মনোজিৎ দাশগুপ্তের শৈশব পশ্চিমবঙ্গে, বাবা হিন্দু মা ফরিদপুরের রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে, দুজনের বয়সের ব্যবধান ১৮ বছর! ১৯৫৬ তে বিবাহ। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ৩ ভাইসহ মনোজিৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন, মায়ের সঙ্গে৷ বাবা রয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গেই।
পরিবার পুনর্মিলিত হলো বেশ কিছুদিনের বিরতিতে
ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া দেশে মুসলিম মায়ের হিন্দুয়ানি নামের পুত্রদের স্কুলে ভর্তি নিচ্ছিল না। পাসপোর্টে ৩ ভাইয়ের নামই গেল বদলে৷ মনোজিৎকে আমরা পেলাম শাফিন আহমেদ নামে!
শাফিন ওরফে মনোজিৎকে নিয়ে লেখা বই আমরা পড়ছি অথবা পড়বো, কারণ আমরা তাকে চিনেছি মিউজিশিয়ান হিসেবে।
‘ফিরিয়ে দাও আমারই প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও’, বয়স ২৯ থেকে ৪৫, অন্তত ইন্টার পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে এবং কঠোর রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠেনি— এমন বৈশিষ্ট্যের ১১ জন বাঙালিও হয়ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে এই গানটি জীবনে ১ বার হলেও শোনেনি।
মাইলস ব্যান্ডের ‘কাল্ট’ এ পরিণত হওয়া এ গানের ভোকাল শাফিন আহমেদ, সুতরাং মিউজিশিয়ান সে বটে।
আমার প্রশ্নটা উদ্ধত এবং মূর্খামি উভয়ার্থে নেয়ার অনিবার্যতা থাকলেও শাফিন আহমেদের মিউজিশিয়ান সত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে চাই, আসলেই মিউজিশিয়ান?
সেলিব্রিটির বায়োগ্রাফি পড়াকালীন গড় মানুষের কৌতূহল থাকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি সংকীর্ণ জিজ্ঞাসাতেই।
১. তার যৌনজীবন
২. ড্রাগস
৩. বউ-বাচ্চা
৪. স্মরণীয় ঘটনা
সাজ্জাদ হুসাইনের লেখায় ‘পথিকার’ বইতে আমরা শাফিন আহমেদের যে পোরট্রেইট অথবা ল্যান্ডস্কেপ পাই সেখানে আমজনতার ফ্যান্টাসি পূরণের সবরকম মশলায় ভরপুর, মনে হবে কোনো ট্যাবলয়েড কাহিনী
– বাংলাদেশের একজন সেলিব্রিটি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন লিভ টুগেদার করে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। ব্রোথেলে যাচ্ছে। তরুণ বয়স থেকে অদ্যাবধি যতরকম যৌনতায় জড়িয়েছে, প্রকাশ করে দিচ্ছে।
– আফিম, গাঁজা সহ যতরকম ড্রাগ আছে, বুঁদ হয়ে থাকত, কোনো রাখঢাক নেই।
-প্লানচেট, ফ্রি লাভ বা কমিটমেন্টবিহীন যৌনতার আইডিওলজি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গুলশান বা ধানমন্ডি কেন্দ্রিক এলিট পরিবারের টিনেজ ছেলেমেয়েদের পার্টি, যৌনতার গল্প
বই হিট করার জন্য যথেষ্ট৷ লেখকও হয়ত মার্কেট ডিমান্ডকেই প্রায়োরিটি দিয়েছেন। নইলে শাফিন আহমেদের জীবনির প্রথম চ্যাপ্টারেই কেন থাকবে তার লিভ টুগেদারের গল্প?
উপমহাদেশে প্রথম লিভ টুগেদার করা বাঙালি মাইকেল মধুসূদন। আজ দেড়শো বছর পরে আমরা তাকে মেঘনাদ বধ কাব্য দিয়ে স্মরণ করি, নাকি তার যৌনজীবন দিয়ে?
শাফিন আহমেদের বর্তমান বয়স ৬২, মিউজিকে যা কন্ট্রিবিউট করার হয়ে গেছে, ২ বার হার্ট এটাক, তাকে এখন অবসরপ্রাপ্ত মিউজিশিয়ান বলা যায় নির্দ্বিধায়। যদি ২০১৯ এ কক্সবাজারের কনসার্ট শেষে হওয়া হার্ট এটাকেই শাফিন আহমেদ দেখা করতে যেতেন আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু বা তার তারুণ্যের বন্ধু হ্যাপি আখন্দের সঙ্গে, তাতেও তার অবস্থান একটুও নড়চড় হত না৷ অর্থাৎ তার এখনকার জীবন সবটাই বোনাস, ক্ষেত্রবিশেষে লায়াবিলিটি!
