১০৫৭১২৯, নিছকই এক রোল নম্বর নয়, আমার জন্য এটাই পাসপোর্ট এবং ভিসা, যার ক্ষমতাবলে পেয়েছিলাম আত্ম অন্বেষণ অভিযানে দার্শনিকতার মহাদেশ ভ্রমণের অবারিত অধিকার
নটরডেম কলেজকে অনেকে অনেক কারণে মনে রাখে, আমি রেখেছি প্রথম মৃত্যুতীর্থ রূপে। আমার ২য় মৃত্যুতীর্থ ৪৫ দিনের ভারত পরিভ্রমণ৷ অর্থাৎ নটরডেম কলেজে আমার যে পুনর্জন্ম হয়েছিল, সেই আয়ু নিয়ে বেঁচে ছিলাম ২০ বছর।
যদি নটরডেমের ২ বছর বাদ দিই, নিজেকে খুঁজে পাই হাজারো পেশাজীবীর একজন হিসেবে। সে হত এক বিভীষিকাময় জীবন। প্রথম মৃত্যুতীর্থ হয়ে নটরডেম আমাকে দিয়েছে মহাজীবনের অন্তহীন গন্তব্যে বাঁচবার আশা।
নটরডেমে আসি ১৭ বয়সে। থাকতাম বড় আপার বাসায়, মুগদাপাড়া ব্যাংক কলোনীতে৷ আমার কলেজ আর তার সংসার শুরু একই সময়ে, তখনো ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষার্থী৷ প্রাইভেট পড়তাম না, কোনো ক্লাবের সাথেও জড়িত নই, ক্লাস শেষে রিকশাযোগে বাসায় ফেরা৷ বোন এবং বোনাই ঘরে ফিরছে সন্ধ্যায়। দিনের বড় অংশ কাটতো পুরোপুরি একাকী। মোবাইল, কম্পিউটার বলতে কিছুর মালিকানা নেই।
দীর্ঘ একাকীত্বে পূর্বজীবনকে প্রশ্ন করতে শুরু করি, আত্মসমালোচনার দুয়ার অবারিত হয়। একাকীত্ব বা বিচ্ছিন্নতার ধারাবাহিকতায় উপলব্ধি আসে- ‘একাডেমিক পড়াশোনা থেকে আমার কিছুই নেই এচিভেবল। টাকা আমাকে একদমই আকৃষ্ট করে না, আমি মানুষের চোখে বিস্ময় দেখে আনন্দ পাই৷ চাকরি বা ব্যবসা করলে কিংবা একাডেমিক পড়াশোনায় অনেক বেশি ডুবে গেলে পরিচিত অন্য ১০-১২ জনের চাইতে আলাদা সিগনেচার তৈরি হবে না। আমি একটা ব্যতিক্রমী জীবন কাটাতে চাই। সুতরাং পূর্বজীবনের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, মূল্যবোধ বিসর্জন দিলাম। আমি এক নতুন পৃথিবীর পথে হাঁটব, যেখানে সবকিছু পরিচালিত হবে লেখার উদ্দেশ্যে। বয়স ৩০ পেরুলে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে আশ্রমে কাটিয়ে দিব বাকি জীবন’
ফলে নটরডেম কলেজে আমার কোনো চার্মিং স্মৃতি নেই। আমার ফ্যান্টাসিতে নটরডেম মানে ক্লাস চলাকালে লোয়ার বেঞ্চে দাবা রেখে মুশফিকের সঙ্গে খেলা। একটা সমগ্র টুর্নামেন্ট চলেছে ক্লাস চলাকালীন, স্যাররা টেরও পাননি। জাভেদ, অপু, অমিয় কলেজ ত্যাগের পরে আর দেখিনি তাদের। মুশফিকের সঙ্গে অনিয়মিত যোগাযোগ অটুট আছে, আমার রঙপ্যাথি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছে, আজও আমরা দাবাই খেলছি নটরডেমের বেঞ্চে। কলেজে পড়াকালে ডায়েরিতে বিভিন্ন ব্যক্তির আপন ভুবন সংগ্রহ করতাম। মুশফিক লিখেছিল ‘আমি পারি না সালমানের মতো গাইতে, হিমেলের মতো লিখতে, যদিও আমাদের লেখক সাহেব বোধহয় জাফর ইকবালকে অনুসরণে ব্যস্ত’।
