগুলোকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি? সাক্ষ্মী তরু হতে গিয়েও এক যুগের বিচ্ছিন্নতা একটা নির্দেশকও বটে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আইকন হওয়ার মতো কি তবে কেউ নেই? পারফরম্যান্সই কি শেষ পর্যন্ত একমাত্র এবং কেবলমাত্র নির্ধারক হয়ে রইলো ঘনিষ্ঠতার?

এক্সপোজার মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। ক্রমাগত মাশরাফি আর সাকিবের ইন্টারভিউ করাটা তেলা মাথায় তেল দেয়ার মতোই ব্যাপার। কিন্তু সৌম্য সরকারের দীর্ঘ এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেয়া হলো, কিংবা মোহাম্মদ মিথুনকে এক্সপোজার দেয়া হলো, এগুলো টনিক হিসেবে কাজ করে। মানুষের সাইকোলজিই এমন সে অবিরাম এক্সপোজার চায়। ক্রিকেটার-দর্শকের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হবে তো পত্রিকা অথবা টেলিভিশনের মাধ্যমেই।

উল্টো পঞ্চপাণ্ডব থিওরি উদ্ভাবন করে দলের মধ্যে এক সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। মিরাজ, মুস্তাফিজ বা রুবেল কি এক্সপোজার পাওয়ার মতো কিছুই করেনি? কিন্তু সেই অনুপাতে তাদের এক্সপোজার হয়েছে কি? স্পোর্টস এমন এক শক্তিশালী বিনোদন যা নাটক বা সিনেমার চাইতেও আসক্তির তীব্রতা বেশি রাখে, এবং সরাসরি জাতীয়তাবাদের সাথে সম্পর্কিত। পঞ্চপাণ্ডবের বিদায়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেট কোন্ মহাসমুদ্রে নিপতিত হবে সেই শংকায় দর্শকমহল আক্রান্ত; এর উৎসও কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্লেয়ারকেন্দ্রিক এক্সপোজার। এটা কি আদৌ খুব সুন্দর-সুষ্ঠু চর্চা হচ্ছে?

মানুষ কি কখনো এন্টিক হতে পারে? যদি হয় তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে উৎপল শুভ্রকে সেই এন্টিক বলা যায় নিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশ যখন আইসিসি ট্রফিতে পর্যুদস্ত হতো কিংবা এখন যেমন বড়ো দলকে প্রায় নিয়মিতই হারায় ওয়ানডেতে, সমগ্র জার্নিতেই একজন উৎপল শুভ্র ছিলেন সফরসঙ্গী হিসেবে। আমরা যদি একটু ভিন্নভাবে দেখি তবে বিসিবির পরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বের নাম উৎপল শুভ্র। বিসিবি একটি প্রতিষ্ঠান এবং ক্রিকেট নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের মাধ্যমে, উৎপল শুভ্র একজন একক ব্যক্তিত্ব, যার চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম মিডিয়া। তার ক্ষমতার উৎসও এটাই, বিসিবির কোনো মিটিংয়ে বহিরাগত কারো প্রবেশাধিকার নেই, তাদের আলোচনা-পর্যালোচনা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু উৎপল শুভ্রর লেখা দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায় মুহূর্তের মধ্যেই।

ক্রিকেটাররাও এটা বিশ্বাস করে তার চাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব দেশের ক্রিকেটে ২য় জন নেই। সেই বিশ্বাসকে মিথ বলেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না, যেহেতু মিথেরও শক্ত ভিত্তি থাকতে হয়। যে কারণে টেস্টপূর্ব যুগের তারকা ব্যাটসম্যান নান্নু তার কাছে বোর্ড এবং তৎকালীন কোচ মহিন্দর অমরনাথের ব্যাপারে ঝাঁঝালো ইন্টারভিউ দেন, বুলবুল ধরে নেন তার লেখার কারণেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে এবং সেই অভিমানে তাকে ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দেন, পাইলট তাকে রসিকতা করে ডাকেন ব্র্যাডম্যান, হাবিবুল বাশার আইসিএল এ যাবেন কিনা সে ব্যাপারে তার সাথে মিটিং করেন, আশরাফুল তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে ফিক্সিংয়ের সমস্ত ঘটনা অকপটে স্বীকার করেন এই আশায় যদি তিনি মিডিয়াকে ম্যানেজ করতে পারেন। যতই মুখে বলুন তিনি পেশাগত দায়িত্বের বাইরে কিছুই করেন না তবু ক্রিকেটার এবং বোর্ডের মনোজগতে উৎপল শুভ্রের ইমপ্যাক্ট আদৌ কি অস্বীকার করা যায়? ৯৯ বিশ্বকাপের দলে নান্নুর অন্তর্ভুক্তি কিংবা অভিষেক টেস্টে হাবিবুল বাশারের খেলা এসবের পেছনে ক্রিকেটের চাইতে মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সই যে মূখ্য হয়ে উঠেছিলো বইয়ের মাধ্যমে প্রকারান্তরে তা মেনে নিয়েছেন তিনি।