কিন্তু বাংলা ব্যান্ড নিয়ে যদি ১০০ বছর পরেও কেউ জানতে বা পড়াশোনা করতে চায়, শাফিনকে তার জানতেই হবে৷ সেই শাফিনের বায়োগ্রাফিতে মিউজিকের চাইতে লিভ টুগেদারে সন্তান উৎপাদনের স্বীকারোক্তি কেন হবে জীবনের হাইলাইটস?
লেখক-মিউজিশিয়ান-ফিল্মস্টার মানেই বহুমাত্রিক এবং বহুমুখী যৌনতা, ফ্যান্টাসি জগত, বেপরোয়া চালচলন, ভুল বোঝাবুঝি, একাকীত্ব এর চেনা ছক। শাফিনের জায়গায় আমরা যদি জেমস, আইয়ুব বাচ্চু বা মাকসুদুল হককে বসাই ওইসব প্যারামিটারে একই গল্পই পাওয়া যাবে হয়ত; কেবল কুশীলবেরা আলাদা।
কিন্তু শাফিন যেখানে ইউনিক, তার জন্ম হয়েছিল মনোজিৎ নামে, তার জীবনের গল্পটা শুরুই হয়েছিল disown এর মধ্য দিয়ে। তার অবশিষ্ট জীবন কি সেই disown এরই পরম্পরা? একই গল্পে একই কাঠামোতে থেকেও হামিন কেন disown মানসিকতা থেকে হয়ে উঠলো প্রচলিত বাঙালি মানসিকতার?
কিংবা মাইলস ব্যান্ডটা শেষ পর্যন্ত কালচারালি কোথায় বিলং করে। শাফিনের একসেন্ট মাকসুদ-বাচ্চু বা জেমসের চাইতে পুরো আলাদা, আধা বাঙালি আধা ইংরেজি মিলিয়ে নিজস্ব একসেন্ট, মিউজিকাল কম্পোজিশনও শহুরে ধাঁচের। ফলে মফস্বলে বা গ্রামে জেমস বা বাচ্চু যেভাবে প্রবেশ করেছিল, মাইলস কি সেখানে পিছিয়ে?
মাইলস এর কালচারাল একটা আইডেন্টিটি পলিটিক্স সবসময়ই ছিল, আমার মনে হয়েছে৷
তাই শাফিন আহমেদের বায়োগ্রাফিতে যখন তার মিউজিকাল, ফিলোসফিকাল এবং জিওপলিটিকাল জার্নির চাইতে পপকর্ন উপকরণ এগিয়ে থাকে ৭৫-২৫ ব্যবধানে, অবধারিত প্রশ্ন উত্থিত হয় এই বই লেখার মোটিভ কী কিংবা এটা না লিখলে তার কোথায় অপূর্ণতা রয়ে যেত?
শাফিনের পারসপেক্টিভ থেকে সরিয়ে যদি সাজ্জাদ হুসাইনের পারসপেক্টিভে দেখি বইটাকে, তিনি কেন লিখলেন শাফিন আহমেদকে নিয়ে? তার জীবন কতটা ফ্ল্যামবোয়ান্ট সেই গল্প শোনাতে, নাকি মুখরোচক উপকরণ বের করে আনার লোকরঞ্জনবাদি দায়িত্ব পালন করতে?
দুই পারসপেক্টিভই যখন গোলমেলে, আমি ভাবতে থাকি হু ইজ শাফিন, এর চাইতে হোয়াট ইজ শাফিন, বোধহয় গভীরতর দার্শনিক জিজ্ঞাসা। যার অন্তিম গন্তব্য ‘হোয়াই ইজ শাফিন’?