মুশফিকের সেই লাইনের ভার বহন করেছি বহুদিন।
যে সময়ে মাত্র ২টাকা ছিল চায়ের দাম, তখনো নটরডেমের চায়ের দাম ৫টাকা! আবারো যদি যাওয়া পড়ে নটরডেমের ভেতরে, আমি সর্বপ্রথম ক্যান্টিনের সেই চায়েরই খোঁজ করব৷ ২০ বছর পরেও সেই স্বাদ সে ধরে রেখেছে কিনা। আমার চায়ের সঙ্গী তপু, নাফি, হিমেল প্রত্যেকেই বিদেশে স্থায়ী হয়েছে। নাফি বাংলাদেশের প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড দলের সদস্য, বুয়েটে ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেছিল। বর্তমানে গুগলে অফিস করে শুনেছি। তপু বা হিমেলের কোনো আপডেট জানা নেই৷
জাওয়াদ আল রাতুন এবং সাব্বির নামের দুই কিশোরকে মনে পড়ে কঠোর মূল্যবোধের কারণে৷ সৌরভ-গৌরব নামের জমজ ভাই, ক্লাস না করার কারণে নানারকম শাস্তি ভোগ করত।
নটরডেমের সিট নির্দিষ্ট। ফলে রোল নম্বর ডাকার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতি ৩ সপ্তাহে সিটের পজিশন বদলাতো। আমি শুরু করেছিলাম নাফি আর গৌরবের সঙ্গে। বাকি জীবনে বেঞ্চমেট বাঁধন এবং ইফাত৷ বাঁধন ড্রামস বাজাত, ক্লাব করত, কলেযে পড়াকালেই জানতো আর্কিটেক্ট হবে, এতটাই কনফিডেন্ট যে বুয়েটে পরীক্ষা দিয়েছিল শুধুমাত্র আর্কিটেকচারেই, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নয়। স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কলেজের পরীক্ষাগুলোতে আমরা প্রচুর দেখাদেখি করতাম, বুয়েটে আমাদের পথে চলে গেছে বিপরীত মুখে।
নটরডেমের মাত্র একজন ক্যারেক্টারকে যদি মিস করি সে ইফাত জাহাঙ্গীর। দুর্দান্ত মেধাবি, হিউমার সেন্স তীক্ষ্ম। আমার সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান অতুলনীয়। কালের পরিক্রমায় সেও ইমিগ্র্যান্ট। ভারত ভ্রমণে অনুদান সংগ্রহকালে এতদিন বাদে মনে পড়ে তাকে, নির্লজ্জের মতো অনুদান চাই। সে আমায় মনে রেখেছে৷
হিউমার পছন্দ করার ক্ষেত্রে নাবিল এবং আরাফাত নামের দুজনকে কৃতিত্ব দিব৷ শুনেছিলাম নাবিল মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল, পরের আপডেট জানি না
আরাফাতের একটা মন্তব্য আজও মনে রেখেছি৷ রবীন্দ্রনাথ মা-বাবার ১৪তম সন্তান, সে প্রসঙ্গে বলেছিল – ‘ভাই রে ভাই দেবেন্দ্রনাথের সোনায় ধার কত’
গভমেন্ট ল্যাবরেটরির ‘তামাম’ নামের এক ছেলেকে লক্ষ্য করতাম, তার মধ্যে ক্যারেক্টার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গ্রুপ সেভেন এর ৩১৭ নম্বর রুমে ১৬৯ জন ছাত্র, ৫টা কলাম৷ বায়োলজি আর পরিসংখ্যান মেলানো। পরিসংখ্যানের ক্লাস করতে আমরা চলে যেতাম অন্য রুমে। ফলে এক কলাম পেরিয়ে অন্য কলামে যাওয়াও হয়নি। তামামের ইন্টারভিউটাও রয়ে গেছে ডিউ৷ শুনেছিলাম সে আইবিএ তে ভর্তি হয়েছিল।