আমি এই বইটিকে দেখি উৎপল শুভ্রর জবানবন্দী এবং দায়মুক্তির আখ্যান হিসেবে।

প্রথমে জবানবন্দী প্রসঙ্গে আসি।

প্রচুরসংখ্যক মানুষ যেমন তার অনুরাগী, তার প্রতি বিরক্ত মানুষের সংখ্যাও কাছাকাছিই হবে। এমনকি ক্রিকেটাররাও বিভিন্ন সময়ে নানা কারণেই তাকে ভুল বুঝেছে। সোস্যাল মিডিয়া হিসেবে ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ারও আগে সামহোয়ারইন ব্লগ যখন অনলাইনে মানুষের চিন্তাধারার প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলো, তখনো সেখানে ক্রিকেট সংক্রান্ত আলোচনায় তাকে ভিলেন হিসেবেই দেখা গেছে বেশিরভাগ সময়। উৎপল নামের বিকৃতিতে উটু, উৎপাত, উটপাদ নামগুলোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নিয়ম করে তাকে তুলোধুনা করার জন্য একটা সক্রিয় গ্রুপই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। বইসূত্রে জানা যায়, সেই প্রতিটি কার্যক্রম সম্বন্ধে তিনি অবগত ছিলেন। বইয়ের কনটেন্টে যতটা ক্রিকেটারদের বিভিন্ন ঘটনা আর পেছনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, কাছাকাছি পরিমাণে আত্মপক্ষ সমর্থনের লক্ষণও প্রকাশ পেয়েছে। বেশিরভাগ ব্যাখ্যাকেই সন্তোষজনক বলা যায়, যে কারণে উৎপল শুভ্রর মুণ্ডপাত করতে যাওয়ার পূর্বে এই বইটি পড়ে নিলে এক ধরনের বিচারবোধ তৈরিতে এটি সহায়িকা হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য ট্রলিংই যাদের নেশা আর বিনোদনের বস্তু, যুক্তি তাদের কাছে ছাঁইয়ের চাইতেও মূল্যহীন।

আমার ধারণা ট্রলজীবীদের জন্য জবানবন্দী দেয়ার দায়ও তিনি বোধ করেন না। মূলত যারা তার বিরুদ্ধে ট্রলিংয়ের যৌক্তিক প্রতিবাদ করে অথবা তার চিন্তাধারাকে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সমালোচনা করে জবানবন্দীটা হয়তোবা তাদের কথা মাথায় রেখেই। নির্বিকারত্ব ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য, মানুষ শেষ পর্যন্ত হলেও আশা-ভরসার একটা অবলম্বন চায়। যতোই বলা হোক সমালোচনা গায়ে মাখি না, ক্রমাগত এটা চলতে থাকলে কোথাও যেন খচখচানি কাজ করে।

তবু প্রশ্ন হলো বারবার তাকেই কেন ভুল বুঝে মানুষ; এক্ষেত্রে তার নিজের কি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই?

বিশেষ করে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে তিনি এতো বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেন যার প্রভাবে নির্মোহতা দুর্লভ হয়ে উঠে তার জন্য। বইয়ের প্রচ্ছদটিই এক্ষেত্রে প্রামাণ্য দলিল হতে পারে। বইয়ের নাম এগারো, অথচ প্রচ্ছদে মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, সাকিব- এই ৪জনের ছবিমাত্র; এতে পূর্বপ্রজন্মের খেলোয়াড়েরা যদি বিব্রত বোধ করেন সেটা কি অন্যায্য হবে? বইয়ের কনটেন্টের সাথে এই প্রচ্ছদ কি কোনোভাবেও মানানসই? ছবি থাকলে প্রত্যেকেরটা থাকবে (শেষ প্রচ্ছদে বসানো হয়েছে), নয়তো প্রচ্ছদের কনসেপ্ট বদল করতে হবে। কিন্তু কেবলমাত্র ৪ জন ক্রিকেটার যারা এখনো খেলছেন তাদের রাখাটা কিছুটা অশোভনীয়। যদি ব্যাখ্যা এমন হয়,৪জনই ১১জনের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যেহেতু বাকিরা আর মাঠে নেই, তবে কি ২০২০ এর বইমেলাতে এই বই পুনর্মুদ্রিত হলে সেখান থেকে মাশরাফির ছবি বাদ যাবে?

ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পরদিন প্রথমআলোতে তার যে রিপোর্টটা প্রকাশিত হয় সেটি পড়ে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফোন করে বলে- ‘উৎপল শুভ্রর লেখাটা পড়ছোস? পইড়া বুঝা যাইতেছে ব্যাটা ভয়ের চোটে যাইতেই চায় নাই তামিমদের কাছে, কিন্তু ইসাম পাগলামি করায় চক্ষুলজ্জার খাতিরে সঙ্গে গেছে’। চক্ষুলজ্জায় কেউ জীবনের ঝুঁকি নেয় না অবশ্যই, কিন্তু তার লেখা পড়ে এমনটা মনে হলে সেই দায় তিনি এড়াতে পারবেন? কিংবা মাশরাফির টি২০ থেকে অবসরের আভাস পেয়ে ট্রিবিউট লিখলেন ‘আজই কি শেষ মাশরাফি’?- যেটা পড়ে সোস্যাল মিডিয়াতে লোকজন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন এবং ধরেই নিলেন তিনি ইন্ধন যোগাচ্ছেন এবং তার কিছুদিন পরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে মাশরাফি যখন আচমকাই অবসরের ঘোষণা দিয়ে দিলেন আশঙ্কাটা আক্রোশে রূপ নিলো। ট্রিবিউট কেন বুঝতে ভুল করবে মানুষ, এবং সংখ্যায় তাদের এরকম আধিক্যের কারণ কী; গ্যাপটা কোথায় হচ্ছে?

তবে কি এখনকার তরুণদের পালস তিনি আর ধরতে পারছেন না? যখন তরুণ ছিলেন তখনো তো এরকম ঘটনা ঘটেছে। যেমন হাবিবুল বাশার আর সানোয়ার হোসেনের তুলনামূলক এক লেখার পরবর্তীতে সানোয়ার এক ম্যাচে ফিফটি করার পর কে যেন তাকে ফোন করে গালিগালাজ করে দিয়েছে। সেই সময়ে ফেসবুক ছিলো না, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিলো অনুন্নত, তবুও মানুষ ফোন করেছে। কিংবা তার লেখার সূত্র ধরে বুলবুলকে কেন মানুষ তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে?

এসব প্রশ্নের উত্তরের ইঙ্গিত পাই বইতে রফিককে তার উপস্থাপনের উপাত্তের মধ্যে। ডেভ হোয়াটমোর রফিককে ওয়ানডে দল থেকে বাদ দেয়ার জন্য সুজনসহ তাকে ডেকেছেন, সুজন দোভাষী হিসেবে জানান ওয়ানডে দল থেকে তাকে বাদ দেয়া হবে। রফিক বলে বসেন- খা.পো রে জিজ্ঞাস কর ওয়ানডে দলে থাকতে হইলে কী করোন লাগবো’। কিংবা জিম্বাবুইয়ে সিরিজের মাঝপথে রফিককে দেশে পাঠানো হয়েছিলো হাবিবুল বাশারকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে মারতে উদ্যত হওয়ায়। যে কোনো ট্যুরে গেলে খেলোয়াড়রা চিন্তায় থাকতো রফিক না জানি কী ঘটাবে।

সবকিছুর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি পেয়েছেন রফিকের অনবরত সংগ্রামহেতু ইনসিকিউরিটিতে ভোগা এবং নিজের ছায়াকেও শত্রু ভাবা। একই কথা হয়তোবা তার নিজের জন্যও প্রযোজ্য। ৮০ এর দশকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া এক তরুণ পরিবারের সবার অমতে ক্রীড়া সাংবাদিকতা পেশায় জড়াতে চাইছেন, এমন এক সময় যখন বাংলাদেশের খেলাধুলা অনেকটাই আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল উত্তেজনাতেই সীমাবদ্ধ এবং সাংবাদিকতায় যশ-অর্থ কোনোটাই নেই, তখন একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে কীরকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এটা বুঝতে হলে সেই সময়েই ফিরে যেতে হবে।