এর ব্যবচ্ছেদে ৩ জন ব্যক্তির জীবন সমান্তরালে জানা জরুরী
১. কমল দাশগুপ্ত- মাত্র ২৩ বয়সে কলকাতার অন্যতম প্রভাবশালী রেকর্ডিং কোম্পানির ডিসিসন মেকিং রোল পাওয়া, কাজী নজরুল ইসলামের ৪০০ গানের সুর করা, এবং ৮ হাজার গানের সুরস্রষ্টা একজন কিংবদন্তী যখন সীমান্তের এপাড়ে এসে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নামগ্রহণ করেন কামালউদ্দিন আহমেদ, ব্যাপারটা তার জন্য স্বেচ্ছামৃত্যু হয়ে উঠেছিল কিনা? একই মানুষ পথিকার নামে দোকান খুলছেন, নিয়তির পরিহাস কি এর চাইতেও নির্মম হওয়া সম্ভব?
২. মায়ের সঙ্গে পুত্রের চেহারার এত মিল! ফিরোজা বেগম নিজেই অপার রহস্যের আঁধার। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে ৩ পুত্র, সেমি জমজ বলা যায় হামিন-শাফিনকে। শাফিন আহমেদের এক্সট্রিম আমিত্বময় জীবনে মমতা বলতে যদি কিছু থাকে তা বোধহয় কিছুটা মায়ের প্রতিই৷ ফিরোজা বেগমের কোনো স্বভাব বা প্রবণতা কি শাফিন বহন করে গেলেন উত্তরাধিকার রূপে?
৩. মাইলস এর কনসার্ট মানে শাফিনের গান, হামিন গিটার প্লে করে যাচ্ছেন। নীলা বাদে গুটিকয়েক জনপ্রিয় গানের ভোকাল। অথচ হামিন বামবার সভাপতি ছিলেন, মাইলস নিয়েই ছিলেন সবসময়। হামিন কি শাফিনের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছিলেন, নাকি শাফিনই ক্যালিবার বা ক্যারিশমা দিয়ে হামিনকে ছাপিয়ে স্পটলাইট আদায় করে নিয়েছিলেন নিজের দিকে। ‘সিবলিং রাইভালি’ হামিন-শাফিনের মধ্যে তৈরি হওয়া ছিল অনিবার্য বাস্তবতা, তবু দুই ভাই এতটা লম্বা সময় একই স্টেজে যে টিকেছিলেন তাতে কোনো একজনের বিপুল ধৈর্য অত্যাবশ্যক ছিল। ধৈর্যবান ব্যক্তিটি শাফিন নন, তার জীবন পর্যালোচনা করে নিশ্চিন্তে বলা যায়। হামিনের বাঁধ তবে এত দেরিতে কেন ভাঙলো? দুই ভাইয়ের জার্নিটা বদলে গেল কখন থেকে।
এই পয়েন্টে এসে পুরনো প্রশ্নে ফিরে যাই।।শাফিন আহমেদের কেন এই বায়োগ্রাফি লিখতে হলো।
দুটো হাইপোথিসিস পাই
হাইপোথিসিস-১: মাইলস ব্যান্ড এ তিনি স্থায়ীভাবে অতীত হয়ে গেছেন। মিডিয়াতে একটা সংবাদের স্থায়িত্ব কয়েক দিন মাত্র, বই মানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ভক্তদের কাছে মাইলস নয়, গান মূখ্য। ফলে মূল ভোকালই আইডল। মাইলস এর গৃহদাহে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বইটা হতে পারে এক পলিটিকাল স্টেটমেন্ট।
বই পড়ার সূত্রে জানা যায় আলাপের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ছিলেন সূরামত্ত। তাই কয়েকটা ব্লান্ডার করে ফেলেছেন