একাডেমিক পড়াশোনা থেকে অবসরে গিয়েছিলাম বলে ক্লাস বা শিক্ষক কেউই মনে রেখাপাত করেনি।
তবু ৩ জনকে মনে রেখেছি ৩ ভিন্ন কারণে।
প্রথমত বিদ্যুৎ ভদ্র। ম্যাথ পড়াতেন। ২য় বর্ষে কিছুদিন প্রাইভেট পড়েছিলাম, কয়েকটা মডেল টেস্ট দিয়েছি ইন্টারের পূর্বে। তার পাঞ্চ লাইনগুলো আমার লেখালেখিতে কাজে আসত- ‘১টা আমি করে দিচ্ছি, বাকিগুলো এসো নিজে করি বলে করে নিতে হবে’৷
দ্বিতীয়ত সঞ্জিত গুহ। কেমিস্ট্রি পড়াতেন। পড়ানোর ধরনে মনে হত সমগ্র বই মুখস্থ। কল্লোল নামে এক ছাত্রের রেফারেন্স দিতেন প্রায়ই, আমাদের ২ ব্যাচ সিনিয়র, সেও গ্রুপ সেভেনে, বুয়েটে চান্স পেয়েছে। রেফারেন্স শুনতে শুনতে কল্লোলকে আমি রিক্রিয়েট করতে থাকি। তার নানারকম বৈশিষ্ট্য সেট করতে শুরু করি৷ সেই কল্লোলকে খুঁজে পাই সানরাইজ কোচিং সেন্টারে, ক্লাস নিতে এসেছে। কোচিংয়ে অনিয়মিত বলে ১ দিনের ক্লাসই হয়ে থাকে গুহ স্যারের বর্ণিত কল্লোলকে চাক্ষুষকরণ। ফেসবুকের কল্যাণে তাকে খুঁজে নিই। ২০১৯ এ বেইলি রোডের এক রেস্টুরেন্টে আলাপ হয়, পরে দুটো পডকাস্ট করি, এবং ঘোরবন্দী গোল্ডফিশ বইটা উৎসর্গও করি।
মানুষকে রিক্রিয়েট করার প্রবণতা অবশ্য আরো পুরনো। ১৯৯৯ তে টিভি বিতর্ক হচ্ছে, মানিকগঞ্জ গার্লস হাইস্কুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে অন্য এক স্কুলের বিপরীতে। গার্লস স্কুলের দলনেতা সালমুন নাহার রিমু। বক্তব্যের এক পর্যায়ে সে বলে what is lotted can not be blotted, ওই লাইন থেকেই সিদ্ধান্ত নিই তার একটা ইন্টারভিউ নিব। ২৫ বছর চলে গেলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
৩য়ত, রিতা জোসেফিন রোজারিও। ইংরেজি পড়াতেন। ভয়েস তৈরি করেছিল গভীর অবসেসন। তাকে চিঠি লিখতাম। ২ বছরে বোধহয় ৭০ বা ৮০টা চিঠি জমেছিল, সবই ডায়েরিতে, পোস্ট করার সাহস হয়নি। বুয়েটে প্রবেশের পরও চিন্তা ছিল পোস্ট করব। গল্পে সঞ্চিতা দে ঢুকে পড়ায়, ইচ্ছার জায়গা হয় ওয়েটিং লিস্টে। এবং ডায়েরিও হারিয়ে যায়। ৭০-৮০টা চিঠিও।
যখনই বলি কলেযে পড়াকালেই বৈষয়িক জীবনের প্রতি আগ্রহ মরে গিয়েছিল, অবধারিত প্রশ্ন আসে ইন্টার পাশ কীভাবে করলাম, বুয়েটেই বা কীভাবে চান্স পেলাম। নটরডেমের ক্লাস, কুইজ পরীক্ষা, প্র্যাক্টিকাল ক্লাস এত বেশি নিয়মতান্ত্রিক, কেউ শুধু সেটুকুতে লেগে থাকলেই তার জন্য জিপিএ ফাইভ পাওয়া খুব দুরূহ মনে হয়নি। নটরডেমের পরিবর্তে অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়লে আমার ভাগ্যে জুটতো ইন্টার ফেল পদবি। বুয়েটে সুযোগ পাওয়াটা দৈবক্রম, তাছাড়া মেরিট পজিশন ৯০৩, ওয়েটিং লিস্ট থেকে সুযোগ মিলেছিল; এটা কি খুব এক্সক্লুসিভ অর্জন?
