একজন Nazmul Abedeen Fahim বাংলাদেশ ক্রিকেটের লিখিত ইতিহাসে কোথায় স্থান পাবেন, বা আদৌ কি পাবেন? স্বাস্থ্য-পরিবহন বা গণপূর্ত খাতের মতোই বা ক্ষেত্রবিশেষে অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত যে ক্রিকেটাঙ্গন তার ইতিহাস লিখবার পণ্ডশ্রম করবে কে,যদি কেউ করেও থাকে পর্যাপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে সেটির নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শের লিফলেট হয়ে উঠবার৷

ইতিহাস নিজেই যেখানে ভ্রাম্যমাণ কিংবা নির্মোহতা-নৈর্ব্যক্তিকতা প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে জনৈক নাজমুল আবেদীন ফাহিমের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব অর্থপূর্ণভাবেই অর্থহীন।

সম্প্রতি ওয়েবসাইটসূত্রে জানলাম ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তানের পরেই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল বোর্ড বিসিবি। যদি দর্শক আগ্রহ-উন্মাদনা, স্পন্সর, সরকারি সমর্থন প্রভৃতি অনুষঙ্গ আমলে নিই সবাইকে টপকে ভারতের পরের স্থানটি নিয়ে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে তুমুল লড়াই হবে, তাতে সার্বিক বিচারে বাংলাদেশই এগিয়ে থাকবে। আনুপাতিক বিবেচনায় ৩৮৫ ওয়ানডের মধ্যে ২৩৫ টা কোয়ালিটি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলে জয় মাত্র ৩৮টা, এবং ২১ বছর টেস্ট খেলে জয় মাত্র ১৪টা যার মধ্যে কোয়ালিটি টিমের বিপক্ষে ৩টা!— সিস্টেম লস বিষয়ক ডেটা ড্রিভেন গবেষণা করলে এ হবে ভয়াবহ বিপর্যয়সূচক ফলাফল।

নিউজিল্যান্ডে এককালে পর্যাপ্ত কোয়ালিটি ক্রিকেটারের অভাব নিয়ে প্রচুর আক্ষেপ শোনা যেত, যার অন্যতম কারণ হিসেবে জনসংখ্যার স্বল্পতাকে ধরা হত, নিউজিল্যান্ডের ১০ গুণ জনসংখ্যা নিয়েও অদ্যাবধি সাকিব ব্যতীত কোয়ালিটি ক্রিকেটার কেন তৈরি হলো না অনুসন্ধান চালালে সেই হরিলুট নীতিতেই গিয়ে ঠেকতে হয়; সাকিব এদেশের ক্রিকেট সংক্রান্ত স্যাম্পলিংয়ে ডিফেক্টিভ স্যাম্পল!

নাজমুল আবেদীন ফাহিমকেও কি ডিফেক্টিভ স্যাম্পল বলা উচিত?

‘টিম রকমারি’ নামে একটি সেমি-প্রফেশনাল ক্রিকেট টিম শুরু করি ২০১৪ এর এপ্রিলে, ঢাকার বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমিতে প্র‍্যাক্টিস করা ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠিত এই টিমকে স্পন্সর দিত রকমারি ডট কম, ২০১৮ এর আগস্টে স্পন্সরশিপ জটিলতায় এর কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। সাড়ে ৪ বছরের কার্যক্রমে ঢাকা শহরের ৮০% একাডেমি, এবং দেশের ১৫টি জেলার বিপক্ষে ওয়ানডে খেলেছে সেই টিম। যে সূত্রে প্রায় ৭০-৮০ জন কোচ, এবং ১২০০+ উঠতি ক্রিকেটারকে সরাসরি পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলাম। বেদনাদায়ক হলেও বাস্তবতা, এদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোজগতে সবই আছে ক্রিকেট বাদে। সার্কাসে একপ্রস্থ দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেমন স্কিল, এদের দৃষ্টিতেও ক্রিকেট নিছক সার্কাসস্কিলের বেশি কিছু হতে পারেনি, যেখানে শ্রমের বিনিময়ে টাকা উপার্জন করাই লক্ষ্য, এবং তার মধ্যেও দালালি মারফত উপরি ইনকামের সুযোগ খোঁজা।

এমন যাদের মানসিকতা তারা ক্রিকেটার তৈরি করবেন কীভাবে, নিজেরাই বা কীভাবে হবে ক্রিকেটার!