– প্রতিধ্বনি এলবামের প্রসঙ্গে বলছিলেন জুয়েল বেশি সংখ্যক গানের সুর করায় মানাম আহমেদ অভিমানবশত মাত্র দুটো গানে সুর দেন। এর চাইতেও গুরুতর মন্তব্য- সবাই নাকি গায়ক হতে চাইছিল, এলবামের ১২ গানের মধ্যে তিনি ভোকাল মাত্র ৫টাতে, যা তিনি ভালোভাবে নেননি! এই স্টেটমেন্টে মানাম আহমেদকে হিংসুক এবং অন্য যারা গাইতে চাইছিল তাদের এটেনশন সিকার হিসেবে ফ্রেমিং করার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট হয়ে যায় জেমস বা বাচ্চু যেমন নিজেদের ব্যান্ডে সর্বেসর্বা, অন্যরা অনুগত কর্মচারী এটিচুডের, শাফিন আহমেদও সেই অটোক্রেসি প্রত্যাশা করেছিলেন৷ কিন্তু মাইলস যতখানি শাফিনের, ততটুকুই হামিন আর মানামেরও। ফলে শাফিন দলের চাইতে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছিলেন।
-শাফিন আহমেদ মহাতারকা ভোক্তাশ্রেণির কাছে। নিজ ব্যান্ডে নিছকই শাফিন, সেখানে জুয়েল বা তুর্যের চাইতে আলাদা কিছু নয়৷ ২০ বছর পরে এসে যদি তিনি বোধ করেন তার খ্যাতি টিম মেটদের ঈর্ষাণ্বিত করে তুলেছে, সমগ্র জার্নিটাই তখন মিথ্যা হয়ে যায়৷ নিজের ভাই বা বন্ধুর কাছে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিতও অতি সাধারণ মানুষ, তাদের চোখে সমীহ খুঁজলে সেটা গর্হিত অপরাধ।।
– মূল সংঘাতটা আদতে ভাইয়ে ভাইয়ে, মানামকে তিনি চেয়েছিলেন নেগোশিয়েটরের ভূমিকায়। মানাম চলে গেল হামিনের দলে। হামিনের সঙ্গে এত গেঞ্জাম, তারপরও ২০১৯ এ মেয়র ইলেকশনের আগে হার্ট এটাক করার পরে তার নির্বাচনী প্রচারণাগুলোতে হামিন অংশ নিয়েছেন কোন স্বার্থে? হামিন ভিলেন নাকি এন্টিহিরো, নাকি এর চাইতেও গুরুতর প্রশ্ন শাফিনের কেন মনে হচ্ছে এই গল্পে তিনিই হিরো?
হাইপোথিসিস-২:
শাফিন আহমেদ আদ্যন্ত ভোগী মানুষ। কিশোর বয়সেই বখাটের চূড়ান্ত। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এম্বাসির সিকিউরিটিকে পিটিয়ে জেল খেটেছেন। মা তাকে পাঠিয়ে দিলেন বিদেশে। সেখানে টিকে থাকার সংগ্রাম যেমন করেছেন, অবাধ যৌনাচারও চালিয়ে গেছেন৷ তার মিউজিকাল সেন্স সেসময়ে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে সেই সময়টাতে, সে সংক্রান্ত বর্ণনা অপ্রতুল। দেশে ফিরেছেন হুট করে, লিভিং পার্টনারের সাথে অভিমানবশত। মাইলস ইংরেজি গান ছেড়ে বাংলায় এলো। ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলগুলো কীভাবে তাদের সাথে প্রতারণা করলো শুধু সেই গল্প। সর্বত্র শুধু অভিযোগের ছড়াছড়ি। সর্বান্তে একজন কমপ্লেইনিং এটিচুডের মানুষ।
তার ষাটোর্ধ্ব জীবনে এখনকার সঙ্গী এক পোষা কুকুর, আর নিত্য নতুন শরীরীসঙ্গী। ফলে তার গল্পে ডার্ক ফ্যান্টাসির ছড়াছড়ি। কারো সঙ্গে কি তার বনিবনা হলো সমগ্র জীবনে? ৩ বার বিয়ে করলেন, ১টা লিভ টুগেদার, ভাই, বন্ধু কেউ তাকে বুঝলো না? কেন বুঝলো না? যদি বায়োগ্রাফিটা লেখা হত ২০১৪-১৫ তে যখন তিনি মাইলসের অংশ, তখনো কি বইয়ের কনটেন্ট এরকমই থাকত? আমার সংশয় পুরোমাত্রায়।
এই মুহূর্তে তিনি পুরোপুরি ভালনারেবল। সাজ্জাদ হুসাইন ভুল সময়ে তার বায়োগ্রাফি লিখে এক ঐতিহাসিক ভুল করলেন।
সমগ্র বইতে একটা রেফারেন্স পেলাম না যে ঘটনায় শাফিন নিজেকে দোষী ভাবছেন। মানুষের পক্ষে এতটা পলিটিকালি কারেক্ট থাকা সম্ভব?