একটা তপ্ত লোহা শীতল হতেও লম্বা সময়ের প্রয়োজন পড়ে। মাঝের সময়ের তপ্ততাকে কাজে লাগানো যায় কারো কারো ক্ষেত্রে। এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনায় এত বেশি সিরিয়াস ছিলাম, তার রেশ দিয়েই মোটামুটি পরের দুই বছর টিকে গেছি; আজ এত বছর পরে সেটাই মনে হয়।
পুরনো দিনে ফিরে গেলে কী করবেন, যে কোনো ইন্টারভিউয়ের জনপ্রিয় প্রশ্ন। আমি যদি ২১ বছর আগের জায়গা থেকে শুরু করি, কয়েকটা কাজ করতে চাইব।
প্রথমত ফিজিক্স শিক্ষক সুশান্ত স্যারকে আরেকটু এনালিটিকালি দেখবার চেষ্টা করব। ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি কয়েকজন ছাত্রের খাতায় ইচ্ছাকৃত ১০ নম্বর বেশি দিতেন, কেউ স্বীকার করে কিনা। আমাদের সময়ে মাত্র ১ জন ভুল স্বীকার করেছিল। তার এই এক্সপেরিমেন্টটা সেই বয়সে মনে রেখাপাত না করলেও পরবর্তী জীবনে বহুবার এর ইমপ্যাক্ট নিয়ে ভেবেছি।
দ্বিতীয়ত, ফিজিক্সের বদরুল আলম স্যারের দুটো ইন্টারভিউ নিব। কলেজে ভর্তিরও পূর্বে তার সম্বন্ধে শুনেছিলাম আমার হ্যালুসিনেশন মেন্টর জিয়া ভাইয়ের মুখে, মানিকগঞ্জের এক সন্ধ্যায়। ফিলোসফিকালি নাকি অনেক সমৃদ্ধ। ২ বছরেও ক্লাস পাইনি। তাই বদরুল আলম স্যারকে জানারই সুযোগ ঘটেনি।
৩য়ত মুখতার আহমেদ মিথ ভাঙতে একটা ক্রিটিকাল এনালাইসিস লিখতাম ইন্টারের পরে। জিয়া ভাই তার প্রশংসা করেছিল৷ ডার্ক হিউমার অনেক আগে থেকেই আমার আগ্রহের বিষয়, মুখতার আহমেদের আলাপে চটুলতাই প্রমিনেন্ট মনে হয়েছে, হিউমার উপকরণ অতি সামান্য। তবু তার কিংবদন্তী হওয়ার কারণ কী হতে পারে, আরো গভীর অনুসন্ধান করতাম।
৪র্থত, জওহরলাল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছিলাম ১ মাস। তার প্রতিবেশি গায়ক ফকির আলমগীর। জওহরলাল স্যারের মুখেই প্রথম জেনেছিলাম বুয়েট শিক্ষক ডক্টর কায়কোবাদের সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন কেবল পড়াশোনা করে কায়কোবাদ ধরনের মানুষ হওয়া যায় না, এর জন্য সাধনা এবং সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাগে। তার সংস্পর্শে আরো সময় কাটাতাম।
৫মত, জেমস টি বেনাস সম্বন্ধে বহু গল্প শুনেছিলাম। তার একটা ইন্টারভিউ নিতাম।
৬ষ্ঠত, আমাদের সময়ে নটরডেমে ভর্তি পরীক্ষা হয়নি। জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তি। আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিলেন কেমিস্ট্রির এ.সি. দাশ স্যার। ‘নটরডেমে কেন পড়তে চাও’, প্রশ্নের উত্তর শুনে হেসেছিলেন। ‘আমার বড় আপার খুব ইচ্ছা ভাই নটরডেমে পড়ুক’, শুনে বলেছিলেন ‘তোমার ইচ্ছা নাই’? স্যারের ইন্টারভিউ নিতাম।
৭মত, রিতা জোসেফিন ম্যাডামের কাছে ইংরেজি প্রাইভেট পড়তাম। তার বাসার ঠিকানায় পোস্ট করতাম চিঠিগুলো, বেনামে। ৭০-৮০ চিঠি হারিয়ে যেত না অজ্ঞাতনামা হিসেবে।
আমার জীবনে নটরডেমের ইমপ্যাক্ট লিখতে বললে বাহ্যিক কিছুই পাব না। তবে ডিটাচমেন্ট, অসংখ্য ক্যারেক্টার মিলিয়ে যে বোধ তৈরি করেছিল, তার প্রতাপেই মফস্বল থেকে আসা হিমেল নামের অতি লাজুক এক কিশোর পূর্বজীবনকে মুছে ফেলে শুরু করেছিল আত্ম অন্বেষণ যাত্রা, হিমালয়৭৭৭ নামে
নটরডেমকে গর্বিত করার মতো মানুষ দেশে-বিদেশে প্রচুর, আমি নটরডেমের ডিফেক্টিভ স্যাম্পল। তবু নটরডেমের দেয়া পাসপোর্ট-ভিসাই আমার জাতিস্মর!