এই অবরুদ্ধ পঙ্কিলযুক্ত সংস্কৃতিতে কোচ আর ক্রিকেটাররা সিস্টেমের চুনোপুটি, রাঘব বোয়াল আর হাঙরেরা চালায় সংগঠন, তারাই টাকা ঢালে, এবং সেই টাকা রোলিংয়ের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলে মাফিয়াতন্ত্র।

এরকম জায়গায় কোয়ালিটি ক্রিকেটার তৈরি হওয়া নিতান্তই দৈব দুর্বিপাক, এবং প্রজ্ঞাবান ক্রিকেট প্রশিক্ষক তথা কোচের সন্ধান পাওয়া গিলগামেশের অমৃত লাভের সম্ভাবনার চাইতেও কম। নাজমুল আবেদীন ফাহিম তাই নিঃসন্দেহে বিরল কেইস!

তার সঙ্গে আমার পরিচয়টা ভীষণ কাকতালীয়। ২০১৭ তে ‘কী-ওয়ার্ড সাকিব আল হাসান’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলাম। সাকিব কেন ও কীভাবে চিন্তা করে সেই বিষয়েই ক্রিটিকাল এনালাইসিসের চেষ্টা। ঘন্টাখানেক পরে মেসেঞ্জারে একটা বার্তা পাই- সাকিব বিষয়ে যা লিখেছি তা হাইলি টেকনিকাল, এবং পর্যবেক্ষণগুলো ইউনিক। শুধুমাত্র টিভিতে খেলা দেখে একজন মানুষ সম্বন্ধে এরকম লেখাটা তার বিস্ময়কর লেগেছে, বিসিবিতে তার সাথ একদিন চা পানের নিমন্ত্রণ দেন। প্রোফাইল ঘেঁটে জানতে পারি তিনি একজন কোচ, বিসিবিতে চাকরি করেন। আমার টিমের ক্রিকেটারদের মুখে ‘ফাহিম স্যার’ নামটা অজস্রবার শোনা হলেও ফেসসূত্রে চিনতাম না, এক ক্রিকেটারকে প্রোফাইলের লিংক পাঠিয়ে জানতে চাই ইনিই সেই প্রখ্যাত ফাহিম স্যার কিনা, সে নিশ্চিত করে।

সিদ্ধান্ত নিই, ক্রিকেট বিষয়ে তার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিব, সম্মত হন তিনি। বিসিবিতে দেখা করি, রিসিপশনে সিকিউরিটি চেকিং চলছে, আচমকা কাঁধে কারো স্পর্শে পেছনে তাকাই, ফাহিম স্যার! উভয়েই প্রাক্তন নটরডেমিয়ান হওয়াটা আলাপ শুরুতে ভূমিকা রাখে! প্রায় দেড় ঘন্টা সাক্ষাৎকার নিই, সেসময় তিনি অনেক কিছু বলেছিলেন যা দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত থেকে পাবলিকলি বলতে পারেন না– কথাটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ায় ইন্টারভিউয়ের কনটেন্ট প্রকাশ করিনি কখনো৷

তবে

বাংলাদেশের সকল সাংবাদিক, অধিকাংশ প্রাক্তন ক্রিকেটারদের যেসব বক্তব্য শুনি, তারাও যে আদতে বিবিধ চাপে প্রকৃত বক্তব্য দিতে পারেন না, সেই বোধটা সঞ্চারিত হয় সেদিন। নিজের সরাসরি শিক্ষক ব্যতীত যত প্রতিষ্ঠিত-ক্ষমতাধর-খ্যাতিমান ব্যক্তিই হোক, কাউকে স্যার সম্বোধনে রুচিতে বাঁধে, ভাই/আংকেল/মিস্টার প্রভৃতি দিয়েই প্রক্সি চালাই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আমার টিমের ক্রিকেটারদের মুখে শুনে আর ইন্টারভিউতে ক্রিকেট প্রজ্ঞার ইঙ্গিত পেয়ে তাকে বিনা জড়তাতেই ‘স্যার’ ডাকি, এবং তার ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হয়নি আজও।

কিছুদিন পরে হুট করে ফোন পাই তার – ‘একটা ওয়েবসাইটে তামিমকে নিয়ে লেখা পড়লাম, লেখকের নাম লক্ষ্য না করেই বুঝেছি তোমার লেখা, তাই ফোন দিলাম৷ তুমি ক্রিকেটারদের মনোজগত নিয়ে অসাধারণ কাজ করতেছ, এগুলো জমিয়ে রেখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। যদি ইংরেজিতে লিখতে পারো বাইরের দেশের ওয়েবসাইটে পাঠালে ছাপাবে হয়ত’!