আমার ধারণা, যতোই ইন্টারভিউ করুন খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের, আদতে তিনি ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষ এবং নিজেকে অন্যের জায়গায় বসিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, এই ইমপ্যাথিহীনতাই হয়তোবা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মহীরূহের আকার ধারণ করেছে।

দায়মুক্তির প্রসঙ্গে আসি।

আশরাফুল যখন টিভি ক্যামেরার সামনে সকল অপরাধ স্বীকার করে হাউমাউ করে কেঁদে দেন সেটা লাখো মানুষের আবেগ ছুঁয়ে যায়। তার একটা বাক্য ভাইরাল হয়ে যায়- ‘এক বড়ো ভাইকে বিশ্বাস করে সব বলেছিলাম, তিনি গদ্দারি করেছেন’। দর্শকমাত্রই বুঝতে পারেন আশরাফুলের দাবিকৃত গদ্দার ব্যক্তিটি উৎপল শুভ্র।

আমি মনে করি উৎপল শুভ্রর ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে আশরাফুল একটি ঐতিহাসিক ভুল। তিনি আশরাফুলের সমস্ত তথ্য পত্রিকায় প্রকাশ করে নৈতিক নাকি অনৈতিক কাজ করেছেন সেটা তর্কযোগ্য ব্যাপার হলেও আমি বলবো তিনি নৈতিক কাজটিই করেছেন। এতে আশরাফুলের সাথে হয়তোবা তার সম্পর্কের সলিল সমাধি ঘটেছে, কিন্তু আমরা যারা কোটি দর্শক নিজেদের সর্বোচ্চ আবেগ দিয়ে ক্রিকেট পর্যবেক্ষণ করি তাদের প্রতি তার এ প্রতিবেদন এক নৈবেদ্য। এক্ষেত্রে বলা যেতে তিনি রাজসাক্ষ্মীর চরিত্র বেছে নিয়েছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে আমি তার প্রশংসাই করবো ।

কিন্তু আমার আপত্তির জায়গাটা অন্যত্র। আশরাফুলকে নিয়ে তার মাতামাতি অনেক বেশি চোখে লাগতো, এমনকি এই বইতেও আশরাফুলের লেখাটি বাকি ১০ জনেরটার চাইতে পুরোপুরি আলাদা। আশরাফুলকে তুমি সম্বোধন করে খোলা চিঠি লিখেছেন তার উদ্দেশে। সংশয়বাদীরা চাইলে এটাও বলতে পারেন কেবলমাত্র আশরাফুলকে এই চিঠিটা লেখার উদ্দেশ্যেই বাকি ১০জনকে টেনে এনেছেন উছিলা হিসেবে। তিনি কি নিজে কখনো বুঝতে পেরেছেন আশরাফুলকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন, একজন সাংবাদিক হিসেবে যা তার সাথে যায় না?

আশরাফুল নেটে ব্যাট করার সময় সারাক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা, যা দেখে কোচ ডেভ হোয়াটমোর রসিকতা করে বলেছিলেন, তুমি দেকি এ্যাশের প্রেমে পড়েছো। অপর কোচ জেমি সিডন্স ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আশরাফুলের কাছ থেকে তৃমি কত টাকা পাও, কিংবা ২০১১ বিশ্বকাপের আগে কোনো এক এজেন্সির সিইও সরাসরি তাকে বলে বসেন ‘আপনার কারণেই আশরাফুলটা বাঁইচা গেলো আবার, দেইখেন দলকে ডোবাবে’। সহকর্মীরা তাকে খোঁচাতেন, অনেকে প্রথম আলোকে বলা শুরু করেছিলেন আশরাফুলের আলো- এসবের ভিত্তি কি তার হাতেই স্থাপিত হয়নি?

আশরাফুলের ব্যাটিং দেখলে ভালো না লেগে উপায় নেই, এমনকি এখন এই পড়ন্ত বেলায় বিপিএল এ যখন ব্যাট করতে নামেন তখনো তাকে গালাগালি করা মানুষ মনের সঙ্গোপনে প্রার্থনা করেন আশরাফুল যেন রান করে। সেই ২০০৮ সালেই ব্লগে লিখেছিলাম আশরাফুলের হেটাররাই তার সবচাইতে বড়ো ভক্ত, দীর্ঘদিন প্রত্যাশাভঙ্গের যন্ত্রণা সইতে না পেরে হেটারে রূপ নিয়েছে। এমনকি এমন অনেক মানুষকে চিনি, আশরাফুল রান করলে যারা ফকিরকে টাকা দিতেন কিংবা নফল নামায পড়তেন। আশরাফুল মানুষকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অবিরাম আশরাফুল বন্দনার মধ্য দিয়ে তিনি কি সেই মোহাচ্ছন্নতারই অপব্যবহার করেননি? প্রায় প্রত্যেক ক্রিকেটারকে নিয়েই তিনি প্রয়োজনে সমালোচনামূলক লেখা লিখেছেন, কিন্তু আশরাফুলকে নিয়ে লেখা সমালোচনাগুলোও অনেক বেশি উচ্ছ্বাসমিশ্রিত থাকতো; এটা কি তিনি অস্বীকার করতে পারবেন?