বরং স্টারডম, মেয়েবাজি আর অস্থিরতাই তার চরিত্রের ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করে বারংবার৷ দেশের সবকিছু বিক্রি করে আমেরিকায় চলে যাওয়া, ফেরত আসা, আবার যাওয়া—- মাইলস ব্যান্ড তো তার ব্যক্তিগত খেয়ালে চলতে পারে না। একবার এসি আই তে চাকরি, আবার রিয়েল এস্টেট এ, আবার অন্যত্র— এই জায়গায় তার একটা অনুধাবকে আমার সৎ কনফেশন মনে হয়েছে। মাইলসের গানের কম্পোজিশনগুলো একইরকম হয়ে যাচ্ছে, এবং তাদের প্রাইম ফুরিয়ে গেছে।
কিন্তু স্পটলাইটের প্রলোভনে হয়তবা বন্দী হয়ে পড়েছিলেন৷ নইলে তার কেন মেয়র ইলেকশন করবার প্রয়োজন পড়বে৷ ক্রিকেটার সাকিব বা মাশরাফি যেমন এক অঙ্গনের জনপ্রিয়তাকে অন্য জায়গায় এনক্যাশ করেছে, তার উদ্যোগটাও অবিকল এক, কেবল ভুল প্রতীকের মারপ্যাচে অন্তিম পরিণতিতে ভিন্নতা।
শাফিন আহমেদ মিউজিকের জন্য কী কী স্যাক্রিফাইস করেছেন, বিপরীতে মিউজিক থেকে পাওয়া খ্যাতি থেকে কতটা সুবিধাভোগী হয়েছেন, আনুপাতিক হিসাব করলে দেয়ার চাইতে নিয়েছেনই বেশি। কমল দাশগুপ্ত আর ফিরোজা বেগমের যৌথ জিন যার শরীরে, মিউজিকে তার যেতে হতোই (বড় ভাই তাহসিন যদিও ব্যতিক্রম), কিন্তু তাদের লেগসি কতটুকু বহন করলেন, নাকি মিউজিকাল লেগাসিতেও তিনি বখাটেই?
ফলে বইটা ‘শাফিন মিউজিকের জন্যই যার জন্ম’ ট্যাগলাইনের বদলে ‘আই এম দ্য শাফিন আহমেদ, আ মিউজিকাল ব্রান্ড’ প্রমাণেই অধিক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আমার জানতে ইচ্ছে করে একাকী মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে শাফিন আহমেদের চোখে নিজের কোন বয়সের অবয়ব ভাসে?
আমার ইনটিউশন বলে মনেপ্রাণে তিনি হিপ্পি হতে চেয়েছিলেন। ‘চিল্ড্রেন’স অব গড’ ফিলোসফিতে আকৃষ্ট হওয়া, তাদের রিচুয়ালে আকৃষ্ট হওয়া, ফ্রি লাভ নীতি, এক্টিভিজম সবকিছুর মধ্যে আমরা এক বিশুদ্ধ একাকী পরিব্রাজককে দেখতে পাই। হামিনের জীবন কেটেছে বাংলাদেশেই, ইংল্যান্ডের সেই ৮ বছর দুই ভাইয়ের দার্শনিক ভুবনে গড়ে দিয়েছে ৮০০ বছরের ব্যবধান। শাফিন যেখানে উন্মত্ত হিপ্পি, হামিন অনেকটাই বৈষয়িক— একটা দূরত্বে যাওয়ার পরে গন্তব্য আলাদা হতই।
শাফিন আহমেদের জীবনকে ব্যবচ্ছেদ শেষে যদি উপসংহারমূলক লাইন লিখতে চাওয়া হয়, লিখবো- ‘যদি কেউ বোধ করে নিজের আত্মাকে বাজি রাখবে জুয়ার টেবিলে, তাকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে তার জীবনে স্থায়ী কোনো মানুষেরই প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকেই তার জন্য ভিন্ন নাম আর চেহারার ক্যারেক্টার মাত্র। জুয়ায় জিত যত বড় হার তারচেয়েও মর্মান্তিক৷ সুতরাং একাকীত্ব, বিষন্নতা, বদনাম, বিশ্বাসভঙ্গ, সম্পর্কবিয়োগ সহ যাবতীয় ঋণাত্মক অনুভূতির ফাঁকে এক চিলতে সুখ মিলতে পারে নাও পারে, সেই সাহস থাকলেই কেবল দুনিয়াকে বলো CTN (চো*র টাইম নাই), অন্যথায় লক্ষ্মী ছেলে বা মেয়ে হয়ে পরিশীলিত জীবন কাটাতে আত্মা যথাস্থানে রেখে ঘরে ফিরে যাও’
শাফিন আহমেদ শেষ পর্যন্ত লুজারই, তবু আমৃত্যু বলতে পারবেন CTN, এজন্যই তার গাওয়া আমার সবচাইতে পছন্দের গান ‘পলাশীর প্রান্তর’