এরপরে যখন যে ক্রিকেটারের মনোজগত নিয়ে লিখেছি স্যারকে পাঠিয়েছি। বিসিবি ছাড়ার পূর্বে আরো একবার দেখা হয়েছিল সেখানে৷ এরপরে ২০১৯ বিশ্বকাপের অব্যবহিত পরে একদিন সপরিবারে দাওয়াত পাই তার মিরপুর ডিওএচএস এর বাসায়, যদিও জমজ কন্যারা তখনো বেশ অপরিপক্ব থাকায় যাওয়া হয়নি আমার সহমানুষের।

নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সঙ্গে রিয়েল লাইফ মিথস্ক্রিয়ার ডেটা এটুকুই।

তবে অনেক সময় ফিফটি বা সেঞ্চুরির চাইতে একটা দুর্দান্ত ক্যাচ বা অতর্কিত রান আউট যেমন ম্যাচ জয় এনে দেয়, ফাহিম স্যারের প্রতি ইমপ্রেসনের ক্ষেত্রেও যোগাযোগের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের চাইতে ঘনত্বকেই মূখ্য বিবেচনা করেছি।

শেষ ২ বছরে মিডিয়াতে সক্রিয়তা বেড়েছে তার। স্পন্সর, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পলিটিকাল কারেক্টনেস প্রভৃতি বহু ফ্যাক্টরের কারণে সেখানে প্রজ্ঞার চাইতে পপুলিস্ট কথা-বার্তারই প্রাধান্য থাকে, কিন্তু যেহেতু তার সঙ্গে সেন্সরমুক্ত আলোচনা করার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, জানি তিনি কী বলতে চাইছেন অথচ বলছেন না, যে কারণে প্রতিটি কথাকেই নিজের মতো ডিকোড করে নিই।

এবং এটা অনস্বীকার্য, অন্য যেসব প্রাক্তন ক্রিকেটার, কোচ বা সাংবাদিকেরা যেসব বক্তব্য দেন, সেসব অন্তঃসারশূন্য ডিসকোর্সের তুলনায় তার আপাত পপুলিস্ট ভাবনাও অধিক মেরিটপূর্ণ!

নাজমুল আবেদীন ফাহিম কী করেছেন যেজন্য তাকে মনে রাখবে দেশের ক্রিকেট?

খেলোয়াড় হিসেবে কখনো জাতীয় দলে সুযোগ পাননি, কোচ হিসেবে বিকেএসপিতে কাজ করেছেন। দুর্জয়দের প্রজন্ম থেকে সাকিব-মুশফিক কিংবা সৌম্য-লিটন প্রত্যেককে কৈশোরে দেখেছেন, যখন তাদের অনুসরণ করতো না ক্যামেরা-পত্রিকা কিংবা লক্ষ-কোটি ফ্যান-ফলোয়ারের গোয়েন্দা দৃষ্টি। দেখার ফলাফলটা কী? অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় অর্ধেকের বেশি জীবন তিনি ব্যবহার করে ফেলেছেন, ব্যাট করছেন স্লগ বা ডেথ ওভারে। ক্রিজে সেট হওয়ার জন্য সময় পাবেন না, কিন্তু উইকেট অক্ষত রেখে রান বাড়াতে হবে, অথবা টার্গেট চেইজ!