বাংলাদেশের ক্রিকেটে আশরাফুল এক ক্লোজড-চ্যাপ্টার, তবু নিষেধাজ্ঞা শেষে ফিরে প্রিমিয়ার লীগ খেলেছেন, সেটা যেহেতু টেলিভিশনে দেখানো হয় না, জনসম্পৃক্ততা ছিলো না সেভাবে; কিন্তু বিপিএল এর ম্যাচগুলো অসংখ্য মানুষ দেখে, আশরাফুল এবার দলও পেয়েছিলেন। ফলে তিনি আবারো আলোচনায়, তার একমাস পরই বইমেলা। আশরাফুল ইস্যুতে উৎপল শুভ্রর অবস্থান নিয়ে যাদের ধোঁয়াশা এবং ক্ষোভ ছিলো ক্ষেত্রবিশেষে সেই দায় থেকে মুক্তির জন্য হলেও তার এক দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপনের আবশ্যকতা ছিলো হয়তোবা। নইলে আশরাফুলের অংশটা চিঠি আকারে লেখার ব্যাখ্যা কী?

সময় বদলালে কেবল মানুষের মুখ আর নামগুলোই বদল হয়, তার জায়গায় আসা নতুনদের মধ্যেও পাওয়া যায় সাদৃশ্য। যে কারণে মহাকালের পরিক্রমায় মানুষের গল্পগুলো প্রায় একই থাকে। এটা বলার কারণ হলো, নান্নুর গল্প পড়তে গিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায় ব্যক্তিত্বের দিক থেকে নান্নু আর সাকিব কত কাছাকাছি, অন্তত পাবলিক ইন্টারেকশনে। মুশফিককে মনে হয় বুলবুল আর হাবিবুলের সংমিশ্রণ, আকরাম খান আর মাশরাফি যেন অনেকটাই কাছাকাছি। নাসির আর সাব্বিরের সংমিশ্রণ একজন পাইলট, রফিক যেন কিছুটা রুবেল আর কিছুটা মুস্তাফিজ মিলিয়ে তৈরিকৃত।

বইটি কেন পড়া উচিত?
আমি দুটো কারণ খুঁজে পেয়েছি।
প্রথমত, ক্রিকেট খেলায় ব্যাট-বল আর মাঠের ভাগ বড়োজোর ১৭%, বাকি ৮৩% ই আসে মাঠের বাইরের উৎস থেকে; এই সত্যিটা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধির ক্ষেত্রে এর চাইতে উৎকৃষ্ট বই বাংলাভাষায় এখনো লেখা হয়নি আমার ধারণা। আমরা যারা তারকার পারফরম্যান্স দেখি, কিন্তু দিনশেষে তারকার জীবনের ক্রাইসিস, স্যাক্রিফাইসগুলো রয়ে যায় দৃষ্টির অন্তরালে, সেই জীবনে উঁকি দেয়ার ক্ষেত্রেও এখানে বিশদ রসদ রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ক্রিকেট কালচার এবং ঐতিহ্য বোঝার ক্ষেত্রে এর প্রত্যক্ষ অবদান অনস্বীকার্য। তবে এই জায়গাটিতে লেখক আরো চিন্তাশীলতার ছাপ রাখতে পারতেন। নিবন্ধগুলো একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কহীন, ফলে পরম্পরাগুলো খর্বিত হয়েছে কিছুক্ষেত্রে। আত্মপক্ষ সমর্থন কিছুটা কমিয়ে যদি যোগসূত্র স্থাপনে আরো শব্দ খরচ করতেন সেটা বইয়ের কনটেন্ট মূল্য আরো বাড়িয়ে দিতো।

বাংলাদেশের ক্রিকেট, ক্রিকেটার, ক্রিকেট রাজনীতি, ক্রিকেট সংগঠন প্রভৃতি বিষয়ে আরো অসংখ্য বই লেখা উচিত। এক উৎপল শুভ্র তার ক’টাই বা যোগান দিতে সমর্থ হবেন!