এই ভূমিকায় তার এক্সক্লুসিভনেস কী হতে পারে? ক্রিকেটারদের টেকনিকাল নির্দেশনা দেয়ার জন্য হাজাখানেক কোচ আছেন, ফিলোসফিকাল এনলাইটেনমেন্টের লোক ২-৫ জনও আছে কিনা ঘোরতর সংশয়।

‘ক্রিকেট ফিলোসফার’ হিসেবে তিনি টেকনিকাল কোচিংয়ের পাশাপাশি ফুড হ্যাবিট, লাইফস্টাইল, সোস্যাল ইন্টারেকশন, মিডিয়া হ্যান্ডলিং, মেন্টাল টাফনেস, গেমসেন্স সহ অদৃশ্য ইনার হিউম্যান স্কিলগুলো নিয়ে ক্রিকেটারদের মেন্টরিং করতে পারেন, যা হতে পারে সত্যিকারের ভ্যালু এডিং সুযোগ বা সম্ভাবনা। সাকিবের ব্যাটিং টেকনিক ১০ জনের ৯ জন কোচই অপছন্দ করবে, বোলিংয়েও বিশেষত্ব পাবে না তেমন, তবু সে এক নাগাড়ে এক যুগের বেশি সময় টপ পারফরমার হলো কেন ও কীভাবে?

‘চিন্তাপ্রক্রিয়ায় ভিন্নতা’; স্রেফ সাকিবের কেইসটা গভীর বিশ্লেষণ করলেই ‘ক্রিকেট ফিলোসফার’ পেশাটার অনিবার্যতা উপলব্ধি করবেন যে কোনো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। এবং এই পেশায় কন্ট্রিবিউট করার যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সারাদেশ মিলিয়ে ৫ জনের কম, এটা এরোগেন্টলি বলতে একটুকুও দ্বিধাগ্রস্ততায় ভুগছি না।

আমি বায়োপিক এনালিস্ট, নাজমুল আবেদিন ফাহিমের কন্ট্রিবিউশন স্কোপ নিয়ে মাতলাম কেন হঠাৎ, কারণ ফেসবুক জানাচ্ছে আজ তার জন্মতিথি!

প্রতিটি জন্মদিন আমাকে হিসাব করতে বসায় কতটা জীবন ব্যবহৃত, সম্ভাব্য বাকি আছে কতখানি। এর মধ্যে কী কী করা উচিত, যার ভিত্তিতে ভ্যালু বা ইমপ্যাক্টকে সিগনিফিক্যান্ট স্তরে উন্নীত করতে সমর্থ হব।

অভ্যাসবশত নাজমুল আবেদীন ফাহিমের জন্মদিনেও সেই লেজার শিট খুলে থার্ড আই ভিউ থেকে অবলোকনের চেষ্টা করলাম।

শ্রদ্ধেয় ফাহিম স্যার, ২০১৭ এর চা-আড্ডায় জীবন নিয়ে অপূর্ণতা প্রসঙ্গে বলেছিলাম খুব ইচ্ছা ছিল প্রফেশনাল ক্রিকেটার হব, রমন লাম্বার মৃত্যু আর ব্রিলিয়ান্ট একাডেমিক রেজাল্ট ইচ্ছা পূরণ করতে দিল না, ক্রিকেটার আর হতে পারলাম না।

আপনি প্রত্যুত্তর করেছিলেন- ‘কে বলেছে ক্রিকেটার হওনি। এই যে স্বাধীন পেশায় হার না মেনে ফাইট দিচ্ছো, যারা মাঠে খেলে মাঠের বাইরে থেকে তাদের ব্রেইন স্ক্যান করছো– এগুলোও তো ক্রিকেটারের বৈশিষ্ট্য। মাঠে খেলা তো বিশাল কর্মযজ্ঞের ছোট্ট অংশমাত্র, তুমি অনেক বড়ো ক্রিকেটার। যা বিসিবির করা উচিত ছিল, তুমি ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে নিজেই করছো। একে হালকাভাবে নিয়ো না’!

২০১৭ চলে গেছে, ২১-২২-২৩ চলে যাবে, জাগতিক নিয়মে ব্যতিক্রম না ঘটলে আমার আগে চলে যাবেন আপনিও, তবু আপনার সেই এনালোজিটা এতই পছন্দ হয়েছিল, নিশ্চিত করে বলতে পারি কথাগুলো আমি চলে যাওয়ার পরও জীবিত থাকবে আমার বইয়ের সূত্রে! আপনার কারণেই কোনোদিন স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকের সামনে না খেলেও নিজেকে আমার ক্রিকেটার মনে হয়!

ইতিহাস ইনিংস ডিক্লেয়ার করুক বা বৃষ্টিতে হোক পরিত্যক্ত, আপনার ভাবনা-দর্শন ৫০৩ রানে অপরাজিত থাকবে, সেই প্রত্যাশায় নেই ডট বল এর বাড়াবাড়ি!